বিজ্ঞাপন

বিএনপির সামনে ‘মাইনাস-টু’

November 9, 2018 | 10:34 am

।।কবির য়াহমদ।।

বিজ্ঞাপন

একাদশ সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করেছে নির্বাচন কমিশন। ঘোষিত তফসিল অনুযায়ী আগামী ২৩ ডিসেম্বর ভোটগ্রহণ। এর মধ্যে মনোনয়ন পত্র জমার শেষ তারিখ ১৯ নভেম্বর, বাছাই ২২ নভেম্বর এবং ২৯ নভেম্বর প্রার্থিতা প্রত্যাহার; অতঃপর ভোটগ্রহণ। নির্বাচনী তফসিলের বিরোধিতা করেছে ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বাধীন জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট; এই ফ্রন্টের শরিক দল বিএনপি। তাদের এই বিরোধিতার মূলে রয়েছে উত্থাপিত সাত দফা দাবি। সরকারের সঙ্গে ঐক্যফ্রন্টের দুই দফা সংলাপের পরও এনিয়ে তারা ইতিবাচক কিছু পায়নি। সরকার নির্বাচনকালীন অনির্বাচিত সরকারে নারাজ। ফলে সংলাপে খালি হাতে ফিরতে হয়েছে ঐক্যফ্রন্টকে, বিএনপিকে।

ঐক্যফ্রন্ট খালি হাতে ফিরলেও তাদের জন্যে একাদশ সংসদ নির্বাচন থেমে থাকছে না। নির্বাচনের সূচি ঘোষিত হয়ে গেছে; এবং সেদিকেই দেশ এগুচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে তারা আদৌ কি নির্বাচনে যাবে? কিংবা নির্বাচনে যাওয়ার মত প্রস্তুতি রয়েছে তাদের?

খালি চোখে দেখা যায়, সংসদ নির্বাচনে যাওয়ার মত প্রস্তুতি নাই জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের। এই জোটের শরিক দল হিসেবে বিএনপির নেই কোন পরিকল্পনা, প্রস্তুতি। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ যেখানে স্বাভাবিক রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড ও সরকারের বিভিন্ন কর্মসূচি চালিয়ে গেছে ঠিক সেভাবেই নির্বাচনের প্রস্তুতিও নিয়ে রেখেছে। ইতোমধ্যেই আওয়ামী লীগ নির্বাচন পরিচালনা কমিটিও করে ফেলেছে। দলীয় এবং বিভিন্ন সংস্থার দ্বারা বিভিন্ন প্রার্থী সম্পর্কিত তথ্যও পেয়ে গেছে তারা। নির্বাচনী ইশতেহার তৈরিতে এগিয়েছে তারা। অর্থাৎ নির্বাচনের জন্যে যতখানি প্রস্তুতির দরকার ঠিক সেই প্রস্তুতির গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়ে রয়েছে তারা।

বিজ্ঞাপন

অন্যদিকে, দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম রাজনৈতিক দল বিএনপির তেমন প্রস্তুতি নাই। প্রস্তুতিপর্বের গুরুত্বপূর্ণ দিক মনোনয়ন প্রক্রিয়া, প্রার্থী বাছাই সহ আনুষঙ্গিক কাজ; এটা তারা করতে পারেনি। ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বাধীন সরকারবিরোধী রাজনৈতিক জোট জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের শরিক দল হিসেবে ফ্রন্টের সঙ্গে আসন ভাগাভাগি নিয়েও আলোচনা হয়নি তাদের। তারা জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের সঙ্গে জোট গড়ার পর পরই এই জোটের সিলেট, চট্টগ্রাম ও ঢাকায় সমাবেশ করেছে। দাবি নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ ও সরকারের সঙ্গে দুই দফা সংলাপ করেছে। ওই সংলাপগুলোতে তাদের দাবি অনুযায়ি তারা আশানুরূপ সাড়া পায়নি। এরপর তারা আন্দোলন ও সংলাপ দুই একসঙ্গে চালিয়ে যাওয়ার কথা বলেছে। ইত্যবসরে তারা জোটের হয়ে নির্বাচন কমিশনের (ইসি) সঙ্গে বৈঠক করেছে। বৈঠকে উত্তপ্ত বাক্যবিনিময়ের তথ্য এসেছে গণমাধ্যমে। ইসি নির্ধারিত ৮ নভেম্বরের নির্বাচনী তফসিল ঘোষণা পেছানোর দাবি জানিয়েছিল তারা। তাদের ওই দাবিতে ইসি সম্মত হয়নি, এবং সিইসি নির্ধারিত তারিখেই তফসিল ঘোষণা করেছেন।

তফসিল ঘোষণার প্রারম্ভিক প্রতিক্রিয়ায় জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের মুখপাত্র এবং ওই ফ্রন্টের শরিক দল বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, তফসিলে সরকারের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটেছে। একতরফা নির্বাচন আয়োজনের উদ্দেশ্যে এই তফসিল ঘোষণা বলেও তার দাবি। জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের নেতা ও জেএসডি সভাপতি আ স ম রব নির্বাচনে পুনঃতফসিলের দাবি জানিয়েছেন। বলছেন, তফসিল না পেছালে নির্বাচনে যাবেন না তারা। জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের বাইরে অপর এক জোট যুক্তফ্রন্টের চেয়ারম্যান ও বিকল্পধারা বাংলাদেশের সভাপতি ডা. এ কিউ এম বদরুদ্দোজ্জা চৌধুরী নির্বাচন সাত দিন পিছিয়ে ৩০ ডিসেম্বর করার দাবি জানিয়েছেন। আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল-আলম হানিফ ইসির নির্বাচনী তফসিল ঘোষণাকে স্বাগত জানিয়েছেন। জাতীয় সংসদের বিরোধী দল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের জাতীয় পার্টির মহাসচিব রুহুল আমিন হাওলাদার তফসিল ঘোষণার জন্যে ইসিকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলেছেন, নির্বাচন কমিশনের সততা ও আন্তরিকতা আছে, তাই এই তফসিলেই সুষ্ঠু ভোটগ্রহণ সম্ভব।

ইসির এই তফসিল ঘোষণার পর দলগুলো নির্বাচন নিয়ে মূলত তাদের আগের অবস্থানের ভিত্তিতেই প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে। এর ব্যতিক্রম হতে পারে কেবল যারা এখন পর্যন্ত নির্বাচনে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি তাদের ক্ষেত্রে। এরবাইরে যুক্তফ্রন্টের এই অবস্থানের পরিবর্তন আসতে পারে কারণ প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সংলাপ শেষে তাদের আনুষ্ঠানিক বক্তব্য ছিল নির্বাচনে অংশগ্রহণ বিষয়ক, এবং তারা সরকারের অধীনেই নির্বাচনে সম্মত।

বিজ্ঞাপন

জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের শরিক বিএনপির চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের কেন্দ্র বাংলাদেশের নেতাদের কেউ নন, সিদ্ধান্ত তারেক রহমানের কাছ থেকেই আসতে পারে। দেশে বিএনপির মহাসচিবসহ পুরো কমিটি, স্থায়ী কমিটি, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা কমিটি সহ নানাবিধ কমিটি থাকলেও সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা নেই তাদের। খালেদা জিয়ার কারাবাসের পর দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হয়েছেন লন্ডনে থাকা তারেক রহমান। তার একক সিদ্ধান্ত মেনে নিতে হবে দলকে। তবে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টে যোগ দেওয়ার পর এখানকার নেতাদের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে তিনিও প্রভাবিত হলেও হতে পারেন। দলীয় নেতাদের ওপর তারেক রহমানের প্রভাব থাকলেও দলে তাকে নিয়ে দৃশ্যমান আলোচনা নাই, একইভাবে জনগণের মাঝেও নেই তার গ্রহণযোগ্যতা কিংবা প্রভাব। এর খেসারত দিতে হচ্ছে বিএনপিকে।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশের ইতিহাস নিয়ে অসত্য, বিভ্রান্তিকর ও বিতর্কিত বক্তব্যের কারণে তারেক রহমানের বক্তব্যের প্রচার বাংলাদেশে নিষিদ্ধ। তাই তিনি কী বলছেন, এবং বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ে তার ভাবনা, দলের ভবিষ্যত কর্মসূচি নিয়ে তার দিকনির্দেশনা পাবলিক হওয়ার সুযোগ নাই। এমন অবস্থায় দেশে বিএনপির মহাসচিবসহ অন্যান্যরা থাকলেও তারা টেলিফোনিক নির্দেশনা ছাড়া আর কিছু পাচ্ছেন না। এই দূরত্ব বিএনপির সাংগঠনিক অবস্থাকে ল্যাজেগোবরে অবস্থায় নিপতিত করেছে।

বিএনপির সাংগঠনিক এমন অবস্থা থাকলেও দলটি নির্বাচনে অংশগ্রহণের ব্যাপারে ইতিবাচক হতেও পারে, কারণ এখানে আছে সরকারবিরোধী জোট জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের বিশেষত ড. কামাল হোসেনের প্রভাব। খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের বিরুদ্ধে দুর্নীতির দণ্ডাদেশের পর আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে দলটি ব্যাপকভাবে ভাবমূর্তির সঙ্কটে পড়েছে। এমন অবস্থায় তাদের উদ্ধারকর্তা হিসেবে আন্তর্জাতিক ভাবে পরিচিত ড. কামাল হোসেন ছাড়া আর কেউ নাই। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে মাহমুদুর রহমান মান্না, সুলতান মনসুর ও কাদের সিদ্দিকীর বিএনপির পক্ষে দেওয়া বক্তব্যগুলো। এই নেতাদের বক্তব্যে অনেকেই তাদের দলীয় পরিচয় সম্পর্কে ধন্দে পড়তে হয়। তারা অন্য কোনও দলের নেতা নাকি বিএনপি নেতা এনিয়ে হঠাতই যে কেউ বিভ্রান্ত হয়ে গেলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না! এসব কারণে না চাইলেও বিএনপিকে তাদের ওপর ভরসা করতে হচ্ছে।

ফৌজদারি মামলায় দণ্ডিত হওয়ায় আইনত খালেদা জিয়া নির্বাচন করতে পারছেন না। তারেক রহমানের অবস্থাও একই; তার ওপর বাংলাদেশের ভোটার তালিকায় তারেক রহমানের নাম নাই, এবং তিনি আইন-আদালতের দৃষ্টিতে পলাতকও। এমন অবস্থায় বিএনপিকে নির্বাচনে অংশ নিতে হলে খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানকে বাদ দিয়েই নির্বাচনে আসতে হবে। এটা হলে এক দশক আগে ওয়ান-ইলেভেনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ‘মাইনাস-টু’ ফর্মুলা নয়া তরিকায় বাস্তবায়িত হবে। সে সময় অবশ্য দেশকে বিরাজনীতিকরণের দিকে ঠেলে দিয়ে শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়াকে রাজনীতি থেকেই ‘মাইনাস’ করার ছক আঁকা হয়েছিল। সেই সরকারের অন্যতম একজন উপদেষ্টা ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন আবার আছেন বিএনপির অংশ নেওয়া জোট জাতীয় ঐক্যফ্রন্টে, যদিও জোট গঠনের পর একটা মানহানির মামলায় এখন তিনি কারাগারে। তবে সেই ‘মাইনাস-টু’ আর এখনকার অবস্থা একই নয়, কারণ খালেদা জিয়া-তারেক রহমানের বর্তমান অবস্থা মূলত আদালত কর্তৃক দণ্ডিত হওয়ার কারণেই।

বিজ্ঞাপন

জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের শীর্ষ নেতা ড. কামাল হোসেন নির্বাচনে অংশগ্রহণের ব্যাপারে নেতিবাচক কথা এখনও বলছেন না। তার এই জোটের উদ্দেশ্য শেষ পর্যন্ত নির্বাচনে গিয়ে পৌঁছালে বিএনপিকেও খালেদা জিয়া আর তারেক রহমানকে বাদ দিয়ে নির্বাচনে যেতে হতে পারে। বিএনপির সকল সিদ্ধান্ত দেওয়ার ক্ষমতা তারেক রহমানের হাতে থাকলেও শেষ পর্যন্ত ভরসার জায়গা হিসেবে ড. কামাল হোসেনের দিকে তাকিয়ে তাকেও এই সিদ্ধান্ত নিতে হতে পারে। যদিও খালেদা জিয়া কিংবা তারেক রহমানের প্রতি ড. কামালের ব্যক্তিগত-রাজনৈতিক কমিটমেন্ট নাই, তাই সংলাপে কোনো দাবি পূরণ না হলেও তিনি বিএনপিকে নির্বাচনের জন্যে চাপ দিতে পারছেন। আর বিএনপিও এই চাপের কাছে নতি স্বীকার করতেও হতে পারে। কারণ এছাড়া আর কোন পথ খোলা নাই তাদের। নির্বাচনে জিততে খালেদা জিয়ার মুক্তির বিষয়টি সামনে নিয়ে এসে তারা ‘সহানুভূতির’ ভোটের দিকেও তাকিয়ে আছে।

শেষ করছি সম্প্রতি ফাঁস হওয়া এক অডিও বার্তা দিয়ে। জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের অন্যতম নেতা ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন ইংরেজি দৈনিক ‘নিউ নেশন’-এর সাবেক একজন সাংবাদিকের সঙ্গে টেলিফোনে কথোপকথনের এক পর্যায়ে ওই সাংবাদিক বলছিলেন, ‘রিউমার উঠেছে আপনি আর কামাল হোসেন লন্ডন যাচ্ছেন তারেক রহমানের সঙ্গে দেখার করার জন্যে? তখন মইনুল তারেককে কটূক্তি করে বলেন, ‘তারেকের সঙ্গে আমরা মিটিং করতে যাব? এটা কোথাকার ছাগল? গোট না কাউ? ড. কামালসহ তারেকের সঙ্গে দেখা করতে যাব? আমরা তারেকের নেতৃত্ব ধ্বংস করার জন্য ড. কামালকে আনছি!’

জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের শীর্ষ নেতা ড. কামাল হোসেনের বিভিন্ন বক্তৃতায় খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবি জানাতে ‘ভুলে যাওয়া’, ‘ব্যক্তির চেয়ে দল বড়’ বিএনপি নেতাদের উদ্দেশে এমন বক্তব্য দেওয়াসহ নির্বাচনে অংশগ্রহণের ব্যাপক আগ্রহ, ঐক্যফ্রন্টের অন্যতম নেতা মইনুল হোসেনের ফাঁস হওয়া কথোপকথন, খালেদা-তারেকের নির্বাচনে অংশগ্রহণের অযোগ্যতার পর বিএনপি নির্বাচনে অংশ নিলে এটা তাদের তরফে দলটির দুই শীর্ষ নেতাকে ‘মাইনাস’ করেই এগিয়ে যাওয়া।

সকল দলের অংশগ্রহণে সুষ্ঠু নির্বাচন দেশবাসীর চাওয়া। সকল দলের অংশগ্রহণে এই নির্বাচনের জন্যে বিএনপির অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে ‘মাইনাস-টু’ হয়ে গেলে সরকার, নির্বাচন কমিশন, জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট কিংবা দেশবাসীর এখানে করার কিছু নাই। এর দায়ও নাই কারও, কারণ এই পরিণতির জন্যে তারা নিজেরাই দায়ী।

সারাবাংলা/এমএইচ

আরও পড়ুন

ঠাট্টা থামান, মেয়েদের সামাজিক অবস্থান নিয়েও ভাবুন

আপনি একা ‘প্রধানমন্ত্রীর লোক’ নন

Tags: , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন