বিজ্ঞাপন

বিএনপির এই করুণ দশা কেন?

January 2, 2019 | 4:44 pm

সদ্য অনুষ্ঠিত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দেশের নিবন্ধিত সব রাজনৈতিক দল অংশ নেয়। সেই বিবেচনায় নির্বাচনটি ছিল ‘অংশগ্রহণমূলক’। এই নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মহাজোট নিরঙ্কুশ বিজয় অর্জন করে। দেশের রাজনীতিতে প্রধান দু’টি ধারা এবার স্পষ্ট দু’টি শিবিরে বিভক্ত হয়ে নির্বাচনে অংশ নেয়। এর বাইরে আলাদাভাবে নির্বাচনে অংশ নেয় বামপন্থীদের একটি জোট ও ইসলামী আন্দোলন।

বিজ্ঞাপন

প্রার্থিতার ক্ষেত্রে নির্বাচনটি ব্যাপকভাবে অংশগ্রহণমূলক হলেও, প্রচার-প্রচারণার ক্ষেত্রে সেটি দেখা যায়নি। অর্ধেকের বেশি আসনে বিএনপির নেতৃত্বাধীন ঐক্যফ্রন্টের প্রার্থী ও তাদের কর্মীরা ছিলেন ভোটারদের দৃষ্টির আড়ালে। সরকার বিরোধীদের অভিযোগ, মামলা, গ্রেপ্তার, ক্ষমতাসীন দলের কর্মীদের হামলার মতো বিভিন্ন কারণে তাদের জন্য মাঠে টিকে থাকা সহজ ছিল না। কিন্তু বড় সত্যটি হলো, এক সময়ের প্রতাপশালী দল বিএনপির সাংগঠনিক ভিত্তি একবারেই দুর্বল হয়ে পড়েছে। ২০১৪ সালের নির্বাচন ঠেকাতে গিয়ে জ্বালাও-পোড়াও, পেট্রোল বোমার রাজনীতি বিএনপিকে ছিন্নবিচ্ছিন্ন করে ফেলেছে। নেতিবাচক রাজনীতির কারণে একদিকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বিএনপির নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে ব্যাপকহারে মামলা করার সুযোগ পেয়েছে, অন্যদিকে সাধারণ মানুষের মধ্যেও দলটি সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা তৈরি হয়েছে। দশম সংসদ নির্বাচনের একবছর পর ২০১৫ সালে নতুন করে আন্দোলনে নেমেছিল বিএনপি-জামায়াত জোট। কিন্তু সেই আন্দোলনেও তাদের মূল হাতিয়ার হয়ে দাঁড়ায় পেট্রোলবোমা। ফলে ওই আন্দোলন জনগণের ন্যূনতম সমর্থন তো পায়ইনি, বরং জামায়াতের পাশাপাশি বিএনপিকেও দেশে-বিদেশে সন্ত্রাসী দল হিসেবে পরিচিত করে তুলেছে। গ্রেপ্তার এড়াতে তাদের বিপুলসংখ্যক নেতা-কর্মী গা ঢাকা দিয়েছেন। প্রতিকূল পরিস্থিতিতে অনেকে বিদেশে পাড়ি জমিয়েছেন। কেউ কেউ দল ছেড়েছেন।

এ কারণেই গত পাঁচ বছরে কোনো ইস্যুতেই বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট ন্যূনতম আন্দোলন গড়ে তুলতে পারেনি। দলের এই নাজুক অবস্থার মধ্যেই হঠাৎই জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠন করে নির্বাচনে আসার ঘোষণা দেয় বিএনপি। নির্বাচনি লড়াইয়ে একক কোনো নেতৃত্ব সামনে আনতে না পারায় বিএনপি হয়ে পড়ে অনেকটাই নাবিকবিহীন জাহাজ। দলীয় মনোনয়ন থেকে শুরু করে প্রতিটি ক্ষেত্রেই তাদের অপ্রস্তুত অবস্থায় পড়তে দেখা গেছে। বেশকিছুই আসনে অত্যন্ত দুর্বল প্রার্থীদের মনোনয়ন দেওয়া হয়। সবচেয়ে বড় দুর্বলতা ছিল নির্বাচনি প্রচারণায়। গ্রামে বা শহরে ঘরে ঘরে গিয়ে ভোট চাওয়ার মতো বিএনপি বা ঐক্যফ্রন্টের নেতা-কর্মী ছিলেন না অধিকাংশ এলাকায়। বেশিরভাগ প্রার্থীই খুব বেশি তৎপর ছিলেন না। কেউ কেউ পোস্টার পর্যন্ত ছাপাননি। সেই সঙ্গে তফসিল ঘোষণার পর থেকে নতুন নতুন মামলা, গ্রেপ্তার ও কোথাও কোথাও প্রতিপক্ষের হামলা বিএনপি ও তার জোটকে দুর্বল করে ফেলে। সব মিলিয়ে এই নির্বাচনে এই জোটের পরাজয় ছিল অবশ্যম্ভাবী। মানবতাবিরোধী অপরাধী রাজাকার-আলবদরের প্রতি চরম ঘৃণা নির্বাচনে বিএনপি-জামায়াতের পরাজয়ের ব্যবধান ব্যাপক আকারে বাড়িয়ে দিয়েছে।

অন্যদিকে ‘একতরফা’ নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় এলেও বিএনপি-জামায়াতের ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ডের কারণে সারা বিশ্বে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মহাজোট সরকারের গ্রহণযোগ্যতা বেড়েছে। পাশাপাশি গত এক দশকে দেশকে পরিকল্পিত উন্নয়নের পথে এগিয়ে নিতে মহাজোট সরকারের ব্যাপক কর্মকাণ্ড তাদের জনসমর্থন বাড়িয়েছে। ফলে এবারের নির্বাচনে মহাজোটের বিজয় ছিল অবধারিত। ভোটকেন্দ্রে আওয়ামী লীগ জোটের নেতা-কর্মীদের ‘আগ্রাসী’ অবস্থান নির্বাচনের সামগ্রিক ফলকে ‘নিরঙ্কুশ’ করেছে মাত্র।

বিজ্ঞাপন

আওয়ামী লীগের শাসন নিয়ে নানা প্রশ্ন থাকলেও বিকল্প গ্রহণ কোনো শক্তি এখনো শক্তিশালী অবস্থান নিয়ে দৃশ্যমান না হওয়ায় আবারও এ দলকেই বেছে নিয়েছে দেশবাসী। নির্বাচনি ফলে প্রমাণিত হয়েছে, মুক্তিযুদ্ধ ও গণতন্ত্রের পক্ষের শক্তির ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য কোনো স্বৈরাচার বা সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর সঙ্গে ঐক্য বা সমঝোতার প্রয়োজন নেই। এদেশের মানুষ যেমন মুক্তিযুদ্ধের প্রশ্নে কাউকে ছাড় দিতে রাজি নয়, তেমনি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রতিও তাদের আস্থা ব্যাপক। তবে ক্ষমতা কাঠামোয় এই শক্তির অবস্থান নিরঙ্কুশ হবে, যদি সরকার ও বিরোধী দল—উভয় পক্ষই মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের রাজনৈতিক দলগুলো শক্তিশালী অবস্থানে থাকে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশকে স্পষ্ট দু’টি ধারায় বিভক্ত করে ফেলা হয়েছে। একটি মুক্তিযুদ্ধের ধারা, অন্যটি মুক্তিযুদ্ধে পরাজিত শক্তি স্বাধীনতাবিরোধী ধারা। স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি দীর্ঘকাল ক্ষমতায় থেকে দেশকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিপরীত ধারায় নিয়ে যাওয়ার সব রকম চেষ্টা চালিয়েছে। রাজনীতিতে দুর্নীতি, সন্ত্রাস ও দুর্বৃত্তায়নের ধারা ব্যাপক শক্তিশালী হয়েছে। সামরিক শাসকদের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে নানা নেতিবাচক প্রবণতা যুক্ত করে রাজনীতিকে চরমভাবে কলুষিত করা হয়েছে।

১৯৯০-পরবর্তী সময়ে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠার ফলে রাজনীতিতে নীতি-আদর্শের ভিত্তিতে ইতিবাচক প্রবণতা শক্তিশালী হবে বলে দেশের মানুষ আশা করেছিল। কিন্তু যেনতেন প্রকারে ক্ষমতায় যাওয়া ও টিকে থাকার প্রতিযোগিতার কারণে দুর্নীতিবাজ, লুটেরা, সন্ত্রাসী ও কালো টাকার মালিকরা রাজনীতিতে আধিপত্য বিস্তারের সুযোগ পায়। অন্যদিকে, অর্থনীতি ও সমাজব্যবস্থায়ও লুটপাটের ধারাই প্রধান হয়ে ওঠে। এই সুযোগে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী মানবতাবিরোধী অপরাধীদের দল জামায়াতসহ সাম্প্রদায়িক-মৌলবাদীরা নানাভাবে শক্তি সঞ্চয় করতে থাকে।

২০০১ সালে ক্ষমতায় যাওয়ার পর বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার দুর্নীতি, লুটপাট, সন্ত্রাস, রাজনৈতিক নিপীড়নের মাধ্যমে দেশের মানুষের ওপর চরম দুঃশাসন চাপিয়ে দিয়েছিল। একইসঙ্গে তাদের আমলে চাল, ডাল, তেল. লবণসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় সব ভোগ্যপণ্যের দাম অসহনীয় পর্যায়ে চলে গিয়েছিল। এসব কারণে দেশের মানুষ দ্রুত ওই সরকারের পতন চেয়েছিল। কিন্তু ক্ষমতার মসনদ ধরে রেখে দুঃশাসন দীর্ঘায়িত করতে মরিয়া হয়ে উঠেছিল বিএনপি-জামায়াত জোট। যেনতেন প্রকারে এই কাজটি সম্পন্ন করতে নির্বাচন কমিশন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারসহ প্রশাসনের সর্বস্তরে নিজেদের লোক বসানোর পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করছিল তারা। তাদের সেই অপচেষ্টাই মূলত নির্দলীয় সরকার ব্যবস্থাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছিল। ওই সময়ে নির্দলীয় সরকারে নিজেদের লোক বসাতে বিএনপি এমন মরিয়া অপচেষ্টা না চালালে হয়তো এখনই তাদের নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য এত হা-হুতাশ করতে হতো না।

বিজ্ঞাপন

লেখক: রাজু আহমেদ, সাংবাদিক, জিটিভি

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন