বিজ্ঞাপন

‘রোজিনা আমার ছেলের কাজ করতো’

April 23, 2018 | 9:10 am

।। জাকিয়া আহমেদ, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট ।।

বিজ্ঞাপন

ঢাকা: মেয়ে দুর্ঘটনার খবর পেয়ে ময়মনসিংহ থেকে রাজধানীতে ছুটে এসেছেন কৃষক রসুল মিয়া। ছয় মেয়ে আর এক ছেলের মধ্যে দুর্ঘটনায় পা হারানো রোজিনা ছিল দ্বিতীয়। ঢাকায় গৃহপরিচারিকার কাজ করে বাবার অভাবের সংসারে বেশ ভাল ভূমিকা রাখতো সে। অথচ রাজধানীর বেপরোয়া বাস এখন তাকে পঙ্গু করে দিয়েছে। কেবল পঙ্গুই নয় চিকিৎসকরা বলছেন, রোজিনার অবস্থা এখনও শঙ্কামুক্ত নয়। এই অবস্থায় একজন দরিদ্র বাবার অভিব্যক্তি কতটা করুন আর অসহায় হতে পারে তা কেবল রসুল মিয়াকে দেখেই বোঝা যায়।

সংসারে অভাব ঘোচাতে ছোট বয়সেই রোজিনাকে গৃহকর্মী হিসেবে ঢাকায় পাঠান। তারপর থেকেই সংসারের হাল ধরেন রোজিনা। অথচ সংসারের সেই হাল ধরা ‘ছেলে রোজিনা’-র জীবন আজ সংকটাপন্ন। হাসপাতালে মেয়ের বিছানার পাশে বসে রসুল মিয়া অসহায় তাকিয়ে থাকেন, আবার উদভ্রান্তের মতো পায়চারি করেন। তার এমন নির্বাক পায়চারী বুকের ভেতরে হাজারো কষ্টের কথা বলে নীরবে-নি:শব্দে।

রসুল মিয়া বলেন, ‘আমি খুবই একজন অসহায় বাবা। সংসার চালানোর ক্ষমতা আমার ছিল না, সেখানে রোজিনা স্যারের বাসায় কাজ করে আমাকে সাহায্য করতো। উপার্জনের পুরো টাকাটাই তুলে দিতো আমার হাতে, কোনওদিন নিজের জন্য কিছু রাখেনি।’

বিজ্ঞাপন

গত ২০ এপ্রিল (শুক্রবার) রাত ৯টার দিকে রাজধানীর বনানীর চেয়ারম্যান বাড়ি এলাকায় যাত্রীবাহী একটি বিআরটিসি বাসের চাপায় রোজিনা আক্তার গুরুতর আহত হন। দুর্ঘটনার পর পথচারীরা তাকে উদ্ধার করে পঙ্গু হাসপাতালে ভর্তি করেন এবং পরে চিকিৎসকরা তার ডান পা কেটে ফেলতে বাধ্য হন। এদিকে চিকিৎসকরা বলছেন, ডান পা কেটে ফেলা হয়েছে, তারপরও রোজিনার অবস্থা সংকটাপন্ন। পায়ের বাকি অংশও ফেলে দিতে হয়েছে।

রোববার (২২ এপ্রিল) জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুর্ণবাসন প্রতিষ্ঠানে (পঙ্গু হাসপাতালে) গিয়ে দেখা যায়, অচেতন রোজিনার বেডের পাশে রয়েছেন বাবা রসুল মিয়া, ছোট বোন তানজিলা এবং দাদি রাশিদাসহ অন্য স্বজনরা। তারা উদ্বিগ্ন, শঙ্কিত। আর অচেতন হয়ে শুয়ে থাকা রোজিনার বাম হাতে মেহেদি, নখে লাল নেইল পলিশ দেওয়া, চুলগুলো ছড়ানো, মুখে কিশোরীর লাবণ্যতা।

এরই মাঝে বোন তানজিলা একটি ভেজা রুমাল দিয়ে রোজিনার মুখ মুছিয়ে দিচ্ছে, গায়ের ওপর থাকা চাদর ঠিক করে দিচ্ছেন দাদি। আর বাবা অসহায় মুখে তাকিয়ে আছেন মেয়ের মুখের দিকে।

বিজ্ঞাপন

রোজিনার চিকিৎসার জন্য ইতোমধ্যে হাসপাতালটির পরিচালক অধ্যাপক ডা. আব্দুল গনি মোল্লাহর নেতৃত্বে ৪ সদস্যের মেডিকেল বোর্ড গঠন করা হয়েছে।

অপারেশন শেষে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন চিকিৎসক সারাবাংলাকে বলেন,‘দুর্ঘটনায় রোজিনার যে ক্ষতি হয়েছে তা থেকে রিকভারি না করলে তাকে বাঁচানো যাবে না। কারণ হিসেবে ওই চিকিৎসক জানিয়েছেন, দুর্ঘটনায় রোজিনার উরুর চামড়া থেকে মাংসের লেয়ার পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। এ কারণে তার বাইরের চামড়া মরে গেছে। ভেতরের মাসলের কিছু কিছু অংশও অকার্যকর হয়ে গেছে। শরীরে সেপ্টিসেমিয়ার আশঙ্কা রয়েছে। ’

এই চিকিৎসক বলেন, এসব কারণে সবাই রোগীকে নিয়ে রিস্কি অবস্থায় আছে। রোজিনার চিকিৎসায় গঠিত মেডিকেল বোর্ডের পরামর্শেই এখন থেকে তাঁর চিকিৎসা হবে। মরা চামড়া রিকভারি করা গেলেই কেবল রোজিনাকে বাঁচানো সম্ভব হবে জানান ওই চিকিৎসক।

বিজ্ঞাপন

অপরদিকে, পঙ্গু হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. আব্দুল গনি মোল্লাহ বলেন, আমরা আমাদের সাধ্যমতো চেষ্টা করছি, আমাদের চিকিৎসার কোনও ত্রুটি নেই। তবে যদি রোগীর পরিবার চায়, তাহলে তারা বিদেশে নিয়ে যেতে পারেন।

গৃহকর্মী রোজিনা আক্তার সারাবাংলা ও জিটিভির এডিটর-ইন চিফ সৈয়দ ইশতিয়াক রেজার বাসায় গৃহকর্মী হিসেবে রয়েছে অনেক বছর ধরে।

‘সেদিন আমার মেয়ে রাস্তায় পড়ে ছিল কতোটা সময়, কিন্তু কেউ তাকে ধরেনি। সবাই খালি ভিড় করছে, সবাই নাকি বলছে-এটা পুলিশ কেস, ধরলেই পুলিশি ভেজালে যেতে হইবো।

তাই বইল্যা মানুষ মাইনষ্যের বিপদে আগায়ে আসবো না বলেই হাউমাউ করে কাঁদেন রসুল মিয়া। আমার মাইয়াটা কত কষ্ট পাইছে-সেইটা মনে হইলেই আমার বুকটা জ্বালাপোড়া করে। যেইখানে বাবা হইয়া মাইয়ারে আমার দেহার কতা, সেইখানে মাইয়া আমার আমারে দেখতো-আমার সেই মাইয়া আজ’….আর কিছু বলতে পারেননা রসুল মিয়া।

কিছুটা সামলে নিয়ে বলেন, ‘সেদিন কেউ আগায়ে না আসলেও ইঞ্জিনিয়ার নরজুল (নজরুল) নামের একজন এগিয়ে আসছে, হাসপাতালে ভর্তি করাইছে।’

‘তার ফোন নাম্বার আমি আজকে পাইছি’- একথা বলেই ফোনে সেভ করা রোজিনাকে হাসপাতালে নিয়ে আসা সেই লোকের নাম্বার দেখান রসুল মিয়া।

দেখা যায়, রসুল মিয়ার ফোনে ‘নরজুল (নজরুল) বাবা’ নামে তার ফোন নম্বর সেভ করা। কোনও প্রশ্ন করার আগেই তিনি বলেন, এই নরজুল (নজরুল) সাহেবই বনানীতে সেদিন দুর্ঘটনার পর রোজিনাকে পঙ্গু হাসপাতালে নিয়ে আসেন। হাসপাতালে আনার পর তার রক্তের সঙ্গে গ্রুপ মিলে যাওয়াতে রোজিনাকে রক্তও দেন তিনি। যে আমার এত বড় উপকার করছে-সেতো আমার বাবা-ই।

এ ঘটনায় বিআরটিসির ডাবল ডেকার বাসটিকে জব্দ ও বাসের চালক শফিকুল ইসলাম সুমনকে (৩২) ওইদিনই আটক করে পুলিশ। শনিবার বনানী থানার এসআই মিজানুর রহমান সুমনকে মহানগর মূখ্য হাকিমের আদালতে হাজির করে ৭ দিনের রিমান্ড চান। পরে ম্যাজিস্ট্রেট গোলাম নবীর আদালত একদিনের রিমাণ্ড মঞ্জুর করেন।

সারাবাংলা/জেএ/এমএস

** দ্রুত খবর জানতে ও পেতে সারাবাংলার ফেসবুক পেজে লাইক দিয়ে রাখুন: Sarabangla/Facebook

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন