বিজ্ঞাপন

বাজেট এলে কালোটাকা সাদার হিড়িক, কত লাভ- কত ক্ষতি

April 19, 2018 | 5:24 pm

।। সন্দীপন বসু ।।

বিজ্ঞাপন

বিদেশে অর্থপাচার বন্ধ ও দেশে বিনিয়োগ বাড়াতে আসছে ২০১৮-১৯ অর্থবছরের বাজেটে অপ্রদর্শিত অর্থ (কালোটাকা ) সাদা করার সুযোগ থাকবে বলে জানিয়েছেন জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) চেয়ারম্যান মো. মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া। সম্প্রতি প্রাক বাজেট আলোচনায় তিনি জানিয়েছেন, জরিমানার বিধান রেখেই বাজেটে কালোটাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়া হবে।

অনেক বছর ধরেই বাজেটের আগে নিয়ম করেই এমন সভা হয়। এবারের সভায়ও এর ব্যতিক্রম কিছু হয়নি। উপস্থিতির তালিকার মানুষগুলোর কয়েকজন হয়তো বদলেছে, তবে পাল্টেনি পদবীগুলো। ছিলেন আবাসন খাতে বাংলাদেশে সবচেয়ে বড় সংগঠন রিহ্যাবের নেতারা। বরাবরের মতোই রিহ্যাব নেতারা এনবিআর চেয়ারম্যানের কাছে এবারের বাজেটেও আবাসন খাতে কালোটাকা বিনিয়োগের সুযোগ চান। আরো অন্যান্য অনেক সংগঠনেরও ছিল এমন দাবি। এই দাবির পরিপ্রেক্ষিতে এনবিআর চেয়ারম্যান কালোটাকা সাদা করতে জরিমানার বিধান রেখে এ সুযোগ দেওয়া হবে বলে জানান।

বাজেট এলেই প্রতিবারই আলোচনায় আসে কালোটাকা বা অপ্রদর্শিত আয় বৈধ করার বিষয়টি। অর্থনীতিবিদ ও গবেষকরা প্রতিবছর বিষয়টি নিয়ে আপত্তিও তোলেন। গণমাধ্যমে লেখালেখি প্রতিবেদন প্রচারিত হয় প্রতিবার। তা সত্ত্বেও নিয়ম করে বাজেটে কালোটাকা সাদা করার সুযোগ দেয়া হয়। যুক্তি আসে অপ্রদর্শিত অর্থ মূল অর্থনীতিতে নিয়ে আসা। এ যেন এক অলিখিত চক্রাকার প্রক্রিয়া!

বিজ্ঞাপন

চলতি বছরের সভায় এনবিআর চেয়ারম্যান বলেছেন, ‘কালোটাকা সাদা করার ক্ষেত্রে কর ও জরিমানা আদায় করা হয়। প্রতিবছর এটা হয়ে আসছে। যদি আমরা কালোটাকা সাদা করার সুযোগ বন্ধ করে দেই, তাহলে টাকাগুলো বাইরে চলে যাবে। এতে বিনিয়োগও বাধাগ্রস্ত হবে। বিনিয়োগ বাড়াতে আমরা কালোটাকা সাদা করার সুযোগ দিচ্ছি।’ সাংবাদিকদের উদ্দেশ করে তিনি বলেন, ‘আপনারা এটাকে কেউ ভুলভাবে ব্যাখ্যা করবেন না। আমরা ট্যাক্স ও জরিমানাসহ এ সুযোগ দিচ্ছি।’

এদিকে এনবিআর সূত্রে জানা গেছে, আসছে ২০১৮-১৯ অর্থবছরের বাজেট প্রস্তাবে তিনভাবে কালোটাকা সাদা করার সুযোগ রাখা হয়েছে। এগুলো হল- আবাসন খাতে বিনিয়োগ, বাংলাদেশ অবকাঠামো উন্নয়ন তহবিলে বিনিয়োগ এবং স্বেচ্ছায় ঘোষণা দিয়ে নির্দিষ্ট জরিমানার মাধ্যমে অপ্রদর্শিত আয় বৈধ করা।

বিজ্ঞাপন

টাকার উৎস সম্পর্কে কোনো প্রশ্ন করবে না জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)— এমন সুযোগ রেখে বিনিয়োগ করার সুযোগ থাকছে গত কয়েক বছর ধরেই। তবে এই টাকা দিয়ে শুধু ফ্ল্যাট, প্লট বা জমি কেনা যাবে। ফ্ল্যাট, জমি বা প্লটের শুধু ক্রয়মূল্যের ওপর নির্দিষ্ট পরিমাণ কর দিলেই বিনা ব্যাখ্যায় তা গ্রহণ করবে এনবিআর। এর মানে হলো, কালোটাকা সাদার সুযোগ নেওয়া যাবে ফ্ল্যাট, প্লট বা জমি কিনে। তবে দুটি শর্ত আরোপ করা হয়েছে। প্রথমত, বিনিয়োগকৃত অর্থ অবৈধ উপায়ে উপার্জন করা হলে তা গ্রহণযোগ্য হবে না। দ্বিতীয়ত, অপরাধ সংঘটনের মাধ্যমে অর্জিত অর্থ বিনিয়োগ করা যাবে না। অবশ্য এ ধরনের শর্ত প্রতিবারই থাকে। এ জন্য পৃথকভাবে একটি ঘোষণা দিতে হয়।

এবারের এনবিআরের সভায় অপ্রদর্শিত অর্থ আবাসন খাতে বিনিয়োগের জন্য পাঁচ বছর সময় চেয়েছে রিহ্যাব। একই সঙ্গে ফ্ল্যাট ও প্লট নিবন্ধন করতে সংশ্লিষ্ট কর ও ফি ৭ শতাংশ করাসহ মোট ১২টি প্রস্তাব দেয় আবাসন খাতের এ সংগঠন। দুই বছর আগে বিনিয়োগে ১০ বছরের সময় চেয়েছিল সংগঠনটি।

এদিকে এই কালোটাকা সাদার বিষয়ে সারাবাংলার কথা হয় সংশ্লিষ্ট খাতে দেশের খ্যাতনামা অর্থনীতিবিদ ও বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে। সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) অতিরিক্ত গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম সারাবাংলাকে জানান, বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত দেশে কালোটাকা সাদা করার কোনো সুযোগ ছিল না। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার পর সামরিক সরকার এক ফরমান জারির মাধ্যমে দেশে প্রথম কালোটাকা সাদা করার সুযোগ দেন। তারপর থেকে এ সুযোগ বিভিন্নভাবে দেওয়া হচ্ছে। বর্তমানে আয়কর আইনের ১৯-ই ধারার ৩(ঘ) উপধারা অনুযায়ী বেআইনি অপ্রদর্শিত অর্থ মূলধারার অর্থনীতিতে আনা হয়। তবে এতে উল্লেখ আছে সন্ত্রাসী কার্যক্রমের মাধ্যমে অর্জিত আয় সাদা করা যাবে না।

বিজ্ঞাপন

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান সারাবাংলাকে বলেন, দেশে কী পরিমাণ কালোটাকা আছে তা নিয়ে ভালো কোনো গবেষণা কিংবা তথ্য-উপাত্ত নেই। বেশ কয়েকবছর আগে অর্থ মন্ত্রণালয় একটি প্রতিবেদন তৈরি করেছিল। কিন্তু সঠিক পরিমাণ এতে উঠে আসেনি। এটা সম্ভবও নয়।

এদিকে, বিপুল পরিমাণ কালোটাকা থাকলেও সাদা হয় সামান্যই। অন্যদিকে পাচারও বাড়ছে। ওয়াশিংটনভিত্তিক সংস্থা গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইনটেগরিটি সম্প্রতি হিসাব দিয়ে বলেছে, গত ১০ বছরে বাংলাদেশ থেকে পাচার হয়েছে ৬ লাখ কোটি টাকা।

এদিকে এই কালোটাকা সাদা করার আইনি পদ্ধতিটি সাধারণ নৈতিকতা এবং সংবিধান পরিপন্থী বলে মত দিয়েছেন ড. ইফতেখারুজ্জামান। তিনি জানান, সংবিধানের ২০(২) অনুচ্ছেদ কালোটাকা সাদা করার বিষয়টি সমর্থন করে না। কারণ এতে অবৈধ সুযোগধারীরা বেশি সুবিধা পায় ও দুর্নীতিকে উৎসাহিত করা হয়।

সংবিধানের ২০(২) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে- ‘রাষ্ট্র এমন অবস্থা সৃষ্টির চেষ্টা করিবেন, যেখানে সাধারণ নীতি হিসাবে কোনো ব্যক্তি অনুপার্জিত আয় ভোগ করিতে সমর্থ হইবেন না এবং যেখানে বুদ্ধিবৃত্তিমূলক ও কায়িক সকল প্রকার শ্রম সৃষ্টিধর্মী প্রয়াসের ও মানবিক ব্যক্তিত্বের পূর্ণতর অভিব্যক্তিতে পরিণত হইবে।’ অর্থাৎ অবৈধ উপায়ে উপার্জিত অর্থ এই রাষ্ট্রে ভোগের অধিকার সংবিধান কাউকে দেয়নি।

তারপরও পঁচাত্তর পরবর্তী সরকারগুলো কালোটাকা সাদা করার আইনি ব্যবস্থা করেছে বলে জানান খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম। তিনি বলেন, প্রতি বছর বাজেটের আগে সমাজের সচেতন ব্যক্তিরা এই প্রসঙ্গে প্রশ্ন তুলে যাচ্ছেন এবং অর্থমন্ত্রীরা বিভিন্ন অজুহাতে এই ব্যবস্থা চালু রাখছেন। তাদের যুক্তিগুলোর অন্যতম হচ্ছে, দেশে বিপুল অংকের কালোটাকা রয়েছে, এই টাকা অর্থনীতির মূলধারার মধ্যে না আনতে পারলে অর্থনীতিকে কার্যকরভাবে পরিচালনা সম্ভব নয়।

খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম আরও বলেন, ‘বাস্তবে দেখা যায় যে, এই অনৈতিক এবং অসাংবিধানিক সুযোগ দেওয়ার পরও আশানুরূপ সাড়া পাওয়া যায় না। কালোটাকার মালিকেরা খুব কম অর্থই এখন পর্যন্ত সাদা করেছেন।’

সিপিডির এই অতিরিক্ত গবেষণা পরিচালকের বক্তব্যের প্রমাণ মেলে অর্থ মন্ত্রণালয়ের ২০১৪ সালের গবেষণাপত্র ‘আন্ডারগ্রাউন্ড ইকোনমি অব বাংলাদেশ: অ্যান ইকোনোমেট্রিক এনালাইসেসিসেও’।

গবেষণাপত্রটি অনুযায়ী, ২০১১ সালে দেশের অর্থনীতিতে প্রায় ৬০ শতাংশ (৫৯.৬৭%) কালোটাকা ছিল। যার পরিমাণ সাড়ে ৫ লাখ কোটি টাকার বেশি। যা ২০১৪-১৫ অর্থবছরের জাতীয় বাজেটের দ্বিগুণেরও বেশি। ওই গবেষণাপত্রটিতে আরো জানানো হয়েছে, ১৯৭৫ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত ৩৯ বছরে মাত্র ১৩ হাজার ৮০৮ হাজার কোটি কালোটাকা সাদা করা হয়েছে। আর এর বিপরীতে সরকারের কোষাগারে জমা পড়েছে এক হাজার ৪৫৫ কোটি টাকা কর।

তবে স্বাধীনতার পর কোন সময়ে কত ‘কালোটাকা সাদা’ হয়েছে তার একটি পরিসংখ্যান ২০১৭ সালে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত সংসদে তুলে ধরেছিলেন। তিনি জানিয়েছিলেন, ১৯৭৫ এ সেনা সরকারের আমলে দুই কোটি ২৫ লাখ টাকা কালোটাকা সাদা করা হয়। এরপর ১৯৭৬ থেকে ৮১ জিয়াউর রহমানের সেনাশাসন ও বিএনপি সরকারের আমলে ৫০ কোটি ৭৬ লাখ টাকা, ৮২-৯০ এইচ এম এরশাদের সেনাশাসন ও জাতীয় পার্টির সরকারের আমলে ৪৫ কোটি ৮৯ লাখ কালোটাকা সাদা হয়েছে। এরপর ১৯৯১ থেকে ৯৬ খালেদা জিয়ার বিএনপি সরকারের আমলে ১৫০ কোটি ৭৯ লাখ টাকা, ৯৭ থেকে ২০০০ সালে শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ৯৫০ কোটি ৪১ লাখ টাকা, ২০০১ থেকে ০৬ সালে খালেদা জিয়ার চার দলীয় জোট সরকারের আমলে ৮২৭ কোটি ৭৪ লাখ টাকা, ২০০৭ থেকে ০৮ সালে সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে ৯ হাজার ৬৮২ কোটি ৯৯ লাখ টাকা, ২০০৯ থেকে ১৩ শেখ হাসিনার মহাজোট সরকারের আমলে ১ হাজার ৮০৫ কোটি টাকা ও সবশেষ ২০১৪ থেকে ২০১৭ সালে শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ৮৫৬ কোটি ৩০ লাখ কালোটাকা সাদা হয়েছে। অর্থমন্ত্রীর এই অংক যোগ করলে বৈধ হওয়া টাকার অংক ১৪ হাজার কোটি ছাড়িয়ে যায়।

বছরের পর বছর ধরে সামান্য অংকের কালোটাকা সাদা করার জন্য এই সুবিধা চালু রাখাকে অনৈতিক বলে মত প্রকাশ করলেন ড. ইফতেখারুজ্জামান। এতে অনৈতিকতা উৎসাহিত হয় বলে জানান তিনি।

বছরের পর বছর এভাবে কালোটাকা সাদা করার সুযোগের কারণে সৎ করদাতারা নিরুৎসাহিত হচ্ছেন বলেও মত প্রকাশ করেন ড. ইফতেখারুজ্জামান। তিনি বলেন, ‘কালোটাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়া যে অনৈতিক, টিআইবি বরাবরই তা বলে আসছে। বর্তমান অর্থমন্ত্রীই একবার বলেছিলেন, কালোটাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়া রাজনীতির কাছে নৈতিকতার পরাজয়। কিন্তু বারবারই একই পরাজয় বরণ করছে সরকার। এটা দুঃখজনক।’

তবে ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে এই সুযোগ কমানো শুরু হয়েছে বলে জানালেন এনবিআর চেয়ারম্যান মো. মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া। সারাবাংলাকে তিনি জানান, এখন প্রধানত তিনটি ক্ষেত্রে কালোটাকা বিনিয়োগ করার ব্যবস্থা রয়েছে- বিনিয়োগ, আবাসন ও স্থাবর সম্পত্তি। এনবিআর চেয়ারম্যান সারাবাংলাকে আরো জানান, আগে কালোটাকা সাদা করার জন্য ১০ শতাংশ কর দিতে হত। এখন নিয়মিত করের সঙ্গে ১০ শতাংশ জরিমানা দিতে হয়।

এনবিআর চেয়ারম্যান আরো জানান, আবাসন খাতে কালোটাকা বিনিয়োগের সুযোগ রাখা হয়েছে মূলত বাজার চাঙ্গা রাখার জন্য। আবাসন খাত শক্তিশালী থাকলে যাদের হাতে অপ্রদর্শিত অর্থ আছে তারা তাদের সঞ্চয় এসব খাতে বিনিয়োগ করতে উৎসাহিত হয়। এই ছোট বিনিয়োগগুলোই উদ্যোক্তাদের হাতে বড় পুঁজি হয়ে জমা হয়। উদ্যোক্তাগণ এই পুঁজি দিয়ে নিজেদের বড় বড় পরিকল্পনাগুলো বাস্তবায়নের সুযোগ পায়। সবচেয়ে বেশি সুবিধা পান সে সকল উদ্যোক্তা যাদের বড় বিনিয়োগ করার ক্ষমতা নেই। তাই আবাসন খাতে কালোটাকা বিনিয়োগ করা হয় এই কারণেই।

এ বিষয়ে ভিন্নমত পোষণ করেন ড. ইফতেখারুজ্জামান। তিনি বলেন, ‘আবাসন খাত ও স্থাবর সম্পত্তিতে কালোটাকা বিনিয়োগের সুযোগ দেওয়ার ফলে বড় বড় শহরগুলোতে, নামিদামি পাড়ায়, দামি দামি বাড়িঘরের মালিক হয়েছেন কালোটাকার মালিকরা। বৈধ উপায়ে রোজগার করা মানুষজন হয়ে পড়েছেন প্রান্তিক। ফলে দেশের নীতিনির্ধারণের উপর প্রভাব রাখছেন দামি পাড়ার দামি বাড়িতে বসবাস করা কালোটাকার মালিক সেইসব অসৎ মানুষরা।’

ড. ইফতেখারুজ্জামান আরো বলেন, আপাতদৃষ্টিতে মনে হয় সরকারের দেওয়া আইনি সুযোগ নিয়ে কালোটাকা সাদা করে নিলে কালোটাকার মালিকদের সুবিধা হয়, তারা অন্ধকার জগত ছেড়ে আলোতে চলে আসতে পারেন।  অর্থনীতির মূলধারায় এসে দেশজ উৎপাদনে অগ্রণী ভূমিকা রাখতে পারেন। কিন্তু বাস্তব পরিস্থিতি একেবারেই ভিন্ন। কালোটাকা দিয়ে যদি বেশি উপার্জন করা যায়, ছেলেমেয়েকে বিদেশে লেখাপড়া করানো যায়, বিদেশে যদি নিশ্চিত এবং উন্নত ভবিষ্যৎ গড়ে তোলা যায়, তবে কোন দুঃখে নিয়মিত কর এবং জরিমানা দিয়ে কালোটাকা সাদা করা হবে!’ এমন কাজ কোনো বোকাও করবে না বলে মত প্রকাশ করেন তিনি।

আবাসন খাতে কালো টাকা বিনিয়োগের বিষয়ে ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, অবৈধ অর্থ উপার্জনকারীকে এভাবে পুরস্কৃত করে আবাসন খাতে অর্থ বিনিয়োগের সুযোগ প্রদান করা হলে তা হবে বৈধ ও সৎ পথে অর্থ উপার্জনকারী নাগরিকের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ। ফলে আবাসন খাত আরও প্রকটভাবে দুর্নীতি ও অবৈধতার করায়ত্ত হবে।

বৃহৎ করদাতা ইউনিটের (এলটিইউ) সাবেক কমিশনার আলমগীর হোসেন জানান, কালোটাকা সাদা করার বিষয়ে সব সময় একটি নেতিবাচক মনোভাব পোষণ করা হয়। আসল সত্যটা হলো সমাজে কালোটাকা উৎপাদন হয়। এখন এই টাকাকে হিসাবের মধ্যে নিয়ে আসাটা আসলে অর্থনৈতিক শৃংখলাই প্রতিষ্ঠা করা। এখন যিনি জরিমানা দিয়ে টাকা সাদা করছেন তিনি পরে নিয়মিত কর দিচ্ছেন। তিনি সিস্টেমে প্রবেশ করেছেন। যারা কালোটাকা সাদা করার বিপক্ষে বলেন, তাদের এটা বুঝতে হবে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক আবু আহমেদ বলেন, বাংলাদেশে আবাসন খাত ও পুঁজিবাজারে বিনিয়োগে কালোটাকা কাজে লাগাতে সরকারের অনেক পরিকল্পনা ছিল। কিন্তু অসাধু ব্যক্তিদের দৌরাত্মে সেই পদক্ষেপ সফল হয়নি।

তিনি বলেন, পুঁজিবাজারে শেয়ার ইস্যু করে সবচেয়ে বড় কর্পোরেট হাউসগুলো। এদের প্রধান উদ্দেশ বাজার থেকে পুঁজি আহরণ নয়, বরং কম হারে কর প্রদান করা এবং নিজেদের বিনিয়োগের বাজার-দর বাড়ানো। এরা অত্যন্ত বড় মাপের পুঁজিপতি। শেয়ার বাজারে কালোটাকা ঢুকলে তাদের পুঁজির অংকই শুধু বাড়ে, সাধারণ বিনিয়োগকারীদের ভাগে পড়ে সামান্যই।

আবু আহমেদ আরো বলেন, প্রকৃত অর্থে খুবই অল্প কিছু কোম্পানি রয়েছে যারা বাজার থেকে পুঁজি তুলে ব্যবসা সম্প্রসারণ করে। সেটা পুঁজিবাজারেই হোক বা আবাসন খাতে। কালোটাকার বিনিয়োগের সুযোগ থাকলে এ ধরণের কিছু কোম্পানির উপকার হয়। কিন্তু আদতে তা হয় না। এনবিআর যদি কালো টাকার ব্যবস্থাপনা যথাযথভাবে করতে পারে তাহলে, মেধাবী উদ্যোক্তাদের কাজে আসবে।

এদিকে কালোটাকা আবাসন খাতে বিনিয়োগের বিষয়ে রিহ্যাব প্রেসিডেন্ট আলমগীর শামসুল আল আমিন বলেন, কালোটাকা আবাসন খাতে বিনিয়োগ হলে নির্মাণ শিল্প গতিশীল হয়। আর এই শিল্প গতিশীল হলে সরাসরি প্রভাব পড়ে নির্মাণ শিল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট দুই শতাধিক খাতে। এতে শ্রমিকের কর্মসংস্থান হয়।

রিহ্যাব এর ভাইস প্রেসিডেন্ট (প্রথম) লিয়াকত আলী ভূইয়া বলেন, বাংলাদেশের আবাসন খাতের সঙ্গে দুইশর বেশি খাত জড়িত। আর এই খাতগুলোতে রয়েছে হাজারো প্রতিষ্ঠান। প্রায় অর্ধকোটি মানুষের সরাসরি রুটিরুজি জড়িত আবাসন খাতে। এই খাতের উন্নয়ন হলে লাখো মানুষের উন্নতি হয়।

কর আইনজীবীদের সংগঠন বাংলাদেশ ট্যাক্সেস বার অ্যাসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মিজানুর রহমান দুলাল জানালেন, দেশে প্রচলিত আয়কর আইন, মানি লন্ডারিং আইনসহ কোথাও কালো টাকা শব্দটির উল্লেখ নেই। অপ্রদর্শিত অর্থের বিকল্প একটি শব্দ এই কালোটাকা। টাকাকে কালো বলার এই প্রচলনটি প্রতীকি। যে টাকার উৎস দেশের প্রচলিত আইন অনুযায়ী বৈধ বা আইনসম্মত নয়, দুর্নীতি, কালোবাজারি, চোরাকারবারসহ অবৈধ উৎস থেকে উপার্জিত অর্থ হচ্ছে কালোটাকা । এছাড়া বাংলাদেশের প্রচলিত আয়কর আইন অনুযায়ী বৈধ উপায়ে উপার্জিত অর্থও কালো হতে পারে, যদি এর মালিক আয়কর বিবরণীতে সঠিকভাবে এর উল্লেখ না করেন। নির্দিষ্ট পরিমাণ কর ও জরিমানা দিয়ে এই অর্থ মূলধারায় অন্তর্ভুক্তি করাকে প্রচলিত ভাষায় কালোটাকা সাদা করা বলা হয়।

কালোটাকা ও অপ্রদর্শিত অর্থ এই দুইয়ের মধ্যে একটি পার্থক্য থাকা উচিত। এটি সরকারেরই আইন প্রয়োগে সহায়ক হবে। কারণ অপ্রদর্শিত অর্থের উৎস বৈধ-অবৈধ দুটোই হতে পারে বলেও জানান আইনজীবী মিজানুর রহমান।

মিজানুর রহমান দুলাল বলেন, ‘আমাদের দেশে সাধারণত কালোটাকার সঙ্গে বৈধ অপ্রদর্শিত অর্থকে গুলিয়ে ফেলা হয়। এতে নানা আইনি জটিলতা তৈরি হয়। কারণ অধিকাংশ মানুষই নিজের বৈধ অর্থকে আয়কর বিবরণীতে উল্লেখ করতে পারেন না। নানা জটিলতায় এবং প্রচলিত আইনের স্বল্পতায় এটি হতে পারে। তবে এটি অনিচ্ছাকৃত।’

বাংলাদেশ ট্যাক্সেস বার অ্যাসিয়েশনের এই সাধারণ সম্পাদক বলেন, ‘একজন ব্যক্তি হয়তো নিজের প্রয়োজনে উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া এক খণ্ড জমি বিক্রি করেছেন। কিন্তু আইনী জটিলতায় পুরো অর্থ আয়কর বিবরণীতে দেখাতে পারেননি। কারণ ভূমি অধিদপ্তর বিভিন্ন এলাকায় জমির একটি দর নির্ধারণ করে দেয়। তাই চাইলেও জমি বিক্রির দলিলে তার বেশি মূল্য উল্লেখ করা যায় না। তখন প্রকৃত বিক্রয় মূল্যের চেয়ে কম মূল্য উল্লেখ করতে হয়। এমন পরিস্থিতি বিক্রয় মূল্যের বাকী অংশ আয়কর বিবরণীতে উল্লেখ করা যায় না। এভাবেও বৈধ পথে উপার্জিত টাকা অপ্রদর্শিত থেকে যায়। এটি কাগজে কলমে অপ্রদর্শিত অর্থ হলেও প্রকৃত কালোটাকা হিসেবে চিহ্নিত করা যাবে না।

আবার অন্য একজন যখন কর ফাঁকি দেওয়ার অসাধু উদ্দেশ্য বার্ষিক আয়ের একটি অংশ আয়কর বিবরণীতে উল্লেখ না করে গোপন করেন তখন ওই অর্থ হল প্রকৃতই অপ্রদর্শিত অর্থ। অবৈধ উৎসের টাকাগুলোকে কালোটাকা নামে যেভাবে চেনা হয়, সেভাবে সরকারিভাবে নামকরণ করা উচিত বলেও মনে করেন তিনি।

নানা কারণে কালোটাকা সমাজ ও অর্থনীতির জন্য ক্ষতিকর বলেও উল্লেখ করেন কর আইনজীবি মিজানুর। কালোটাকার নির্দিষ্ট কোনো হিসাব থাকে না বলে এটি রাষ্ট্রবিরোধী অপরাধে ব্যবহারের আশংকা থাকে। এ ধরনের অর্থ দুর্নীতিকে উৎসাহিত করে। এছাড়া সরকার বিপুল অংকের আয়কর থেকে বঞ্চিত হয়।

বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) জ্যেষ্ঠ রিসার্চ ফেলো ড. নাজনীন আহমেদ জানান, দেশের অর্থনৈতিক খাতের উন্নয়নে কালোটাকা সরাসরি ভূমিকা রাখে না। এই কাজে সরকারের বিভিন্ন বিভাগের সমন্বয় জরুরি বলে মনে করেন তিনি।

কালোটাকার অভিশাপ থেকে মুক্তি পেয়ে কিভাবে এই টাকাকে মুলধারায় ফিরিয়ে আনা যায় এই প্রশ্নের জবাবে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, ‘কালোটাকা মূলধারায় ফিরিয়ে আনতে হলে প্রথমেই দরকার কালোটাকা বানানোর পথগুলো বন্ধ করে দেওয়া। এছাড়া দুর্নীতি দমন করা, বিদেশে টাকা পাচারের পথ বন্ধ করা, কালোটাকা সাদা করার আইনি পথ বন্ধ করা এবং কালোটাকা ওয়ালাদের আইনের আওতায় আনা। তারপর দরকার আইনের শাসন, উন্নত শিক্ষা, চিকিৎসা, বাসস্থানের ব্যবস্থা করা, লাভজনক বিনিয়োগের পরিবেশ সৃষ্টি করা।’

কাজগুলো করা সহজ নয়। এগুলো বাস্তবায়ন তাৎক্ষণিকভাবে করা যায় না, অনেক সময় লাগে। সময় যতই লাগুক না কেন শুরুটা এখনই করা দরকার। প্রস্তুতিপর্ব শুরু করতে হবে কালোটাকা সাদা করার আইনি পথ বন্ধ করার মাধ্যমে,’ বলেন মির্জা আজিজুল।

সারাবাংলা/এসবি/এমএম

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন