বিজ্ঞাপন

যে গল্পের শেষ নেই

August 19, 2018 | 10:54 am

রেজানুর রহমান ।।

নেতা যেন একটু সন্দিহান। পাশেই দাঁড়ানো ফজলুকে জিজ্ঞেস করলেন, অয় মিয়া এদেরকে দিয়া কাজ হবে তো নাকি? ফজলু জ্যান্ত চিংড়ি মাছের মতো লাফ দেওয়ার ভঙ্গি করে বলল, বলেন কি লিডার? কাজ হবে না মানে? হ্যারা এক একটা বিচ্ছু! ঐ যে অবরোধের সময় হ্যারাই তো রাস্তায় গাড়ি ভাঙ্গছে। গাড়িতে আগুন দিছে… যা করতে বলবেন, হ্যারা তাই করবে। ফজলুর কথা শুনে নেতা ঘরময় পায়চারি করতে করতে কিছু একটা ভাবলেন। তারপর ফজলুকে কাছে ডেকে নিয়ে সিরিয়াস ভঙ্গিতে বললেন, আচ্ছা ফজলু এদেরকে বিশ্বাস করা যায় তো? ধরা পড়লে আমাদের নাম টাম বলে দিবে নাতো…?
ফজলু বলল, লিডার আপনি নিশ্চিন্ত থাকেন, হ্যারা সেই কিসিমের মানুষই না। যতক্ষণ যার টাকা খায় ততক্ষণ তারই গুনগান করে।
তার মানে ওরা আমাদের মতাদর্শের কেউ না?
নেতার কথা শুনে ফজলু যেন একটু বিব্রত হলো। পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, না লিডার, ওরা আমাদের দল করে না। অর্থ দিলেই বিভিন্ন দলের হয়ে ভাড়া খাটে। তবে বিশস্ত। যখন যার টাকায় ভাড়া খাটবে তখন তার জন্য জীবন দিতেও প্রস্তুত!
ওরা মার্ডার করতে পারবে?
লিডারের প্রশ্ন শুনে তরমুজের বিঁচির মতো ময়লা দাঁত বের করে অনেকটা বিজয়ীর ভঙ্গিতে ফজলু বলল, লিডার, যাদেরকে বারান্দায় বসায়া রাখছি মাশাআল্লাহ তাদের সবারই মানুষ খুন করার এক্সপেরিয়েন্স আছে। একজন তো খুনী হেসেবে জিপিএ-৫ পাওয়ার যোগ্য। এগারটা খুনের মামলা নিয়াও ডেমকেয়ার ভঙ্গিতে প্রকাশ্যে চলাফেরা করে। আমার ধারনা আপনি ওর নাম শুনেছেন।
ফজলুর কথা শুনে নেতা উৎসাহী হয়ে জানতে চাইলেন, কি নাম বলোতো…!
গাল কাটা ছাম্বিল!
হ্যা, হ্যা এই নামটা শুনেছি। দেখেছিও মনে হয়। বেঁটে, কালো চেহারা। মুখে বসন্তের দাগ…
ফজলু মুখে হাসি ছড়িয়ে বলল, হ্যা হ্যা আপনি ঠিকই ধরেছেন। গালকাটা ছাম্বিলের সাথে আপনার একাধিকবার দেখা হইছে। ঐ যে… অবরোধের সময় সে আপনারে পুলিশের হাত থাইক্যা একবার ‘সেফ’ করল না? শেষে তো আপনিই পুলিশের হাতে ধরা দিলেন। মনে নাই সেই ঘটনা?
নেতা স্মৃতির পর্দা মেলে ধরলেন। একবার সরকার বিরোধী আন্দোলনে পল্টন এলাকায় নেতার নেতৃত্বে দেধারছে গাড়ি ভাঙ্গা হচ্ছিলো, একটার পর একটা গাড়িতে আগুন দেওয়া হচ্ছিলো। পুলিশ গ্রেফতার করতে আসে নেতাকে। হঠাৎ কোত্থেকে যেন ছবিতে দেখা স্পাইডার ম্যানের মতো ছুটে আসে মিশমিশে কালো চেহারার একজন বেঁটে যুবক, সাথে তার দশ-বারো জন সাঙ্গপাঙ্গো। পুলিশকে ফাঁকি দিয়ে বিশেষ কায়দায় নেতাকে সরিয়ে নেয় ঘটনাস্থল থেকে। নেতা অবশ্য সেদিন পুলিশের হাতে গ্রেফতার হতে চেয়েছিলেন। অনেকদিন পত্র-পত্রিকা সহ প্রচার মাধ্যমে নাম ছাপা হচ্ছে না। এখন তো অনেক সুবিধা। প্রচার মাধ্যমে নাম ফাটানোর জন্য বেশী কষ্ট করতে হয় না। হরতাল অবরোধের দিন রাস্তায় নেমে পুলিশের সাথে একটু তর্ক করলেই সেটা খবর হয়ে যায়। আর গ্রেফতার হলে তো সোনায় সোহাগা। নিউজ চ্যানেল গুলোতে পাঁচ মিনিট পর পর গ্রেফতারের খবর প্রচার হয়। টিভির স্ক্রলে দিনরাত ২৪ ঘণ্টা গ্রেফতার হওয়া ব্যক্তির নাম হাঁটতেই থাকে।
এজন্যই নেতা সেদিন পুলিশের হাতে গ্রেফতার হতে চেয়েছিলেন। অথচ কালো চেহারার বেঁটে মতো সেই যুবক সেদিন নেতার সকল প্লানই মাটি করে দেয়। কঠিন, কঠোর ভাষায় ধমক দিয়েছিলেন ওই যুবককে, অয় মিয়া তোমরা এইটা কি করল্যা?
বুঝতে না পেরে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায় ওই যুবকÑ কেন লিডার আমরা কি কোনো ভুল করেছি?
হ্যা ভুল করেছ?
বুঝলাম না লিডার ভুলটা কোথায় করলাম?
তোমরা ভুল কর নাই?
না, মানে…
পুলিশের হাত থেকে আমাকে ছাড়ায়ে নিতে আমি কি তোমাদের বলেছি?
না, বলেন নাই।
তাহলে তোমরা উজবুকের মতো এই কাজটা করল্যা কেন?
স্যরি আমরা বুঝতে পারি নাই লিডার…
বুঝতে পার নাই?
না লিডার।
তাহলে এবার বুঝতে পারার মতো একটা কাজ করো…
কি করবো লিডার…?
আমি যাতে পুলিশের হাতে গ্রেফতার হতে পারি তার ব্যবস্থা করো… গাড়ি ভাঙ্গো, গাড়িতে আগুন দেও, প্রয়োজনে লাশ ফেলো…
মুহূর্তের মধ্যে চেহারা বদলে গেল কালো চেহারার ওই বেঁটে যুবকের। নেতার নেতৃত্বে জঙ্গি মিছিল বের হলো রাস্তায়। গাড়ি পোড়া হলো, গাড়ি ভাঙ্গা হলো। প্রকাশ্যে গুলিও ছোড়া হলো। পুলিশ গ্রেফতার করলো নেতাকে। সাথে সাথে নেতার নাম ছড়িয়ে পড়লো দেশ-বিদেশে। তিন মাস থাকতে হয়েছিল কাশিমপুর কারাগারে। তারপর জামিন পান নেতা। ততদিনে দলের কাছে তার একটা নির্ভরযোগ্য অবস্থান তৈরি হয়েছে। দলের কেন্দ্রীয় সেক্রেটারি জেনারেল স্বয়ং তাকে মাঝে মাঝেই ফোন করেন। মিছিল মিটিং এ ডেকে নেন। এর ফলে নিজের এলাকা অর্থাৎ মগবাজারে নেতার অবস্থান বেশ পোক্ত হয়েছে। ব্যবসা-বাণিজ্য করতে সুবিধা হচ্ছে। এক অর্থে বেটে মতো ওই যুবকই তো তাকে এই সুযোগটা করে দিয়েছে। ওকে ধন্যবাদ দেওয়া হয়নি। আজ সুযোগ এসেছে। ফজলুকে তাড়া দিলেন নেতা। ফজলু এক কাজ করো, ভুড়ি কাটা ছাম্বিলকে ডাকো…
ফজলু বলল, লিডার ওরা তো সংখ্যায় দশজন। একজনকে ডাকবো?
হ্যা প্রথমে ছাম্বিলকে ডাকো!
ফজলু ছাম্বিলকে ডাকার জন্য পাশের ঘরের দিকে চলে গেল। এসময় হঠাৎ নেতার মোবাইলে ফোন এলো। দলের মহানগর শাখার যুগ্ম সম্পাদক জগলুল হায়দার ফোন দিয়েছেন। ফোন ধরতেই জগলুল জানতে চাইলেনÑ নেতা খবর কি?
নেতা জানতে চাইলেন কোন খবর? নির্দিষ্ট করে বলেন কি জানতে চান?
জগলুল ফিসফিস কণ্ঠে বললেন, হেড কোয়াটার থাইক্যা আন্দোলনের ব্যাপারে কি কোনো দিক-নির্দেশনা পাইছেন? স্কুলের পোলাপানরা কিন্তু আমাদেরকে একটা সুযোগ কইর‌্যা দিছে। এই সুযোগটা কাজে লাগাইতে হবে। পাইছেন কোনো দিক নির্দেশনা?
নেতা কণ্ঠ নামিয়ে বললেন, একটা দিক নির্দেশনা পাইছি। সেই ভাবে কাজ করতেছি…
নেতার কথা শুনে জগলুল উৎসাহী ভঙ্গিতে বললেন, আপনি আসলে কি করতেছেন বলেন তো… আমারে একটু সাজেশন দেন। থানা পুলিশের ভয়ে তো ভাই কেউ মাঠে নামতে চায় না। অথচ হেড কোয়াটার থেকে কড়া নির্দেশ স্কুলের পোলাপানদের আন্দোলনে নেতৃত্ব আমাদেরকেই দিতে হবে। সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে হবে। আমি অবশ্য এর মধ্যে কিছু উদ্যোগ নিয়ে ফেলেছি। বিভিন্ন স্কুল কলেজের ছাত্র-ছাত্রীদের ড্রেসের ডিজাইন অনুযায়ী একশ ড্রেসের অর্ডার দিছি। ওই ড্রেস পইর‌্যা ৫০ জন ইতিমধ্যে মাঠে নাইম্যা পড়ছে। তাদের পারফরমেন্স বেশ ভালো। এজন্য হেড কোয়াটার থাইক্যা ইতিমধ্যে প্রশংসাও পাইছি। ভাই আপনাকে যে জন্য ফোন করেছি। সেটা বলি। স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীদের এই আন্দোলনকে ইস্যু বানিয়ে সরকারকে বেকায়দায় ফেলা খুবই সহজ। এক কাজ করেন যত পারেন ফেসবুকে গুজব ছড়ান। নারী কেলেঙ্কারীর গুজব। এর মধ্যে ফেসবুকে নিশ্চয়ই দেখছেন একটা মেয়ে কাঁদতে কাঁদতে তার উপর নির্যাতনের কথা বলতেছে। মাথায়, হাতে, পায়ে রক্তাক্ত ব্যান্ডেজ বাধা আহত ছাত্র-ছাত্রীর ছবি নিশ্চয়ই ফেসবুকে দেখছেন। এই আইডিয়াটা কিন্তু আমার। যে মেয়েটা কাঁদতে কাঁদতে তার ওপর পাশবিক নির্যাতনের কথা বলেছে তাকে ভাড়া করেছি মাত্র আড়াই হাজার টাকায়। আর মাথায়, পায়ে, হাতে ফলস ব্যান্ডেজ বাধা ছেলে-মেয়েরা আমাদের কর্মী। এই বুদ্ধিটা কিন্তু ওরাই আমাকে দিছে। আমি শুধু ইমপিলিমেন্ট করেছি। ভাই আপনারাও এই ধরনের কিছু কিছু একটা করেন। স্কুলের ছেলে-মেয়েরা আমাদেরকে একটা সুযোগ করে দিয়েছে। সুযোগটা কাজে লাগাইতে পারলেই…
গাল কাটা ছাম্বিল নেতার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। নেতাকে ফোনে কথা বলতে দেখে ইতস্তত করছিলো। চলে যাবে কিনা ভাছিলো। সেটা বুঝতে পেরে তড়িঘড়ি ফোন কেটে দিয়ে নেতা তাকে বসতে বললেনÑ কেমন আছো ছাম্বিল?
নেতার অমায়িক কণ্ঠ শুনে ছাম্বিল যেন একটু অবাক হল। পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নিয়ে মৃদু হেসে বলল, জ্বি লিডার ভালো…
এরকম ভাবে কাচুমাচু হয়ে দাঁড়িয়ে আছো কেন? বস।
নেতার কোমল কণ্ঠের আহবান শুনে নেতার সামনেই একটা খালি সোফায় বসতে বসতে নিজের পরিবর্তন দেখে অবাক হলো ছাম্বিল। খ্যাপ মারতে এসে ছাম্বিল সাধারনত এভাবে কারও সামনে কাচু মাচু হয়ে বসে না। বরং পায়ের উপর পা তুলে ভয়ংকর স্টাইলে বসে ‘খ্যাপ’ নিয়ে কথা বলে। প্রথম প্রথম ছাম্বিল এতোটা ভয়ংকর ছিল না। খ্যাপ অর্থাৎ রাজনৈতিক কর্মসূচিতে গাড়ি ভাঙ্গুচুর করা অথবা পিস্তল উচিয়ে ত্রাস সৃষ্টি করার কাজে তার ডাক পড়তো। প্রথম দিকে অর্থনৈতিক ব্যাপারে কোনো চুক্তি করতো না ছাম্বিল। বরং নেতাদেরকে বলতো, ভাই আপনাদের যা খুশি পোষায়া দিয়েন। এটা করতে গিয়ে দেখা গেল নেতারা যা দেয় তা অনেকটা ভিক্ষার মতো। অবস্থা বুঝে চেহারা পাল্টালো ছাম্বিল। মিছিল মিটিংএ ডাক পড়লে অবস্থা বুঝে আগেই রেট নির্ধারণ করে সে। শুধু মিছিলে লোক জোগাড় করতে হলে রেট এক ধরনের। গাড়ি ভাঙ্গচুরের রেট একটু বেশি। আর যদি মিছিলে গোলাগুলি করতে হয় তাহলে তার রেট সবচেয়ে হাই। ছাম্বিলের নেতৃত্বে এখন শতাধিক কর্মী কাজ করে। তাদের অধিকাংশরাই রাজনৈতিক মিছিলে, মিটিং আর সভা সেমিনারে দর্শক হিসেবে ভাড়া খাটে। চুক্তিটা হয় ছাম্বিলের সাথে। ছাম্বিলই তার কর্মীদেরকে দিন হাজিরা হিসাবে একটা নির্দিষ্ট পরিমান টাকা দেয়। এসব করতে গিয়ে ছাম্বিলের নেতৃত্বে একটা ছোটো খাটো দল গড়ে উঠেছে। যাদের কাজই হলো রাজনৈতিক সভা, সেমিনারে যোগ দেওয়া, মিছিলে হামলা করা, গুলি চালানো… কাজের ধারা গুলো যেহেতু ভয়ংকর। তাই চুক্তি করার সময় ভয়ংকর স্টাইলে পাটির সাথে কথা বলতে হয়। নমনীয় অথবা বিনীত হয়ে কথা বললেই পার্টি ঘাড়ের উপর চড়ে বসে। টাকা কম দিতে চায়। সে জন্যই পার্টির সাথে কথা বলার সময় সাধারনত গম্ভীর থাকে ছাম্বিল। কিন্তু এই মুহূর্তে নেতার সামনে কেন যেন গম্ভীর হতে পারছে না। নেতা ছাম্বিলকে প্রশ্ন করলেন, দেশের পরিস্থিতি কেমন বুঝতেছ ছাম্বিল? স্কুলের পোলাপানরা তো এক হাত দেখিয়ে ছাড়লো।
ছাম্বিল বিনীত ভঙ্গিতে বলল, হ্যা, আমি ওদের আন্দোলনকে সমর্থন করি। রাস্তার একটা আইন থাকা দরকার। বাচ্চা বাচ্চা পোলাপান রাস্তায় গাড়ি থামিয়ে ড্রাইভারের লাইসেন্স ‘চেক’ করতেছে। সুন্দর দৃশ্য…. অনেক দিন এই ধরনের সুন্দর দৃশ্য দেখি নাই।
ছাম্বিলের কথা শুনে নেতা যেন একটু বিব্রত হলেন। ছাম্বিল যে ভাবে সড়ক পথের আন্দোলনের ক্ষেত্রে ছাত্র-ছাত্রীদেরকে সমর্থন করে কথা বলছে তাতে কি সে তার সাঙ্গপাঙ্গদের নিয়ে ছাত্র ছাত্রীদের আন্দোলন কর্মসূচিতে নাশকতা করার জন্য ঢুকে যেতে চাইবে? নেতা ভাবলেন, ছাম্বিলকে সরাসরি প্রস্তাব দেওয়া ঠিক হবে না। কথার পিঠে কথা বলে প্রস্তাব দিতে হবে। ছাম্বিলের মুখের দিকে তাকালেন নেতা।
তোমার বাড়িটা যেন কোথায় ছাম্বিল?
জ্বি, আমার বাড়ি নেত্রকোনো।
ঢাকায় কোথায় থাকো?
লালবাগে আমার এক বোনের বাসায়।
পড়াশুনা কতদূর করেছ?
এইচ এস সি পাশ করে আর পড়ি নাই।
ও… বোনের বাসায় থাকো বললে… দুলাভাই কি করেন?
একটা ব্যাংকের প্রিন্সিপাল অফিসার।
তোমার বোন কি করেন?
কিছু করে না? গৃহিনী।
তোমার ফ্যামিলি ব্যাকগ্রাউন্ড তো ভালই মনে হচ্ছে। এইচএসসির পর আর পড়ো নাই কেন?
ছাম্বিল হঠাৎ বিরক্ত হয়ে বলল, আপনি আসলে আমাকে কেন ডেকেছেন সেটা বলেন!
আমার কথায় তুমি কি মাইন্ড করলে?
না মাইন্ড করি নাই। তবে আপনি আমাকে যে ধরনের কথা বলতেছেন সে কথা গুলো আসলে আপনার মনের কথা না। আমি কেন পড়াশুনা করি নাই, কেন গাল কাটা ছাম্বিল হলাম এখন এসব বলে তো কোন লাভ নাই? থানায় আমার বিরুদ্ধে ১০টা মার্ডার কেস আছে। অথচ একটা মার্ডারও আমি করি নাই। এইসব কথা বলে তো কোন লাভ হবে না। বলেন হবে? আপনি আমাদেরকে কেন ডাকছেন সেটা বলেন। আমার অনেক কাজ আছে… বলেই যাবার জন্য ব্যস্ততা দেখালো ছাম্বিল। সাথে সাথেই নেতা না না করে উঠলেন। ছাম্বিলের চোখের দিকে তাকিয়ে বললেন, দেশটাকে যে বাঁচাতে হয় ছাম্বিল…
নেতার কথায় ছাম্বিল অবাক হয়ে বলল, দেশকে বাঁচাতে হবে মানে? দেশের আবার কি হল? দেশ তো ভালই চলতেছে…
নেতা মৃদু হেসে বললেন, না দেশ ভালোভাবে চলতেছে না। হত্যা, খুন, রাহাজানি বেড়েই চলছে। জান মালের নিরাপত্তা নাই। বিরোধীরা কোনো কথা বললেই গ্রেফতার করা হচ্ছে। এই যে সড়ক পথে নিরাপত্তার দাবিতে ছোটো ছোটো বাচ্চারা যে আন্দোলন শুরু করেছে, তাতে তোমার কি ধারনা সরকারের ক্ষমতায় থাকা উচিৎ? লজ্জায় সরকারের তো পদত্যাগ করা উচিৎ। কিন্তু সরকারের তো কোনো লজ্জা নাই। সরকারকে লজ্জা দিতে হবে। তোমরা কি এই ব্যাপারে একটু হেল্প করতে পার?
নেতার কথা বুঝতে পেরেছে ছাম্বিল। তবুও না বোঝার ভান করে বলল, নেতা আপনি আসলে আমাদেরকে কেন ডেকেছেন সেটা বলেন। ভূমিকা অনেক বড় হয়ে যাচ্ছে। আসল ঘটনা বলেন…
নেতা আর ছাম্বিলের কথার মাঝখানে এক ফাকে ফজলু এসে দাঁড়িয়েছে। এতক্ষণ সে নেতার পিছনে দাঁড়িয়েছিল। তাই নেতা তার উপস্থিতি টের পায়নি।
ছাম্বিলের প্রশ্নে নেতা ইতঃস্তত করছিলেন। পিছন থেকে ফজলুই কথাটা তুলল, ছাম্বিল… কথা হইল যে.. আসল কথাটা তোমাকে বলি… এই যে ছোটো ছোটো বাচ্চারা সড়ক পথে যাতায়তের ক্ষেত্রে নিরাপত্তার দাবিতে যে আন্দোলন শুরু করেছে আমরা এই আন্দোলনের নেতৃত্ব নিতে চাই। ইতিমধ্যে আমাদের অনেক তরুণ নেতা কর্মী স্কুল, কলেজের ইউনিফর্ম পড়ে আন্দোলনে ঢুকে পড়েছে। আমরা চাই তোমার অধীনে শখানেক যে তরুণ দল আছে তারাও আন্দোলনে ঢুকে যাক। আমরা চাই একটা বড় বিশৃঙ্খলা। প্রয়োজনে লাশ ফেলতে হবে। টাকার জন্য চিন্তা করবে না। আমরা তোমার জন্য একটা বড় অ্যামাউন্ট বরাদ্দ রাখব। এবার বল তুমি কাজটা করতে রাজি কিনা?
অন্যসময় হলে ছাম্বিল সাথে সাথেই রাজি হয়ে যেত। কিন্তু আজ কেন যেন সরাসরি হ্যাঁ বলতে পারল না। প্রস্তাবটা দিয়েছে ফজলু। কিন্তু এটা নেতার প্রস্তাব। তাই নেতার দিকে চোখ ফেলে বলল, লিডার আমাকে কয়েকঘণ্টা সময় দেন। কাজটা করব কিনা একটু ভেবে দেখি! বলেই উঠে চলে যাচ্ছিলো ছাম্বিল। নেতা চেয়ার ছেড়ে উঠিয়ে দাঁড়িয়ে ছাম্বিলের ডান কাধ ছুঁয়ে বললেন, পল্টনের ওইদিনের মিছিলের কথা আমার মনে আছে। আমাকে বাঁচাইতে গিয়া তুমি পুলিশের হাতে মাইর খাইছো… সেদিন থাইক্যা প্রায়ই তোমার কথা মনে পড়ে। আমাদের সাথে আসো। দেশটাকে বাঁচাইতে হবে। কথা দিতেছি আমরা সরকারে গেলে তুমি একটা বিশেষ উপহার পাবে। কি হইল, তুমি কি আমার কথায় রাজি, নাকি…
নেতার চোখের দিকে তাকিয়ে ছাম্বিল বলল, ধরেন আমি আপনার কথায় রাজি। ডিলটা কেমন হবে? আমি কি পাব?
নেতা বললেন, কি চাও বলো?
আপনিই বলেন আমাদের জন্য কি বরাদ্দ রাখছেন?
পাশেই টেবিলের ওপর রাখা একটা ব্যাংকের চেক বইয়ের পাতা ছিড়ে ছাম্বিলের হাতে দিয়ে নেতা বললেন, আমাউন্টটা বসায়া নিও। শোনো যে কোনো মূল্যে দেশটাকে অস্থির করে তুলতে হবে। প্রয়োজনে লাশ ফেলে দিতে হবে।
ছাম্বিল চেকটা হাতে নিয়ে অস্থির ভঙ্গিতে ঘর থেকে বেড়িয়ে গেল। নেতা ফজলুর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, কিরে কাজ হবে?
ফজলু মৃদু হেসে বলল- হবে না মানে… একেবারে খাপে খাপে মন্তাজের বাপ। আন্দোলনের জন্য তৈরি হয়ে যান।

বিজ্ঞাপন

মন্টু এক নাগাড়ে কথা বলেই যাচ্ছে। কত যে কথা! মামা শোনো না। তারপর কি হলো বলি? একজন বুড়ো ড্রাইভার তারও অরিজিনাল ড্রাইভিং লাইসেন্স নাই। এইটা কি বিশ্বাসযোগ্য কথা মামা? তার বয়স… ধরো ষাইট এর উপরে হবে। তার নাকি অরিজিনাল ড্রাইভিং লাইসেন্স নাই। অথচ ৩০ বছর ধরে গাড়ি চালায়। আমরা ড্রাইভিং লাইসেন্স এর কথা জিজ্ঞাসা করতেই বাস থেকে নেমে দিল দৌড়। এইটা কি কোনো লজিকের মধ্যে পড়ে মামা? বয়স্ক মানুষ কোথায় আমরা তার কাছে শিখব তা না আমরা তাকে শিখাইতেছি! এক নাগাড়ে কথা গুলো বলে থামল মন্টু। দম নিয়ে ছাম্বিলের দিকে তাকাল। আচ্ছা মামা তুমি আমার একটা প্রশ্নের জবাব দাও তো…
এতক্ষণ ভাগ্নে মন্টুর কথা শুনতে শুনতে মোবাইলে দলের দায়িত্ববান সদস্যদের সাথে কথা বলছিল ছাম্বিল। গতকাল নেতার কাছ থেকে চলে আসার পর ছাম্বিল সিদ্ধান্ত নিয়েছে ছাত্র-ছাত্রীদের মিছিলে তার দলের ছেলেদের নিয়ে ঢুকে যাবে। তারপর অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা নিবে। ছাম্বিল প্রথমে ভেবেছিল এই কাজটা করবে না। কিন্তু টাকার অংকটা বেশ বড়। তাই না করতে পারেনি। মোবাইল বাজছে। নেতা ফোন করেছেন।
ছাম্বিল, তোমরা রেডি তো…
জ্বি আমরা রেডি।
শোনো, যে কোন মূল্যে সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে হবে। পারবা না?
ছাম্বিল বিরক্ত হয়ে বলল, বারবার আমাকে ফোন দিবেন না। আমি যখন কথা দিয়েছি, ধরে নেন কাজটা হয়ে গেছে। বলেই ফোন কেটে দিল ছাম্বিল।
মন্টু ছাম্বিলের দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে আছে। অবাক হবার কারণ সে ছাম্বিলকে একটা প্রশ্ন করেও জবাব পাচ্ছে না। হঠাৎ ধমক দেওয়ার ভঙ্গিতে সে প্রশ্নটা করলো, মামা তুমি কি আমার কথা শুনতে পাচ্ছ? অ্যাই মামা…
ছাম্বিল চমকে উঠে বলল, হ্যা হ্যা শুনতে পাচ্ছি। কি বলবি বল…
তোমরা বড়রা এতো পচা কেন?
আমরা বড়রা আবার কি করলাম?
মন্টু হেসে বলল, তোমরা বড়রাই তো যত ঝামেলা কর। আইন মানো না। ওই যে ড্রাইভারটা বাস তুলে দিল আমাদের দু’জন বন্ধুর উপর। ড্রাইভার কি মানুষ মামা? যদি সে মানুষ হয় তাহলে কি করে এটা করতে পারল? ওই পঁচা ড্রাইভারটার নিশ্চয়ই ছেলে-মেয়ে আছে। সে তাদরেকে কিভাবে মুখ দেখায় মামা! আমি যাই… আমাদের স্কুল থেকে মিছিল বের হবে। উই ওয়ান্ট জাস্টিস। বলতে বলতে দৌঁড়ে বাসা থেকে বেড়িয়ে গেল মন্টু। ছাম্বিল চিৎকার দিয়ে বলল, মন্টু শোন, আজ তুই কোনো মিছিলে যাবি না। মন্টু… মন্টু ততক্ষণে বাসা থেকে বেড়িয়ে গেছে। একটু যেনো উৎকণ্ঠা হচ্ছে ছাম্বিলের। বোনকে ডাকলো ছাম্বিল। আপা… এই আপা…
পাশের ঘর থেকে আঁচলে হাত মুছতে মুছতে ছাম্বিলের সামনে এসে দাড়াল সুহিতা-কি বলবি বল।
আজ মন্টুকে স্কুলে না পাঠালো চলতো না?
সুহিতা অবাক হয়ে বলল, তুই কি বলতেছিস এসব? ওকে স্কুলে পাঠাব না কেন? ওরা এতবড় একটা আন্দোলন করতেছে। আমাদের তো সবারই উচিৎ ওদের পাশে দাঁড়ানো। বলেই ব্যস্ততা দেখিয়ে চলে গেল সুহিতা।
ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল ছাম্বিল। সকাল সাড়ে ১০টা। ছাত্ররা নিশ্চয়ই রাস্তায় নেমেছে। কাজেই এখনই বাসা থেকে বের হওয়া দরকার।
মোবাইল বাজছে। মিজান ফোন দিয়েছে। সে জাতীয় প্রেসক্লাব এলাকার দায়িত্বে আছে। প্রেসক্লাবে প্রতিদিন ছোট বড় একাধিক রাজনৈতিক দলের সভা, সেমিনার হয়। অনেকে সেমিনার করতে এসে দর্শক খোঁজে। তাদের জন্য ভাড়ায় দর্শককে বসিয়ে দেয় মিজান। সেমিনারের দর্শক হলে জনপ্রতি ৫০ টাকা পাওয়া যায়। সাথে নাস্তার প্যাকেট বাধ্যতামূলক। খাওয়ার লোভে প্রেসক্লাবের আশে-পাশেই দলের অধিকাংশ সদস্যর ঘোরাফিরা করে। তাদের নেতৃত্ব দেয় মিজান।
মোবাইল বেজেই চলেছে। ফোন রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে মিজানের গলা শোনা গেল, ভাই, মিছিলে নাকি লোক লাগবে?
হ্যা, রাতে তোমাকে তো সব বলে দিয়েছি। জিগাতলা মোড়ে সবাই প্রথমে আমার সাথে দেখা করবে। তারপর অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা…
ছাম্বিলের কথা শুনে মিজান বললো, ভাই একটা ঝামেলা হয়া গ্যাছে।
ঝামেলা? কি?
প্রেসক্লাবের ভিআইপি লাউঞ্জে একটা বড় সেমিনার আছে। মালদার পার্টি। রেট ভালো দিব। ওরা তো ভাই ১০০ লোক চায়।
ছাম্বিল বলল, ১০০ লো চায় দিয়ে দেও… মিজান বলল, আমাদের মানুষই তো ভাই ১০০ জনের মতো। সেমিনারে পাঠাইলে আপনার কাছে তো… মিজানের কথা টেনে নিয়ে ছাম্বিল বলল, এককাজ করো তুমি আমার কাছে ‘কাটা’ চালাইতে পারে এমন কয়েকজনকে পাঠাও। এই যেমন ধরো লালবাগের বাসু, আরমানিটোলার পিয়াল, নারিন্দার জব্বার, ধানমন্ডির টাক জামাল এই ধরনের কয়েকজনকে পাঠাও। এদের সবাইকে আমার সাথে মোবাইলে কথা বলতে বলো… কি বললাম বুঝছো..
ছাম্বিলের কথা শুনে মিজান অনেকটা ইতস্তত করে বলল, ভাই একটা কথা বলব।
বল।
রাগ করবেন না তো…
রাগ করার মতো কিছু বলবা নাকি?
না, মানে… কথাটা খুবই জরুরি।
নির্ভয়ে বলো…
পোলাপানগো মিছিলে আমাদের না নামলে কি হয় না? ওরা ভাই অনেক ভালো একটা কাজ করতেছে।
মিজানের কথায় গুরুত্ব না দিয়ে ছাম্বিল বলল, তুমি দেখি নীতি-নৈতিকতা নিয়া আছো! পার্টির কাছ থেকে টাকা নিয়েছি। বেশ বড় অ্যামাউন্ট। এখন আর না বলা যাবে না। কি বুঝল্যা…
তবুও ভাই ব্যাপারটা ভাইবা দেইখেন… স্কুলের ছোটো ছোটো বাচ্চারা ভাই সত্যি একটা ভালো কাজ করতেছে। ওদেরকে সহযোগিতা করা দরকার। বলেই ফোন কেটে দিল মিজান।
ছাম্বিলের খুব অস্থির লাগছে। মিছিল মিটিং এ যাবার আগে সাধারনত এমন অস্থিরতা তাকে পেয়ে বসে না। আজ কেন অস্থির লাগছে? মিজানের কথা গুলো তাকে যেন পিছু টানছে। ভাই, ছোট ছোট ছেলে-মেয়েরা একটা ভালো কাজ করতেছে। ওদের পাশে আমাদের দাঁড়ানো দরকার। ফোনের শব্দে চমকে উঠলো ছাম্বিল। ধানমন্ডির টাক জামাল ফোন দিয়েছে। বস কোথায় আসতে হবে বলেন! ‘কাটা’ কি সাথেই থাকবে?
হ্যা ‘কাটা’ সাথে নিয়া জিগাতলা মোড়ে আমার সাথে দেখা করো। তারপর অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা। বলেই ফোন কেটে দিতে যাচ্ছিলো ছাম্বিল। জামাল বলল, বস আমার একটা কথা আছে।
কথা? কি বল।
মিছিলে কি গুলি ফুটাইতে হবে!
মিজানের প্রতি ক্ষুব্দ হয়ে উঠলো ছাম্বিল, অয় মিয়া মোবাইলে এত কথা বলতেছ কেন? তোমাকে যা যা বলছি তাই করো। জিগাতলা মোড়ে আমার সাথে দেখা করো। হারিয়াপ। বলেই ফোন কেটে দিল ছাম্বিল। সাথে সাথেই নেতার ফোন এলো। নেতা বেশ উদ্বিগ্ন-ছাম্বিল খবর কি? তোমরা নাকি এখনও স্পটে যাও নাই।
ছাম্বিল রেগে বলল, কে বলল আপনাকে এসব কথা? আমরা তো জিগাতলা মোড়েই আছি… নেতা ধমক দিলেন ছাম্বিলকে, এমন একটা জলজ্যান্ত মিথ্যা কথা তুমি বলতে পারলা ছাম্বিল? তুমি তো এখনও তোমার লালবাগের বাসা থেকেই বের হও নাই। বারান্দায় দাঁড়িয়ে দেখ লাল হোন্ডায় আমার দু’জন লোক তোমার গতিবিধি ফলো করতেছে… শোনো মিয়া আমি কিন্তু ঘাস খেয়ে নেতা হই নাই? কথাটা মনে রাখবা… বলেই নেতা রাগত ভঙ্গিতে ফোন কেটে দিলেন।
ছাম্বিলের বেশ অবাক ঠেকছে। সাধারনত কেউ তার সাথে এভাবে রেগে কথা বলে না। সে যতবড়ই নেতা হউক না কেন? তার মানে কি ছাম্বিল কোনো কারণে দুর্বল হয়ে পড়েছে। দুর্বল যারা তারাই সাধারনত পরিস্থিতি সামলানোর জন্য হঠাৎ মিথ্যা কথা বলে বসে। এই যেমন ছাম্বিল অনেক দিন পর একটা মিথ্যা কথা বলল। তার মানে কি ছাম্বিল একটু হলেও দুর্বল হয়ে পড়েছে। না, না দুর্বল হওয়া চলবে না। এই দুনিয়ায় দুর্বলের কোনো জায়গা নাই। ঘর থেকে বেড়িয়ে দ্রুত পথে নামলো ছাম্বিল।
নেতা আবার ফোন দিয়েছে। জিগাতলার দিকে না গিয়ে ধানমন্ডির দিকে যেতে বলল। সায়েন্স ল্যাবরেটরী মোড়ে নাকি ছাত্র-ছাত্রীদের একটা বড় মিছিল বের হয়েছে। কাজটা ওখানেই করতে সুবিধা হবে। কর্মীদের সবাইকে ফোন দিয়ে সায়েন্স ল্যাবরেটরি মোড়ের দিকে আসতে বলল ছাম্বিল। নিজেও সেদিকে হোন্ডা ছোটালো…

সায়েন্স ল্যাবরেটরি মোড়ে সত্যি সত্যি একটা বিরাট মিছিল এসে থামলো। ছোটো ছোটো মুখের অনেক বড় মিছিল। সবার ঘাড়ে বইয়ের ব্যাগ। মিছিলে গগন বিদারী শ্লোগান হচ্ছে। উই ওয়ান্ট জাস্টিস… মিছিলের অগ্রভাগে অনেক সাংবাদিক আর ক্যামেরাম্যান। পথচারীরাও মিছিলে নেমেছে। ফুটপাতের ওপর দাঁড়িয়ে মিছিল দেখছিল ছাম্বিল। আরমানিটোলার পিয়াল, নারিন্দার জব্বার, লালবাগের রাসু, ধানমন্ডির টাক জামাল ছাম্বিলের পাশে দাঁড়িয়ে আছে। লালবাগের রাসু যেন একটু উত্তেজিত। ছাম্বিলকে বলল, ভাই মিছিল দেখছেন? নাক টিপলে এখনও যাদের মুখ থাইক্যা মায়ের দুধ বাইর হবে তারাই কি ঘটনাটা ঘটাইল? ছাম্বিল কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলো হঠাৎ এক বৃদ্ধ তাকে ধাক্কা দিয়ে দৌড়ে মিছিলে নেমে যেতে যেতে বলল, পোলাপানেরা যা দেখাইল রে, ভাই!
বৃদ্ধের দিকে তেড়ে যাচ্ছিলো পিয়াল। ছাম্বিল তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, কুল… কুল থাকো মিয়া। সায়েন্স ল্যাবরেটরি মোড়ে মিছিলটা থেমে গেছে। চারদিকে বিরাট ট্রাফিক জ্যামের সৃষ্টি হয়েছে। পুলিশ মিছিলকারীদের শান্ত করতে পারছে না। হঠাৎ আবার নেতার ফোন এলো ছাম্বিলের মোবাইলে। নেতা ছম্বিলকে ধমকের সুরে বললেন, কাজের কাজ তো দেখি কিছুই করতেছ না। আরে ভাই এইটাতো আমার প্রেস্টিজের ব্যাপার হয়ে যাচ্ছে। আমার পাশের ওয়ার্ডের জলিল সওদাগরের কর্মীরা কিন্তু মিছিলে নেমে গেছে। ভালো করে চেয়ে দেখ মিছিলে কিছু বয়স্ক ছাত্রকে দেখা যাচ্ছে… দেখতে পাচ্ছ? ওরা জলিল সওদাগরের লোক। ওই যে ওদের কাছে ব্যাগ দেখতেছ? বোমা আছে ব্যাগে। ওরা মিছিলে বোমা ছুঁড়বে। এখন পর্যন্ত জলিল সওদাগরের কর্মীদের পারফরমেন্স নাকি অনেক ভালো। কিন্তু তোমরা তো ভাই আমারে ডুবাইতেছ! কিছু একটা করো। বুঝতেছ না কেন আজকের ঘটনার ভালো-মন্দের ওপর আমার ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক ক্যারিয়ার নির্ভর করতেছে… ছাম্বিল কিছু একটা করো। দরকার হলে মিছিলে গুলি করো… হারিয়াপ…
মিছিলের কারণে সায়েন্স ল্যাবরেটরির চারপাশের রাস্তায় প্রচণ্ড ট্রাফিক জ্যাম লেগেছে। পুলিশ ছাত্র-ছাত্রীদেরকে কোনো ভাবেই থামাতে পারছে না। পরিস্থিতি এতটাই ভয়ংকর হয়ে উঠলো যে কোনো কারণে পুলিশ যদি মিছিলে হামলা করে, অথবা ফাঁকা গুলীও ছোড়ে তাহলে প্রাণ ভয়ে দৌড়াতে গিয়েও ছাত্র-ছাত্রীদের অনেক মারা যেতে পারে। পরিস্থিতি বলছে আর কিছুক্ষণের মধ্যেই ভয়াবহ কিছু একটা ঘটবে। ছাত্র-ছাত্রীরা গগণ বিদারী শ্লোগান দিচ্ছে… উই ওয়ান্ট ফর জাস্টিস।
পুলিশ বাঁশিতে ফুঁ দিচ্ছে। হঠাৎ মিছিলের পিছন দিকে একটা হাত বোমা ফুটলো। ছাত্র-ছাত্রীদের মিছিলটা হঠাৎ খান খান হয়ে গেল। মিছিল কারী ছোটো ছোটো বাচ্চারা বইয়ের ব্যাগ কাধে নিয়ে রুদ্ধশ্বাসে যে যেদিকে পারে দৌঁড়ে পালাচ্ছে। ছাম্বিলের মোবাইলে আবার নেতার ফোন এসেছে। ধমক দিচ্ছে নেতা-ছাম্বিল এর চেয়ে বড় সুযোগ আর পাবে না। গুলি করো, গুলি… ছাম্বিল…
ছাম্বিল চোখ বন্ধ করে পর-পর কয়েকটি গুলি ছুঁড়লো। নেতার কথা মতো কাজ হয়েছে। গুলিতে তিনজন ছাত্র মারা গেছে। এবার ছাম্বিলের মোবাইলে প্রথম ফোন এলো নেতার, ছাম্বিল ওয়েলডান। কনগ্রাচুলেশন!
নেতার ফোন কেটে দিতেই দ্বিতীয় ফোন এলো ছম্বিলের বোন সুহিতার। সুহিতা হাউমাউ করে কাঁদছে আর বলছে ছাম্বিলরে… আমাদের সর্বনাশ হয়ে গেছেরে… সায়েন্স ল্যাবেরটরি মোড়ে সন্ত্রাসীদের গুলিতে আমাদের মন্টু মারা গেছে… আমার মন্টু… আল্লারে…

সারাবাংলা/এমএম

বিজ্ঞাপন

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন