Thursday 05 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

ভিনদেশি সংবাদমাধ্যমে একাত্তরের কথা (তৃতীয় পর্ব)

ফয়জুল লতিফ চৌধুরী
১২ ডিসেম্বর ২০২৩ ১৩:৪৫

একাত্তরের ডিসেম্বর

১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পূর্ব পাকিস্তান পৃথিবীর মানচিত্রে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আবির্ভূত হয়, যার নাম ‘বাংলাদেশ’। কিন্তু নভেম্বরের শেষ ভাগেও দখলদার পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর পরাজয় এতটা সন্নিকট বলে প্রতীয়মান হয়নি। নভেম্বরে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে প্রাধান্য লাভ করেছিল বাঙালিদের নেতা শেখ মুজিবের বিচার। আগস্টের প্রথম সপ্তাহে পশ্চিম পাকিস্তানের লায়ালপুরে শেখ মুজিবের বিচার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল। এ বিচার চলে নভেম্বরের শেষ পর্যন্ত। ভারতের শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় গ্রহণকারী বাঙালিদের দুরবস্থার খবরাখবর আন্তর্জাতিক পত্রপত্রিকায় সংক্ষিপ্তাকারে নিয়মিত প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়া পাকিস্তান-ভারত সীমান্তে ঘন ঘন সামরিক সংঘর্ষের খবরও কিছু প্রকাশিত হয়েছে। কোনো পত্রিকাতেই ভারতের যুদ্ধ প্রস্তুতির কোনো ইঙ্গিত দেয়া হয়নি। পূর্ব পাকিস্তানের সীমান্ত এলাকায় ও খোদ ঢাকা শহরে মুক্তিযুদ্ধ এ সময় তীব্র রূপ ধারণ করেছিল। দেশের বহু এলাকা বিচ্ছিন্নভাবে পাকিস্তানের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে এসেছিল। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের এ রকম অগ্রগতি সম্পর্কে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম অবগত ছিল বলে মনে হয় না।

এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যেতে পারে যে যশোরের চৌগাছা এলাকায় ২০ ও ২১ নভেম্বর পাকিস্তানি ও ভারতীয় সেনাদলের মধ্যে একটি ট্যাংক যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল। সে সময় ভারতীয় বাহিনী পূর্ব পাকিস্তানের সীমানার ভেতরে ঢুকে পড়লে পাকিস্তান সরকার এই বলে প্রতিবাদ জানিয়েছিল যে কোনো আনুষ্ঠানিক যুদ্ধ ঘোষণা ব্যতিরেকেই ভারত পূর্ব পাকিস্তান আক্রমণ করেছে। ২২ নভেম্বর ভারত পাকিস্তানের তিনটি যুদ্ধবিমান ভূপাতিত করে। এই গুরুত্বপূর্ণ সংঘর্ষটি আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে ব্যর্থ হয়েছিল।

পাকিস্তান সরকার ভারতীয় সেনাবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণের সিদ্ধান্ত কবে-কখন নিয়েছিল তা সর্বজনবিদিত কিন্তু ডিসেম্বরের শুরুর দিকেই যুদ্ধ বন্ধ করে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে সেনাদল প্রত্যাহার করে সেনাসদস্যদের ঢাকায় সরিয়ে আনার তত্পরতা পরিলক্ষিত হয়। এই গুরুত্বপূর্ণ সংবাদটিও যথাযথ গুরুত্ব লাভ করেনি। পূর্ব পাকিস্তানে অবস্থানকারী পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর লক্ষাধিক সেনার মধ্যে ৬০ হাজার সেনা ১২ ডিসেম্বরের আগেই ঢাকায় পৌঁছে গিয়েছিল। ঢাকা শহরকে সুরক্ষিত রাখার জন্য এত বিপুলসংখ্যক সেনাসদস্যের প্রয়োজন ছিল না। সম্ভবত মুক্তিবাহিনীর হাতে ধরা পড়ে মার খাওয়ার পরিবর্তে ভারতীয় সেনাবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন পাকিস্তানের সেনাপতিরা। জেনারেল নিয়াজি সম্ভাব্য পরাজয় ও আত্মসমর্পণের কথা বিবেচনা করেছিলেন বলে মনে হয়। আনুষ্ঠানিক যুদ্ধে আত্মসমর্পণের ক্ষেত্রে জেনেভা কনভেনশন অনুযায়ী পরাভূত সামরিক বাহিনীর জানমালের সুরক্ষা নিশ্চিত করা বিজয়ী বাহিনীর অবশ্য কর্তব্য।

এই সংক্ষিপ্ত নিবন্ধ কোনো দীর্ঘমেয়াদি গবেষণার ফল নয়। ফলে এর ব্যাপ্তিও সীমিত। আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরে কীভাবে প্রতিফলিত হয়েছিল, তার উদাহরণস্বরূপ কিছু সংবাদ প্রতিবেদনের শিরোনাম নিবন্ধের এই অংশে তুলে ধরা হয়েছে।

‘টাইম’ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে প্রকাশিত একটি প্রভাবশালী সাপ্তাহিক ম্যাগাজিন। ১৯৭১-এর ১৬ ডিসেম্বর পরবর্তী সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছিল ২০ ডিসেম্বর। এর প্রচ্ছদের যথোপযুক্ত শিরোনাম ছিল ‘বাংলাদেশের রক্তাক্ত অভ্যুদয়’। এ সময় অন্যান্য প্রভাবশালী সাপ্তাহিকের মধ্যে ‘নিউজ উইক’, ‘ফার ইস্টার্ন ইকোনমিক রিভিউ’ ও ‘এশিয়া উইক’ সমজাতীয় প্রচ্ছদ প্রতিবেদন করে থাকবে। কিন্তু এগুলো সংগ্রহ করা যায়নি। এ প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য যে ‘টাইম ম্যাগাজিন’ ৬ ডিসেম্বরের সংখ্যায়ও পূর্ব পাকিস্তানের সংকট নিয়ে প্রচ্ছদ প্রতিবেদন করেছিল, যার শিরোনাম ছিল ‘এশিয়ায় রণদামামা—ভারত বনাম পাকিস্তান’।

লন্ডন থেকে প্রকাশিত ‘দ্য গার্ডিয়ান’ পত্রিকা একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের অসংখ্য সংবাদ প্রকাশ করেছে। কোনো কোনো দিনের পত্রিকায় বিভিন্ন বিষয়ে যুগপৎ কয়েকটি সংবাদ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল গার্ডিয়ান। ১৫ ডিসেম্বর প্রকাশিত একটি খবরের শিরোনাম ছিল ‘ভারত পূর্ব বাংলায় পাকিস্তানি বাহিনীর সার্বিক আত্মসমর্পণ চায়’। নয়াদিল্লি থেকে প্রতিবেদনটি লিখেছিলেন হ্যারল্ড জ্যাকসন। ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী এক পর্যায়ে ‘পূর্ব পাকিস্তান’ ব্যবহার বন্ধ করে ‘পূর্ব বাংলা’ শব্দবন্ধ ব্যবহার শুরু করেছিলেন। তারই অনুরণনে এ প্রতিবেদনে ‘পূর্ব বাংলা’ শব্দবন্ধের ব্যবহার। ‘বাংলাদেশ’ উল্লেখ করলে বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি দেয়া হয়ে যায়, তাই পূর্ব বাংলার ব্যবহার।

ভারতীয় সেনাবাহিনীর চিফ অব স্টাফ জেনারেল স্যাম মানেকশ ওইদিন সন্ধ্যা ৫টা থেকে ঢাকায় বোমাবর্ষণ বন্ধ রাখার নির্দেশ দেন। একই সঙ্গে তিনি পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের জন্য সময়সীমা বেঁধে দেন ১৬ ডিসেম্বর সকাল ৯টা। এর আগে পাকিস্তানের জেনারেল এএকে নিয়াজি ভারতীয় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলেন। দিল্লিস্থ মার্কিন দূতাবাস নিয়াজির বার্তা পৌঁছে দিয়েছিল। নিয়াজি তার চিঠিতে কী লিখেছিল তা সাংবাদিকদের কাছে গোপন রাখা হয়েছিল। তা ছিল যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব। তবে সাংবাদিকদের কাছে স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল যে আত্মসমর্পণ ছাড়া পাকিস্তানের কোনো উপায়ান্তর নেই।

গার্ডিয়ানের প্রতিবেদনে ঢাকা দখলের জন্য ভারতীয় পদাতিক বাহিনীর সাফল্য তুলে ধরে বলা হয়: পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী ঢাকার পতন সময়ের ব্যাপার। মালাক্কা প্রণালি থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রণতরী সপ্তম নৌবহরের বঙ্গোপসাগরে প্রবেশের উদ্দেশ্যের ব্যাপারেও কৌতূহল ব্যক্ত করে বলা হয় সম্ভবত পাকিস্তানি বাহিনীকে সমর্থন দেয়া নয়, বরং আটকে পড়া পাকিস্তানিদের সরিয়ে নিতে এ রণতরী ব্যবহার হবে।

মার্কিন সপ্তম নৌবহরে ছিল পারমাণবিক অস্ত্র বহনকারী যান ‘এন্টারপ্রাইজ’, উভচর রণতরী ‘ত্রিপলী’, ২৩টি হেলিকপ্টার, গাইডেড মিসাইল ফ্রিগেট, যার নাম ‘কিং’ এবং গাইডেড মিসাইল ধ্বংসকারী ‘পারসন ডিকেইটার’। এছাড়া ছিল সমুদ্র থেকে স্থলভাগে অবতরণের নৌযান। ভারতীয় মুখপাত্রের বরাত দিয়ে বলা হয়, যখন ১৫ লাখ বাঙালিকে হত্যা করা হয়েছে তখন পশ্চিমের অনেক শক্তি কোনো প্রতিবাদ জানায়নি।


আরও পড়ুন: ভিনদেশি সংবাদমাধ্যমে একাত্তরের কথা (প্রথম পর্ব)


এ প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, সোভিয়েত রাশিয়ার উপপররাষ্ট্রমন্ত্রী ভ্যাসিলি কুেনসং এ সময় নয়াদিল্লিতে অবস্থান করছিলেন। সোভিয়েত রাশিয়ার যুদ্ধজাহাজ কোরিয়া থেকে বঙ্গোপসাগরের দিকে রওনা দিয়েছে উল্লেখ করে মন্তব্য করা হয়, হয়তো সমুদ্রেই এ স্থলযুদ্ধের পরিসমাপ্তি ঘটবে।

১৫ ডিসেম্বর লিখিত এ প্রতিবেদনে উঠে এসেছে যুদ্ধের সামগ্রিক অবস্থা, বিশেষ করে ভারতীয় রণকৌশল সম্পর্কে অজ্ঞতা। ভারতীয় পক্ষ পূর্ব পাকিস্তানে তাদের দীর্ঘ প্রস্তুতি ও রণকৌশলের কথা সাংবাদিকদের কাছ থেকে পুরোপুরি গোপন রাখতে সক্ষম হয়েছিল।

নানা সীমাবদ্ধতা থাকলেও মান্য যে বিদেশী পত্রপত্রিকায় যেসব প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছিল তা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। তাই এসব প্রতিবেদন অনুবাদের ব্যবস্থা করা অতিজরুরি।

১ থেকে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত ৮৩টি সংবাদ প্রতিবেদনের শিরোনাম এ নিবন্ধে উদ্ধৃত করা হলো, যা থেকে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের সচেতনতার মাত্রা ও ধারণার অভিমুখ সম্পর্কে সম্যক ধারণা লাভ করা যায়। বোধগম্যতার স্বার্থে অনেক ক্ষেত্রে শিরোনাম ব্যাখ্যা করে উপস্থাপন করা হয়েছে। বলা দরকার এ নিবন্ধের পরিধি থেকে ভারত ও পাকিস্তানের সংবাদগুলোকে বোধগম্য কারণে বাদ রাখা হয়েছে।

১৭ ও ১৮ ডিসেম্বর শত শত বিদেশী পত্রিকায় ১৬ ডিসেম্বর পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী ঢাকায় ভারতীয় সামরিক বাহিনীর কাছে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর আত্মসমর্পণের খবরটি মুদ্রিত হয়েছিল।

তবে বিস্তারিত প্রতিবেদন পরবর্তী সপ্তাহের বিভিন্ন দিনেও প্রকাশিত হয়েছে। ১ থেকে ২২ ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রকাশিত ও সংগৃহীত সংবাদগুলোকে চার ভাগে ভাগ করা যায়। যথা—

ক. চলমান মুক্তিযুদ্ধ ও সংশ্লিষ্ট খবরাখবর;

খ. ৩ ডিসেম্বর তারিখে শুরু হওয়া পাক-ভারত যুদ্ধের খবর;

গ. ১৬ ডিসেম্বর ঢাকায় রেসকোর্স ময়দানে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর আত্মসমর্পণ;

ঘ. ২১-২২ ডিসেম্বর পাকিস্তানের কারাগার থেকে শেখ মুজিবের মুক্তির খবর।

নিম্নোক্ত ৮৩টি শিরোনাম প্রকৃত ইংরেজি শিরোনামের ভাবানুবাদ। তদুপরি স্পষ্টতার স্বার্থে অনেক ক্ষেত্রে ব্যাখ্যামূলক শব্দাবলি সংযোজন করা হয়েছে:

১ ডিসেম্বর ১৯৭১, দ্য গার্ডিয়ান: পাকিস্তান শান্তি চায়, তার ইঙ্গিতস্বরূপ ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী সেনা প্রত্যাহার করতে পাকিস্তানের প্রতি আহ্বান জানালেন।

২ ডিসেম্বর ১৯৭১, দ্য নিউইয়র্ক টাইমস: ভারত ও পাকিস্তানের সংঘর্ষ অতিরঞ্জন করে প্রচার করা হচ্ছে;

৩ ডিসেম্বর ১৯৭১, দ্য বার্মিংহাম পোস্ট: সীমান্তে লড়াই অব্যাহত রয়েছে;

৩ ডিসেম্বর ১৯৭১: এস্কানবা ডেইলি প্রেস: ‘পাকিস্তানি বিমান ভারতে আঘাত হেনেছে;

৩ ডিসেম্বর ১৯৭১: বিবিসি রেডিও: পাকিস্তান ভারতীয় ভূখণ্ডে বিমান আক্রমণ তীব্রতর করেছে;

৪ ডিসেম্বর ১৯৭১: দ্য নিউইয়র্ক টাইমস: উপমহাদেশে যুদ্ধ;

৪ ডিসেম্বর ১৯৭১: দ্য বার্মিংহাম পোস্ট: পাকিস্তানের সর্বাত্মক যুদ্ধ, দাবি ভারতের;

৪ ডিসেম্বর ১৯৭১: ফিলাডেলফিয়া ডেইলি নিউজ: পাকিরা ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে;

৪ ডিসেম্বর ১৯৭১: ক্রনিকল অব থাইল্যান্ড: ভারতীয় বিমানঘাঁটিতে পাকিস্তানি জেট বিমানের আক্রমণ এবং ভারতীয় ডেস্ট্রয়ার পাকিস্তানি সাবমেরিনকে ডুবিয়ে দিয়েছে;

৪ ডিসেম্বর ১৯৭১: কভেন্ট্রি ইভনিং টেলিগ্রাফ: যে যুদ্ধ সারা পৃথিবীকে বিপদে ফেলে দিতে পারে: পশ্চিম বিশ্ব এখন কার পক্ষে যাবে?;

৬ ডিসেম্বর ১৯৭১: টাইম ম্যাগাজিন: ভারত ও পাকিস্তান যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত;

৬ ডিসেম্বর ১৯৭১: দ্য হাচিনসন নিউজ: ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ছে;

৬ ডিসেম্বর ১৯৭১: দ্য গার্ডিয়ান: যুদ্ধ ব্যতিরেকে পাকিস্তানের উপায়ন্তর নেই;

৬ ডিসেম্বর ১৯৭১: দ্য নিউইয়র্ক টাইমস: যুদ্ধে ভারতের আরো অগ্রগতি, কাশ্মীরে পাকিস্তানের সাফল্য দাবি, জাতিসংঘের শান্তি প্রস্তাবে বাধা (প্রথম পৃষ্ঠার প্রতিবেদন);

৭ ডিসেম্বর ১৯৭১: আনন্দবাজার পত্রিকা: বাংলাদেশ সরকারকে ভারত স্বীকৃতি দিল;

৭ ডিসেম্বর ১৯৭১: ইভনিং এক্সপ্রেস: ভারতীয় জেট বিমানের আক্রমণে ঢাকা বিধ্বস্ত;

৭ ডিসেম্বর ১৯৭১: দ্য নিউইয়র্ক টাইমস: ভারত পূর্ব রণাঙ্গনের শত্রুদের চারপাশ থেকে ঘিরে ফেলার কৌশল অবলম্বন করছে;

৭ ডিসেম্বর ১৯৭১: দ্য গার্ডিয়ান: ঠাণ্ডা মাথায় সভ্য সমাধান খুঁজে বের করতে হবে;

৮ ডিসেম্বর ১৯৭১: দ্য গার্ডিয়ান: ঢাকার পথে ভারতীয় বাহিনীর ত্বরিত বিজয়;

৯ ডিসেম্বর ১৯৭১: বাল্টিমোর সান: উত্ফুল্ল বাঙালি জনতা যশোরে ভারতীয় বাহিনীকে অভিনন্দন জানাচ্ছে;

৯ ডিসেম্বর ১৯৭১: ইভনিং স্ট্যান্ডার্ড: ঢাকার দিকে অগ্রসর হচ্ছে ভারতীয় বাহিনী;

৯ ডিসেম্বর ১৯৭১: দ্য গ্যাস্টোনিয়া গেজেট: ঢাকাকে ঘিরে আরো শক্ত হচ্ছে ভারতীয় ফাঁদ;

১০ ডিসেম্বর ১৯৭১: দ্য বার্মিংহাম পোস্ট: পাকিস্তানে অস্ত্রের চালান বন্ধ করে দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র;

১০ ডিসেম্বর ১৯৭১: দ্য হার্ভার্ড ক্রিমসন: পাকিস্তানি সৈন্যরা পিছু হটে ঢাকায় সমবেত হচ্ছে;

১০ ডিসেম্বর ১৯৭১: দ্য নিউইয়র্ক টাইমস: ভারত জানিয়েছে চারদিক থেকে ঢাকা ঘিরে ফেলায় শত্রুরা অবরুদ্ধ হয়ে পড়েছে;

১০ ডিসেম্বর ১৯৭১: ল্যান্সিং স্টেট জার্নাল: ভারত পূর্ব পাকিস্তানের আত্মসমর্পণের আহ্বান অব্যাহত রেখেছে;

১০ ডিসেম্বর ১৯৭১: দ্য গার্ডিয়ান: ভারতের বিজয় কোন পথে?

১০ ডিসেম্বর ১৯৭১: কভেন্ট্রি ইভনিং পোস্ট: পাকিস্তান বাহিনীর পশ্চাত্পসরণ;

১১ ডিসেম্বর ১৯৭১: দ্য গার্ডিয়ান: আগামী সপ্তাহেই ঢাকার পতন অনিবার্য;

১২ ডিসেম্বর, ১৯৭১: দ্য নিউইয়র্ক টাইমস: পাকিস্তান পূর্বাঞ্চলে সামরিক পরিস্থিতিকে ‘ভয়াবহ’ বলে অভিহিত করেছে;

১৩ ডিসেম্বর ১৯৭১: কোয়াড সিটি টাইমস: ভারত বলেছে শিগগিরই ঢাকার পতন হবে;

১৩ ডিসেম্বর ১৯৭১: দ্য হাচিনসন নিউজ: ঢাকার উপকণ্ঠে পৌঁছে গেছে ভারতীয় বাহিনী;

১৩ ডিসেম্বর, ১৯৭১: দ্য নিউইয়র্ক টাইমস: ঢাকায় বড় ধরনের আক্রমণের জন্য ভারতীয় সামরিক বাহিনীর প্রস্তুতি এবং যুদ্ধবিরতির পদক্ষেপ নিতে জাতিসংঘের প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আহ্বান (প্রথম পাতার প্রতিবেদন);

১৩ ডিসেম্বর ১৯৭১: ফিলাডেলফিয়া ডেইলি নিউজ: এখানে একটি ‘বাংলাদেশ’ যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল;

১৩ ডিসেম্বর ১৯৭১: ডেইলি মেইল (লন্ডন): মিরর প্রতিনিধি ডোনাল্ড ওয়াইজ প্রেরিত প্রতিবেদন: টাইগার নিয়াজির দুর্গের অভ্যন্তরে এবং ভারত যুদ্ধবিরতিতে আগ্রহী, তবে পাকিস্তানকে আত্মসমর্পণ করতে হবে;

১৪ ডিসেম্বর ১৯৭১: লুবক অ্যাভালাঞ্চ জার্নাল: ঢাকার চারপাশে ভারতীয় কামানের ব্যুহ;

১৪ ডিসেম্বর ১৯৭১: লাস ভেগাস অপটিক: পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানীতে ভারতের বোমাবর্ষণ;

১৩ ডিসেম্বর, ১৯৭১: দ্য নিউইয়র্ক টাইমস: ভারতীয় বাহিনীর কামানের আওতায় ঢাকা শহর (প্রথম পাতার প্রতিবেদন);

১৫ ডিসেম্বর ১৯৭১: দ্য গার্ডিয়ান: ভারত পূর্ব বাংলায় পাকিস্তান বাহিনীকে পূর্ণ আত্মসমর্পণের আহ্বান জানিয়েছে;

১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১: বার্মিংহাম পোস্ট: সোভিয়েত রাশিয়ার উপর্যুপরি ভেটোর কারণে ‘শান্তি প্রস্তাব’ অনুমোদন করতে পারছে না জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ;

১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১: বার্মিংহাম পোস্ট: চারপাশে অবরুদ্ধ ঢাকায় টাইগার নিয়াজি যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব;

১৬ ডিসেম্বর, ১৯৭১: দ্য নিউইয়র্ক টাইমস: নিয়াজির প্রতি মানেকশের বার্তা;

১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১: হেরাল্ড টাইমস: জেনারেল নিয়াজি ভারাক্রান্ত হূদয়ে আত্মসমর্পণ দলিলে স্বাক্ষর করলেন;

১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১: ডেইলি গ্লোব: পাকিস্তানিদের আত্মসমর্পণ;

১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১: দ্য ব্রিজপোর্ট পোস্ট: ঢাকায় পাকিস্তানি বাহিনীর পতনের পর ভারত স্বীয় সৈন্যদের পশ্চিমাঞ্চলে যুদ্ধ বন্ধ করার নির্দেশ দিল;

১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১: দ্য টাইমস অফ লন্ডন: অশ্রুসিক্ত চোখে পাকিস্তানি জেনারেল রেসকোর্সের অনুষ্ঠানে স্বাক্ষর দিলেন;

১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১: ইউনাইটেড প্রেস ইন্টারন্যাশনাল (বার্তা সংস্থা): মিসেস গান্ধী ভারতকে সতর্ক থাকার জন্য তাগিদ দিয়েছেন;

১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১: দ্য গার্ডিয়ান: বাংলাদেশের প্রচুর বৈদেশিক সাহায্যের প্রয়োজন হবে;

১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১: বুলেট টেলিগ্রাফ: পূর্ব পাকিস্তানের আত্মসমর্পণ;

১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১: দ্য জার্নাল ট্রিবিউন: ইন্ডিয়ার ঘোষণা: পাকিস্তান আত্মসমর্পণ করেছে;

১৬ ডিসেম্বর, ১৯৭১: দ্য নিউইয়র্ক টাইমস: আক্রমণ স্থগিত;

১৬ ডিসেম্বর, ১৯৭১: দ্য নিউইয়র্ক টাইমস: বোমা বর্ষণ বন্ধ;

১৬ ডিসেম্বর, ১৯৭১: দ্য নিউইয়র্ক টাইমস: ঢাকা দখল: যুদ্ধবিরতি (প্রথম পাতায় আট কলাম জোড়া প্রতিবেদন);

১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১: কভেন্ট্রি ইভনিং পোস্ট: এতক্ষণে ইয়াহিয়ার যুদ্ধবিরতি প্রস্তাব;

১৭ ডিসেম্বর ১৯৭১: ম্যানিটক হেরাল্ড টাইমস:পাক-ভারত যুদ্ধ সমাপ্ত: সমস্ত সংঘর্ষ বন্ধ;

১৭ ডিসেম্বর ১৯৭১: ডেইলি ওয়ার্ল্ড : ৭৮ মিলিয়ন আত্মা, নবজাতক বাংলাদেশের বিপজ্জনক শৈশবকাল;

১৭ ডিসেম্বর ১৯৭১: দ্য অস্টিন স্টেটসম্যান: ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ থামল পূর্ব-পশ্চিম উভয় রণাঙ্গনে;

১৭ ডিসেম্বর ১৯৭১: দ্য গার্ডিয়ান: বাংলায় বিজয়ের পর পশ্চিম রণাঙ্গনে যুদ্ধ বন্ধ করল ভারত;

১৭ ডিসেম্বর ১৯৭১: দ্য হল্যান্ড ইভনিং সেন্টিয়াল, মিশিগান: ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ এখন শেষ;

১৭ ডিসেম্বর ১৯৭১: ইভনিং টেলিগ্রাফ: সব শেষ—যুদ্ধবিরতিতে সব পক্ষ সম্মত;

১৭ ডিসেম্বর ১৯৭১: ডিক্সন ইভনিং টেলিগ্রাফ: ১৪ দিনের যুদ্ধ শেষে পূর্ব পাকিস্তান এখন বাংলাদেশ;

১৭ ডিসেম্বর ১৯৭১: প্রেস অ্যান্ড সান বুলেটিন: পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট পশ্চিম রণাঙ্গনে অস্ত্রবিরতি মেনে নেয়ায় যুদ্ধ শেষ হলো;

১৭ ডিসেম্বর ১৯৭১: দ্য গার্ডিয়ান: পূর্ব পাকিস্তানে সেনাবাহিনীর আত্মসমর্পণ—প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার সংকল্প প্রতিশ্রুতি;

১৭ ডিসেম্বর ১৯৭১: ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল: পাকিস্তান বাহিনীর আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে পূর্বাঙ্গনে যুদ্ধের সমাপ্তি হলো এবং ভারতীয় বাহিনীর ঢাকা প্রবেশ (প্রথম পাতার আট কলাম জোড়া খবর, সঙ্গে দুটি ফটো);

১৭ ডিসেম্বর ১৯৭১: বার্মিংহাম পোস্ট: ইয়াহিয়া খানের যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার অঙ্গীকার;

১৭ ডিসেম্বর ১৯৭১: দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট: আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে পূর্ব রণাঙ্গনে যুদ্ধ শেষ হলো;

১৭ ডিসেম্বর ১৯৭১: জাপান টাইমস: ভারত ও পাকিস্তানের যুদ্ধ শেষ হয়েছে;

১৭ ডিসেম্বর ১৯৭১: কভেন্ট্রি ইভনিং পোস্ট: খেলা শেষ—যুদ্ধবিরতিতে উভয় পক্ষ সম্মত;

১৭ ডিসেম্বর ১৯৭১: সিডনি মর্নিং হেরাল্ড: পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণ;

১৮ ডিসেম্বর, ১৯৭১: দ্য নিউইয়র্ক টাইমস: পূর্ব পাকিস্তানে আত্মসমর্পণের খবরে পশ্চিম পাকিস্তানে বিক্ষোভ;

১৮ ডিসেম্বর ১৯৭১: দ্য জার্নাল: রয়টারের প্রতিনিধির আত্মসমর্পণ-পরবর্তী ঢাকায় প্রবেশ;

১৮ ডিসেম্বর ১৯৭১: বার্মিংহাম পোস্ট: ভারত ও পাকিস্তান অর্জন ও বিসর্জনের হিসাব কষছে এখন;

১৯ ডিসেম্বর ১৯৭১: দ্য নিউইয়র্ক টাইমস: বাংলার সম্ভ্রান্ত ১২৫ জনকে হত্যা করা হয়েছে;

২০ ডিসেম্বর ১৯৭১: টাইম ম্যাগাজিন: বাংলাদেশ: যুদ্ধের মধ্য দিয়ে একটি জাতির অভ্যুদয়;

২০ ডিসেম্বর ১৯৭১: দ্য গার্ডিয়ান: ভুট্টো পাকিস্তানের নতুন রাষ্ট্রপতি;

২০ ডিসেম্বর ১৯৭১: বার্মিংহাম পোস্ট: জুলফিকার আলী ভুট্টো ইয়াহিয়ার স্থলাভিষিক্ত হবেন;

২১ ডিসেম্বর ১৯৭১: দ্য নিউইয়র্ক টাইমস: কে জানে কত লাখ বাঙালিকে পূর্ব পাকিস্তানে হত্যা করা হয়েছে;

২১ ডিসেম্বর ১৯৭১: ইভনিং পোস্ট: পূর্ব পাকিস্তানকে পুনরুদ্ধারের জন্য নতুন প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার ভুট্টো সংগ্রাম করবেন;

২১ ডিসেম্বর ১৯৭১: দ্য নিউইয়র্ক টাইমস: পাকিস্তান সরকার শেখ মুজিবকে মুক্তির ব্যাপারে ঘোষণা দিয়েছে;

২২ ডিসেম্বর ১৯৭১: দ্য জার্নাল হেরাল্ড: পাকিস্তান জানিয়েছে বাঙালিদের নেতা শেখ মুজিব জীবিত আছেন;

২২ ডিসেম্বর ১৯৭১: রেডিও পাকিস্তান: পাকিস্তানের নবনিযুক্ত রাষ্ট্রপতি ও চিফ মার্শাল ল অ্যাডমিনিস্ট্রেটর জুলফিকার আলী ভুট্টোর সিদ্ধান্ত মোতাবেক পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক নেতা শেখ মুজিবকে মিয়াওয়ালি কারাগার থেকে মুক্তি দেয়া হয়েছে;

২২ ডিসেম্বর ১৯৭১: দ্য নিউইয়র্ক টাইমস: শেখ মুজিব মুভড ফ্রম প্রিজন টু হাউজ অ্যারেস্ট। লেখা হয়, তাকে অজ্ঞাত স্থানে গৃহবন্দি করে রাখা হয়েছে;

২২ ডিসেম্বর ১৯৭১: দ্য নিউইয়র্ক টাইমস: যেসব বিহারি শত্রু সহায়তা করেছিল বাঙালিরা তাদের খুঁজে বেড়াচ্ছে;

২৯ ডিসেম্বর ১৯৭১: দ্য নিউইয়র্ক টাইমস: মুক্তিযোদ্ধারা হারানো স্বজনদের খুঁজে ফিরছেন;

১৬ ডিসেম্বরের খবরের অভিমুখ

১৬ ডিসেম্বর মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় সেনাদলের যৌথ বাহিনীর কাছে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর আত্মসমর্পণের উল্লিখিত অন্যূন ২৪টি প্রতিবেদন পরীক্ষা করে বলা যায়, অধিকাংশ সংবাদপত্র ঘটনাটিকে পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধের অবসান বলে বিবেচনা করেছে। কোনো পত্রিকা একে পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধবিরতি হিসেবে আখ্যায়িত করেছে। কেউ দেখেছে এটি পাকিস্তানের হার ও ভারতের বিজয় হিসেবে; লিখেছে ভারতের জয়, পাকিস্তানের পরাজয়। ১৬ ডিসেম্বর অপরাহ্নে ঢাকা শহরের কেন্দ্রে অবস্থিত রেসকোর্সের মাঠে ভারতীয় সামরিক বাহিনীর কাছে পাকিস্তানি সেনাদল আত্মসমর্পণ করেছে—এটাই ছিল অধিকাংশ পত্রপত্রিকার প্রদেয় প্রধান বার্তা।


আরও পড়ুন: ভিনদেশি সংবাদমাধ্যমে একাত্তরের কথা (দ্বিতীয় পর্ব)


অন্যদিকে এ রকম শিরোনাম বিরল যে ‘১৪ দিনের যুদ্ধ শেষে পূর্ব পাকিস্তান এখন বাংলাদেশ’ (১৭ ডিসেম্বর ১৯৭১: ডিক্সন ইভেনিং টেলিগ্রাফ)। পূর্ব পাকিস্তান এখন বাংলাদেশ প্রশংসার্হ একটি শিরোনাম, যার যাথার্থ্য প্রশ্নাতীত।কিন্তু আমরা জানি, এটা পাকিস্তান ও ভারতের ১৪ দিনের যুদ্ধ ছিল না। এ যুদ্ধ শুরু হয়েছিল ২৫ মার্চ রাতে চট্টগ্রামে সশস্ত্র সেনা বিদ্রোহের মধ্য দিয়ে। এটি ছিল বাঙালির স্বাধীনতা অর্জনের জন্য বিদ্রোহ, প্রতিরোধ ও যুদ্ধ।

টাইম ম্যাগাজিন ২০ ডিসেম্বর ১৯৭১ সংখ্যার প্রচ্ছদে লিখেছিল: বাংলাদেশ: যুদ্ধের মধ্য দিয়ে একটি জাতির অভ্যুদয়। ১৬ বা ১৭ ডিসেম্বর প্রকাশিত দৈনিক পত্রিকাগুলোয় এ রকম শিরোনাম ছিল না বলেই চলে। আমরা ১৭ ডিসেম্বরের অস্ট্রেলিয়ার ‘দি এজ’ পত্রিকা এখনো সংগ্রহ করতে পারিনি। আমরা আশা করি, এটিতে হয়তো বস্তুনিষ্ঠতা থাকবে। কারণ ২৭ মার্চ ১৯৭১: দ্য এজ (অস্ট্রেলিয়া) পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদের শিরোনাম ছিল—ঢাকা আর পাকিস্তানের অংশ হিসেবে থাকবে না। এছাড়া এ পত্রিকায় ২৯ মার্চ ১৯৭১ প্রকাশিত সম্পাদকীয় নিবন্ধ ছিল—পাকিস্তানের দুঃখজনক পরিণতি।

মার্কিন সাংবাদিক টম টিডি ১৬ ডিসেম্বরের ঘটনাবলির ওপর একাধিক প্রতিবেদন রচনা করেন। ১৭ ডিসেম্বর কেনোসা নিউজ পত্রিকায় প্রকাশিত তার সংবাদ প্রতিবেদনের শিরোনাম ছিল ‘এখন সেখানে সত্যই এক বাংলাদেশ’। একই দিনে টেক্সাস থেকে প্রকাশিত ব্রাউনউড বুলেটিনে প্রকাশিত প্রতিবেদনের শিরোনাম ছিল ‘বাংলাদেশ এখন একটি বাস্তবতা’। টম টিডি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বার্তা সংস্থা নিউজ পেপার এন্টারপ্রাইজ অ্যাসোসিয়েশনের যুদ্ধবিষয়ক প্রতিবেদক ছিলেন। তিনি যথাযথভাবে অনুধাবন করতে সক্ষম হয়েছিলেন যে ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর আত্মসমর্পণ কেবল একটি যুদ্ধবিরতি ছিল না, তা ছিল একটি জাতির নয় মাসব্যাপী মুক্তিযুদ্ধের সফল পরিণতি এবং বিশ্বের মানচিত্রে ‘বাংলাদেশ’ নামের নতুন একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের অভ্যুদয়। টম টিডির এ প্রতিবেদনের ওপর ভিত্তি করে ১৭ ও ১৮ ডিসেম্বর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অনেক আঞ্চলিক পত্রিকা স্বাধীন রাষ্ট্র বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের সংবাদটি সঠিকভাবে প্রকাশ করতে সক্ষম হয়েছিল।

এ নিবন্ধে কেবল সংবাদ প্রতিবেদনগুলোর শিরোনাম উপস্থাপন করা হয়েছে। প্রতিবেদনগুলো পাঠ করলে বোঝা যায় এসবে এমন সব তথ্য রয়েছে, যা অন্য কোনো সূত্রে লভ্য নয়। উদাহরণস্বরূপ, ১৬ ডিসেম্বর, ১৯৭১ দ্য নিউইয়র্ক টাইমসে মুদ্রিত ‘ঢাকা দখল: যুদ্ধ বিরতি’ শীর্ষক প্রতিবেদনটির কথা বলা যায়। দীর্ঘ এ প্রতিবেদন থেকে কয়েকটি তথ্য তুলে ধরা হলো-

(ক) বিদ্রোহী বাংলাদেশ সরকারের চারজন ঊর্ধ্বস্থানীয় কর্মকর্তা আগামীকাল কলকাতা থেকে ঢাকা আসবেন, যাতে অচিরেই একটি স্বাধীন সরকার গঠন করা যায়।

(খ) জেনারেল জ্যাকব আগেই ঢাকা এসে জেনারেল নিয়াজির সঙ্গে আত্মসমর্পণ চুক্তিটি চূড়ান্ত করেন; তারপর জেনারেল অরোরা ও ভারতীয় সামরিক বাহিনীর অন্যান্য কর্মকর্তা ঢাকায় আসেন এবং আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মসমর্পণ চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হয়।

(গ) নামোল্লেখ না করে এ প্রতিবেদনে আরো লেখা হয়েছিল মুক্তিবাহিনীর প্রধান (অর্থাৎ জেনারেল ওসমানী) এ অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছিলেন। তথ্যটি ভুল ছিল।

১৫ ডিসেম্বর ১৯৭১ দ্য নিউইয়র্ক টাইমসে মুদ্রিত একটি খবরে বলা হয়েছিল পাকিস্তানি পক্ষের যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব কলকাতাবাসী বাংলাদেশ সরকারের প্রধান তাজউদ্দীন আহমদকে পাঠানো হয়েছিল; তিনি তা অনুমোদন করেছিলেন। এর আগে কোনো বিদেশী পত্রিকার প্রতিবেদনে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের নামোল্লেখও পরিদৃষ্ট হয় না।

লেখক: অর্থনীতিবিদ ও সাহিত্যিক

সারাবাংলা/এসবিডিই

ফয়জুল লতিফ চৌধুরী ফিচার ভিনদেশি সংবাদমাধ্যমে একাত্তরের কথা (প্রথম পর্ব) মুক্তিযুদ্ধ


বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ
সম্পর্কিত খবর