বিজ্ঞাপন

শিক্ষার মান ও উদ্ভাবনী দক্ষতা, আমরা কোথায়?

September 17, 2018 | 7:52 pm

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০১৮-১৯ শিক্ষাবর্ষে ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদের অধীন ‘গ’ ইউনিটের ১ম বর্ষ স্নাতক সম্মান শ্রেণির ভর্তি পরীক্ষায় ৮৯ দশমিক ০২ শতাংশ পরীক্ষার্থী ফেল করেছেন। পরীক্ষায় পাসের হার মাত্র ১০ দশমিক ৯৮ শতাংশ।

বিজ্ঞাপন

এদিকে Global Innovation Index 2018 report বলছে বাংলাদেশ এশিয়ায় সবচেয়ে কম উদ্ভাবনী দক্ষতার দেশ।

দুটোই সোমবারের খবর। দুটো তথ্যই আমাদের বলে দিচ্ছে শিক্ষার মাপকাঠিতে বাংলাদেশ বিশ্ব শুধু নয়, এশীয় বা দক্ষিণ এশীয় গড়ের তুলনায় পিছিয়ে রয়েছে। মানুষের মাঝে উদ্ভাবনী ক্ষমতা তৈরি হয় ভাল শিক্ষা থেকে। এই যে এত এত ছেলে মেয়ে এসএসসি ও এইচএসসিতে এত ভাল ফল করে শেষ পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় পাশ করতে পারেনা, কিংবা আমরা যে এত পিছিয়ে থাকি উদ্ভাবনে তার সবই আসলে শিক্ষার মান নিয়ে আলোচনা করতে শেখায়।

নানা সীমাবদ্ধতার মধ্যে বাংলাদেশে শিক্ষার অগ্রগতি হলেও তা টেকসই নয়। ভাল বই পাচ্ছে না শিক্ষার্থীরা, ভিড়ে ঠাসা শ্রেণিকক্ষ এবং সেখানে ভাল শিক্ষকের অভাবও প্রকট। প্রতিবছর আমরা নতুন বই তুলে দিচ্ছি ছেলে মেয়েদের হাতে। এটি ভাল কাজ। আর এমন একটি ভাল কাজের জন্য সরকারকে ধন্যবাদ প্রতিবছরই আমরা দেই। শিক্ষার জন্য অভিভাবকদের আগ্রহ বেড়েছে, শিক্ষায় রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগ বেড়েছে। চার দশকের বেশি সময় ধরে সরকার, দাতা ও বেসরকারি সংস্থার চেষ্টায় এবং সমাজ সচেতন হওয়ায় স্কুলে যাওয়ার একটা সচেতনতা তৈরি হয়েছে।

বিজ্ঞাপন

এসব আমরা উন্নতি হিসেবেই ধরবো। আমরা দাবি করে চলেছি যে, বাংলাদেশ শিক্ষায় এগিয়ে গেছে। কিন্তু কিভাবে এগুচ্ছি? প্রশ্ন হলো এগুতে থাকলে উদ্ভাবনী দক্ষতায় পিছিয়ে কেন? প্রাথমিক শিক্ষার মান মাধ্যমিককেও নিয়ন্ত্রণ করে এবং এই দুই স্তরের শিক্ষায় দুর্বলতা উচ্চশিক্ষায় প্রভাব ফেলে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে একাডেমিক বছরের শুরুতে ভর্তি পরীক্ষার সময় শুনি জিপিএ-৫ পেয়েও ভর্তি-ইচ্ছুকদের অনেকেই বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারছে না। শিক্ষার মানের অবস্থা বোঝার জন্য এটি একটি বড় দৃষ্টান্ত।

আসলে সমস্যার পরিধিটা বিরাট। বিশেষত এই কারণে যে, শুরুটাই হচ্ছে পিছিয়ে থেকে। কাজ অনেক প্রত্যেক স্কুলে বিদ্যুৎ পৌঁছে দেয়া, শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দেয়া, গ্রামের স্কুলে কম্পিউটার নিয়ে যাওয়া এবং সবার উপরে স্কুলগুলোতে লেখাপড়ার মান উন্নত করা। শিক্ষার মূল জায়গা শ্রেণিকক্ষ, শিক্ষকরা হলেন শ্রেণিকক্ষের প্রাণ। তাই শ্রেণিকক্ষে লেখাপড়া নিশ্চিত করতে পারলে এবং শিক্ষককে শক্তিশালী করা গেলে গুণগত মান আরও বাড়বে।

শিক্ষকদের আচরণও বড় প্রশ্ন হয়ে উঠছে। শিক্ষার্থীরা সিলেবাস শেষ করল কিনা, সেটিই এখন শিক্ষকদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ, কি শিখল তা নয়। অভিভাবকের কাছে গুরুত্বপূর্ণ ভাল ফলাফল। কিন্তু তারা কী শিখল, সেটি গুরুত্ব পাচ্ছে না। এর ফলে বর্ণমালা না শিখেই অনেকে তৃতীয় শ্রেণিতে উঠেছে। পঞ্চম শ্রেণিতে গিয়ে মাত্র এক-চতুর্থাংশ শিক্ষার্থী বাংলায় এবং এক-তৃতীয়াংশ শিক্ষার্থী গণিতে দক্ষতা অর্জন করছে। শিক্ষক-শিক্ষার্থীর মধ্যে পারস্পরিক বোঝাপড়া ছাড়া শিক্ষার গুণ ও মান নিশ্চিত হয়না। এযুগে শিক্ষক-ছাত্র সম্পর্ক কেবল টাকার সম্পর্ক। গুণ ও মানের বদলে এখন কত ভাগ পাস করল, কতজন জিপিএ-৫ পেল, তা নিয়ে দৌড়ঝাঁপ চলে। সত্যি বলতে কি এজন্য শিক্ষার্থীরা নয়, নীতিনির্ধারক, শিক্ষক, শিক্ষা প্রশাসনের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরাই দায়ী এসবের জন্য।

বিজ্ঞাপন

শিক্ষকের মান নিয়েই ভাবার সময় এখন। স্কুলের ভবন, শ্রেণিকক্ষ ভাল হচ্ছে, কিন্তু যোগ্য শিক্ষক পাচ্ছিনা আমরা। গুণগত শিক্ষা চাইলে মানসম্মত শিক্ষক দরকার, যা খুবই কম। শ্রেণিকক্ষে লেখাপড়া নেই। গরিব পরিবারের সন্তান প্রাইভেট পড়তে পারে না, গাইড বই পড়তে পারে না। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অদক্ষ শিক্ষক নিয়োগ দেয়া আমাদের দীর্ঘ দিনের রাজনৈতিক সংস্কৃতি। ফলে শিক্ষার্থীরা যথাযথ জ্ঞান থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। যিনি অর্থনীতি পড়াচ্ছেন তিনি অর্থনীতিবিমুখ। ইতিহাসের শিক্ষক ইতিহাসে কাঁচা। বিজ্ঞানের শিক্ষকতো নেই বললেই চলে। অংক আরো বড় সমস্যা। আর ইংরেজির বেহাল দশাতো বলাই বাহুল্য। শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার পাশাপাশি শিক্ষকতা পেশায় মেধাবীদের আগ্রহী করে তোলার কাজটি করতে হবে রাষ্ট্রকে।

স্কুলে কিছু না শেখার সাথে আরেকটি বড় সমস্যা হলো অতি-গৃহশিক্ষকনির্ভরতা। সরকারি বা বেসরকারি, কোনও স্কুলেই ছাত্রদের শিক্ষার মান সন্তোষজনক নয়। গৃহশিক্ষক নিয়োগের প্রবণতা এখন পুরো সমাজকে পেয়ে বসেছে। স্কুলের খাতায় নাম থাকা আর সত্যই লেখাপড়া শেখার মধ্যে সম্পর্ক ক্ষীণ হয়ে আসছে। এমন বাস্তব স্বস্তিদায়ক হতে পারে না। গৃহশিক্ষক-নির্ভরতার চড়া হার এই স্কুলব্যবস্থার প্রতি অনাস্থার প্রকাশ। কেন বিদ্যালয়ে লেখাপড়া শেখা এক রকম অসম্ভব হয়ে উঠছে, এই প্রশ্নটিকে শিক্ষাবিষয়ক আলোচনার মূলে নিয়ে এসেই সমাধান খুঁজতে হবে।

আমরা যতই চিৎকার করিনা কেন, সমস্যা আসলে রাজনৈতিক। আজকাল সবকিছুতেই রাজনীতি। শিক্ষকতার চাকুরিকে রাজনৈতিক আনুগত্যের পুরস্কার হিসাবে ব্যবহার করা। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক হবার প্রধান, কার্যত একমাত্র, যোগ্যতা শাসকদলের ঝাণ্ডা বাহক হতে পারা। শাসক বদলায়, কিন্তু অভ্যাস থেকে যায়। রাজনীতির ঠিক দিকে থাকতে পারলেই আর কোন চিন্তা নেই, অভিজ্ঞতাসঞ্জাত এই বিশ্বাসটি আমাদের সরকারি স্কুলগুলিকে সম্পূর্ণ ধ্বংস করেছে। এখন নিস্তার পাচ্ছে না বেসরকারি স্কুলও। এই ছবি বদলাবার দায়িত্ব সরকারের যদি মানসম্মত শিক্ষা সত্যিই চাওয়া হয়।

শিক্ষকরা বেতন ভাতা নিয়ে যত কথা বলেন, ততটা বলেননা শিক্ষা নিয়ে। শিক্ষাদানের উপযুক্ত অবকাঠামো, গবেষণার পরিবেশের উন্নতি ইত্যাদি নিয়ে বিশেষ মাথাব্যথা নেই আমাদের। শিক্ষামন্ত্রী আশ্বাস দিয়ে যাচ্ছেন শিক্ষকদের ব্যাপকহারে এমপিওভুক্ত করার কথা সরকার বিবেচনা করছে। কিন্তু শিক্ষার মান উন্নয়নের সাথে শিক্ষকদের এই খুশি করার একটি সামঞ্জসতা তৈরি করা দরকার। শিক্ষকসমাজের মধ্যে বেতন-ভাতামুখী মানসিকতা প্রোথিত করে দিয়ে আমরা সচচেয়ে বড় ক্ষতিটা করেছি।

বিজ্ঞাপন

প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার বুনিয়াদটি নড়বড়ে থাকায় কেবল উচ্চশিক্ষার ভর্তি পরীক্ষায় নয়, রাজনীতি, প্রশাসনসহ সমাজ ও জাতীয় জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রই অপরিণত, অনুন্নত থেকে যাবে। দেশের বিভিন্ন ক্ষেত্রের দিকে তাকালে এই সার্বিক অবনমনের চিত্রটি বোঝা যায়। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষার দুর্বল ভিত্তি যে সেই অধঃপাতের অন্যতম কারণ, তা অস্বীকার করার উপায় নেই। দুর্নীতিপরায়ণ ও অপরাধপ্রবণ রাজনীতিক, ফাঁকিবাজ আমলা, দলীয় পক্ষপাতদুষ্ট অদক্ষ আমলাতন্ত্র, দুর্নীতিবাজ সেবাদানকানরী সংস্থা — এ সব কিছুর পিছনেই শৈশব-কৈশোরের অসম্পূর্ণ, খণ্ডিত প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষার অবদান জাতি বয়ে বেড়াচ্ছে।

||সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা, এডিটর ইন চিফ সারবাংলা.নেট ও জিটিভি||

সারাবাংলা/এমএম

Tags: , , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন