বিজ্ঞাপন

শিল্পে বাঁচি আর বাঙালিয়ানায় সাজাই ঘর

April 9, 2018 | 3:37 pm

রাজনীন ফারজানা।।

বিজ্ঞাপন

ঠিক কবে থেকে ঘর সাজানোর আগ্রহ শুরু তা মনে নেই চিত্রশিল্পী পীযুষ সরকারের। তবে ছোটবেলা থেকেই সাজানো গোছানো ঘরদোর খুব পছন্দ করতেন। বিশেষত মাকে দেখতেন সুন্দর করে কাঁথা সেলাই করতে। কাপড়ের উপর সুতা আর সূচের চমৎকার বুননে ফুঁটে উঠত অসাধারণ সব শিল্পকর্ম। সেই শিল্পের সাথে বসবাসই তার শিশুমনে সৌন্দর্যবোধের বীজ বপন করেছিল। তারপর সেই বীজ দিনে দিনে ডালপালা মেলে মহীরুহ হয়ে উঠেছে। এভাবেই তিনি শিল্পী হয়েছেন, আর তার গৃহকোণ হয়ে উঠেছে এক শিল্পের ভাণ্ডার।

 

বিজ্ঞাপন

 

পীযুষ সরকার ও তার শিক্ষক স্ত্রী সাগরদীপার বাসাটি ছোট্ট কিন্তু দারুণ ছিমছাম। পুরো বাসাটাই এমনভাবে সাজানো যেন সমস্তটাই একটা ছবির ক্যানভাস। শিল্পীর নিজের পছন্দ ল্যান্ডস্কেপ বা প্রাকৃতিক ভূচিত্রের রিয়েলিস্টিক ঘরানার ছবি। ঘররূপী ক্যানভাসের বেইজ কালার হিসেবে বেছে নিয়েছেন সাদা।

 

বিজ্ঞাপন

 

দেওয়ালে সাদা রঙে যেমন মনের আর চোখের আরাম হয় তেমনি হালকা রঙের প্রেক্ষাপটে ঘর সাজানোর বাকি উপাদানগুলো অর্থাৎ সাবজেক্ট ফোকাস হয়। আর শিল্পীর ঘরের বাদবাকি সাবজেক্টগুলোও দেখার মতই বটে!

 

বিজ্ঞাপন

 

ঘরময় সাজানো নানা দেশ থেকে সংগ্রহ করা ছোট ছোট পুতুল, শো পিস, ডোকরার মূর্তি, চুড়ি, শঙ্খ, টেপা পুতুল, বাটি, লক্ষির সরা, কালিঘাটের পটচিত্র। আছে পারিবারিক স্মৃতিমন্ডিত কাঁসা আর পিতলের থালাবাসন, পূজার উপকরণ। এসব থালাবাসন কোন কোনটার বয়স একশ কিংবা দেড়শ বছরেরও বেশি। সেই সাথে আছে ছোট বড় নানা আকারের ধ্যানমগ্ন বুদ্ধমূর্তি- পিতল, পাথর, পোড়ামাটি আর অথবা ধবধবে শ্বেতপাথরের।

 

 

পীযুষ শৈশবে যখন গ্রামে থাকতেন তখন দেখতেন সন্ধ্যার আগে আগে ঘরদোর, উঠোন সব পরিষ্কার করে পরিপাটি করা হত, তুলসীমঞ্চে প্রদীপ জ্বালানো হত, শুকনো কাপড় তুলে ভাঁজ করে রাখা হত- গ্রাম্য জীবনের এইসব গোছানো ব্যাপার চিত্রশিল্পী পীযূষের মনকে ভীষণ আলোড়িত করত। এভাবেই মনের গভীরে দেশীয় রীতি রেওয়াজ গভীরভাবে রেখাপাত করে। তাই তার আঁকা ছবিই বলুন আর গৃহসজ্জা কি জীবনযাপন সবকিছুতেই খুঁজে পাওয়া যায় মাটির কাছাকাছি থাকার বাসনা আর বাঙালিয়ানার প্রতি গভীর টান।

 

 

বাঙালিয়ানার প্রভাব তো আছেই, এছাড়া ঘর সাজানোর জন্য মিনিমালিস্টিক ঘরানা তার পছন্দ। তাই ঘরময় একগাদা আসবাব না রেখে বসার ঘরে রেখেছেন দুটো বেতের সোফা আর কিছু সুদৃশ্য মোড়া। মেঝেতে পাতা রংপুরের শতরঞ্জি। খাবার ঘরে বেতের খাবার টেবিল ছাড়াও আছে নিজের হাতে বানানো ও রঙ করা কাঠের আসবাব। আর বাসনপত্রও বেশিরভাগ সিরামিকের বা কাঁসার।

 

 

গ্রামীণ জীবনের নস্টালজিয়া তাকে এতটা উদ্দীপ্ত করে যে জীবনযাপনেও তার প্রভাব দেখা যায়। পূজোর সময় অতিথি আপ্যায়ণে বের হয় কাঁসার বাসনপত্র আর পহেলা বৈশাখে অতিথিরা খাবার খান কলাপাতায়। তখন দুজনের পরনে পোশাকও হয় খাঁদির কিংবা তাঁতের।

 

 

পুরো ঘরটাই যেন একটা চিত্র প্রদর্শনী। আঁকা ছবির সাথে তার বাসার দেওয়ালে স্থান পেয়েছে দেশ বিদেশের নানা শিল্প নিদর্শন। যেহেতু শিল্পীর বাসা, তাই বাসার দেওয়ালে তাঁর নিজের আঁকা ছবি তো আছেই, নামীদামী চিত্রশিল্পীদের আঁকা ছবিও কম না। শিল্পী হাশেম খান, শিশির ভট্টাচার্য, কাইয়ুম চৌধুরী, আনিসুজ্জামান, বিশ্বজিৎ গোস্বামীসহ প্রখ্যাত শিল্পীদের অনেকের ছবিই শোভা বাড়িয়েছে বাসার। এছাড়া বিদেশি চিত্রশিল্পীদের ছবিও আছে প্রচুর। জাপান, ভিয়েতনাম, ভারত, নেপাল, ইন্দোনেশিয়াসহ নানা দেশ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে সেগুলি।

 

 

ফুল খুব ভালোবাসেন এই দম্পতি। প্রতি বৃহস্পতিবারে তারা তাজা ফুল কেনেন। বসার ঘরের সাইড টেবিলে কাঁচের বড় ফুলদানীতে রাখার পাশাপাশি মাটির বাটিতেও ভাসে রঙিন ফুল।

 

 

খাবার টেবিলের উপর কাঁচের জারে পানিতে বাঁচে এমন গাছ আর বেসিনের উপর বাসনে রাখা ফুল। শুধু তাই নয়, বেসিনে রাখা হয়েছে আয়ারল্যান্ড থেকে আনা ছোটবড় অনেকগুলো ব্যাঙ, সাথে কক্সবাজারের ঝিনুক আর শঙ্খ।

 

 

দেশ বিদেশ থেকে ঘর সাজানোর জিনিস তো কমবেশি সবাই সংগ্রহ করে। পীযূবের সংগ্রহের বৈশিষ্ট্য হল সেগুলো সবই লোকজ।

পীযুষ আর সাগরদীপার ঘরভর্তি এই যে লোকজ জিনিস, তাদের অবস্থান বদলানো হয় বৈচিত্রের জন্য। সপ্তাহে একবার ঘরের আসবাবপত্রের পাশাপাশি এসব শো পিসও এক জায়গা থেকে সরিয়ে অন্য কোন জায়গায় নিয়ে যান। প্রত্যেকটা জিনিসের যত্ন নিজের হাতে করতে ভালোবাসেন তারা।

 

 

ঘর সাজাতে খুব পছন্দ করেন বলেই পীযুষ এ সম্পর্কিত বইপত্র সংগ্রহ করেন ধারণা নিতে। গৃহসজ্জায় আলোকসজ্জা বিশেষত পেইন্টিং এর উপর আলোর প্রক্ষেপণ খুব গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন তিনি। তাই পুরো বাসা জুড়েই চাপা আলোর খেলা। এমনকি টিউবলাইটও শেড দিয়ে মুড়ে মৃদু আলোর ভাব বজায় রেখেছেন।

 

 

চিত্রশিল্পী পীযূষের বাসায় ঢোকার পর আপনার দৃষ্টি চলে যাবে বাতাসে দুলতে থাকা হরিণের দিকে। যেন দুলে দুলে আপনাকে স্বাগত জানাচ্ছে সে। তবে বাস্তবের হরিণ নয়, সাদা পর্দায় প্রিন্ট করা কালো হরিণ।

 

একই পর্দা খাবার ঘরের জানালার শোভাও বাড়িয়েছে। এভাবেই একটা বাসা হয়ে উঠেছে একজন শিল্পীর শিল্পের কারখানা।

 

আলোকচিত্র- আশীষ সেনগুপ্ত

 

সারাবাংলা/আরএফ/এসএস

 

 

 

Tags:

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন