Thursday 05 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

দিপালী, জাফর, জয়নাল, মোজাম্মেল, কাঞ্চনের রক্তমাখা ফাগুন

হাবীব ইমন
১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ১০:০৭

এক.

১৪ ফেব্রুয়ারি আজ। একটি ঐতিহাসিক দিন। ‘স্বৈরাচার প্রতিরোধ দিবস’। আবার বিশ্ব ভালোবাসা দিবসও। ইতিহাস রক্তস্নাত অধ্যায় এই স্বৈরাচার প্রতিরোধ দিবস, অথচ আমরা তা কতোটুকুই বা জানি। অপূর্ণ ইতিহাসচর্চার কারণে প্রজন্মের সামনে ছাত্র সমাজের উজ্জ্বল দিনের কথা অস্পষ্ট।

দুই.

ফাগুনে আগুন। ১৯৮৩ সালের সেদিন ছাত্র সমাজ জাতির কাঁধে চেপে বসা সামরিক শাসকের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের এক ইতিহাস সৃষ্টি করেছিল বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়ে। ছাত্র সমাজের বুকের রক্তে কৃষ্ণচূড়া ফুলগুলোর মতো কালো রাজপথকে রক্তিম করে তুলেছিল। গভীর শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করতে হয়, সেদিনের শহীদ দিপালী সাহা, জাফর, জয়নাল, মোজাম্মেল, আইয়ূব, কাঞ্চনসহ নাম না জানা অসংখ্য শহীদকে। ভালোবাসার ফুল তাদের চরণে। ভালোবাসার প্রাণ এই বাংলা, সেই ভালোবাসার কল্যাণেই এই মাটির ইতিহাস কখনোই ভুলবার নয়।

১৯৮২ সালে বাংলাদেশে তৎকালীন সামরিক প্রেসিডেন্ট হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের শিক্ষামন্ত্রী ড. মজিদ খানের ঘোষিত শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে শিক্ষার্থীরা আন্দোলন শুরু করে। ছাত্রসমাজের দাবি ছিল একটি অবৈতনিক বৈষম্যহীন শিক্ষানীতি। কিন্তু ড. মজিদ খান যে নীতি ঘোষণা করেন, সেখানে বাণিজ্যিকীকরণ আর ধর্মীয় প্রতিফলন ঘটেছে বলে শিক্ষার্থীরা অভিযোগ করেন। তাই শুরু থেকেই ওই নীতির বিরোধিতা করতে শুরু করেন শিক্ষার্থীরা।

সে বছর ১৭ সেপ্টেম্বর ওই শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে আন্দোলনের বিষয়ে একমত হয় ছাত্র সংগঠনগুলো। তারই ধারাবাহিকতায় ১১ জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বটতলায় সমাবেশ ও সচিবালয় অভিমুখে মিছিলের কর্মসূচি ঘোষণা করে। সেদিন সকালে হাজার হাজার ছাত্র-ছাত্রী যখন বটতলায় সমবেত হয়েছে তখন কেন্দ্রীয় নেতারা অনিবার্য কারণবশত আজকের কর্মসূচি পালন করা যাবে না বলে সিদ্ধান্ত দেন। ছাত্র-ছাত্রীরা সেটি মানলেন না। সেদিনই বিক্ষুব্ধ ছাত্রদের হাতে বটতলায় নেতারা লাঞ্ছিত হলেন। পরবর্তী তারিখ নির্ধারণ করা হলো ১৪ ফেব্রুয়ারি। সেই ১৪ ফেব্রুয়ারিতে বটতলায় সমবেত হয়েছিল জীবন বাজি রেখে সামরিক স্বৈরাচারের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে হাজার হাজার ছাত্র-জনতা।

ছাত্র-জনতার শত বছরের আকাঙ্খা গণতান্ত্রিক অধিকার জনতার হাতে ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য মূলত সেই ১৪ ফেব্রুয়ারি স্বৈরাচার প্রতিরোধ দিবসের কর্মসূচিতে শামিল হয়। অকুতোভয় ছাত্রসমাজ কার্জন হলের মুখে সামরিক জান্তার পুলিশের ব্যারিকেডের মুখে পড়ে। কিন্তু জান্তার কী সাধ্য সেই দুর্বার আন্দোলন অপ্রতিরোধ্য মিছিলকে প্রতিহত করার! শুরু হয় টিয়ার গ্যাস, জলকামান, অবশেষে নির্বিচারে গুলি। লুটিয়ে পড়েন শহীদরা যাদের লাশ গুম করা হয়েছিল পরবর্তীতে। ছাত্র-জনতার আন্দোলন এগিয়ে যেতে থাকে মুক্তির আকাঙ্খায়। সেই কারণেই ১৪ ফেব্রুয়ারি স্বৈরাচার প্রতিরোধ দিবস হিসেবে পালন করা হয়।

এ কাঙ্খিত আন্দোলন অনেক চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে ১৯৯০ সালের ৪ ডিসেম্বর স্বৈরাচারী এরশাদের পতন ঘটিয়ে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের বিজয় সূচনা করে। ৬ ডিসেম্বর এরশাদ আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে বাধ্য হন।

তিন.

১৯৯৩ সালে শফিক রেহমান বাংলাদেশে প্রবর্তন করেন ‘ভালোবাসা দিবস’। ‘যায়যায়দিন’ খ্যাত সাপ্তাহিকে পরকিয়ার আখ্যান ‘দিনের পর দিন’ কলামে ‘মিলা ও মইনের’ টেলিফোনে কথোপকথনের ভালোবাসার মূর্তরূপ ধারণ করে ১৪ ফেব্রুয়ারি।

কিন্তু এটা প্রতিষ্ঠিত সত্য, বিশ্ব ভালোবাসা দিবস বাংলাদেশে পালিত হয় তারুণ্যের হলুদাভ বস্ত্রের ও গাঁদা ফুলের মর্মর মিলনমেলার আচ্ছাদনে। নগর থেকে বন্দর রাজপথ থেকে শিক্ষাঙ্গন ছেয়ে যায় হলুদাভ ভালোবাসায়—‘ফুল ফুটুক আর না ফুটুক, আজ বসন্ত’। আজ আমরা যে ভালোবাসা দিবস পালন করছি এর পেছনে রয়েছে ইতিহাস। কিছু কিছু ক্ষেত্রে মতপার্থক্যও রয়েছে। সে প্রায় সাড়ে সতের শত বছর আগে একজন রোমান ক্যাথলিক ধর্মযাজক সেন্ট ভ্যালেন্টাইনের কথা। সেই ইতিহাস আমাদের হয়তো কমই জানা। ফেব্রুয়ারিতে এই সময়েই শুরু হয় বসন্ত ঋতু। বসন্ত ফুল ফোটার সময় আর বসন্ত প্রেমের সময় বলে একটি কথা প্রচলিত আছে। ফুল আর প্রেম এগুলোর একটা ব্যাপার ভ্যালেন্টাইন্স ডে-র একটা বন্ধন মনে মনে হলেও চলে আসে।

চার.

ইতিহাস সূর্যের আলোর মতো। সময়ের দূরবর্তীতে ইতিহাস তার নায়কদের প্রতিস্থাপন করে, আবার আদর্শিক জায়গায় ইতিহাস তার খলনায়কদের সরিয়ে নিতে পিছপা হয় না। প্রজন্ম সেই সাক্ষ্য দেয় এবং দেবে। এটা হলো, ইতিহাসের মাজেজা। কোনো কোনো নায়ক সবসময় নায়কের অবতীর্ণ হতে পারে না। আজকের তারুণ্যকে জানতে হবে প্রিয়জনে ফুল ছড়িয়ে দেওয়া ভালোবাসার দিনটির আরেকটি অন্যরকম মহিমা আছে। বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাসে তারুণ্য-জাগানিয়া ‘স্বৈরাচার প্রতিরোধ দিবস’ বলে একটি দিন আছে। বিস্মরণের অতলে হারালেই কি ইতিহাসের ধ্রুব সত্যকে নিশ্চিহ্ন করা যায়? গোলাপ দিয়ে তো আর রক্ত ঢাকা যায় না। জহির রায়হানের মতো ‘আসছে ফাগুনে আমাদের দ্বিগুণ’ হতে হবে।

লেখক: রাজনীতিবিদ, সংগঠক

সারাবাংলা/এসবিডিই

ইতিহাস দিপালী জাফর জয়নাল মোজাম্মেল কাঞ্চনের রক্তমাখা ফাগুন ফিচার হাবীব ইমন


বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ
সম্পর্কিত খবর