বিজ্ঞাপন

ভালোবাসায় একসঙ্গে জিতে যাওয়ার গল্প

February 14, 2019 | 7:10 pm

।। মাকসুদা আজীজ, অ্যাসিস্ট্যান্ট এডিটর ।।

বিজ্ঞাপন

ঢাকা: বসন্তের পিছু পিছু চলে এলো ভালোবাসার দিনও। তবে আমাদের আজকের প্রেমের গল্প রোমান পাদ্রি সেন্ট ভ্যালেনটাইনের মতো হৃদয় বিদারক নয়। এই গল্প জিতে যাওয়ার। হ্যাঁ, যুদ্ধ এখানেও ছিল। সম্রাট ক্লডিয়াসের রূপ ধরে নয়, লৌকিকতা-সামাজিকতা আর বাস্তবতার মুখোশে। তারপরও যুগলরা জিতে যায় জীবনের চড়াই-উতরাই পার করে, পরিস্থিতির কাছে হেরে না গিয়ে, একজন আরেকজনের সহায় হয়ে। সেরকম এক যুগল শফিউর রহমান ও ফিরোজা রহমান।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মৃত্তিকা বিজ্ঞান বিভাগের প্রবীণ শিক্ষক শফিউর রহমান অবসর নিয়েছেন প্রায় এক যুগ হলো। যদিও এখনকার শিক্ষার্থীরাও তাকে চেনেন। সৌম্য-শান্ত এই প্রৌঢ় এক যুগে দারুণ ‘হ্যান্ডসাম’ ছিলেন। সেটাই ফিরোজা রহমানকে চুপি চুপি এসে বলেছিলেন তার বান্ধবীরা।

পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে ফিরোজা-শফিউর দম্পতি

সে প্রায় ৫৪ বছর আগের ঘটনা। ভেতরের ঘরে দুরু দুরু বুকে বসেছিলেন তরুণী ফিরোজা। বাইরের ঘরে বর। সে যুগের স্বাভাবিক নিয়মে সেদিন ছিল ফিরোজার ‘উঠ ছুড়ি তোর বিয়ে’। বন্ধু মালা এসে কানে কানে বলে, দুলাভাই কিন্তু দারুণ সুদর্শন, লম্বা ফর্সা… প্রেমটা কি সেই কথা থেকেই হলো কি না, সে জবাব পাওয়া যায়নি আজও। গত ৫৪ বছরে জীর্ণ হয়েছে ত্বক, শীর্ণ হয়েছে দেহ। তবু সেদিনের মতো তরুণ আছে ভালোবাসাটা, যেটাকে একটু একটু করে চারা গাছ থেকে মহীরুহতে পরিণত করেছেন তারা।

বিজ্ঞাপন

ফিরোজা-শফিউর দম্পতির চার কন্যা। চার জনই নিজ নিজ ক্ষেত্রে সফল। ফিরোজা উদ্যমী মানুষ। বিয়ের পরে শেষ করেছেন নিজের শিক্ষাজীবন। ইউনিভার্সিটি ল্যাবরেটরি স্কুলে শিক্ষকতা করেছেন, মেয়েদেরও দিয়েছেন সর্বোচ্চ শিক্ষা। মা-বাবার মতোই মেয়েরাও। জীবনকে তারা জয় করেছেন নিজেদের সবটা সাধ্য দিয়ে। দেশ-বিদেশে ছড়িয়ে থাকা মেয়েদের দেখতে বেড়িয়ে পড়েন তারা। এই তো গত বছরও বড় নাতনীকে বিয়ে দিয়ে এলেন কানাডায়।

বাবা-মায়ের দাম্পত্যের গল্প জিজ্ঞাসা করতেই মেয়েরা হেসে গড়িয়ে পড়েন। মেঝ মেয়ে সিমকী রহমান বলেন, আম্মা-আব্বা সারাদিন একজন আরেকজনের নামে অভিযোগ করেন। কিন্তু একজনের কাছে আরেকজনকে নিয়ে কথা বলতে গেলে আমাদের খবরই আছে। তাদের মধ্যে আমাদের কারও জায়গাও নেই।

ছোট মেয়ে মিথিলা রহমান বলেন, আম্মা-আব্বা দু’জন দুই ঘরে দুই টিভিতে এক চ্যানেলে একই শো দেখেন। তারপরও যদি কারও সাউন্ড কম বা বেশি হয়, তাই নিয়ে অভিযোগ! ওদিকে একজন একটু অসুস্থ হলে আরেকজনের অস্থিরতা হয় দেখার মতো! যে আব্বা নিজে নিজে জুতা জোড়াও খুঁজে পান না, তিনিই কোমড় বেঁধে লেগে যান আম্মার সেবায়।

বিজ্ঞাপন

বাহ, একেই তো বলে ভালোবাসা, ভালোবাসতে বাসতে একসঙ্গে বুড়ো হয়ে যাওয়া!

ভালোবাসতে বাসতে এভাবেই ১০ বছর ধরে বুড়ো হচ্ছেন তৃষা আর মনজুর দম্পতিও। তবে একসঙ্গে বুড়ো হওয়া কই হচ্ছে তাদের— দু’জন এক দেশে থাকলেও তাদের বাস দুই প্রদেশে।

সন্তান অ্যামেলিয়ার সঙ্গে তৃষা-মনজুর

শিরিন মির্জা তৃষা পেশায় ডাক্তার, মনজুর ইঞ্জিনিয়ার। তবে মনজুরের আরেকটা পরিচয় আছে এখন, অ্যামেলিয়ার বাবা। এই নামেই এখন মনজুরকে চেনেন সবাই। কারণ মনজুর একাই এক প্রদেশে বসে কন্যা অ্যামেলিয়াকে বড় করছেন। তৃষা ৪০ দিন পর পর আসতে পারেন পরিবারের কাছে। এসে দেখেন কী সুন্দর মানিয়ে নিয়েছে বাবা-মেয়েতে।

তৃষা বলেন, অ্যামেলিয়ার বাবার সঙ্গে যখন আমার পরিচয়, তখন সে নিতান্তই একজন ছেলেমানুষ। লেখাপড়া ছাড়া তার জীবনে আর তেমন কিছুই নেই। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তার জীবনে অনেক পরিবর্তন, উত্থান-পতন আমার দেখা হলো।

বিজ্ঞাপন

অ্যামেলিয়া জন্মেছিল খুব ছোট্ট হয়ে। তৃষা বলেন, চোখের সামনে সেই মুহূর্তে অ্যামেলিয়ার বাবার বাবা-জন্মটা দেখলাম। এরপর অনেক দিন পার হয়ে গেছে, অ্যামেলিয়া এখন মোটেও আর ছোট নেই, প্রায় পাঁচ বছরের দুরন্ত দস্যি মেয়ে।

অ্যামেলিয়ার বাবার সারাদিন যায় মেয়েকে নিয়ে। সময়ের প্রয়োজনে অ্যামেলিয়ার বাবাই এখন তার মা ও বাবা। ‘আমি কাজ করি অন্য শহরে। জানি সবাই এ কথা পড়লে অবাক হয়ে যাবেন। কিন্তু এমেলিয়া একদম একাই থাকে তার বাবার সঙ্গে। মেয়ের স্কুল, সাঁতারের ক্লাস, মনমতো রান্না করা, খেলতে নিয়ে যাওয়া থেকে শুরু করে জামার সঙ্গে মিলিয়ে নেইলপলিশ দেওয়া পর্যন্ত সব সে একাই করে,’— বলেন তৃষা।

তবে এখানেই শেষ নয় অ্যামেলিয়ার বাবার দায়িত্ব। তৃষার বর্ণনায়, এখানে শেষ হলেও হতো। কিন্তু এরপর হতে হয় পাইরেট, মনস্টারদের সঙ্গে ফাইট করতে হয়ে, পোকাদের হাত থেকে অ্যামেলিয়াকে রক্ষা করতে হয়। চোখের পলকে কেক, আইসক্রিম হাজির করতে হয়। যাবতীয় আবদার মেটাতে হয়, খেলনাপাতি কিনে দিতে হয়। অ্যামেলিয়ার চোখে বাবার চেয়ে বেশি সাহসী আর কেউ নেই। কিছু হলেই ‘বাবা ফিক্স করবে’।

বলতে বলতে হেসে ওঠেন তৃষা। সেই হাসিতে ঝরে পরে ভালোবাসা, গর্ব। কে বলে ভালোবাসা শুধু পাশে বসেই হয়! শচীন কর্তা তো আর এমনি এমনি বলেননি, ‘বিরহ বড় ভালো লাগে!’

দূরত্ব বাধা হতে পারেনি দোদুল-মুকাররমের ভালোবাসায়

এই বড় ভালোলাগা বিরহের খোঁজেই বুঝি দোদুল আর মুকাররম দূরে দূরে থাকেন একে অন্যের। দোদুল বেলজিয়াম বসে লেখাপড়া করছেন, আর মুকাররম দেশে বসে বানাচ্ছেন সিনেমা। আর এই জীবন নিয়ে তারা খুব খুশিও। কে বলে, চোখের আড়াল হলে হৃদয়ের আড়াল হয়? এরা তো এসব মানেন না। দোদুল বলেন, আমরা  দুই জন নিজ নিজ ক্ষেত্রে শ্রেষ্ঠ হওয়ার চেষ্টা করছি। এটার জন্য অবস্থানগত দূরত্ব আমাদের তেমন কষ্ট দেয় না। কারণ আমরা মানসিকভাবে খুব কাছে থাকি।

তাদের এই মানসিক নৈকট্যের কাছে সব তুচ্ছ হয়ে যায়। সব মানে সব। এই যে সামাজিকতা, লৌকিকতা, প্রচলিত জীবন ধারণা— সব। বরং তারা একে অন্যের বেহিসাবী জীবনযাপনকেই ভালোবাসেন। হিসাব করে কে কবে ভালোবাসাকে মুঠে পুড়তে পেরেছে?

লুবনা-ম্যাথিউ, ভালোবাসায় জয় করেছেন দুই দেশের ব্যবধান

হিসাবের ধার ধারেনি লুবনা আর ম্যাথিউও। লুবনার বাড়ি মাদারিপুর, আর নীল চোখের ম্যাথিউ ব্রিটেনের। ম্যথিউকে লুবনা দেখেছিলেন কাওরান বাজারের ফুটপাথে। সত্যি কোথায় কোথায়ই না ভালোবাসার মানুষটি জুটে যায়। লুবনা তখন একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের হয়ে পথশিশুদের পড়ান। অন্যদিকে, ম্যথিউ এসেছিলেন লন্ডন থেকে সেই শিক্ষকদের ট্রেনিং দিতে।

তাদের ভালোবাসা অবশ্য প্রথম দর্শনেই হয়নি। তবে জীবনে চলতে চলতে একে অন্যের হাত ধরেছেন। এক গোছা কোঁকড়া চুলের বাঙালি লুবনার পাশে এখন বেশ মানিয়ে যান নীল চোখের সাহেব ম্যাথিউ। বিয়ে হয়েছে তাও বছর দুয়েক। পরিবারে পরিবারে, বাড়িতে বাড়িতে, দেশে দেশে যুদ্ধের পরে এখন তারা শান্তির সংসার করছে শ্যামদেশে। কেমন লাগে সে জীবন?

লুবনা বলেন, জীবন কখনও স্বপ্নের মতো হয় না। স্বপ্নের কাছে পৌঁছাতে অনেক যুদ্ধ করতে হয়। যুদ্ধ নিজেকে এগিয়ে নেওয়ার, যুদ্ধ একসঙ্গে জিতে যাওয়ার। দু’জনে দল করে লড়ে যাওয়ার এই জীবনটাই সবচেয়ে সুন্দর স্বপ্ন।

সেই সুন্দর স্বপ্নের পথে অসাধারণ কাটুক আজকের ভালোবাসার দিনটি। ভালোবাসার মানুষটিকে পাশে নিয়ে জয় হোক ভালোবাসার, জয় হোক জীবনের।

সারাবাংলা/এমএ/টিআর

Tags: ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন