বিজ্ঞাপন

বেগম রোকেয়া কি নারীবাদী ছিলেন?

December 9, 2017 | 2:37 pm

বাংলাদেশে নারীবাদ নিয়ে আলোচনা খুব বেশি দিনের নয়। তবে যতটা আলোচনায় আছে বাস্তবে মাঠপর্যায়ে এর প্রভাব পড়েছে খুব ধীরগতিতে। তাই এর অগ্রগতিও সীমাবদ্ধ হয়ে আছে শহুরে মহলেই।

বিজ্ঞাপন

নারীবাদের আলোচনায় প্রায়শই তর্ক আর বিতর্কে বেগম রোকেয়া শাখাওয়াত হোসেনের প্রসঙ্গ চলে আসে। কেউ কেউ দ্বিধায় থাকেন বেগম রোকেয়া আসলে নারীবাদের উদাহরণ হতে পারেন কি না। তাদের যুক্তির একটি দিক আবার চলে আসে বেগম রোকেয়া কেন মাথায় ঘোমটা দিতেন? তাহলে কি তিনি ভিতরে ভিতরে ধর্মের গন্ডি থেকে নিজেকে মুক্ত করতে পারেন নি? শৃঙ্খলিত মানুষ কেমন করে শৃঙ্খল ভাঙ্গার উদাহরণ হতে পারেন? আছে নানামুখী যুক্তি।

কিন্তু বেগম রোকেয়ার ইতিহাস আমাদের এই সময়কার নয়। ১৮৮০ সালের এই দিনে তাঁর জন্ম এবং ১৯৩২ সালের একই দিনে মৃত্যু হয়। অর্থাৎ, আজ থেকে ১৩৭ বছর আগে জন্মেছিলেন এই নারী।  তাঁকে বলা হয় বাঙ্গালী নারী জাগরণের পথিকৃৎ। তিনি একাধারে শিক্ষাবিদ, সমাজ সংস্কারক, নারী আন্দোলনের নেতা এবং সাহিত্যিক। সবকিছুকে ছাপিয়ে আমার কাছে তিনি একজন মানুষ যিনি সমাজ থেকে অন্ধকার দূর করে আলোর সন্ধান করেছেন।

ঊনবিংশ শতাব্দীর যে সময়টাতে তিনি নারীদের শিক্ষা এবং মুক্তির জন্য লড়াই করেছেন, আজকের এই একবিংশ শতকেও আমরা সেই সাহস দেখাতে পারি কি না তা প্রশ্নের সম্মুখীন। তিনি নিজে শিক্ষিত হয়েছেন এবং সমাজের অন্যান্য নারীর জন্য শিক্ষার পরিবেশ তৈরি করতে লড়াই করে গেছেন। প্রকৃতপক্ষে তিনি একজন নারীকে নিজেকে বোঝার ও বিবেচনা করার দৃষ্টিটা দিতে চেয়েছিলেন।

বিজ্ঞাপন

এই যে আজকের দিনে বসে আমরা খুব সহজেই রোকেয়া কেমন ছিলেন, কী ছিলেন, তাঁর অবদানের কোন কোন ক্ষেত্রকে আমরা উদাহরণ হিসাবে নেব ইত্যাদি বিষয় নিয়ে নিজেদের মত প্রকাশ করছি, এর পিছনে আসলে কার অবদান?

উত্তরটি আশা করছি বিনা তর্কেই মীমাংসিত। আমরা যারা নারীবাদ কি  নারীমুক্তি নিয়ে লড়াই করে যাচ্ছি এর পিছনে প্রথম প্রেরণাটা কে দিয়েছিলেন? এর উত্তরটাও খুব পরিষ্কার।

বেগম রোকেয়া সম্পর্কে আমরা কম বেশী সবাই জানি। সমসাময়িক কালে আরও কিছু নারী ছিলেন যারা যুগের চেয়ে নিজেদেরকে এগিয়ে নিয়েছিলেন। অবদান রেখেছিলেন সমাজের অগ্রগতিতে, বিশেষ করে নারীদের অগ্রগতির ক্ষেত্রে তাঁদের অনেকেরই রয়েছে বিশেষ ভূমিকা। কিন্তু রোকেয়ার বিশেষত্ব এই যে তিনি নিজেকে কেবল একজন সমাজসেবক হিসাবেই সীমাবদ্ধ রাখেননি বা রাখতে পারেননি। তাঁর রাজনৈতিক চিন্তা চেতনার প্রতিফলন আমরা দেখি নানামুখী সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডে। সেই যুগে বসে তিনি নারীদের সংগঠিত করার চিন্তা করেছিলেন এবং ১৯১৬ সালে তিনি মুসলিম বাঙালি নারীদের সংগঠন “আঞ্জুমানে খাওয়াতিনে ইসলাম” প্রতিষ্ঠা করেন। বিভিন্ন সভায় তাঁর বক্তব্য তুলে ধরেন। ১৯২৬ সালে কলকাতায় অনুষ্ঠিত বাংলার নারী শিক্ষা বিষয়ক সম্মেলনেও তিনি সভাপতিত্ব করেন।

বিজ্ঞাপন

তিনি জানতেন, কেবল চিন্তা করলেই হবে না। চিন্তা বা বিশ্বাসকে সমাজে, রাষ্ট্রে প্রতিষ্ঠা করতে না পারলে কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন সম্ভব নয়। তিনি এও জানতেন নারীদের পিছিয়ে রাখার পিছনে রয়েছে একটি বিরাট পুরুষতান্ত্রিক রাজনীতি। সেজন্যই তিনি বলতে পেরেছিলেন নারী পুরুষের মাঝে মূল পার্থক্য হচ্ছে ক্ষমতায়। নারীকে সেই ক্ষমতা থেকে পিছিয়ে রাখতে পুরুষেরা করতে পারে না এমন কোন কাজ নেই। আর তাই তিনি রাজনৈতিকভাবে নিজের মত প্রতিষ্ঠা করতে এবং নিজেকে একজন চিন্তা ও চেতনার দিক থেকে ক্ষমতাশীল মানুষ হিসাবে প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যেই তাঁর সাংগঠনিক ক্ষমতাকে কাজে লাগিয়েছিলেন।

পুরুষতন্ত্রের সেই রাজনীতি এই একবিংশ শতকে এসেও একইভাবেই আছে সমাজে। রাষ্ট্র কর্তৃক লালিত পুরুষতন্ত্র নারীদের বঞ্চিত করে যাচ্ছে পদে পদে। যে সম্পত্তির অধিকারের কথা রোকেয়া বলে গিয়েছিলেন আজ থেকে একশ বছর আগে আজও সেই অধিকার প্রতিষ্ঠা হয়নি। সেই একই কথা আমার মত লাখো সচেতন নারী বলে যাচ্ছেন আজও। তাঁর মানে বেগম রোকেয়া আজকের নারীবাদীদের চেয়ে অনেক অনেক বেশী আগানো ছিলেন। তাঁরই দেখানো নারীবাদের পথেই হাঁটছি আমরা। এই উপমহাদেশের প্রথম স্বীকৃত নারীবাদী বল্লেও বোধ করি অতিরিক্ত হবে না। কারণ নারীবাদ কোন ভিনগ্রহের মতবাদ নয়। এটি একটি জীবনাচরনকে নির্দেশ করে, একটি ব্যবস্থার কথা বলে যেখানে নারী বা পুরুষ পরিচয়ে কাউকে পিছিয়ে রাখা হবে না। নারীকে একজন সামাজিক অংশীদার হিসাবে তার প্রাপ্য মর্যাদা ও অধিকারগুলো নিশ্চিত করা হবে।

আজকের বাংলাদেশের নারীদের বাস্তব চিত্র আসলে কী? এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে আমরা বাংলাদেশী নারীরা অনেক ক্ষেত্রেই বেগম রোকেয়ার যুগের চেয়ে অনেক এগিয়েছি কিন্ত প্রকৃত মুক্তি বলতে যা বুঝায় তা কী পেয়েছি? বাহ্যিকভাবে বিবেচনা করলে দেখা যাবে, আমরা নারীরা আর ঘরে আবদ্ধ নই। নারীরা আজকাল অংশ নিচ্ছে অনেক রকম অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে। কিন্তু নারী মুক্তি কী কেবল একজন নারীর চাকরি করা বা উচ্চতর ডিগ্রী অর্জনে?

নারী মুক্তিকে ত্বরান্বিত করতে রয়েছে জাতীয়, আন্তর্জাতিক আইন, কিন্তু বাস্তবে সেসব আইনের প্রয়োগ কী আমরা শতভাগ করতে পারছি?

বিজ্ঞাপন

বড় সংখ্যক নারী বর্তমানে ঘরের বাইরে কাজে এলেও এখনো পর্যন্ত আমরা দাবী করতে পারিনা যে নারীকে মানুষ হিসাবে সমাজের সকল অধিকার প্রয়োগ করার মত পরিবেশ গড়ে উঠেছে। বেগম রোকেয়ার সময়ে তিনি নারীর রাজত্বের স্বপ্ন দেখেছিলেন তার লেখায়। সেই স্বপ্ন এখনো স্বপ্নই থেকে গেছে । বেগম রোকেয়া নারীদেরকে মানসিক দাসত্ব থেকে মুক্ত হবার উপর জোর তাগিদ দিয়েছিলেন। সেই দাসত্ব থেকে কী আমরা মুক্ত হতে পেরেছি? পোষাকী মুক্তি ছাড়া আর কী পেয়েছি আমরা?

নারীরা যে হারে ঘর থেকে বেড়িয়ে এসেছিলো, সাম্প্রতিক এক পরিসংখ্যান বলছে সেই একই হারে তারা আবার ঘরে ঢুকতে শুরু করেছে। কর্মজীবি নারীর সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে কমতে শুরু করেছে বলে পত্রিকার এক রিপোর্ট বলছে। এই হার ৬৭ শতাংশ থেকে নেমে এখন সম্ভবত ৩৫ বা ৩৭ শতাংশ বা তার কিছু কম বেশিতে এসে আটকেছে। তাহলে এই নারীরা কোথায় পিছিয়ে পড়ছে? তারা কী আবার রোকেয়ার সেই “অবরোধবাসিনী” হতে শুরু করেছে? নারীরা শারীরিকভাবে নির্যাতনের শিকার হলেও সেটা প্রকাশ করতে চায় না বলে আরেক পরিসংখ্যান বলছে। এটা কী নারীর “মানসিক দাসত্ব”নয়?

আজ থেকে শত বছর আগে যে সমাজ বাস্তবতায় বেগম রোকেয়া বলে গেছেন, একজন নারীকে তার মতামত গঠনের মত স্বাধীনতা দিতে হবে। আজকের বাস্তবতা হচ্ছে আমরা আজো একই লড়াই চালিয়ে যাচ্ছি।

বেগম রোকেয়া তাঁর প্রবন্ধ, গল্প, কবিতা, উপন্যাসের মধ্য দিয়ে নারীশিক্ষার প্রয়োজনীয়তা আর লিঙ্গসমতার পক্ষে যুক্তি তুলে ধরেছেন। তাঁর লেখায় তিনি পিতৃতান্ত্রিক সমাজে নারীর অসম অবস্থান ফুটিয়ে তুলেছেন। তিনি তাঁর লেখনী দিয়ে সামাজিক সচেতনতা সৃষ্টির চেষ্টা করেছেন, ধর্মের নামে নারীর প্রতি অবিচার রোধ করতে চেয়েছেন, শিক্ষা আর পছন্দানুযায়ী পেশা নির্বাচনের সুযোগ ছাড়া যে নারী মুক্তি আসবে না – তা বলেছেন। এই চিত্র কী এখনো আমরা দেখছিনা? ধর্মীয় গোড়ামী কী এখনো আমাদের নারীদেরকে বাধাগ্রস্ত করছেনা?

বেগম রোকেয়া একাই লড়ে গিয়েছিলেন সেইসব কুসংস্কার আর সামাজিক বিধির বিরুদ্ধে। আজকে তো আমরা অনেক সচেতন, অনেক বেশী শিক্ষিত আর অধিকারবোধসম্পন্ন। তাহলে আমাদের মাঝে লড়াইয়ের সেই প্রবনতা কম কেন? এত বিভক্তি কেন নারী অধিকার প্রশ্নে? কেন আমরা কে নারীবাদ আর কে পুরুষবাদ এই সীমারেখাকে উপড়ে ফেলে কেবল নারীর অবস্থানকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য ঐকবদ্ধ হতে পারছি না? কোথায় সে বাধা? ভাবতে হবে আরও পরিষ্কার হয়ে। রোকেয়া নারীবাদকে ধারণ করতেন কি না সেই তর্কের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে কেন নারীরা আবার ঘরে ঢুকতে শুরু করেছে!

নারীর মানসিক দাসত্বকে ভাঙতে হলে আবারও রোকেয়ার কাছেই যেতে হবে, বারবার যেতে হবে। রোকেয়ার লড়াইকে নিজের লড়াই মনে করে সাহসের সাথে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। তিনিই নারীমুক্তি আন্দোলনের একমাত্র প্রাতিষ্ঠানিত পথিকৃৎ আজও– তার স্থলাভিষিক্ত হবার মত কেউ এখনও আসেনি।

 

সারাবাংলা/ এসএস

 

Tags: , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন