Friday 06 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

মানিক মিয়া একাই ছিলেন এক চতুর্থ স্তম্ভ


১ জুন ২০১৮ ১১:৩৬

।।মাহমুদ মেনন, নির্বাহী সম্পাদক।।

বাংলাদেশে সাংবাদিকতা আজও প্রাতিষ্ঠানিকতা পায়নি… এমন একটি কথা প্রায়শঃই শোনা যায়। সত্যিই যে পায়নি তার জন্য উদাহরণ দাঁড় করানোর দরকার পড়বে না। তবে একথা বলা চলে বাংলাদেশের সাংবাদিকতা জগতে কিছু নাম রয়েছে… যাদের একেক জন নিজেই একটি প্রতিষ্ঠান হয়ে উঠেছেন। আর এই তালিকায় প্রথম ও প্রধানতম নামটি তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া।

একটি শোনা কথা- গল্পে গল্পে অনেকেই বলেন, স্বাধীনতার পরপরই ঢাকায় জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যখন মানিক মিয়া এভিনিউ নামে একটি সড়ক করেন, তখন বলেছিলেন সড়কটি হবে মানিক মিয়ার মনের সমান বড়। সত্যই এক বৃহৎ উদারমনা মানুষ ছিলেন তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া। যার নাম উজ্জ্বল হয়ে টিকে রয়েছে স্বাধীন বাংলাদেশের ক্যানভাস জুড়ে। তিনি চলে গেছেন স্বাধীনতারও দুই বছর আগে। তবে তার প্রতিষ্ঠিত সংবাদপত্রটি ছিলো, প্রাকারান্তরে বলা চলে তিনিই ছিলেন সেই চতুর্থ স্তম্ভ যার ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছিলো বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলন।

আওয়ামী লীগের বর্ষীয়ান নেতা আমীর হোসেন আমুর মুখেই শুনুন মানিক মিয়ার কথা। তিনি বলছিলেন, বাংলাদেশের ইতিহাসের সঙ্গে মানিক মিয়া ছিলেন অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। ২০১৭ সালে মানিক মিয়ার মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে এক জনসভায় তিনি আরও বলছিলেন, ‘মোসাফির’ ছদ্ম নামে মানিক মিয়ার লেখা কলাম  না থাকলে দেশে গণ-আন্দোলন হতো না। তার লেখা পড়েই তখন ছাত্ররা আন্দোলনের অনুপ্রেরণা পেতেন। মানুষ রাজনৈতিক শিক্ষা পেতেন।

একটি সংবাদপত্রের প্রধান চারটি কাজ হচ্ছে- জানানো, শেখানো, বিনোদিত করা আর প্রভাবিত করা। তাহলে মানিক মিয়া কিংবা তার সংবাদপত্র ইত্তেফাক সে কাজটিই করতো যা একটি সংবাদপত্রের কাজ। একটি কলামের কতখানি জোর থাকলে বলা চলে- মোসাফির ছদ্মনামে তার লেখা ‘রাজনৈতিক মঞ্চ’ নামের কলাম না থাকলে দেশে গণ-আন্দোলন ত্বরান্বিত হতো না।

একই অনুষ্ঠানে আরেক বর্ষীয়ান রাজনীতিক রাশেদ খান মেনন বলেছিলেন, বাংলাদেশে সংবাদপত্রের সঙ্গে রাজনীতির সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য। আর এ দুটি ক্ষেত্রেই মানিক মিয়ার অবদান অনেক। তিনি তার সাহসিকতায় সংবাদপত্রে এক অন্য মাত্রা যুক্ত করেছেন।

মানিক মিয়ার জন্ম হয় ১৯১১ সালে পিরোজপুর জেলার ভান্ডারিয়ায়। ১৯৪৭ সালের আগস্টে দৈনিক ইত্তেহাদের পরিচালনা পরিষদের সেক্রেটারি হিসেবে যোগ দেওয়ার মধ্য দিয়ে তার সাংবাদিকতা জগতে যাত্রা শুরু। ১৯৫১ সালে সম্পাদন শুরু করেন সাপ্তাহিক ইত্তেফাক। ১৯৫৩ সালে তারই সম্পাদনায় প্রকাশ শুরু হয় দৈনিক ইত্তেফাকের। ১৯৬৯ সালের ১ জুন পাকিস্তানের রাওয়ালপিন্ডিতে চিকিৎসা নিতে গিয়ে মারা যান।

এক অনুচ্ছেদে জীবনবৃত্তান্তটি এমনই। কিন্তু মানিক মিয়ার অবদানকে আসলেই কোনও একক ফ্রেমে বন্দি করা যাবে না। গ্রামের পূর্ব ভান্ডারিয়া মডেল প্রাইমারি স্কুল ও পরে ভান্ডারিয়া হাই স্কুলে মানিক মিয়ার শিক্ষা জীবনের গোড়াতেই মেলে তার মেধার পরিচয়। তখন থেকেই তিনি সহচর-সহপাঠীদের কাছে ক্ষুদে নেতা হয়ে ওঠেন। পরে মেট্রিক পাশ করে কৃতিত্বের সাথে। আর বরিশাল বিএম কলেজ থেকে বিএ ডিগ্রি লাভ করেন ডিস্টিংশন সহ।

আর কর্মজীবনে শুরুটা কিন্তু সাংবাদিকতায় নয়। গোড়াতেই কাজ শুরু হয় পিরোজপুর জেলা সিভিল কোর্টে। আত্মমর্যাদায় বলীয়ান মানিক মিয়া সে কাজটি ছেড়ে দেন এক মুন্সেফের খারাপ আচরণের প্রতিবাদ করে। তবে সেই সময়েই তিনি সান্নিধ্য পেয়েছিলেন অবিসংবাদিত নেতা হোসেন শহীদ সোহ্‌রাওয়ার্দীর। এরপর কিছুদিন তদানীন্তন বাংলা সরকারের জনসংযোগ বিভাগে বরিশাল জেলার সংযোগ অফিসার পদে দায়িত্ব পালন করেন। তবে দ্রুতই এসব ছেড়ে নিজেকে জড়ান রাজনীতিতে। কলকাতার প্রাদেশিক মুসলিম লীগের অফিস সেক্রেটারি হিসেবে কাজ শুরু করেন। সে পর্যায়ে মানিক মিয়া উপলব্দি করেন, রাজনৈতিক প্রচারকে আসলে নিয়ে যেতে হবে জনগণের কাছে। তার জন্য প্রয়োজন প্রচারপত্র। সেই চিন্তা থেকেই ১৯৪৬ সালে আবুল মনসুর আহমেদের সম্পাদনায় বের করলেন ‘দৈনিক ইত্তেহাদ’। সেভাবে এগুচ্ছিলো। এক বছরের মধ্যে দেশ বিভাগ হয়ে গেলে সেই ইত্তেহাদকে ঢাকায় আনার চেষ্টা করলেন। কিন্তু পাকিস্তান সরকার এসব প্রচারযন্ত্রে ছিলো সেই গোড়ার দিনগুলো থেকেই ভীতু। ফলে আনা সম্ভব হলো না। এমনকি পত্রিকাটি পূর্বপাকিস্তানে নিষিদ্ধই করা হলো।

১৯৪৯ সালে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের জন্ম হলে ইত্তেহাদের আদলে এই রাজনৈতিক দলের মুখপত্র কিংবা প্রচারপত্র হিসেবে প্রকাশিত সাপ্তাহিক ইত্তেফাক। এরপর ধীরে ধীরে একটি প্রচারপত্রের সংবাদপত্র হয়ে ওঠা ও তার মধ্য দিয়ে ইতিহাস সৃষ্টি করার ইতিহাস সকলেরই জানা। বাংলাদেশে স্বাধীকার আন্দোলনের বীজ বপনে ইত্তেফাকের ভূমিকা সর্বোতভাবেই স্বীকৃত। বিশেষ করে আইউব খানের সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলনে এই সংবাদপত্রের ভূমিকা ছিলো গুরুত্বপূর্ণ। এ কারণে মানিক মিয়াকে দুই দফা গ্রেফতার হতে হয়, নিষিদ্ধ ঘোষণার খাড়া নেমে আসে ইত্তেফাকের উপর। কিন্তু দমেননি মানিক মিয়া। যার ফল হিসেবেই ইত্তেফাকের এগিয়ে চলা।

স্বাধীনতা পূর্বকালে ইত্তেফাকের যে ভিত তিনি গড়ে দিয়েছিলেন তারই সুফল হিসেবে সে সংবাদপত্র এগিয়েছে তার পথচলার পরবর্তী দশকগুলো। আজ হয়তো ইত্তেফাক সে অবস্থানে নেই, যার কারণ হিসাবে আমরা প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতাকেই দেখি, কিন্তু সমাজের চতুর্থ স্তম্ভ হিসাবে মানিক মিয়ার ইত্তেফাক কিংবা মানিক মিয়া নিজেই ছিলেন একটি প্রতিষ্ঠান।

সাংবাদিকতাকে প্রাতিষ্ঠানিকতা দিতে তার চেষ্টার অন্ত ছিলো না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গণযোগযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগটি চালু হওয়ার পিছনে মানিক মিয়ার অবদানের কথাও আমরা আমাদের শিক্ষকদের মুখে শুনেছি। তিনি চেয়েছিলেন এখান থেকে শিক্ষার্থীরা সাংবাদিকতা শিখে তবেই তার পেশায় অংশ নেবে। আর সে কারণেই ১৯৬২ সালে যখন এই বিভাগটি প্রথম চালু হয়, তখন তার পৃষ্ঠপোষকতাও এতে ছিলো।

তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলা চলে মানিকজোড়ই ছিলেন। ঢাকায় এসে মানিক মিয়া ১৯৪৮ এ ভাষা আন্দোলনের সূচনা লগ্নেই এখানে সংবাদপত্রের প্রয়োজনীয়তা দেখতে পান আর সেই আন্দোলনের এক অন্যতম নাম ছিলো শেখ মুজিবুর রহমান। সেই শুরু এরপরের দীর্ঘ দুই দশকের পথ চলায় একে অপরের পরিপূরক হয়েও কাজ করেছেন। একজনের হাতে দেশের জনগণ আরেক জনের হাতে জনগণকে উদ্বুদ্ধ করার হাতিয়ার। ফলে স্বাধিকার প্রশ্নে জাতিকে উজ্জিবীত করে তোলা এগিয়ে চলেছে তার যথা পথে। আরও একটি কথায় কথায় শোনা গল্প বলে শেষ করি। এই স্বাধিকারের পথে চলতে গিয়ে তাদের দুই জনের ধকলও কম যায়নি। বলা হয়- এমন হতো পাকিস্তানি সরকারের পুলিশ মানিক মিয়াকে আটক করে গাড়িতে তুললে তিনি দেখতে পেতেন শেখ মুজিব আগে থেকেই সে গাড়িতে বসে আছেন, নয়তো শেখ মুজিবকে আটক করে গাড়িতে তোলা হলে তিনি দেখতে পেতেন মানিক মিয়া গাড়িতে রয়েছেন।

একটি রাষ্ট্রের জন্মের পথে রাজনৈতিক নেতার ও সাংবাদকর্মীর এই পারস্পরিক সম্পর্ককে সর্বার্থে মূল্যায়ন করতে হবে। স্বাধিকারের পক্ষে, সাড়ে সাত কোটি মানুষের পক্ষে ছিলেন তারা দুজনই। সেখানেই ছিলো দুজনের পক্ষপাত। বিষয়টি আজ যে অবর্তমান সে ব্যাপারে সন্দেহমাত্র নেই। সে কারণে সাংবাদিকতা তথা সংবাদপত্র প্রাতিষ্ঠানিকতা পাচ্ছে না, হয়ে উঠতে পারছে না একটি পরিণত শিল্প। সংবাদপত্রকে আসলে আজও থাকতে হবে ১৬ কোটি জনগণের পক্ষে, সেটা আর হচ্ছে কোথায়? রাষ্ট্রযন্ত্রও কী রয়েছে ১৬ কোটি মানুষের পক্ষে? কিংবা রাজনৈতিক দলগুলোও কী মানুষের পক্ষে? তাহলে এত দুর্নীতি, এত হিংসা, হানাহানি, হত্যা, সন্ত্রাস, বৈষম্য কেন?

মানিক মিয়ার মৃত্যুদিবসে সংবাদমাধ্যমগুলোর জন্য থাকলো শুভ কামনা।

সারাবাংলা/এমএম


বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ
সম্পর্কিত খবর