বিজ্ঞাপন

বারেক সাহেবের অরাজনৈতিক ঈদ

September 4, 2018 | 12:34 pm

অধ্যাপক মামুন আল মাহতাব (স্বপ্নীল) ।।

বিজ্ঞাপন

এবার একটি অরাজনৈতিক ঈদ কাটাবেন বলে পণ করেছেন বারেক সাহেব। এলাকার লোকজন জানে দলের গুরুত্বপূর্ণ তদ্বিরে বিদেশে যাচ্ছেন তিনি। ইদানিং রাজনীতি যেরকম বিদেশমুখী তাতে এতে তার টিআরপি রেটিং বেড়েছে বৈ কমেনি। একটা আদর্শ কোরবানী ঈদ উদ্যাপনের সব প্রস্তুতিই ছিল। পোলো টি-শার্ট, ক্যাপ, জিন্স আর গামবুট পায়ে তিনশ ফুটের গরুর হাটে সদলবলে হাজির বারেক সাহেব। বহুদিনের অনভ্যাসে হাট আর হাটের আশপাশটা অচেনা অচেনা লাগে। সারি-সারি গরু বাঁধা, কিন্তু ময়লার পাহাড় কোথায়? খেয়াল আছে আগে গাবতলী হাটে যাওয়া মানেই ছিল গামবুট উপচে প্যান্টতো প্যান্ট এমনকি শার্ট-ফার্টও গোবরে মাখামাখি হওয়া। ম্যানেজার আবুল বাসা থেকে বের হওয়ার আগে কেন গামবুট না পরার পরামর্শ দিচ্ছিল এখন সেটা বুঝতে পারছেন বারেক সাহেব। গামবুট পরে নিজেকে এখন কেমন যেন গবেট-গবেট লাগছে।

ময়লা নাই ভাল কথা, তাই বলে মাস্তানি- সেটাই বা কোথায়? অবাকই হন বারেক সাহেব। মাস্তান দিয়ে গরু বোঝাই ট্রাকের ড্রাইভারকে কান ধরে হাটে ট্রাক ঢোকাতে বাধ্য করার সেই চিরচেনা দৃশ্যওতো আর চোখে পড়ছে না। ‘দেশে হচ্ছেটা কি?’ ভাবেন বারেক সাহেব। হাটের আশেপাশে কিছু পুলিশ দেখা যাচ্ছে। একজন এসআই, সাথে তিন-চারজন কন্সটেবল। এতবড় হাট- কোথাও কি কোনো ছিনতাই হয়না? মলম পার্টির খপ্পড়ে কি পড়ছে না কেউ? এসব নিয়ে কোথায় বেটারা তটস্থ থাকবে, তা না মনের সুখে দাঁত কেলাচ্ছে আর বাদাম চিবুচ্ছে। দেখে পিত্তি জ্বলে যায় বারেক সাহেবের। ‘আরেকবার যদি গাড়িতে পতাকা উড়াতে পারি, সামনে পিছনে চারটার কম প্রটোকল গাড়ি ছাড়া চলবোই না।’ মনে মনে ঠিক করেন বারেক সাহেব। ‘বেটাদের দাঁত কেলানো আর বাদাম গেলা ছুটাতে হবে।’

‘আচ্ছা, দেশ থেকে কি মলম পার্টি-টার্টি গায়েব হয়ে গেল নাকি র‌্যাব-পুলিশ ‘চলো যাই যুদ্ধে, মলমের বিরুদ্ধে’ টাইপ কোন আওয়াজ তুলেছে’? ‘আবুলকে জিজ্ঞেস করতে হবে’, ভাবেন বারেক সাহেব। ইদানিং টিভি দেখা বাদ দিয়েছেন তিনি। দেখলেই গা জ্বলে যায়। একদিকে সরকারের উন্নয়নের বয়ান আর অন্যদিকে নিজ দলীয় কিছু অর্বাচীনের টকশোতে লম্ফ-জম্ফ। ‘আবুল বেটাই ভাল জানবে’- লুকিয়ে-লুকিয়ে ঠিকই খবর দেখে সে। তার কথায় টের পান বারেক সাহেব।

বিজ্ঞাপন

কোরবানীর জন্য বারেক সাহেবের বরাবরই পছন্দ ভারতীয় গরু। কথায় আাছে না ‘যে যারে নিন্দে, সে তারে পিন্দে’। ভারত শুনলে গা যতই জ্বালা করুক না কেন, ব্যাটাদের গরুগুলো দারুণ। বড়-বড়, উঁচু-উঁচু, কিন্তু দামে নিচু। প্রেস্টিজটাও ঠিক থাকে আবার পকেটের উপর চাপটাও কমে। ‘কিন্তু একি? হাটেতো লম্বা শিংয়ের, সাদা-সাদা একটাও ভারতীয় গরু চোখে পড়ছে না’। অবাক হন বারেক সাহেব। হৃষ্ট-পুষ্ট, বড়-বড় গরু আছে প্রচুর, কিন্তু সবইতো দেশি- যাকে বলে একেবারে মেড-ইন-বাংলাদেশ! মনে পড়লো পত্রিকায় পড়েছিলেন এবার ভারতীয় গরু চোরাচালান একেবারেই বন্ধ। র‌্যাব-পুলিশের দেখাদেখি বিজিবিও বোধহয় ‘চলো যাই যুদ্ধে, ভারতীয় গরুর বিরুদ্ধে’ মন্ত্রে উজ্জ্বীবিত হয়েছে। ব্যাপারটা এতক্ষণে খোলাসা হয় বারেক সাহেবের কাছে। ‘বর্ডার বন্ধ তো ভারতীয় গরু ঢুকবে কোত্থেকে? গরুতো আর ইদুর-চামচিকা না যে কাটাতারের বেড়ার চিপা দিয়ে ঢুকে পড়বে’!

কিন্তু হাটেতো গরুর কোন কমতি নেই। এই ক’দিন আগেইতো জাতীয় শোক দিবস গেল। বরাবরই ওই দিনটাতে কাঙ্গালী ভোজের হিড়িক পরে। এবার আবার নির্বাচনের বছর। কাঙ্গালী ভোজ বেড়েছে কয়েকগুন। তার উপর নেই ভারতীয় গরুর সরবরাহ। গরুতো গরু, গরুর লেজের টিকিটারওতো দেখা পাওয়ার কথা ছিল না। দাম বেশি হওয়াটাও ছিল প্রত্যাশিত। এই সরকারের জমানায় সব হিসেবই কেমন যেন উল্টে-পাল্টে যায়। হাট ভরা গরু, দামও সহনীয়। ক্রেতা-বিক্রেতা সবাই হাসিমুখে গরুর কেনাবেচা করছে। বেশী দামে গরু কেনার আক্ষেপ নেই, নেই কমদামে গরু বেচার খেদও। এ আবার কোন জ্বালা? নিজে যখন পছন্দের গরু জোড়া কিনে ট্রাকে তুলে বাসায় ফিরছেন, তখনতো তার নিজেরই কেমন যেন ফুর্তি-ফুর্তি লাগছিল। পছন্দের গরু দুটা পছন্দসই দামেই পেয়েছেন তিনি। আর আড় চোখে দেখলেন গরু দুটা ট্রাকে তুলে দিয়ে পাইকার বেটাও কি সুন্দর দাত কেলাতে-কেলাতে বিড়িতে সুখটান দিচ্ছে।

গরুর দাম দেয়ার সময়ও নতুন অভিজ্ঞতা হলো বারেক সাহেবের। হাসিল ঘরের আশেপাশে কোথায় মানুষ লুঙ্গির তলা আর বগলের চিপা থেকে টাকা বের করে, যাকে খাস বাংলায় বলে ‘ছ্যাপ লাগিয়ে’ টাকা গুনাগুনি করবে তা না, সবাই মোবাইল টেপাটিপিতে ব্যাস্ত। ‘হচ্ছেটা কি? এখানেও ফেসবুক?’ আপন মনেই ভাবেন বারেক সাহেব। ‘এখনতো পাঁচজন একসাথে খেতে যাওয়া মানে পাচটা সেলফি তুলে পাচটা মোবাইলে ফেসবুকে আপলোড করা’। কাজেই গরুর হাটই বাদ যাবে কেন? তাছাড়া গরুর সাথে সেলফিওতো ইদানিং নতুন ফেসবুক কালচার। তবে একটু পরেই ভুল বুঝতে পারেন বারেক সাহেব। ফেসবুক না, মোবইলে চলছে বিকাশ আর রকেটে গরুর দাম দেয়াদেয়ি। সবকিছু হয়ে যাচ্ছে ভার্চুয়ালি। ‘পকেটমারদের ঈদতো শেষ!’ এতক্ষনে পুলিশদের দাঁত কেলানোর রহস্যটা পরিষ্কার হয় তার কাছে।

বিজ্ঞাপন

সন্ধ্যায় গুলশান ক্লাবে বসে বন্ধুদের কাছে শুনলেন আরেক অবাক খবর। বন্ধু জব্বার জব্বর খুশি। জব্বর একটা কাজ করেছে সে। অনলাইনে হাট থেকে গরু কিনেছে। পেমেন্টও অনলাইনে। সবচেয়ে বড়কথা অনলাইনে বুক করা কসাই ঈদের দিন দুপুরের আগেই গরু কেটে-কুটে বাসায় পৌঁছে দিবে। ‘এও সম্ভব! গোটা দেশটাই কি ডিজিটাল হয়ে গেল নাকি!’ শুনলেন গতবছরের তুলনায় এবার নাকি অনলাইন গরুর হাটের প্রবৃদ্ধি আট শতাংশ বেশি।

কসাইয়ের অত্যাচারে বারেক সাহেবের নিজের কোরবানী শেষ হতেহতে আকাশ চাঁদের দখলে। এক প্যাকেট বেনসন আর কসাই বেটার চৌদ্দগুষ্ঠির খিস্তি-খেউরি উড়িয়ে ঘরে ঢুকতে না ঢুকতেই আবুল খবর দিল সিটি কর্পোরেশনের লোকজন ময়লা নেয়ার জন্য তাগাদা দিচ্ছে। বিশ্বাস হতে চায় না বারেক সাহেবের। চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে ঢাকাকে বর্জ্যমুক্ত করার দুই সিটি মেয়রের ঘোষণা তিনিও শুনেছেন বটে। কিন্তু রাজনীতিবিদরাতো কত কথাই বলে। তিনি নিজেওতো একসময় প্রতিশ্রুতির ফুলঝুড়ি কম ওড়াননি। পরদিন দুপুরে শ্বশুর বাড়ি যাওয়ার পথে তাজ্জব বনে যান বারেক সাহেব। একদম ফকফকা ঢাকা শহর। নাই লোক, নাই কোন ময়লা। ‘আহা’- নিজের অজান্তেই স্বগোক্ততি করেন বারেক সাহেব।

ঈদের পরদিন সকাল থেকেই অবশ্য মেজাজটা খিঁচড়ে আছে বারেক সাহেবের। আবুলের কথা মত টিভি চালিয়ে ছবি দেখেছেন নিজ দলের বড় নেতার অতি ছোট মিছিলের। কি লাভ হলো এতে দলের কে জানে? বারেক সাহেবের মনে হয়েছে দলটাকে মুসলিম লীগ বানানোর এটা আরেকটা ধাপ মাত্র। যে নেতার সর্বোচ্চ রাজনৈতিক অর্জন বাম ছাত্র সংগঠন থেকে ভিপি হওয়া, যিনি জীবনে জেতেননি জাতীয় কোন নির্বাচনে, ভবিষ্যতেও জিতবেন কিনা সন্দেহ, যার মূল দলের নেতা-কর্মীরা একটা সিএনজিতে চড়লে সিট খালি থাকে দু’টি- তার কাছ থেকে অবশ্য এরচেয়ে বেশী কি-ই বা আর প্রত্যাশা করা যায়। মিছিলের ছবি দেখতে দেখতে আবুলের দাঁত কেলানো মাথায় আগুন ধরিয়ে দেয় বারেক সাহেবের। তার দলের অবস্থাও না একদিন ওই সিএনজিতে চড়া দলটার মত হয়ে যায়? নাহ, আর ভাববেন না বারেক সাহেব। ‘এবারের কোরবানীর ঈদ একদম অরাজনৈতিক’ – নিজেকে মনে করিয়ে দেন তিনি।

অধ্যাপক মামুন আল মাহতাব (স্বপ্নীল) : চিকিৎসক ও কলাম লেখক।

বিজ্ঞাপন

সারাবাংলা/পিএম

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন