April 18, 2018 | 8:24 pm
।।জাকিয়া আহমেদ, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট।।
ঢাকা: ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ১০২ নাম্বার ওয়ার্ডের নার্সেস স্টেশনে বসেছিলেন চারজন সেবিকা। সামনে গিয়ে একজনের কাছে হৃদয় কোন বেডে আছে জানতে চাইলে চারজনই একসঙ্গে বলে ওঠেন,‘ হাত কেটে এসেছে যে ছেলেটা? ও ২৪ নাম্বার বেডে রয়েছে, ওই পাশ দিয়ে যান ’
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গোপালগঞ্জে বাস-ট্রাকের চাপায় হাতকাটা পড়া তরুণ হৃদয়ের স্বাস্থ্যের খোঁজ নিতে গেলে বুধবার (১৮ এপ্রিল) সারাবাংলার এই প্রতিবেদককে এভাবেই পথ দেখালেন ১০২ নাম্বার ওয়ার্ডের সবাই।
তাদের দেখিয়ে দেওয়া পথ ধরে এগিয়ে যেতেই কানে আসে চাপা কান্না, কিছুটা যেতেই দেখা যায় মধ্যবয়স্ক এক নারী মুখে আঁচল চেপে কাঁদছেন, তাকে সান্ত্বনা দিচ্ছেন এক তরুণ, ঘিরে রয়েছেন আরও কয়েকজন।
উনি কাঁদছেন কেন জানতে চাইলে জবাব মেলে-উনি হৃদয়ের মা, গোপালগঞ্জ থেকে আসা রোগী হৃদয়। হৃদয়ের মা শাহিদা বেগম কেঁদেই চলেছেন। কোনও ভাবেই তাকে সামলানো যাচ্ছিলো না। তিনি কাঁদছেন আর বলছেন,আমার ছেলেটার কেন এমন হলো? ছেলেটার এখন কী হবে? ছেলেটা কেমন করে বেঁচে থাকবে?
এ সময় পাশ থেকে হৃদয়ের বাবা রবিউল ইসলাম তাকে সান্ত্বনা দেন, ‘ছেলেটা যদি দেখে তুমি কাঁদতেছো তাইলেতো ওর মনটা আরও খারাপ হইবো, তুমি এইখানে বইসা কাইন্দা যাও-ওর সামনে গিয়া কাঁনবা না।’
নির্ধারিত কক্ষের ভেতরে গিয়ে দেখা যায়, হাসপাতালের বেডের ওপর অসাড় হয়ে শুয়ে আছেন হৃদয়। গায়ের ওপর গামছা দেয়া। ডান বাহু থেকে কাটা অংশে ব্যান্ডেজ করা, বাম হাতে সিরিঞ্জ ফুটানো। তার মুখের ডান পাশে রক্ত জমে আছে, ডান চোখের নিচে কাটা দাগ, চোখ দুটো ফোলা, নাকের নিচ থেকে রক্তের দাগের চিহ্ন, হতবিহ্বল শূন্য দৃষ্টি।
এ প্রতিবেদককে হৃদয়কে দেখিয়ে রবিউল ইসলাম বলেন, ‘ও আমার হৃদয়-আমার একমাত্র ছেলে। দেখেন-তার কী অবস্থা। গোপালগঞ্জ সদর হাসপাতালের ফ্রিজে হৃদয়ের কেটে যাওয়া হাতটা রয়েছে জানিয়ে রবিউল ইসলাম বলেন, কোনও ভাবে যদি ওই হাতটা লাগানো যাইতো, ছেলেটা যদি কিছু ধইরা ধইরাও নিজের পায়ে দাঁড়াইতে পারে-তাতেও অনেক কিছু। ছেলেটা ছোট থেকেই চঞ্চল আর দুষ্ট ছিল, সেই ছেলেটা কেমন চুপ হয়ে গেছে, কথা বলছে না।’
কিছুক্ষণ চুপ থেকে রবিউল আরও বলেন, কয়েকদিন আগে খবরে দেখছি, রাজীবের ডান হাত কাটা পড়লো। এখন আমার ছেলেটারও একই অবস্থা হলো। কিন্তু আল্লাহর কাছে শুকরিয়া-ডাক্তাররা বলছেন, ছেলের বিপদ কেটে গেছে। তবে ওষুধ দেওয়াতে হাতের ব্যথাটা এখনও বুঝতে পারছে না। ওষুধের মাত্রা কমে যাবার পরই চিৎকার করতে থাকে। পাশ থেকে এসময় শাহিদা বেগম বলেন, আজ ভোরেও ব্যথায় চিৎকার করছে, পরে ইনজেকশন দিয়ে ঘুম পাড়াইতে হইছে।
তবে চিকিৎসকদের কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন রবিউল ইসলাম। দল ধরে ধরে ডাক্তাররা আসছেন, কথা বলছেন। খুব ভালো ব্যবহার পাচ্ছি তাদের কাছ থেকে।
তিনি বলেন, অস্ত্রোপচারের সময় আট ব্যাগ রক্ত দিতে হয়েছে। সিটিস্ক্যান এবং এক্সরে করা হয়েছে। তারা বলেছেন, বিপদ কেটে গেছে। ছেলেকে এখন কেবল খাবার খেতে বলছে। কিন্তু ছেলেতো কিছু মুখেই দিতে চায় না।
দুই মেয়ে আর এক ছেলের মধ্যে হৃদয় ছোট। বড় মেয়ে লেখাপড়া করেছ, ছোট মেয়েটা ঢাকার একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে কম্পিউটার সায়েন্সে পড়াশোনা করছে। কিন্তু হদয় দশম শ্রেণিতে পড়ে আর লেখাপড়া করেনি, সংসারের কাজে স্বচ্ছলতা আনতে চালকের সহকারী হিসেবে কাজ নেয়। আমারে সাহায্য করার জন্য,পরিবারে যেন একটু স্বচ্ছলতা আসে সেজন্য এই কাজে যোগ দেয়। কিন্তু এখনওতো ছেলেটারই হাত কাটা পড়লো, নাই হইয়া গেল বলেন রবিউল ইসলাম।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের অর্থোপেডিকস বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. শামসুজ্জামান শাহীন বলেন, হৃদয় মোটামুটি ভালো আছে। নিউরোসার্জারি বিভাগের চিকিৎসকরা তাকে দেখেছেন, ভয়ের কিছু নেই বলেই জানিয়েছেন তারা। স্থীতিশীল রয়েছেন বর্তমানে এটা বলা যাায়।
টুঙ্গীপাড়া এক্সপেস নামের একটি বাসে চালকের সহযোগী হিসেবে কাজ করতো হৃদয়। মঙ্গলবার ( ১৭ এপ্রিল ) সকাল সাড়ে দশটার দিকে টুঙ্গীপাড়া থেকে গোপালগঞ্জ যাচ্ছিল বাসটি। এসময় বিপরীত দিক থেকে আসা একটি ট্রাক পাশ কাটিয়ে যাবার সময় বাসটির পেছনের অংশে চাপা দেয়। আর হৃদয় ছিল বাসের পেছনের দিকে বসা। সঙ্গে সঙ্গে হৃদয়ের ডান হাতটি কেটে নিচে পড়ে যায়।
প্রথমে সেখানের একটি হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়ার পরে বিকাল সাড়ে পাঁচটার দিকে ঢামেক হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়।
সারাবাংলা/জেএ/জেডএফ
** দ্রুত খবর জানতে ও পেতে সারাবাংলার ফেসবুক পেজে লাইক দিয়ে রাখুন: Sarabangla/Facebook