বিজ্ঞাপন

‘শরীরের ক্যান্সার দূর করা যায়, মনের ক্যান্সার দূর করা যায় না’

December 15, 2018 | 12:28 pm

পরাধীনতার শৃঙ্খল মুক্তির আনন্দের পাশাপাশি স্বজন হারানোর বেদনা নিয়ে ১৬ ডিসেম্বর জাতি উদযাপন করবে বিজয়ের ৪৭তম বার্ষিকী। বিজয়ের উল্লাসে মেতে উঠবে পুরো দেশ। নানা আয়োজনে স্বাধীনতার বীর যোদ্ধাদের স্মরণ করার পাশাপাশি জাতি ধিক্কার জানাবে স্বাধীনতা বিরোধীদের প্রতিও।

বিজ্ঞাপন

৪৭তম মহান বিজয় দিবসের প্রাক্কালে সারাবাংলা ডট নেট এর পাঠকদের কাছে নিজের বিজয় ভাবনা তুলে ধরেছেন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অন্যতম সঙ্গীত পরিচালক ও কণ্ঠযোদ্ধা সুজেয় শ্যাম। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শেষ গান এবং স্বাধীনতার প্রথম গানের সুর স্রষ্টা তিনি। মুক্তিযুদ্ধের সময়ে স্বাধীন বাংলা বেতারে প্রচারিত তার সুর করা গানগুলো আজও দেশপ্রেমের প্রেরণা জোগায়। ‘বিজয় নিশান উড়ছে ঐ’, ‘রক্ত দিয়ে নাম লিখেছি, বাংলাদেশের নাম’, ‘আজ রণ সাজে বাজিয়ে’, ‘ মুক্তির একই পথ সংগ্রাম’, ‘ওরে আয়রে তোরা শোন’,  ‘আয়রে চাষী মজুর কুলি’, ‘ রক্ত চাই, রক্ত চাই’, ‘আহা ধন্য আমার’–এই গানগুলো একাত্তরে রণাঙ্গনে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রেরণা দিয়েছিল।প্রখ্যাত এই সঙ্গীত পরিচালকের বিজয় ভাবনা নিয়ে মুখোমুখি হয়েছিলেন সালেহীন বাবু

 

একদিন পর বাঙালি জাতির গৌরবের ৪৭তম বিজয় দিবস ।  আর তিন বছর পর বিজয় দিবসের ৫০ বছর পূর্তি হবে। আপনার অনুভূতি কী?

বিজ্ঞাপন

সুজেয় শ্যাম : এই যে স্বাধীন দেশের ৪৭ তম বিজয় দিবস উদযাপিত হচ্ছে, সবচেয়ে কষ্ট হয় তথাকথিত কিছু রাজনীতিবিদ আছেন (সব রাজনীতিবিদদের কথা বলছি না, বিশেষ কিছু রাজনীতিবিদ) যাদের দিকে আগামী প্রজন্ম চেয়ে থাকে। তারা মুক্তিযুদ্ধসহ বাংলাদেশের সব ইতিহাস জানেন, তারা লেখাপড়া জানেন তাদের মুখ থেকে যখন সকালে এক কথা রাতে এক কথা শুনি তখন বড় কষ্ট হয়। ৩০ লাখ মানুষ এ দেশের জন্য জীবন দিয়ে গেছে। আজকে আমাদের দেশে কোন পাকিস্তানি নেই। আমরা সবাই বাঙালি। বঙ্গবন্ধুর ডাকে আমরা দেশ স্বাধীন করেছিলাম। তারপরেও কেন জানি না এখনও আমরা সেই জামাতকে ছাড়তে পারি না। আজকে স্বাধীন দেশে নির্বাচন। দেখা যায় অনেকে এই জামাতের সাথে হাত মিলাল। কারা মিলালো যারা  এই দেশের ব্যাক্তিত্ব। ভাবতেই খুব কষ্ট হয়।


আরও পড়ুন :  ‘আমজাদ হোসেনের মৃত্যুতে প্রিয়জন হারানোর ব্যথা পেয়েছি’


অসাম্প্রদায়িক ও মানবিক  বাংলাদেশ গঠনে আমরা কতটুকু সফল?

সুজেয় শ্যাম : আজকে এই দেশ দুই ভাগ হয়ে গেছে। এটাই সবচেয়ে দুঃখের ব্যাপার। এই দুই ভাগের মধ্যে রাজাকাররা ভাগ হয় নাই। মুক্তিযোদ্ধারা ভাগ হয়েছে। এগুলো সবচেয়ে আফসোসের ব্যাপার। এখনও সাম্প্রদায়িক চেতনা আছে। কিছু কিছু মানুষ এখনও বিপথগামী। আমি অসুস্থ ছিলাম। আমাকে যেভাবে এই দেশের মানুষ, আমার ভাই-বোনেরা আমাকে সমর্থন জানিয়েছে আমি কৃতজ্ঞ। আসলে এই দেশের মত দেশ হয় না।

বিজ্ঞাপন

সংকটের মূল সমস্যা কোথায় এবং তা থেকে উত্তরণের পথ কি ?

সুজেয় শ্যাম : কিছু মানুষ আছে, এর মধ্যে শিক্ষিত মানুষই দেখি। অশিক্ষিতরা যেমন একজন রিকশাওয়ালা একজন দিন-মজুর দেশ সম্বন্ধে জানে। তারা দেশকে ভালবাসেন। আজকে (শুক্রবার) আমাকে সকালবেলা বাচ্চা একটা ছেলে প্রশ্ন করেছে, ‘চাচা আপনারা দেশ স্বাধীনের কথা বলেন। মুক্তিযুদ্ধের কথা বলেন। রাজাকারের কথা বলেন। কিন্তু আমরা তো দেখি কয়েকদিন আগেও যারা জামাতকে বকা দিত তারা কিভাবে জামাতের সাথে হাত মিলালো। ওনারা আবার মুক্তিযোদ্ধাও ছিলেন। তখন আমি কোনো উত্তর দিতে পারিনা। কি উত্তর দেব ? আজকে যারা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কথা বলে আমি বুঝিনা এখানে পক্ষ-বিপক্ষের কি হল। এ ধারণা আসবে কেন? স্বাধীনতা সবার জন্য।

কালকে ছিল বুদ্ধিজীবি দিবস। ওনারা জামাতের সাথে হাত মিলাল কি দেশকে দুই ভাগ করার জন্য। তাও এই সময়ে। এখানে অন্য কোনো দেশের লোক নেই। সবইতো বাঙালি। এর মধ্যেই দেশ চলে যাবে। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন আমরা পূরণ করব যেভাবেই হোক। কিছু কিছু মানুষ পঁচাত্তরের পরে মুক্তিযুদ্ধকে ভুলে গেছে। অথচ তারা অনেকেই মুক্তিযুদ্ধ করেছেন। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধকে ভুলে গেলেন। মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ থেকে বিচ্যুত হলেন। এর থেকে কষ্ট আর কি হতে পারে।


আরও পড়ুন :  বরেণ্য চলচ্চিত্রকার আমজাদ হোসেন আর নেই


স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সঙ্গে জড়িয়ে পড়া কিভাবে?

বিজ্ঞাপন

সুজেয় শ্যাম : স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের কার্যক্রম শুরু হয় একাত্তরের ২৫ মে। বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের জন্মদিনে নতুন দেশের স্বপ্ন নিয়ে কলকাতার বালিগঞ্জে এর যাত্রা। কিন্তু সেই মাহেন্দ্রক্ষণে আমার উপস্থিত থাকার সৌভাগ্য হয়নি। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে আমার যাওয়ার সৌভাগ্য হয়েছিল আরও বেশ কিছুদিন পর। জুন মাসে সেখানে যাওয়ার পরপরই দেখা হয় আশফাকুর রহমানের সঙ্গে। তিনি সঙ্গীত বিভাগের দায়িত্বে ছিলেন। আমাকে দেখেই একবিন্দু অবসরের সুযোগ দেননি। সেদিনই নতুন একটি গান করার অনুরোধ করেছিলেন। ওই দিনই ২৫ জন্য শিল্পীকে নিয়ে রেকর্ড করেছিলাম কবি দিলওয়ারের লেখা ‘আয়রে চাষি মজুর’ গানটি। সেই শুরু। এরপর একে একে ৯টা গান করেছি। তার মধ্যে অন্যতম আবুল কাশেম সন্দ্বীপের লেখা ‘রক্ত দিয়ে নাম লিখেছি, বাংলাদেশের নাম’। এই গান আমাকে দিয়ে সুর করানো হবে, এটা ছিল নিয়তি নির্ধারিত। কেন এই কথা বলছি, তা সে সময়ের একটি ঘটনা বললেই স্পষ্ট হবে। যেখানে আমরা কাজ করতাম সেটা ছিল বালিগঞ্জের একটা দোতলা বাড়ি। একদিন স্টুডিওর দোতলা থেকে নেমে আসছি এমন সময় পেছন থেকে শুনতে পেলাম কেউ একজন ডাকছে- ‘দাদা, একটু শুনবেন?’ আমি ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালাম। দেখি সন্দ্বীপ দাঁড়িয়ে। আমি দাঁড়ালাম। বললাম, কী খবর? কয়েক ধাপ নেমে এসে ও বলল, ‘দাদা, আমি একটা গান লিখেছিলাম। সমর দাকে দিতে পারি না। ভয় করে। আপনি যদি একটু দেখেন।’ আমি হাতে নিয়ে পড়লাম। আমার খুব ভালো লাগল। মুখটা খুব সুন্দর। রক্তবিন্দু দিয়ে একটি দেশের জন্মের বার্তাই যেন সে গানে দারুণভাবে উঠে এসেছে। ঠিক বঙ্গবন্ধুর বলা কথাগুলো যেন কাব্যের রূপ পেয়েছে। সমর দা এই গীতিকথা পড়লে কোনোভাবেই সন্দ্বীপকে ফিরিয়ে দিতেন বলে আমার মনে হয় না। আমিও সন্দ্বীপকে ফেরাতে পারিনি। তাই পরদিনই গানটিতে সুর করি। এটা ছিল আমার সুর করা দ্বিতীয় গান। দুই-একদিনের মধ্যে গানটির রেকর্ডিং করি। পরে নিয়মিত বাজানো হতো গানটি। এখনও যখন এ গানটি কানে ভেসে আসে, তখন সেসব দিনের স্মৃতি চলচ্চিত্রের মতো দেখতে পাই। ভাবি, এখন চাইলেও এমন কোনো গান আর তৈরি করতে পারব কিনা। আমি নিশ্চিত, তারুণ্যের উদ্দীপনায় যে গানগুলো তৈরি করতে পেরেছি তখন, তার মতো আর কোনো গান আর করতে পারব না।

মুক্তিযুদ্ধের কোনো বিশেষ স্মৃতি কি আছে যা আপনাকে এখনও প্রেরণা দেয়, তাড়িয়ে বেড়ায়?

সুজেয় শ্যাম : একাত্তরে ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণের পর বাঙালিদের ভয় কমে গিয়েছিল। আমি আমার পরিবারের পাশে থাকার জন্য এর কদিন পরই সিলেট চলে যাই। সেখানে গিয়ে একটা অনুষ্ঠানও করি। এরপর আসে ২৫ মার্চের সেই কালরাত। একটানা কারফিউর পর আমরা যখন বাইরে বের হই, তখন পুরো সিলেট টাউন একটা কবরস্থান হয়ে ছিল। এ অবস্থায় আমি আমার পরিবারসহ সাতটি পরিবার নিয়ে গ্রামের দিকে রওনা দিই। উদ্দেশ্য ভারত সীমান্ত পেরোনো। সেই যাত্রাপথে যে যেভাবে পেরেছে, আমাদের সাহায্য করেছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যে বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেছিলেন, ৯ মাসের মুক্তি-সংগ্রামের সময় আমি বাংলার মানুষের ভেতর সেই বাংলাদেশের ছায়া দেখেছি। সিলেট টাউন থেকে আমরা গিয়েছিলাম সিলেটের ঢাকা দক্ষিণ গ্রামের দিকে। সেখানে এক জমিদার বাড়িতে সাতটি পরিবারের আশ্রয় হয়। এক সপ্তাহ ধরে আমি একেকটি করে পরিবার নিয়ে ভারতের সীমান্তে দিয়ে আসতাম। যে বাসে করে আমরা যেতাম, সেই বাসের ড্রাইভার আমাদের থেকে কখনোই ভাড়া নিত না। সবশেষ জমিদার বাড়ি থেকে জকিগঞ্জ সীমান্ত দিয়ে ভারতে যাই আমরা, মানে আমাদের পরিবার। কিন্তু ততক্ষণে পাকিস্তানি বাহিনী আমাদের অবস্থানের কথা জেনে যায়। আমরা বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাওয়ার একদিন পরই খবর পাই, জমিদার বাড়িটি আগুনে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে এই কাজটা হয়। মনে হচ্ছিল, আমরাও কয়েক ঘণ্টার জন্যই প্রাণে বেঁচে যাই। জকিগঞ্জ সীমান্ত পেরোনোর পর আমি আমার পরিবারকে নিরাপদ আশ্রয়ে রেখে ১৯৭১ সালের ৮ জুনের দিকে যোগ দেই স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে।


আরও পড়ুন :  সময় নেই জয়ার, তিশা দিলেন সময়


মাঝে আপনি অসুস্থ ছিলেন। এখন কেমন আছেন?

সুজেয় শ্যাম : শরীরতো ভালই ছিল। চারপাশে নানা অসামঞ্জস্য দেখে অসুস্থ হয়ে গেছি। মানুষ ক্যান্সার আমাকে শেষ করে দিচ্ছে। বুদ্ধিজীবি দিবসে ছেলেটা আমাকে যে প্রশ্ন করেছে তার উত্তর আমি দিতে পারি নাই। কি বলব। আমার শরীরের অসুখের ঔষধ আছে। কিন্তু মানুষ ক্যান্সারের ঔষধ তো আমার কাছে নেই। শরীরের ক্যান্সার দূর করা যায়, মনের ক্যান্সার দূর করা যায় না। যারা জামাতকে ভালোবেসে তাদের পক্ষ নিচ্ছে তারা কোনোভাবেই দেশকে ভালবাসতে পারে না। তারা টকশো করে, মিছিল মিটিং করে, বড় বড় কথা বলে তারা কি দেশটার কথা একবারও ভাবে না। ৩০ লাখ মানুষ জীবন দিয়েছিল এ দেশের জন্য তাদের কথা একবার ভাবেন। আসলে যার দেশ তারই ব্যথা লাগে। যেমন আমার লাগে। ওদের কষ্ট লাগবে না। তবে আমি আশাবাদী এই দেশ সব ষড়যন্ত্রকে রুখে দিয়ে বঙ্গবন্ধুর আদর্শেই এগিয়ে যাবে।

স্বপ্নের বাংলাদেশ গড়তে তরুণদের প্রতি আপনার বার্তা…

সুজেয় শ্যাম : তরুণ প্রজন্মকে বলছি তোমরা ইতিহাস দেখো, সত্যিকারের ইতিহাস জানো। যদি আমরা এই দেশকে বাঁচাতে চাই তাহলে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার পতাকাতলে যেতে হবে। কারণ আমরা যারা স্বাধীনতাকে বিশ্বাস করি শেখ হাসিনার পতাকাতলই আমাদের শেষ আশ্রয়স্থল। তরুণরা বঙ্গবন্ধুর আদর্শে উজ্জীবিত  হবে। আমরা শিল্পী। শিল্পী সমাজ বলেন তরুণ বলেন মোট কথা পুরো জাতির আশা ভরসা জননেত্রী শেখ হাসিনা। তার কাছেই যেতে হবে।

সারাবাংলা/পিএম


আরও দেখুন :  একজন আমজাদ হোসেন [ভিডিও স্টোরি]

Tags: , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন