বিজ্ঞাপন

’যদি পুরুষ নির্মাতা হতাম, পরিচিতি অনেক বেশি হত’

March 8, 2018 | 12:56 pm

[আন্তর্জাতিক নারী দিবস উপলক্ষে সারাবাংলার আয়োজনে গত ৬ মার্চ ২০১৮ তে অনুষ্ঠিত হয় বিশেষ আড্ডা ‘আমাদের গল্প’।  এতে অংশ নেন বিভিন্ন অঙ্গনে খ্যাতি ও প্রতিষ্ঠা পাওয়া সাতজন সফল নারী। তাঁরা তাদের পরিবারে বেড়ে ওঠা, পেশাগত জীবনে পদার্পণ, নানা প্রতিকূলতা পেরিয়ে নিষ্ঠা-একাগ্রতার সঙ্গে কাজ করা, পারিবারিক ও সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গিতে পেশা কিংবা ব্যক্তি জীবনের মূল্যায়নসহ নানা বিষয় আড্ডায় তুলে ধরেন। প্রায় চার ঘণ্টার ওই আড্ডায় অংশগ্রহণকারীরা একে অন্যের প্রশ্নের উত্তর দেন প্রাণখুলে। আড্ডায় তাঁদের বক্তব্য আজ সারাবাংলার পাতায় প্রকাশ করা হল]

বিজ্ঞাপন

।। শবনম ফেরদৌসি ।।

চলচ্চিত্র অঙ্গনে পা রাখার আগের এবং পরের যে দীর্ঘ সংগ্রামের সময় সেখানে নারী হিসেবে অবশ্যই বেশ কিছু জায়গায় যুদ্ধটা অনেক বেশি কঠিন ছিলো।

ছোটবেলা থেকেই বলি, আমি আসলে জন্মেছিলাম কবি হয়ে। সেই সাত আট বছর বয়স থেকেই লিখতাম। আট বছর বয়সে নাচ শুরু করতে চাইলাম। সেটা আমার আরেকটা ভালোবাসার জায়গা ছিলো। কিন্তু নাচ শুরু করতে গিয়েই বাঁধা পেলাম। বিটিভির একটা নাচের অনুষ্ঠানে যাবার কথা ছিল। আমার বাবা মার পক্ষ থেকে কোন বাঁধা ছিলোনা। কিন্তু আত্মীয় স্বজনদের অনেকেই বলতে লাগলেন যে, “মাওলানা সাহেবের নাতনির নাচ করাটা ঠিক হবেনা”।  সেই বেদনা আমি ভুলতে পারবোনা।

বিজ্ঞাপন

নারী পুরুষ নির্বিশেষে সবারই যে কোন কাজের জন্যে প্রচন্ড প্যাশন দরকার। আমার মধ্যে সেই প্যাশনটা ছিলো। কিন্তু সেই বয়সেই প্রথম বাঁধা পেয়ে ভেতরে ভেতরে দমে গিয়েছিলাম। অনেকদিন আর শিল্পের অঙ্গনে তেমন কিছু করা হয়নি। তবে শিল্পের প্রতি আমার যে প্যাশন ছিলো সেটা এবার অভিনয়ের দিকেই ঢেলে দিলাম। ২১ বছর বয়স পর্যন্ত মঞ্চে অভিনয় করেছি মনপ্রাণ দিয়ে। আমি লিখতামও। গদ্য লিখতাম। ১৬ বছর বয়সেই লেখার জন্যে পুরষ্কারও পেয়েছি।  এমনি করে এই এতটা বয়স পর্যন্ত গান আর ছবি আঁকা বাদে শিল্প সাহিত্যের প্রায় প্রতিটি অঙ্গনেই আমি কিছু না কিছু কাজ করেছি।

 

বিজ্ঞাপন

 

২১ বছর বয়সটা ছিলো আমার জন্যে একটা টার্নিং পয়েন্ট। এই বয়সে আমি মা হই। একইসাথে আমি পড়াশুনাও করতাম। যার ফলে আমাকে মঞ্চে অভিনয় ছেড়ে দিতে হয়। তখন আমি আবার আমার প্যাশনের জায়গাটাকে ডাইভার্ট করলাম। একদম ছোটবেলা থেকেই আমি খুব সিনেমা দেখার পাগল ছিলাম। দুই এক বছর বয়সে থাকতেই আমার মায়ের কোলে বসে সিনেমা হলে সিনেমা দেখতাম। মায়ের কাছে শুনেছি আমি নাকি সেই বয়সেও গোটা সময় ধরেই চুপ করে বসে মনোযোগ দিয়ে সিনেমা দেখতাম, একটুও কাঁদতাম না। একটু বড় হবার পরে ফিল্ম দেখতে যাবার সময় আমাকে না নিয়ে গেলে বাড়িতে একটা তুঘলকি কান্ড ঘটে যেতো। হল থেকে মা ফিরে এলে আমি তার শাড়ি শুঁকে বলতাম, এই যে তুমি সিনেমা হলে গিয়েছিলে। তখন হলে সবাই সিগারেট খেত, সেই গন্ধটা শাড়িতে লেগে থাকতো অনেকক্ষণ। অর্থাৎ চলচ্চিত্রের প্রতি ভালোবাসা আগে থেকেই ছিলো।

জীবনের নানান পর্যায়ে নানান কারনে আমি একেকটা ভালোবাসার কাজের মধ্যে ছুটোছুটি করছিলাম। থিতু হওয়ার ব্যাপারটা আসে বেশ পরে। ফিল্ম হচ্ছে আমার জীবনের সবচেয়ে দীর্ঘমেয়াদী প্রেম, যেটা এখনো আমাকে আকৃষ্ট করে রেখেছে। পেশাগতভাবে চলচ্চিত্রে কাজ করছি ১৮ বছর হল।  সেই ২০০০ সাল থেকে চলচ্চিত্র নির্মাণের সাথে যুক্ত হওয়া। তার আগে পড়াশুনা করে নিজেকে তৈরি করেছি। ফিল্ম যে বানাবো এই সিদ্ধান্তটা নিয়েছি ১৯৯৫ সালে প্রথম যখন আমি ক্যামেরার সামনে দাঁড়াই। আমি প্রথমে মডেল হিসেবে মিডিয়াতে ঢুকেছিলাম, এশিয়াটিকের হাত ধরে। সাইদুল আনাম টুটুল, মাকসুদুল বারী  উনাদের সাথে প্রথম দিকের  কাজগুলো করেছি। উনাদের সাথে কাজ করার কারণেই কি না জানিনা প্রথম দিন থেকেই আমার কাছে ক্যামেরার সামনে দাঁড়ানোর চেয়ে পেছনে দাঁড়ানোর প্রতি প্রচণ্ড ভালোলাগা কাজ করল। দেখলাম আমরা খুব ঝলমলে  ক্যামেরার সামনে দাঁড়ালেও সেই  দেখতে ছোটখাট পরিচালকই কিন্তু মূলত সব কিছুর কেন্দ্রবিন্দু। তো সেই থেকেই শুরু হল চলচ্চিত্র সাধনা এবং ২০০০ সাল থেকে চলচ্চিত্র নির্মাণ শুরু করলাম।

 

বিজ্ঞাপন

 

আমার প্রথম কাজটিই ছিলো যৌন হয়রানি নিয়ে। ফারজানা রূপা, মৌসুমি আর আমি; এই তিনজনে মিলে করেছিয়াম কাজটা। এখন পর্যন্ত দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন প্রোগ্রামে এটি একটি কম্পোনেন্ট হিসেবে দেখানো হয়। এর পরে যৌন হয়রানি নিয়ে এই অঞ্চলে আরো অনেক চলচ্চিত্র হয়েছে এরকম। তবে তার আগে তেমন উল্লেখযোগ্য ছবি এই বিষয়ে ছিলোনা। বিখ্যাত নারীবাদী কামলা ভাসিন এই চলচ্চিত্রটির দারুন প্রশংসা করেছিলেন। এই প্রথম কাজটি মূলত আমরা সম্পূর্ণ আমাদের অভিজ্ঞতা থেকেই করেছি। সেই কিশোরীবেলা থেকেই তো প্রতিটি মেয়েই নানান ভাবে যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছে। আমরাও তো এর ব্যাতিক্রম ছিলাম না। হয়তো বান্ধবীর বাবা আদরের ছলে পিঠে হাত দিচ্ছে, খুব অস্বস্তি লাগত, খুন করে ফেলতে ইচ্ছা হত, কাউকে আবার কিছুই বলা যেতনা; সব মিলিয়ে যে ক্রাইসিসের মধ্যে দিয়ে আমরা যেতাম সেটাকে তুলে আনার কাজটাই করতে চেয়েছিলাম। আমরা চেয়েছিলাম নীরবতা ভেঙ্গে এই অনুভূতিগুলো প্রকাশ করতে। তাই প্রথম ছবিতে আমরা আমাদের অভিজ্ঞতা ভাগাভাগি করেছিলাম সকলের সাথে। আমরা নির্মাতারাও ক্যামেরার সামনে এসে এইসব অভিজ্ঞতার কথা বলেছি।

এই যে এতদিন ধরে এত চলচ্চিত্র তৈরি করছি, ক্যামেরার পেছনে অনবরত পরিশ্রম করছি, এর মাধ্যমে আসলে কোন কথাটা বলতে চেষ্টা করেছি? আমি আসলে আমার চলচ্চিত্রের মাধ্যমে বলতে চেয়েছি প্রান্তিক মানুষের কথা। প্রান্তিক মানুষের সংজ্ঞা তো অনেক রকম। আমরা তো অনেক প্রিভিলেজড। সমাজের একটা বেশ ভালো অবস্থানে আছি, সন্তানকে ভালো প্রতিষ্ঠানে পড়াতে পারছি, জীবনের মৌলিক প্রয়োজনগুলো নিয়ে তেমন কোন অভিযোগ নেই। কিন্তু দিনশেষে নারী হিসেবে আমি প্রান্তিক শ্রেণিরই মানুষ বলে নিজেকে মনে করি। আবার একইসাথে আমি সংখ্যালঘুর স্বার্থরক্ষায় বিশ্বাসী। এইসময় এসে আমার মত মানুষেরাও আসলে একপ্রকারের সংখ্যালঘু এবং সেই অর্থেও আমি প্রান্তিক শ্রেণিতে আছি।

আমাকে এখন পর্যন্ত বিদেশে ফান্ড নিতে হয়নি। বাংলাদেশের ফান্ডেই কাজ করেছি। কারন আমি এটা করতে চেয়েছি। আমার কাছে আমার কথা বলার এর চেয়ে বড় অস্ত্র আর ছিলনা।

যেমন আমি হিজড়ারদের নিয়ে কাজ করেছি।

ব্যাক্তিজীবনে ক্রাইসিস তো সকলেরই আছে। এখন কথা হল আমি সেই ক্রাইসিসটাকে কোথায় ডাইভার্ট করব? শোককে শক্তিতে রূপান্তরের কথা বোধহয় এসব ক্ষেত্রেই বলা যায়। ফিল্ম আমার কাছে সেই আশ্রয় যে কখনো প্রবঞ্চনা করেনা। আমার পরিচয় শুধু একজন চলচ্চিত্র নির্মাতাই নয়, আমি একজন সিঙ্গেল মাও। আমার পঁচিশ বছরের সন্তানটিকে আমি একজন জেন্ডার সেন্সিটিভ মানুষ হিসেবে তৈরি করেছি।

নারী পুরুষ উভয়েরই যদি পরিষ্কার দৃষ্টিভঙ্গি থাকে যে সে আসলে কী করতে চায় তাহলে সমাজের অনেক অশান্তিই দূর হয়ে যায়। কাজের জায়গায় এসে নিজের অনেক যন্ত্রনাই ম্লান হয়ে গেছে।

আমার ডকুমেন্টারিগুলো করতে গিয়ে আমাকে প্রান্তিক মানুষদের কাছে যেতে হয়েছে। দেখেছি, এই দেশের অনেক নারীর আসলে কুকুর বেড়ালের জীবন। একবার দেখলাম এক সন্তানের মাকে দিনের পর দিন শ্বশুরবাড়ির মানুষ খেতে দেয়না। অনেক সময় তাই চলচ্চিত্র তৈরি করতে গিয়ে আমাদেরকে  কর্মী অর্থাৎ একটিভিস্ট হয়ে যেতে হয়েছে।

এটা অনুভব করি যে আমি যদি আজকে একজন পুরুষ নির্মাতা হতাম তাহলে এই ৩৫টি চলচ্চিত্র তৈরি করার পরে আমার পরিচিতি আরো বেশিই থাকতো। আমাদের দেশে যে পুরুষ নির্মাতারা আছেন তারা কত ভাগ্যবান। তাদের স্ত্রীরা তাদেরকে নিয়ে গর্ব করে। অন্যদিকে প্রায় কোন  নারী নির্মাতার পাশেই শেষ পর্যন্ত  তাদের স্বামীরা থাকে না। মেয়েদের সৃজনশীলতাকে একটা পর্যায় পর্যন্ত নেবার ক্ষমতা আর পুরুষেরা রাখেনা। একজন নারী শিল্পীকে গ্রহণ করার জন্যে এ সমাজ এখনো সেভাবে প্রস্তুত না।

সৃষ্টিশীল একজন মানুষের জন্যে যে নিরবচ্ছিন্নন ভাবনার  সময় দরকার হয় সেটি কিন্তু একজন নারীকে দিতে সমাজ প্রস্তুত না। এমনকি আমাদের পুরুষ শিল্পীরাও প্রস্তুত না। যদিও রান্না করাও একটা শিল্প; সেটি গ্রহণ করতে পুরুষের কোন সমস্যাই হয়নি, কারন সেটি ঘরে বসেই করা হচ্ছে। যখনই নারী নিজের কাজ নিয়ে দৃশ্যমান হয় তখনই সমস্য তৈরি হয়। এই দৃষ্টিভঙ্গির পেছনে আসলে কী মানসিকতা কাজ করে? আমাদের যে তৈরি করা সমাজব্যবস্থা সেটিই কি আমাদের পথে বাঁধা হয়ে দাঁড়ায়? একজন নারী কী করবে কতটুকু করবে সেটা আসলে নির্ধারণ করে দিচ্ছে কারা?

এই এতসব প্রতিবন্ধকতার মাঝে সংগ্রাম আসলে একটি অব্যাহত ধারা। সেটাকে মাথায় নিয়েই আমি চলচ্চিত্র নির্মাণে এসেছি। আমি জানি যে আমাকে কী কী তোপের মুখে পড়তে হবে। এইসব কিছুর মধ্যে টিকে আছি কীভাবে? এই প্রশ্নের সহজ উত্তর হল, উপেক্ষা করে টিকে আছি। এগুলোই হচ্ছে সমাজের চাপিয়ে দেয়া সংগ্রাম।

তবে আমার এই সংগ্রামকে সমাজ স্বীকৃতি দেবে কি দেবে না সেটি নিয়ে আমার কিছু যায় আসে না। আমি কখনো পুরুষবিদ্বেষী না। আমার পুত্র-বাবা এরাও পুরুষ এবং আমার জীবনে আশীর্বাদের মতই রয়েছেন এরা। আমার সহকর্মীরাও  পুরুষ। ব্যাক্তি পুরুষদের  কারো সাথেই আমার সেই অর্থে কোন বিরোধ নেই। আমার সংগ্রাম সমাজের প্রচলিত বাঁধার বিপরীতে। সেই সংগ্রাম আমার চলচ্চিত্রের মাধ্যমেই আমি চালিয়ে যাবো।

অধিকার আদায়ের জন্যে বলতে গেলে যুদ্ধ করতে হয়েছে

মানুষ হতে পেরেছে এমন পুরুষের সংখ্যা খুবই কম

সবাইকে শেখাই কীভাবে নিজের শরীর পরীক্ষা করতে হবে

লজ্জা তো আমার না, লজ্জা তো তোদের, সমাজের

নারী নয়, নিজেকে মানুষ হিসেবে ভাবতে পারাটা খুব জরুরি

মেয়েরা এখন আর দাঁতে দাঁত চেপে নির্যাতন সহ্য করে না

অনুলিখনঃ জান্নাতুল মাওয়া

সারাবাংলা/এসএস

 

Tags: ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন