বিজ্ঞাপন

বিলুপ্তির পথে ‘বাংলা শকুন’

September 3, 2018 | 11:28 am

এসএম মুন্না ।।

বিজ্ঞাপন

আকারে চিলের চেয়ে বড়। শরীর কালচে বাদামি। পালকহীন মাথা, ঘাড়। কালো শক্তিশালী পা ও ঠোঁট।  মিথ প্রচলিত, এরা নাকি মৃত্যুর খবর আগে থেকে জানতে পারে। তাই এরা অসুস্থ ও মৃতপ্রায় প্রাণীর চারদিকে উড়তে থাকে। অপেক্ষায় থাকে কখন ওই প্রাণীটি মারা যাবে। এরা তীক্ষ্ম দৃষ্টিসম্পন্ন। তাই এদের বলা হয় শিকারি পাখি। প্রশস্ত ডানা তাদের। তাই দ্রুত ডানা ঝাঁপটিয়ে চলাচল করতে পারে। এরা লোকচক্ষুর আড়ালে ‘মহীরুহ’ বলে পরিচিত বট, পাকুড়, অশত্থ, ডুমুর প্রভৃতি বিশালাকার গাছে বাসা বেঁধে থাকে। অন্ধকার গুহা কিংবা গাছের কোটরে বা পর্বতের চূড়ায় এক থেকে তিনটি সাদা বা ফ্যাকাসে ডিম পাড়ে। পরিণত বয়সে দলবেঁধে আকাশে উড়ে। তাল, শিমুল. দেবদারু, তেতুল, বট গাছের মগডালে বসে থাকে শিকারের আশায়। গলার স্বর খুবই কর্কশ ও তীষ্ট। দেখতে খুবই কুৎসিত। বলছি ‘বাংলা শকুন’ এর কথা। এই প্রজাতির পাখি বাংলাদেশের স্থায়ী বাসিন্দা। অথচ দুঃখের বিষয় হচ্ছে এই শিকারি পাখিটি আজ বিলুপ্তির দ্বারপ্রান্তে।

শকুন না থাকায় নদীতে, হাওড়ে ও উপকূলীয় চরে প্রায়ই গৃহপালিত জীবজন্তুর মৃতদেহ দীর্ঘদিন ধরে পড়ে থাকতে দেখা যায়। লোকালয় থেকে মৃতদেহ অপসারণ করা গেলেও জনবিরল প্রান্তর, জলাশয় ও বনে থেকে সম্ভব হয় না। বন-বাদাড় থেকে মৃতদেহ অপসারণের ক্ষেত্রে শকুনের কোনো বিকল্প নেই। যে শকুন প্রাণীর মৃতদেহ খেয়ে প্রকৃতিকে পরিষ্কার রাখে। তারাই আজ বিলুপ্তি হয়ে যাচ্ছে।

পরিবেশ-প্রকৃতিবিষয়ক আন্তর্জাতিক সংস্থা-ইইউসিএন এই শিকারি প্রজাতির শকুনকে ‘বিশ্ব মহাবিপণ্ণ’ পাখি ঘোষণা করেছে। এক গবেষণাগ্রন্থে জানা গেছে, ‘৩৫ বছর আগেও ভারতবর্ষে ৪ কোটি শকুন ছিল। বর্তমানে এ সংখ্যা ৪০ হাজারের নিচে নেমে এসেছে। বাংলাদেশে এখন শকুন নেই বললেই চলে। যাও আছে তা ক্রমাগত হারিয়ে যাচ্ছে।

বিজ্ঞাপন

কয়েক বছর আগেও বাংলাদেশে ৭ প্রজাতির শকুন দেখা যেত। এর মধ্যে চার প্রজাতির শকুন এদেশের অনিয়মিত আগন্তুক। প্রজাতিগুলো হলো- ইউরেশিয়-গৃধিনি, হিমালয়ী-গৃধিনি, ধলা শকুন এবং কালা শকুন। বাকি তিন প্রজাতি বাংলাদেশে স্থায়ীভাবে বসবাস করত। প্রজাতিগুলো হলো- বাংলা শকুন, সরুঠুঁটি শকুন ও রাজ শকুন। গত প্রায় ৪৫ বছরে সরুঠুঁটি-শকুন ও রাজ-শকুন বাংলাদেশ হতে পুরোপুরি বিলুপ্ত হয়ে গেছে। এখন মাত্র কয়েক শত ‘বাংলা শকুন’ বেঁচে আছে। এরাই বাংলাদেশের শেষ শকুন। এই শেষ শকুনগুলোও প্রতিদিন একটি-দুটি করে মারা যাচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে এসময় নিঃশেষ হয়ে যাবে। এমনটাই আশঙ্কা করেছেন পাখিবিশারদ ড. ইনাম আল হক। তিনি বলেন, বাংলা শকুনের লুপ্ত হওয়ার কারণ জানা এবং এ মৃত্যু রোধ করার ব্যবস্থাও অজানা নয়।  তারপরেও রোধ করা যাচ্ছে না মৃত্যু।

ইনাম আল হক জানান ‘গত ৩০ বছরের বেশি সময় ধরে দেশে পশুচিকিৎসায় বেদনাহর ওষুধ হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে ‘ডাইকোফেন’। এর বিষক্রিয়ায় ৩৫ বছরে ভারতবর্ষের ৯৯ শতাংশ শকুন মারা গেছে। ২০০৬ সালে ভারতবর্ষে পশু চিকিৎসায় ‘ডাইকোফেন’ ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়। ২০১০ সালে বাংলাদেশে। কিন্তু এখনও গোপনে এর ব্যবহার দিব্যি বহাল আছে। পাশাপাশি মানুষের জন্য যে ডাইকোফেন আছে তাও গবাদি চিকিৎসায় ব্যবহার করা হচ্ছে। ডাইকোফেনের বিকল্প হিসেবে যে ‘কিটোপ্রোফেন’ ব্যবহার করা হয় তাতেও শকুন মারা যায়। ওইসব ওষুধ খাওয়া মৃত পশু খেয়ে করে মারা যাচ্ছে শকুন। ফলে দিন দিন আশঙ্কাজনকভাবে হারে কমে যাচ্ছে শকুনের সংখ্যা।

বিজ্ঞাপন

ইনাম আল হক বাংলা শকুনের প্রকার ও প্রকৃতি ও বিচরণচিত্র তুলে ধরে বলেন, বাংলা শকুনের বৈজ্ঞানিক নাম জিপস বেজ্ঞালেনসিস। চোখের সামনে অতি প্রয়োজনীয় ও অতুলনীয় এই পাখিটি বাংলাদেশ থেকে বিলুপ্ত হওয়ার পথে। এখনও তৎপর হলে এই বিলুপ্ত রোধ করা সম্ভব। প্রয়োজন কিছু দরকারি পদক্ষেপ ও কঠোর বাস্তবায়ন। যেমন-পশুচিকিৎসায় ‘ডাইকোফেনের’ ব্যবহার বন্ধের জন্য সরকারি নিষেধাজ্ঞাটি মাঠ পর্যায়ে কঠোরভাবে প্রয়োগ করা।’ তিনি আরও বলেন, ‘মানুষের জন্য যে ডাইকোফেন রয়েছে, পশুচিকিৎসায় তার ব্যবহার বন্ধ করতে হবে। কিটোপ্রোফেন ব্যবহার নিষিদ্ধ ঘোষণা করে মেলোক্সিক্যাম ব্যবহার উৎসাহিত করা এবং শকুন না মারার জন্য প্রচারণা চালাতে হবে।

মাঝে মধ্যেই মাথা চাড়া উঠে বিপদজনক রোগ ‘অ্যানথ্রাক্স’। এ প্রসঙ্গ ধরে ইনাম আল হক জানালেন ‘মৃত গরুর দেহে অ্যানথ্রাক্স-এর রোগ-জীবাণু বা ‘স্পোর’ দীর্ঘদিন টিকে থাকে এবং তা স্পর্শ করলে অন্য জীব সহজেই রোগাক্রান্ত হয়। তবে শকুন এর ব্যতিক্রম। অ্যানথ্রাক্স রোগাক্রান্ত গরু মারা গেলে তা খেয়ে শকুন সম্পূর্ণ নিরাপদ থাকে।’

গবেষণায় প্রমাণিত, অ্যানথ্রাক্স-এর স্পোর শকুনের পেটে পুরোপুরি ধ্বংস হয়। অ্যানথ্রাক্স রোগাক্রান্ত গরু খেলেও শকুনের মলে অ্যানথ্রাক্স-এর স্পোর পাওয়া যায় না। শকুনের মলে মৃতদেহের প্যাথোজেন বা রোগ-জীবাণু সম্পূর্ন অনুপস্থিত। রোগ-জীবাণু ধ্বংসের এই অসাধারণ দক্ষতার বলেই কোটি কোটি বছর ধরে মৃতদেহ খেয়ে শকুন টিকে আছে।

গবেষণাবিভিক্ত এক প্রবন্ধ থেকে জানা গেছে, ‘মৃতদেহের রোগ-জীবাণু শকুনের পেটে সহজেই যেমন ধ্বংস হয়ে যায়, ইঁদুর, কুকুর ও কাকের মতো বিকল্প শবভুক প্রাণীর পেটে তা হয় না। তাই এদের মাধ্যমে অ্যানথ্রাক্স, খুরা-রোগ, জলাতঙ্কের মতো অসুখ ছড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা থাকে। মৃতদেহ খাওয়ার প্রতিযোগিতায় শকুনের সাথে পাল্লা দেওয়া কঠিন ছিল বলে আগে এদেশে ইঁদুর ও লাওয়ারিশ কুকুরের মাত্রাতিরিক্ত বংশবৃদ্ধির ভয় ছিল না। এদের সংখ্যার ওপর শকুনের প্রাকৃতিক নিয়ন্ত্রণটি খর্ব হওয়ায় এখন জলাতঙ্ক রোগ বেড়ে গেছে। ক্রমবর্ধমান জলাতঙ্ক রোগ রোধ করার জন্য ভারত ১০ বছরে ৮০ লাখ কুকুর বন্ধ্যা করার প্রকল্প হাতে নিয়েছে। ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানাইজেশন এশিয়া মহাদেশে প্রতি-বছর প্রায় ৫০০ কোটি টাকার জলাতঙ্ক ভ্যাকসিন বিতরণ শুরু করেছে।

বিজ্ঞাপন

ছবি : ইনাম আল হক এর সৌজন্যে

সারাবাংলা/পিএম

Tags:

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন