বিজ্ঞাপন

ভয়ংকর আগুনের থাবায় মৃত্যুপুরী চকবাজার

February 21, 2019 | 3:37 pm

। এমএকে জিলানী, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট ।।

বিজ্ঞাপন

ঢাকা: ঘড়ির কাঁটায় রাত ১টা ৫৩ মিনিট। চকবাজারের চুরিহাট্টার সরু গলিতে হাজী ওয়াহেদ ম্যানসন তখন দাউদাউ আগুনে পুড়ছে। বিদ্যুৎ নেই, চারদিক অন্ধকার। ফায়ার সার্ভিসের কর্মীদের অক্লান্ত পরিশ্রমেও বাধ মানছে না আগুন। ঠিক তাদের পায়ের কাছেই পড়ে আছে তিন তিনটি মৃতদেহ। কিন্তু চামড়া পোড়া চর্বি বেরোনো বিকৃত সেই দেহগুলো যে মানুষের, তখন পর্যন্ত তা বুঝে উঠতেই পারেননি স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবক বা ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরাও। এই প্রতিবেদক তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করলে মৃতদেহগুলো সাদা আর কালো কাপড়ে ঢেকে দেওয়া হয়। অজ্ঞাত সদ্য লাশ হওয়া মানুষগুলো সেখানেই পড়ে থাকে ঘণ্টাখানেক।

রাত বাড়ে, বাড়তে থাকে আগুনের ভয়াবহতা আর হতাহতের সংখ্যা। ভোরের দিকে আগুন কিছুটা নিয়ন্ত্রণে এলেই শুরু হয় লাশ উদ্ধার প্রক্রিয়া। হাজী ওয়াহেদ ম্যানসনের পশ্চিম পাশের রাস্তায় পড়ে থাকা তিন মৃতদেহের পাশেই দেখা যায় আরও দশ দশটি লাশ। ভোরের আলো ফুটতে থাকে, আর বাড়তে থাকে লাশ উদ্ধারের সংখ্যা।

বিজ্ঞাপন

আরও পড়ুন- ৩ বন্ধু বেঁচে ফিরেছে, একজন লাশ, এখনও নিখোঁজ রোহান

একদিকে তখন চলছে মরদেহ উদ্ধার, অন্যদিকে দানবের মতো আগুনকে নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা। বীভৎস-ভয়াবহ সেই আগুনের থাবায় ভোরের আলো ফোটার আগেই লাশের সংখ্যা দাঁড়ায় পঞ্চাশে । বাতাসে বাড়তে থাকে পোড়া লাশের গন্ধ। বৃহস্পতিবার (২১ ফেব্রুয়ারি) সকাল ১০টা নাগাদ লাশের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৭০টিতে। ১১টা নাগাদ ঢাকা মেডিকেল মর্গে জমা হয় ৮১টি লাশ।

বিজ্ঞাপন

হাজী ওয়াহেদ ম্যানসন থেকেই বেশকিছু মৃতদেহ উদ্ধার করে ফায়ার সার্ভিস। ছয়টি ব্যাগে করে সেগুলো পাঠানো হয় ঢাকা মেডিকেল কলেজে। কোনো ব্যাগে একটি, কোনো ব্যাগে তিনটি পর্যন্তও মৃতদেহ ছিল। এখানকার এক গুদামঘর থেকেই উদ্ধার করা হয় সাত সাতটি পোড়া মৃত মানুষ।

আরও পড়ুন- লাশ বেড়ে ৮১, ঠাঁই হচ্ছে না ঢামেক মর্গে!

বুধবার (২০ ফেব্রুয়ারি) সারাবাংলার এই প্রতিবেদক আগুন লাগার পর টানা ৯ ঘণ্টা ঘটনাস্থলে ছিলেন। সরেজমিনে ও স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, রাত সাড়ে ৯টার দিকে আগুন লাগে চকবাজারের চুরিহাট্টা এলাকার ব্যস্ততম ও বাণিজ্যিক এই এলাকায়।

বিজ্ঞাপন

স্থানীয়রা জানান, চুরিহাট্টা এলাকাটি একটি সরু গলি, যেখানে দুইটি রিকশা কোনোমতে যাতায়াত করতে পারে। আগুনের ঘটনার সময়ে  সরু এই গলির হাজী ওয়াহেদ ম্যানসন থেকে শুরু করে পাশের ওয়াটার ওয়ার্কস রোড, জেলখানা মোড়সহ আশেপাশের সবখানেই ছিল যানজট।  আর তাই হঠাৎ যখন আগুনের বিস্ফোরণ ঘটে, তখন ওই যানজটে পড়া মানুষগুলো আর বের হতে পারেননি। আগুনের বিস্ফোরণের সঙ্গে সঙ্গেই হাজী ওয়াহেদ ম্যানসনের দ্বিতীয় তলার পশ্চিম পাশের দেয়ালটি যানজটপূর্ণ এলাকার রাস্তার ওপর ভেঙে  পড়ে। প্রত্যক্ষদর্শীরা  জানান, এতে তাৎক্ষণিকভাবেই মারা যান বেশ কজন পথচারী।

আরও পড়ুন- ‘শিশুটিকে কোলে রেখেই পুড়ে গেলেন মা’

এলাকাবাসীরা বলেন, আগুন এমন দানবের মতো হানা দেয় যে হাজী ওয়াহেদ ম্যানসনের উত্তরের রাস্তায় দাঁড়ানো পিকআপ ভ্যান, রিকশা, সাইকেল, মোটর সাইকেল— সব নিমিষেই পুড়ে ছাই হয়ে যায়। যেগুলো এখন বিবর্ণ হয়ে চুরিহাট্টার ওই রাস্তায় পড়ে আছে।

সরেজমিনে দেখা যায়, আগুনে নষ্ট হওয়া দালান-কোঠা, গাড়ি, দোকান-পাটের টুকরা হাজী ওয়াহেদ ম্যানসনের উত্তর ও পশ্চিম পাশের রাস্তায় লণ্ডভণ্ড হয়ে পড়ে আছে। যেন যুদ্ধবিধস্ত কোনো এলাকা বা ধ্বংসস্তূপ কোনো।

আরও পড়ুন- ‘সব বডি পুড়ে কয়লা, ভাইয়ের লাশটাই খুঁজে পাচ্ছি না’

আগুন লাগা  ভবন ছাড়াও  আশপাশের আরও  কমপক্ষে পাঁচ থেকে ছয়টি ভবন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলেও জানান স্থানীয় বাসিন্দারা। আগুনের তাপে খসে পড়তে দেখা গেছে  ভবনটির পাশের বড় একটি  মসজিদের বাইরের দেয়ালের টাইলস।

যে আগুন এত প্রাণ, এত সম্পদ কেড়ে নিয়েছে, সেই আগুনের সূত্রপাত সম্পর্কে স্থানীয় বাসিন্দা ও প্রত্যক্ষদর্শীদের কাছে জানতে চাইলে সঠিক কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। কেউ বলছেন, ওয়াহেদ ম্যানসনের দ্বিতীয় তলার কারখান থেকে এর সূত্রপাত; কেউ বলছেন, আগুন লেগেছে ভবনটির পাশের হোটেল থেকে। কেউবা ভবনের উত্তর দিকের রাস্তার গাড়ির সিলিণ্ডার বিস্ফোরণ থেকে এই আগুনের সূত্রপাত বলে জানান।

আরও পড়ুন- সব পুড়ে ছাই, শুধু পড়ে ছিল ৪টি খুলি

সরেজমিনে দেখা গেছে, চুরিহাট্টার ৬৪ নন্দ কুমার দত্ত লেনে অবস্থিত হাজী ওয়াহেদ ম্যানসন। ভবনটি চার তলা, এর আন্ডারগ্রাউন্ডে আরও একতলা রয়েছে। আন্ডারগ্রাউন্ডের পুরোটাই গুদাম হিসেবে ব্যবহার করা হয়। গুদামটি কেমিকেল বোঝাই, কিন্তু পৌঁছাতে পারেনি আগুনের শিখা। চার তলা ভবনটির মূল মালিক হাজী ওয়াহেদ মারা গেছেন। শীর্ষ তলায় থাকেন তার দুই ছেলে। দ্বিতীয় ও তৃতীয় তলার পুরোটাই কারখান ও গুদাম হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এসব কারখানা ও গুদামে সুগন্ধি, পাউডার (কসমেটিকসসহ কলকারখানার পণ্য), খেলনা, বাতি (ডিমলাইট), ফ্রিজ মেরামত, গ্রিজ-মবিলসহ দাহ্য পদার্থের ব্যাপক কারবার। আর নিচতলাতে বিভিন্ন দোকান-পাট ভাড়া দেওয়া আছে।

হাজী ওয়াহেদ ম্যানসনের উল্টো দিকে ৬৩/১ নন্দ কুমার দত্ত লেনের বাসিন্দা মো. খাতিবুর রহমান  সারাবাংলাকে বলেন, ‘রাত সাড়ে ৯টার দিকে আগুন লাগে। হাজী ওয়াহেদ ম্যানসনের দ্বিতীয় তলা থেকেই আগুনের সূত্রপাত। ওই তলায় অনেক রাসায়নিক বা দাহ্য পদার্থ থাকায় মুহূর্তেই  বিস্ফোরণ ঘটে।’

আরও পড়ুন- মর্গ উপচে লাশের সারি বারান্দায়, ব্যাগের ছাইয়ে প্রিয়জনের খোঁজ

তিনি আরও বলেন, ‘আগুনের বিস্ফোরণের সঙ্গে সঙ্গেই হাজী ওয়াহেদ ম্যানসনের দ্বিতীয় তলার পশ্চিম পাশের দেয়ালটি যানজটপূর্ণ ব্যস্ত রাস্তার ওপর আছড়ে পড়ে। সঙ্গে সঙ্গে ভবনটির পশ্চিম-উত্তর কোণে থাকা বৈদ্যুতিক ট্রান্সফরমারটিতেও বিস্ফোরণ ঘটে। সে এক ভয়াবহ দৃশ্য।’

সারাবাংলা/জেআইএল/জেডএফ

Tags: , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন