বিজ্ঞাপন

মাউস: একটি ইঁদুর’র বিবর্তনের গল্প

February 18, 2019 | 2:00 pm

।।মিনহাজুল আবেদীন।।

বিজ্ঞাপন

কম্পিউটারের স্ক্রিনে চোখ। গভীর মনযোগিতায় এগুচ্ছে পাঠ কিংবা কাজ। গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিতে স্ক্রিনের কোনও একটি স্থানে ‘ওকে’ লেখাটিতে সম্মতির স্পর্শ দিতে হবে। কিংবা স্ক্রল ডাউন করতে হবে। হাতের কাছেই রয়েছে একটি মাউস। অনেকটা নিজের অজান্তেই হাত চলে যাবে। সামান্য স্পর্শেই কাজটি হয়ে যাবে।

মাউস ব্যবহার এখন অপরিহার্য- তা হয়তো আর বলা যাচ্ছে না। স্ক্রিনটাচ কম্পিউটার এসে গেছে অনেক আগেই। কিন্তু বিশ্বজুড়ে সাধারণ কম্পিউটার ব্যবহারকারীদের কাছে মাউস এখনো অবশ্য প্রয়োজনীয় একটি ইলেকট্রনিক ডিভাইস। ইঁদুর-সদৃশ বস্তুটির এই বিশাল প্রয়োজনীয় হয়ে উঠার পেছনে আছে সুদীর্ঘ ইতিহাস।

মাউস মূলত কম্পিউটারের একটি ইনপুট ডিভাইস। এর মাধ্যমে কম্পিউটারকে আমরা নির্দেশনা দিতে পারি। কম্পিউটার স্ক্রিন যেহেতু একটি দ্বি-মাত্রিক বস্তু তাই এর যেকোনো স্থানে অংশের অবস্থান নির্ধারণ করতে দরকার জ্যামিতিক হিসাব নিকাশ। তাই আজকে যাকে আমরা মাউস বলি তার একদম প্রথম নাম ছিলো ‘X-Y position indicator for a display system’।

বিজ্ঞাপন

মাউস আসার আগে কম্পিউটারকে কাজ করার জন্য প্রতিটি নির্দেশনা কিবোর্ডে লিখে দেওয়া হত।

ছবি: এঙ্গেলবার্টের করা মাউসের ডিজাইন

ষাটের দশকে স্ট্যানফোর্ড রিসার্চ ইন্সটিটিউটের ল্যাবে বসে ডগলাস এঙ্গেলবার্ট কম্পিউটার ডিসপ্লের জন্য একটি ইন্ডিকেটর নির্মাণ শুরু করেন। তার উদ্ভাবনের পেটেন্টও করে নিয়েছিলেন তিনি, যেটিই আসলে পরবর্তী সময়ের মাউসের ভিত্তি। কিন্তু তখনো পার্সোনাল কম্পিউটারের জোয়ার শুরু হয়নি পৃথিবীতে, মাউসের প্রয়োজনীয়তাও অনুভূত হয়নি ব্যবহারকারীদের কাছে। বাণিজ্যিকভাবে যতদিনে পার্সোনাল কম্পিউটার সুলভ হওয়া শুরু হয়েছে, মাউসের কদর বেড়েছে বহুগুণে। ততদিনে অবশ্য এঙ্গেলবার্টের পেটেন্টের মেয়াদ শেষ হয়ে যায়। তাই মহামূল্যবান এই উদ্ভাবন থেকে আর্থিকভাবে কোনো লাভ হয়নি তার।

ছবি: এঙ্গেলবার্টের নির্মিত মাউস প্রোটোটাইপ

মাউস শব্দটি সর্বপ্রথম ব্যবহৃত হয় বিল ইংলিশ নামে এক কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারের লেখায়। ইঁদুরের মতো চোখ, কান কিংবা নাক না থাকলেও ছোটোখাটো আকারের এই যন্ত্রের সাথে তার যুক্ত থাকলে একে ইঁদুরের মতোই মনে হয়। সেখান থেকেই এর নাম হয়ে যায় মাউস। ‘X-Y position indicator for a display system’ এমন ভারিক্কি নামের চেয়ে মাউস নামটি সহজবোধ্য হওয়ায় এটিই মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে যায়।

বিজ্ঞাপন

কম্পিউটারের ব্যবহার সহজবোধ্য করতে ষাটের দশকের পুরোটা সময় জুড়েই বিভিন্ন জন বিভিন্ন উপায়ে মাউসের কাছাকাছি যন্ত্র নিয়ে কাজ করে যাচ্ছিলেন। জার্মান কোম্পানি ‘টেলেফানকেন’ মাউসসদৃশ যন্ত্রের উদ্ভাবন করে। জার্মান ভাষায় দেওয়া নাম ‘রোলকুগেল’ শব্দের অর্থই ছিলো ‘রোলিং বল’।

ছবি: টেলিফানকেন কোম্পানির ‘রোলকুগেল’

মাউসসহ ব্যক্তিগত কম্পিউটারের জগতে প্রথম প্রবেশ করে ‘জেরক্স আলটো’ নামের একটি কম্পিউটার। তিন বোতামের মাউস ছিলো কম্পিউটার প্রযুক্তির জগতে এক বিশাল চমক। ১৯৭৩ সালে বাজারে আসা জেরক্স আলটোর পথ ধরে বাজারে মাউসসহ আরো কয়েকটি ব্যক্তিগত কম্পিউটার বাজারে জায়গা করে নেয়।

১৯৮১ সালে ২৭ এপ্রিল বাজারে আসে ‘জেরএক্স স্টার’ নামের কম্পিউটার। আর এই কম্পিউটারের সাথেই দেখা মিলে প্রথম দুই বোতাম মাউসের। যার বহুরুপী উত্তরসূরীরা এখন আমাদের হাতে হাতে।

ছবি: জেরক্স আলটো (বাঁয়ে) জেরক্স স্টারের দুই বোতামের মাউস (ডানে উপরে) ম্যাকিনটশের বদৌলতে জনপ্রিয় হয়েছিল মাউস (ডানে নিচে)

অ্যাপল নির্মিত ম্যাকিনটোশের হাত ধরে মাউস যুগান্তকারী সাফল্য পায়। ম্যাকিনটোশ ছিলো ব্যক্তিগত কম্পিউটারের জগতে বিপ্লবের নাম আর ম্যাকিইনটোশের সাথে যে এক বোতামের মাউসটি খুব সহজেই ব্যবহারকারীদের মনে স্থান করে নেয়। এই মাউস নিয়ে অ্যাপলের ইঞ্জিনিয়াররা আত্মবিশ্বাসী ছিলেন যে কিবোর্ডে তারা ‘তীর চিহ্নিত বোতাম’ বাদই দিয়ে দিয়েছিলেন।

বিজ্ঞাপন

এরপর প্রায় সব কম্পিউটার নির্মাতা প্রতিষ্ঠান নামে মাউস নির্মাণের যুদ্ধে। কারো ডিজাইন টিকে গিয়েছে আর কেউ হারিয়ে গিয়েছে ভীড়ে।

ছবি: হিউলেট-প্যাকার্ড এর নির্মিত মাউস

মাউসকে মেকানিক্যাল, অপ্টোমেক্যানিক্যাল আর অপ্টিক্যাল এর তিনভাগে ভাগ করা হয়। মেকানিক্যাল মাউসের নীচে থাকে চাকার মতো একটি বল যেটি এটিকে চলাচলে সাহায্য করে। অপ্টোমেকানিক্যালের থাকে অপ্টিক্যাল সেন্সর যেটি দিয়ে এটি ব্যবহারকারীর নড়াচড়া বুঝতে পারে আর অপ্টিক্যাল মাউস ব্যবহার করে লেসার প্রযুক্তি। সময়ের সাথে সাথে নোটবুক আর ল্যাপটপের প্রচলনের সাথে সাথে মাউসকে ছোট করে আনার প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। চালু হতে থাকে টাচপ্যাড।

ছবি: অ্যাপল পাওয়ারবুক নিয়ে আসে টাচপ্যাড, কম্পিউটারের জগতে আবারো শুরু হয় বিপ্লব

টাচপ্যাডে আঙ্গুল বুলিয়ে কম্পিউটার স্ক্রিনে পয়েন্টারকে নিয়ন্ত্রণ করা যাবে। টাচপ্যাডকে জনপ্রিয় করার পেছনেও আছে অ্যাপলের অবদান। ১৯৯৪ সালে বাজারে আসা ‘অ্যাপল পাওয়ারবুক ৫০০’ প্রথম কোনো ল্যাপটপ যেখানে মাউস বাদেই টাচপ্যাড দিয়েই কাজ করা যেত।

অ্যাপলের সাফল্যে অনুপ্রাণিত হয়ে অনেকেই ল্যাপটপে নতুন নতুন পরিক্ষা নীরিক্ষা চালাতে থাকে। আইবিএম তাদের ল্যাপটপে চালু করে ট্র্যাকপয়েন্ট। কিবোর্ডের মাঝে থাকা লাল বিন্দু দিয়েই কাজ করা যাবে মাউসের। দেখতে ছোট এবং ট্র্যাকপ্যাডের তুলনায় অনেক কম জায়গা দখল করে এই ট্র্যাকপয়েন্ট।

ছবি: আইবিএম তাদের ল্যাপটপে ব্যবহার করে ট্র্যাকপয়েন্ট

তবে এটি ট্র্যাকপ্যাডের মতো সাফল্যের মুখ দেখেনি। এটি ব্যবহার এবং নিয়ন্ত্রণ করা ট্র্যাকপ্যাডের তুলনায় কঠিন হওয়ায় প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে পারেনি।

তবে ট্র্যাকপ্যাডের জগতে এসে মাউস হারিয়ে যায়নি, সময়ের সাথে মাউসের ধরণ আর গঠন বদলেছে। স্বভাবসুলভ লেজ বাদ দিয়ে তারবিহীন মাউস নির্মাণ করেছে অনেক প্রযুক্তিপণ্য নির্মাতা প্রতিষ্ঠান। যেগুলো ব্লুটুথ আর ওয়াইফাই দিয়ে কম্পিউটার কিংবা ল্যাপটপের সাথ যুক্ত থাকতে পারে।

ছবি: মাইক্রোসফটের নির্মিত তারবিহীন মাউস

টাচস্ক্রিন জনপ্রিয় হওয়ার সাথে সাথে মাউসের ভবিষ্যৎ গতিপথও বদলে যাচ্ছে। মূলধারার কম্পিউটার আর ল্যাপটপ নির্মাতা ল্যাপটপে টাচস্ক্রিন ব্যবহার শুরু করেছেন। বহনযোগ্যতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে কম্পিউটারের আকারও হয়ে আসছে ছোট। তাই মাউসের প্রয়োজনীয়তাও কমছে।

ছবি: টাচস্ক্রিনের ব্যবহার বৃদ্ধির সাথে সাথে মাউসের প্রয়োজনীয়তা কমছে

শুধু কি টাচস্ক্রিন, ভয়েস কমান্ড জনপ্রিয় হওয়ার ফলে মাউস আরেক দফা ধাক্কা খেয়েছে। মোবাইল, ট্যাবলেটের পর এখন কম্পিউটারে আর ল্যাপটপে শুরু হয়েছে ভয়েস কমান্ড দেওয়ার দিন। কল্পকাহিনীকে সত্য করে দিয়ে ‘গুগল হোম’, ‘এমাজন ইকো’র মতো হাজারো প্রযুক্তি বাজারে আসছে প্রতিনিয়ত।

ছবি: মাউসকে জাদুঘরে পাঠাবার সময় হয়ে এসেছে কি?

তবে ভয়েস কমান্ড আর টাচস্ক্রিন বাদেও হাতের ইশারাতেই কম্পিউটারের পয়েন্টার নড়াচড়া করবে এমন প্রযুক্তির নিয়ে কাজ শুরু হয়েছে। আমাদের দেহের অঙ্গভঙ্গি দিয়েই দূর থেকেই নিয়ন্ত্রণ করা যাবে প্রতিটি প্রযুক্তি পণ্য। এই প্রযুক্তির নাম দেওয়া হয়েছে ‘জেশচার সেন্সিং’

ছবি: হাত দিয়ে না ছুঁয়েই নিয়ন্ত্রণ করা যাবে ইলেকট্রনিক স্ক্রিন

তবে কেউ কেউ বলছেন বিজ্ঞানী গবেষকরা হয়তো কল্পবিজ্ঞান থেকেও এগিয়ে যাচ্ছেন। চোখের ইশারায় যা চাইবেন যেভাবে চাইবেন মুহূর্তের মধ্যে ঠিক সেটাই বাস্তবায়িত হবে আপনার স্ক্রিনে। অর্থাৎ, আমাদের মস্তিষ্কের সাথে সরাসরি যুক্ত থাকবে প্রযুক্তি পণ্যটি। এই প্রযুক্তির নবাম দেওয়া হয়েছে ‘ব্রেইন ইন্টারফেস’ নামে।

ছবি: সেদিন হয়তো খুব বেশি দূরে নয় যখন আমাদের চোখের ইশারাই যথেষ্ট হবে

তবে এই প্রযুক্তির বেশীরভাগই এখনো পরীক্ষামূলক। আর যতদিন না এই প্রযুক্তিগুলো পুরোদমে বাজারে আসছে আর মানুষ অভ্যস্ত হচ্ছে ততদিন মাউসের ব্যবহার চলতে থাকবে।

ছবি: অত্যন্ত আধুনিক একটি মাউস

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা আর নিত্যনতুন প্রযুক্তির কল্যাণে হয়তো খুব অল্প সময়ের মধ্যেই হারিয়ে যাবে মাউস। তবে পেছনে রয়ে যাবে এর সোনালী ইতিহাস।

সারাবাংলা/এমএম

Tags: , , , , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন