বিজ্ঞাপন

রাজীবের মৃত্যু ও রক্তাক্ত রাজপথ

April 17, 2018 | 7:21 pm

দুই বাসের প্রতিযোগিতায় ডান হাত হারানো রাজীব হোসেন মারা গেছেন। সোমবার রাত ১২টার পর ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে তিনি মারা যান। গত ৩ এপ্রিল সার্ক ফোয়ারার কাছে দুর্ঘটনায় রাজীবের হাত ছিঁড়ে যায়। শমরিতা হাসপাতালে প্রাথমিক চিকিৎসার পর রাজীবকে ঢাকা মেডিকেল কলেজে স্থানান্তর করা হয়। সাময়িক উন্নতির পর গত সোমবার থেকে তাঁর মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ শুরু হয়। রাজীবের মস্তিষ্ক অসাড় হয়ে যায়। সেই থেকে আর জ্ঞান ফেরেনি তাঁর।

বিজ্ঞাপন

সড়ক, মহাসড়কগুলোতে ‘সেফ ড্রাইভ’ বা সাবধানে গাড়ি চালান বলে স্লোগান দিয়ে প্রচার চলছে যুগের পর যুগ ধরে। কিন্তু দুর্ঘটনা ঠেকানোর সেই উদ্যোগে কাজের কাজ বিশেষ হয়নি। বরং বাংলাদেশের পরিবহন খাত আরও বেপরোয়া হয়েছে।
দুর্ঘটনা এড়াতে প্রতি বছরই সড়ক নিরাপত্তা সপ্তাহ ঘটা করে পালিত হয়। কিন্তু দুর্ঘটনা এড়ানো কোনও ভাবেই সম্ভব হচ্ছে না। পথকে সুরক্ষিত করতে, জীবনকে নিরাপদ রাখতে এসব কর্মসূচী শুধু প্রচারেই সীমাবদ্ধ থেকেছে, কমানো যায়নি দুর্ঘটনা। যেভাবে রাজধানী ও দেশজুড়ে বেপরোয়া গাড়ির দাপাদাপি চলছে তা কমানোর কোন কার্যকর উদ্যোগও নেই। তাড়াহুড়ো করে গাড়ি চালাতে গিয়ে পথচলতি মানুষকে পিষে দিয়ে যাচ্ছে, কখনও রেষারেষি করতে গিয়ে মানুষের প্রাণ কেড়ে নিচ্ছে — প্রতিদিনের এই ছবিটি বদলের জন্য পুলিশ কি কোন ব্যবস্থা নেবে? রাজীবের মৃত্যুর পর এই প্রশ্ন এখন সবার।

দুর্ঘটনায় প্রতিদিন অনেক মানুষের প্রাণ যাচ্ছে। সড়ক যোগাযোগ থেকে শুরু করে সব ক্ষেত্রেই যে নৈরাজ্য চলছে, তাতে দুর্ঘটনাই হয়ে গেছে নিয়মিত বিষয়। অস্বীকার করার উপায় নেই যে, সড়ক দুর্ঘটনা এবং তাতে হতাহতের বাস্তবতাই এখন স্বাভাবিক। অস্বাভাবিক হলো নিরাপদ ভ্রমণ। সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুহীন একটি দিনও নেই এখন।

মহাসড়ক থেকে শুরু করে নগরের সড়কগুলো, বিশেষত ঢাকা মহানগরের সড়কের দিকে তাকালে মনে হয় না যে এখানে কোনও পরিকল্পনা কাজ করছে। সড়কের তুলনায় অতিরিক্ত যানবাহন, অনুপযোগী পথঘাট, আর দুর্বল ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা মিলিয়ে এক দুর্বিষহ অবস্থা। সরকারি হিসেবে বছরে প্রায় তিন হাজার লোক সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান। তবে সব মৃত্যুর কারণ হিসেবে সড়ক দুর্ঘটনা নিবন্ধিত না হওয়ায় প্রকৃত সংখ্যা আরও অনেক বেশি।

বিজ্ঞাপন

যানবাহনের তুলনায় বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর হার পৃথিবীর মধ্যে প্রায় শীর্ষে- প্রতি ১০ হাজার যানবাহনে ৮৫টি মৃত্যু। পশ্চিমা দেশগুলোর তুলনায় এ হার প্রায় ৫০ গুণ বেশি। ১০-১৪ বছর বয়সীদের মৃত্যুর অন্যতম কারণ সড়ক দুর্ঘটনা। একদিকে গণদুর্ভোগ, অন্যদিকে গণমৃত্যু দিয়ে দেশের সড়ক-মহাসড়কগুলো এখন নিয়মিত রক্তাক্ত। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এক হিসাবে সড়ক দুর্ঘটনার কারণে জিডিপির অন্তত ২ শতাংশ হারিয়ে যায়।

ত্রুটিপূর্ণ সড়ক, যানবাহন, অদক্ষ চালকসহ অনেক কারণ আমরা জানি। কিছু হয়তো ব্যবস্থার কথাও সরকার ভাবছে। কিন্তু সড়ক দুর্ঘটনা যে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে অপরাধ, এ থেকে বেরিয়ে আসতেই হবে – সেই সত্য মানতে চায়না আমাদের পরিবহন খাতের মালিক ও শ্রমিকরা। এদের জন্যই সড়কে গণমৃত্যু ঠেকাতে বা হত্যার বিচার করতে কোন আইন করা যায়না। পরিবহন খাতের পেশিশক্তিসম্পন্ন মালিক-শ্রমিকরা বারবার ক্ষমতা দেখিয়ে চলেছে। সমালোচনা বা বিরোধিতা নিয়ে তারা মোটেই চিন্তিত নন।

আমাদের মনে আছে তারেক মাসুদ ও মিশুক মুনীরকে বহনকারী মাইক্রোবাসকে চাপা দেওয়া বাসচালক জামির হোসেনের যাবজ্জীবন সাজার বিরুদ্ধে অনির্দিষ্টকালের পরিবহন ধর্মঘট ডাকা হয়েছিল। কোন ব্যবস্থা নিতে গেলে, এমনকি আদালতে আদেশের বিরুদ্ধেও এরা ধর্মঘট করে। যেন পরিবহন শ্রমিকরা খুনের অবাধ অধিকার চান।

বিজ্ঞাপন

এ দেশের সবচেয়ে উচ্ছৃঙ্খল খাত পরিবহন খাত। কিছুই বলা যায় না এদের। এরা মানুষ মারবে, পুলিশ ধরলে ধর্মঘট ডাকবে। এরা বিচারের ঊর্ধ্বে। যখন যে সরকার ক্ষমতায় থাকুক, এ খাতের শ্রমিক ইউনিয়ন বা মালিক সমিতির কর্তারা থাকেন ক্ষমতার কেন্দ্রে। ক্ষমতায় এরা এমন অবস্থানে, যেকোনও দুর্ঘটনার এসব হত্যাকাণ্ডে শেষ পর্যন্ত ভিকটিমরাই আবারও ভিকটিম পরিণত হন। মানুষ নিরাপদ চলাচলের জন্য সড়কে নামে, কিন্তু তারা জানেনা পথে পথে অপেক্ষা করছে তার জীবন কেড়ে নেযার সব আয়োজন।

সড়ক দুর্ঘটনার অধিকাংশের কোনও বিচার হয় না। কারণ বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দরিদ্র মানুষই দুর্ঘটনার শিকার হন। যারা পরিবহন মালিক তাদের আর্থিক ও রাজনৈতিক শক্তি আছে। যারা শ্রমিক, তাদের পেশিশক্তি প্রশ্নাতীত। আর দরিদ্র মানুষের মৃত্যু নিয়ে ভাববার সময় কোথায় আমাদের নীতি নির্ধারকদের? ফলে নৈরাজ্যই নিয়তি এই খাতে। প্রায় সব দুর্ঘটনার জন্য দায়ী চালকদের বেপরোয়া আচরণ। এই যে অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে নির্দিষ্ট গতিসীমা না মেনে গাড়ি চালানো, তার কারণ হলো, এই চালক মহাশয় জানেন যে তার কিছুই হবে না। কারণ তাদের নেতারা সরকারে থাকেন, বিরোধী দলেও থাকেন। পরিবহনের মালিকানায় আছেন রাজনীতিক, ব্যবসায়ী, এমনকি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর লোকজনও।

এত-এত গাড়ি বাণিজ্য হয়, কিন্তু ড্রাইভার প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানের বড় অভাব। সরকারিভাবে অপ্রতুল। পরিবহন মালিকরা প্রশিক্ষিত দক্ষ চালক ও সহকারী তৈরির কোনও উদ্যোগ আজ পর্যন্ত নেয়নি। যোগাযোগ ব্যবস্থা মোটেও গণকেন্দ্রিক নয়। পুরো ব্যবস্থাপনায় দুর্নীতি। বাণিজ্যিক স্বার্থের কাছে জনগণের স্বার্থ পরাজিত।

মানুষের কথা বিবেচনা করে রাষ্ট্রের এখন কঠিন হওয়ার সময়। সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর জন্য মৃত্যুদণ্ডের মতো কঠোর আইন প্রয়োজন। যারা আইন মানবেনা, যারা আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে অবস্থান নিবে সেইসব শ্রমিক সংগঠনের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া দরকার। তাদের নিবন্ধন বাতিল করা না হলে যখন-তখন যাত্রীদের জিম্মি করে অবৈধ সুবিধা আদায়ের সংস্কৃতি চলতেই থাকবে।

বিজ্ঞাপন

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা: এডিটর ইন চিফ সারাবাংলা.নেট, দৈনিক সারাবাংলা ও জিটিভি

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন