বিজ্ঞাপন

মৃত্যুর মিছিলে জীবনের খোঁজে

March 27, 2018 | 7:56 pm

গেল ১৮ মার্চ নেপালে আমার দুই বছর হলো। ২০১৬ সালে যে অ্যাসাইনমেন্ট নিয়ে নেপালে আসি, তা বেশ কঠিন ছিল, অনেকটা নতুন করে কোম্পানিটা কে শুরু করা। একটি প্রতিষ্ঠানকে চালানোর অভিজ্ঞতাও আমার ছিল না। হঠাৎ করেই এমন এক গুরু দ্বায়িত্বকে সামলে নেবার প্রচেষ্টায় নিজের উপর আত্মবিশ্বাসটা বেড়ে যায়,আয়ত্বে আসে ভাষাটাও। নেপালের এই দুই বছর একলা থাকাতে আমার নিজেকে জানার যে সুযোগ আমি পেয়েছি, তাতে আমার জীবন বোধেও এসেছে পরিবর্তন।

বিজ্ঞাপন

নেপালের ত্রিভুবন বিমানবন্দরে ঘটে যাওয়া উড়োজাহাজ দুর্ঘটনাটা খুব কাছ থেকে দেখতে পারার অভিজ্ঞতাটিও তেমনি আমার জন্য এপিফেনিক। দুর্ঘটনাটি ঘটার প্রথম ঘন্টা থেকে শেষ কফিনটি বাংলাদেশ পাঠানো পর্যন্ত যে জীবিত ও মৃত মানুষগুলোর সংস্পর্শে আসি এবং যে ঘটনাগুলো প্রত্যক্ষভাবে দেখেছি, তা আমাকে আরোও বেশি ‘মানুষ’হয়ে উঠতে সাহায্য করবে।

সেদিন ১২ মার্চ। অন্য দিনগুলোর মতোই অফিসে কাজ করছিলাম। সহকর্মী শ্যাম খাড়কা এয়ারপোর্টের কাছেই একটা মিটিং এ ছিল। সেই আমাকে কল করে জানায়, বিমান বাংলাদেশের একটা প্লেন ক্র্যাশ করেছে। কিছুক্ষণ পর ইউএস বাংলার স্টেশন ম্যানেজার রিমনকে কল করে জানতে পারলাম ওটা বিমান নয়। কি করব বুঝতে না বুঝতেই নানান জায়গা থেকে কল আর ইনবক্স আসতে লাগল। একটু খোঁজ নিয়ে জানলাম হতাহতদের কাঠমান্ডু মেডিকেলে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, ছুট দিলাম ওখানে।

গিয়ে দেখি প্রচণ্ড ভিড়, শুধুমাত্র আত্মীয়দের ঢুকতে দিচ্ছে। নেপালি ভাষা জানলেও বাংলায় কথা বলে আমার আত্মীয় ভেতরে আছে বলে ভেতরে ঢুকে গেলাম। মৃত্যুকে দেখে আসা মানুষগুলো হাসপাতালে যখন আসছিল, পোড়া শরীরের যন্ত্রণা ভুলে তাদের বেঁচে থাকার খবর আপনজনদের কাছে পৌঁছে দেওয়াই যেন মূখ্য ছিল তাদের কাছে। ঢাকা থেকেও একের পর এক গুজব কল আর ইনবক্স আসতে থাকল আমার কাছে। এই যোগাযোগের কাজটি করতে করতে বুঝে গেলাম আমার অবস্থান থেকে এটাই আমার কাজ। যখন যার খোঁজ পাচ্ছিলাম, সাথে সাথে আপডেট করছিলাম। খোঁজাখুঁজি করতে করতে আর হাসপাতালগুলোতে ছুটতে রাত ১০টা বাজলেও সবাইকে পেলাম না। সব যাত্রীদের লিস্টও তখন আমার কাছে নেই। খবর নিয়ে জানতে পারলাম বাকিরা টিচিং হাসপাতালে।

বিজ্ঞাপন

আমি তখনও জানি না ওখানে গিয়ে জানতে পারব ৪৯ টি মৃতদেহ রাখা সেখানে। ফরেনসিক বিভাগে যাবার পর বলা হলো সেদিন কাউকেই দেখতে দেয়া হবে না আর, অপেক্ষা সকাল পর্যন্ত।

কাকে যেন কল করে ঢাকা থেকে যাত্রীদের লিস্টটা নিলাম। হাসপাতালে যারা ভর্তি হয়েছিল তাদের নাম সবুজ কালি দিয়ে মার্ক করলাম। এর আগে কে এম সি তে আসা ৮টি লাশের মধ্যে তিনজনকে নিশ্চিত করা হলেও বাকিরা নিখোঁজের তালিকায়, বুঝে গেলাম বাকিরা মর্গে। এর মধ্যে যাত্রীদের আত্মীয়-বন্ধু বান্ধব কিভাবে যেন আমার নাম্বার আর ফেসবুক আইডি পেয়ে গেছেন বুঝলাম না। সারা রাত ধরে যারা আমার সাথে যোগাযোগ করছিলেন, তাদের দুঃসংবাদ দিতে দিতে হাঁপিয়ে উঠছিলাম আমি।

পরদিন ভোরে যখন মর্গে গেলাম, কোন বাংলাদেশির আত্মীয় নেই সেখানে। নিজেকে সমস্ত নিখোঁজ বাংলাদেশীদের অভিভাবক মনে হচ্ছিল। নেপালি যেসব পরিবার এসেছিল স্বজনদের খোঁজে কেবল তাদেরই ঢুকতে দেয়া হচ্ছিল ভেতরে। তাই এবার ভেতরে ঢোকার জন্য মিথ্যার আশ্রয় নিলাম, সদ্য নেপালে আসা বাংলাদেশির মত কথা বলতে লাগলাম। লিস্ট থেকে একটা নাম (মিনহাজ বিন নাসির) মুখস্ত করে আত্মীয় সেজে ভেতরে ঢুকলাম। ভেতরে যাওয়া মাত্র, আমাকে একটা রুমে নিয়ে যাওয়া হল যেখান থেকে বডি ক্লেইমের ইন্টারপোল ফরম দিচ্ছিলেন ডা. অস্তি। উপায় না পেয়ে হরহর করে আরোও কিছু বানোয়াট মিথ্যা কথা বলে একটা ফরম তুলে ফেললাম, সেটা দেখে শরীরটা ভার হয়ে এলো। ১৬ পাতার ফরমটা পড়তে গিয়ে মনে হলো, মরদেহ শনাক্তের জন্য এই দীর্ঘ ফরম পূরণ করতে হবে সব স্বজনদের? ফরমটার প্রত্যেকটা পাতার ছবি তুলে আপলোড করে দিলাম যাতে যারা নেপালে আসছেন, তারা যেন একটু প্রস্তুতি নিয়ে আসতে পারেন।

বিজ্ঞাপন

সেদিন বিকালে জানলাম মিনহাজ ভাইয়ের খালু এসেছেন মরদেহ শনাক্তে, আমার হাতে মিনহাজ ভাইয়ের নামে তোলা ফরম। তারা নেপালে পৌঁছানোর পর দূতাবাসে ব্রিফিং শেষে রাতে হোটেলে ফিরলেন, আমি অপেক্ষা করছি হোটেলের লবিতে তার জন্য, কেউ একজন আমাকে তাকে চিনিয়ে দিলেন। খালু নিয়ে যান তার রুমে, বলতে থাকেন মিনহাজ ভাইয়ের ছোটবেলার গল্প। জানালেন, মিনহাজ বিন নাসির নামটা তারই দেওয়া, তার জন্মের পর তিনি আযান দিয়েছিলেন।

“যে ছেলেকে আমরা একটু কষ্ট করতে দেইনি, কিভাবে এত কষ্ট সহ্য করল ছেলেটা?”- বলতে গিয়ে খালুর চোখটা যেন ভিজে এল। এভাবেই অসংখ্য গল্পের মধ্য দিয়ে মানুষগুলোর জীবনে ঢুকে যাই আমি।

আমার জন্য বেশ কঠিন ছিল আলিমুন্নাহার অ্যানিকে যেদিন দেখতে গেলাম। আমার ঠিক জানাও ছিল যে তামারা উনার মেয়ে। কি মনে করে যেন আমাকে ডাক দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “আমার মেয়েটা কোথায়?” কোত্থেকে মাথার মধ্যে এক গল্প তৈরি করে হরহর করে মিথ্যে এক গল্প বলে দিলাম। আমি ঠিক জানতামও না অন্যরা কি বলে তাকে বুঝিয়ে রেখেছিলেন। আমার গল্পটা ঐ গল্পের সাথে মিলল কিনা জানি না, কিন্তু উনি আর কোন প্রশ্ন না করে যেন আমার গল্পটা বিশ্বাস করতে চাইলেন। প্রচন্ড এক অপরাধবোধ নিয়ে সেদিন আইসিইউ থেকে বের হলাম। লাশ সনাক্তের পর যেদিন মর্গে আমি তামারাকে দেখলাম, আমার সবচেয়ে বেশি কষ্ট হচ্ছিল অ্যানির জন্য যে মা হয়েও তার মেয়েকে শেষ দেখাটাও তার দেখা হবে না।

মর্গে যেদিন প্রথম ১৭টি লাশ সনাক্ত হল এবং সন্ধ্যায় যখন স্বজনদের থাকতে বলা হল আমিও রয়ে গেলাম। মর্গের ভেতরে হিমাগারে আমার কোন আত্মীয় নেই। তাই ভেতরেও আমার ঢোকার কোন কারণ নেই। কিন্তু লাশ দেখানো শুরু করার ঠিক আগ মুহুর্তে কাকতালীয়ভাবে পৃথুলার বাবার কল পেলাম আমি। উনি আমাকে জানালেন উনারা কেউই নেপালে নেই, আমি যেন দেখে জানাই। পৃথুলার যেহেতু কেউ নেই, পৃথুলার লাশ দেখার জন্য আমি মর্গের গেটে দাঁড়িয়ে গেলাম। আমার সাথে ক্যাপ্টেন আবিদের ভাই মাহমুদ ভাই আর খাজার বোন বেসিমাহ আর স্ত্রী সাদিয়া। সাদিয়া ঐদিনই বিকালে এসে পৌছেছে মাত্র। হোটেল থেকে প্রথম বারের মতো মর্গে আসার পর সাদিয়াকে সরাসরি হিমাগারের গেটে নিয়ে আসা হলো। তিনটা লাশ একসাথে হিমাগারের ফ্রিজার থেকে দেখানোর রুমটাতে দেখা আনা হবে।

বিজ্ঞাপন

প্রথম ধাপে দেখানো হবে ক্যাপ্টেন আবিদ, পৃথুলা আর খাজার লাশ। লাশগুলো বাইরে আনতে আর দেখানোর জন্য প্রস্তুত করতে মিনিট দশেক সময় লাগলো। খাজার স্ত্রী সাদিয়া হিমাগারের গেটে হাত বোলাচ্ছেন আর দোয়া পড়ছেন যেন খাজার গায়ে হাত বুলিয়ে দোয়া পড়ছেন তিনি। মর্গের হিমাগারের গেটের ঐ ১০ মিনিটে আমার পা মাথা ভারী হয়ে আসছিল। জীবনে কোনদিনই আমি মর্গে ঢুকিনি। প্রথমে আমাদেরকে ভেতরে একটা রুমে নিয়ে বসানো হল। রুমে ঢোকা মাত্রই বিদ্যুৎ চলে গেল। বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষার পর যখন বিদ্যুৎ আসছিল না আমাদেরকে চার্জার লাইট দিয়ে লাশ দেখানোর ব্যবস্থা করছিলেন তারা। ভয়ে আমার গা হিম হয়ে আসছিল। কিন্তু কি এক দ্বায়িত্বের ভারে যেন ভয়টা কাটিয়ে উঠছিলাম। ভাগ্যক্রমে বিদ্যুৎ চলে আসল। প্রথমে মাহবুব ভাই ভেতরে গেলেন। ফিরে এসে কোনমতে চেয়ারে বসে কান্নায় ভেঙে পড়লেন তিনি। এরপর গেল বেসিমাহ আর সাদিয়া। কিছুক্ষণ পর তারাও বেরিয়ে এলেন। প্রথম থেকেই বেসিমাহ অনেক কান্নাকাটি করলেও সেদিন মর্গ থেকে বের হবার পর কান্নায় ভেঙে পড়া সাদিয়াকে সামলে নিলেন উনি। তারপর ডাক আসলো পৃথুলা রশীদের লাশ দেখার জন্য। আমি খুব ধীর পায়ে নিস্তব্ধ হিমাগারের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। আমার সাথে ইউএস বাংলার মুসা স্যার। মূল রুমটাতে যখন আমি ঢুকলাম তিনটা লাশকেই কাপড়ে ঢাকা অবস্থায় দেখতে পেলাম। একজন অ্যাটেন্ডেন্ট আমাকে পৃথুলার লাশের দিকে নিয়ে গেলেন। পৃথুলা রশীদের ছবি কিছু কুলাঙার বাংলাদেশীদের বদৌলতে কটুক্তিপূর্ণ পোস্ট সহ আমার ফিডে আসছিল। উনার চেহারাটা আমার ভালভাবেই চেনা হয়ে গিয়েছিল। পৃথুলার লাশের উপর থেকে যখন কাপড়টা উঠানো হল, আমার মাথাটা একটু ঘুরে উঠল। আমি কোনমতে নিজেকে সামলে নিলাম। কি জবাব দিব আমি পৃথুলার বাবাকে? একজন বাবা কি তার মেয়েকে এই অবস্থায় কল্পনা করেছেন কোনদিন?

কোন এক টান থেকে জানি না, আমি এরপর খাজা আর ক্যাপ্টেন আবিদ দুজনেরই লাশ দেখতে চাইলাম। খাজা যেন ঘুমাচ্ছিলেন। সবগুলো লাশের মধ্যে সবচেয়ে অক্ষত অবস্থায় তার শরীরটাই আমি দেখেছি। তারপর দেখতে চাইলাম ক্যাপ্টেন আবিদকে। আহ ক্যাপ্টেন আবিদ! আপনিই সেই আবিদ? আর থাকতে পারলাম না। বেরিয়ে এলাম মর্গ থেকে। এই পৃথিবীর সমস্ত শূণ্যতা যেন আমাকে ভর করল। বাইরে এসে দেখতে পেলাম মাহমুদ ভাই দেয়াল ধরে দাঁড়িয়ে থাকার চেষ্টা করছেন। সাদিয়ার কান্নায় মর্গের ভেতরের বাতাস ভারী হয়ে উঠছিল।বেসিমাহ একবার প্রায় জ্ঞান হারিয়ে ফেলছিলেন। তিন তিনটে লাশ দেখে বেরিয়ে আসার পর আমাকে ধরার কেউ ছিল না।আমি বাইরে গিয়ে একটা সিগারেট ধরালাম। কে যেন এসে আমাকে পৃথুলার মামার ফোন ধরিয়ে দিল। আমি শুধু মামাকে এটুকুই বললাম, মামা লাশটা যেন কিছুতেই তার বাবা মাকে না দেখানো হয়।

কিছুক্ষণ পর দেখতে পেলাম মিনহাজের খালু কাঁদতে কাঁদতে বেরিয়ে আসছেন। খালুকে আমি ধরতে এগিয়ে গেলাম। খালু আমাকে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়লেন- “আমাকে ওরা একটু দেখতেও দিল না। একটুখানি পা দেখালো।ওর পা আমি চিনি। আমি চিনতে পেরেছি ও মিনহাজই। কিন্তু একবারের জন্য ওরা আমার মিনহাজকে আমাকে দেখতে দিল না। আমি কেন নেপালে আসলাম তাহলে?” সেদিন মানুষের তাদের স্বজনদের ক্ষত-বিক্ষত লাশ দেখার আকুতি দেখে আমার নিজের কথা চিন্তা হতে লাগলো যদি আমার মৃত্যুও এমনভাবে হয় আর আমার স্বজনরা আমাকে শেষবারের মতো দেখতেও না পারে। কিভাবে সেদিন হোটেলে ফিরেছিলাম মনে নেই আমার।

পরদিন সন্ধ্যা নাগাদ মোট ২৩ জন সনাক্ত হল। একে একে স্বজনরা তাদের স্বজনদের চিহ্নিত করে হোটেলে ফেরত গেলেন। পরদিন ২৩টি লাশ কফিনে করে দেশে পাঠানো হবে। যেকোন একটি কারণে যে কফিনগুলো প্রথমে আনা হয়েছিল, তা পরিবর্তন করে নতুন কফিন আনতে বলা হলো। ভেতরে তখন ১৭টি লাশের ইসলামিক উপায়ে গোসল আর এম্বামিং করা হয়েছে। কিন্তু নতুন কফিন আসতে একটু দেরি হওয়াতে স্ট্রেচারগুলো খালি করানো যাচ্ছিল না। ফলে বাকি লাশগুলোর ইসলামিক উপায়ে গোসল বা এম্বামিং করা যাচ্ছিল না।

রাত প্রায় ১২ টা বেজে গেল। বাকি লাশগুলো গোসলের জন্য অপেক্ষায় থাকা মসজিদের ইমামরা আজকে আর না করে আগামীকাল সকালে এসে করবেন বললেন। ওদিকে অ্যাম্বাসি থেকে আগে থেকেই আগামীকালের জানাজার সময় ঘোষণা থাকায়, অ্যাম্বাসি থেকে মাহবুব ভাই এসে বলে গেলেন যেকোন ভাবে যেন আমরা আজ রাতের মধ্যে সবগুলো কফিনের কাজ শেষ করি। আমি নেপালি ভাষাটা পারাতে ইমামদের ম্যানেজ করার দ্বায়িত্ব আমার উপর পড়লো। খুব একটা ধর্ম কর্ম না করলেও ধর্মের যাবতীয় জ্ঞান নিয়ে ইমামদের সাথে কথা বলে কালক্ষেপন করতে লাগলাম। একদিকে বাইরে গিয়ে কফিনের সাপ্লায়ারকে চাপ দেয়া আরেকদিকে ইমামদের সাথে হাসিমুখে কথা বলে তাদেরকে ধরে রাখা। ঐ সময় মর্গে আমি আর ইউএস বাংলার মামুন ভাই, রিমন আর দেওয়ান। মামুন ভাই আর রিমন মর্গের ভেতরে ঢুকবেন না বলে উনাদের হোটেলে পাঠিয়ে দিলাম। কিছুক্ষণ পর কফিন এলো। বাকি লাশগুলোকে গোসল করিয়ে ইমামদের বিদায় করে দিলাম।

রাত প্রায় দেড়টা। এবার ভেতরে কফিনের কাজ শুরু হলো। প্রথমে রুমটাতে ঢোকার পর ফরমালিনের ঝাঁঝালো গন্ধে চোখ জ্বালা করছিল। ঠিক মত তাকাতেও পারছিলাম না। কিছুক্ষন পরে সয়ে এল। আমি দেখতে পেলাম আমি যে রুমে আছি আমার চারপাশে লাশ আর লাশ। একে একে ২৩টি লাশকেই ঐ রাতে খুব কাছ থেকে দেখলাম। ক্ষত-বিক্ষত যে লাশগুলোকে তাদের স্বজনদের দেখানো হয়নি, যে লাশগুলো আমারও দেখতে পারার কথা না, সেই লাশগুলোর পাশে দাঁড়িয়ে একটুও ভয় বা অস্বস্তি হয়নি আমার। ওদের পাশে দাঁড়িয়ে আমি একটা কথাই ভাবছিলাম যে কি কষ্টই না তারা পেয়েছেন। তামারা আর অনিরুদ্ধর লাশের সামনে দাঁড়িয়ে থেকে আমি কতক্ষণ নড়তে পারিনি আমি জানি না। ঝাপসা হয়ে ওঠা চোখে বারবার তামারা আর অনিরুদ্ধর মুখ দুটো ভেসে উঠছিল।

রাত আড়াইটার দিকে হোটেলে ফিরে এলাম।পর পর পাঁচ রাত আমার এক মিনিটও ঘুম হয়নি। সে রাতেও হলো না। এক কাপড়েই আছি পাঁচ দিন।পরদিন সকালে গোসল করে গেলাম লাশগুলো রিসিভ করতে। এম্বামিং এর সার্টিফিকেট গুলো আমার হাতে ধরিয়ে দিলেন ফরেনসিক বিভাগের কালিকা জি। কাগজগুলো নিয়ে কফিনগুলো বহনকারী কাভার্ড ট্রাকের পেছনে পেছনে আরেকটা গাড়িতে অ্যাম্বাসিতে গিয়ে পৌঁছলাম। কফিনে কাঁধ দিতে গিয়ে এক সময় কাঁধে আসল তামারার কফিন। আমি জানতাম কাকে বহন করছি আমি। আর ধরে রাখতে পারিনি নিজেকে। আর কতই বা ধরে রাখা যায়? সবচেয়ে ছোট কফিন দুটো সত্যিই সবচেয়ে ভারী লেগেছিল সেদিন।

জানাজা শেষে সবার সাথে এয়ারপোর্টে গেলাম। এয়ারপোর্টের বাইরে থেকেই বিদায় নেবার কথা ছিল আমার। ইউএস বাংলার সিইও আসিফ ভাই এর সাথে একই গাড়িতে এসেছিলাম। এয়ারপোর্টে পৌঁছে আমার নামে উনি একটা পাস করিয়ে দিলেন দেওয়ান ভাইকে দিয়ে যেন আমি ভেতর পর্যন্ত যেতে পারি। এয়ারপোর্টের বাইরে সবার পৌঁছানোর অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে ছিলাম আমরা যারা আগে পৌঁছেছিলাম। নাবিলার ভাই বেলাল ভাই বাসায় কথা বলছিলেন সামনেই দাঁড়িয়ে। ফোনটা রেখে বেলাল ভাই কাঁদতে কাঁদতে বললেন “হিয়া পাখি (নাবিলার মেয়ের বাসার আদরের নাম) বলে কি জানেন ভাই, ওর মাকে নাকি একটা ম্যাও কামড় দিসে। আর আম্মু টুস করে মাটিতে পড়ে গিয়ে চোখে ব্যাথা পাইছে”। সহ্য না করতে পেরে সরে গেলাম।

পিয়াস রায়ের ফরম ফিল-আপটা উনার বাবার হয়ে আমি করে দিয়েছিলাম। ফলে প্রথম থেকেই কাকার সাথে আমার একটা সম্পর্ক হয়ে গিয়েছিল। ইমিগ্রেশনে গিয়ে যখন উনার এম্বারকেশন ফরমটা ফিল-আপ করছিলাম উনি কেঁদেই যাচ্ছিলেন। ছেলের লাশ নিতে এসে লাশ না নিয়েই ফেরত যাচ্ছেন তিনি।কাকা আমাকে জড়িয়ে ধরে বললেন আপনি একটু জানাবেন আমাকে কি হয়। ছেলেকে যেন আমার কাছেই রেখে গেলেন। যেদিন পিয়াস রায়ের লাশ সনাক্ত হয় কাকাকে জানাতে পেরে খুব স্বস্তি পাই আমি।

বিদায়ের সময় আমি বুঝতে পারলাম এই মানুষগুলো আমাকে কতটা আপন করে নিয়েছিলেন। সকল নিয়ম ভঙ্গ করে সবার সাথে দেখা করার জন্য বিমানে উঠতে দিল ইউএস বাংলা। প্লেন রানওয়ে থেকে টেক অফ করার পর খালি রানওয়ের পাশে দাঁড়িয়ে হঠাৎ যেন মাথাটা খালি হয়ে গেল।নানান কাজে ব্যস্ততার কারণে অনেক কিছুই টের পাইনি আমি। এয়ারপোর্ট থেকে অফিসে আসলাম। গত আটদিনে মোট ১০/১২ ঘন্টার বেশি অফিসে থাকতে পারিনি। আমার বসদেরও একটা ধন্যবাদ দিতে হয়। আমার নেপালি বস সুবু দাই আমাকে শুধু একবার কল করে একটাই কথা বলেছিলেন ঠিক মত খাওয়া দাওয়া করো। আমার বাংলাদেশী বস, উইন্ডমিল বাংলাদেশের এমডি তানিম ভাইয়ার শুধু একটা কথাই পেয়েছিলাম…থ্যাঙ্ক ইউ ব্রাদার।

এরপর যার মধ্য দিয়ে আমি যাচ্ছিলাম তা বেশ ভয়ানক। একটা ঘোর আমাকে ঘিরে রেখেছিল। কিছুতেই বের হতে পারছিলাম না। এখনো পারিনি আসলে, যদিও একটু একটু ঘুম হচ্ছে এখন। ঘুমের মধ্যে প্রত্যেকদিন দুঃস্বপ্নে জেগে উঠি। তবে সবার শুভকামনা আর দোয়ায় ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হয়ে উঠছি। কিন্তু একটু বেশি বেশি যেন বড় করে দেখছেন সবাই আমাকে। সত্যিই আমার মনে হয় না তেমন বড় কিছু আমি করেছি। তবে এটা সত্যি বড় কিছু করব বলে শক্তি পেয়েছি।

এত সহজ কাজগুলো করে যদি এত মানুষের শুভ কামনা আর দোয়া পাওয়া যায়, মানুষকে প্ররণা যোগায়, তাহলে এই সহজ কাজগুলো আমাদের যার যার জায়গা থেকে সবারই করা উচিৎ। জীবনের মানে খুঁজতে গিয়ে, জীবনের উদ্দেশ্য বুঝতে না পারার হতাশায় আমরা সবাই কম বেশি ভুগি। নেপাল ট্রাজেডিতে আমার ইনভলভমেন্ট আমাকে কিছুটা হলেও বুঝতে সাহায্য করেছে কি করলে আমি আরোও বেশি “মানুষ’ হয়ে উঠতে পারব। নেপাল ট্রাজেডির কাছে আমার এটাই পাওয়া। আমি এখন জানি যার যার জায়গা থেকে আমরা যদি দেয়ার জায়গাটা খুঁজে বের করে সেই অনুযায়ী কাজ করে যাই, জীবনটা কতটা অর্থবহ হয়ে উঠতে পারে। বুঝতে যেহেতু পেরেছি, এবার সহজ কাজগুলো করার পালা। এ তো সবে শুরু।

লেখক: নেপাল থেকে আশিক কাঞ্চন।

সারাবাংলা/জেএ/জেডএফ

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন