বিজ্ঞাপন

সন্তান গ্রামে, জোটে না মাছ-মাংস, এ কেমন বেঁচে থাকা!

January 15, 2019 | 7:21 am

।। উজ্জল জিসান, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট ।।

বিজ্ঞাপন

ঢাকা: রুমা বেগম (১৬)। রাজধানীর দারুস সালামে অ্যাপারেলস এক্সপোর্ট নামে একটি পোশাক কারখানায় দু’মাস ধরে কাজ করছেন। বেতন পান সাড়ে ৫ হাজার টাকা। ভোলা সদরের আলগি গ্রামের রুমা রাজধানীর মিরপুর ঝিলপাড় এলাকায় স্বামী শামীম হোসেনকে নিয়ে থাকেন একটি টিনশেড ঘর ভাড়া নিয়ে। শামীম পল্লবীর আরেকটি পোশাক কারখানার অপারেটরের কাজ করেন। বেতন পান ১১ হাজার টাকা। এই দম্পতির সন্তান একটি— নুশরাত জাহান মীম। একদিকে সংসারের অভাব, অন্যদিকে দু’জনেই চাকরি করায় ঢাকায় মেয়েকে দেখাশোনারও কেউ নেই। ফলে মীমকে থাকতে হয় ভোলায় নানীর কাছে।

আরও পড়ুন- প্রত্যাশা পূরণ হয়নি পোশাক শ্রমিকদের, শঙ্কায় মালিকেরাও

সম্প্রতি সরকারি মজুরি কাঠামো মেনে শ্রমিকদের বেতন-ভাতার দাবিতে রাজধানীসহ আশপাশের এলাকার পোশাক কারখানার শ্রমিকরা সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেন। তাদেরই একজন রুমা। তিনিসহ আরও কয়েকজন পোশাক কর্মীর সঙ্গে এই প্রতিবেদকের কথা হয় আয়-ব্যয়ের হিসাব নিয়ে।

বিজ্ঞাপন

পোশাক কর্মী রুমা বেগম সারাবাংলাকে আয়-ব্যয়ের যে হিসাব দিলেন, সে অনুযায়ী—  স্বামী-স্ত্রী মিলে প্রতিমাসে বেতন পান ১৬ হাজার ৫শ টাকা। ঘর ভাড়া দিতে হয় প্রতিমাসে ৪ হাজার ৮শ টাকা। গ্রামে মেয়েকে ২ হাজার টাকা, আর শ্বশুড়-শাশুড়ির জন্য পাঠাতে হয় ৪ হাজার টাকা। চিকিৎসা, যাতায়াত, খাওয়া-দাওয়া, পোশাকসহ যাবতীয় খরচের পর মাস শেষে দু’জনের হাতে একটি টাকাও থাকে না। বরং কখনও কখনও অন্যের কাছে ধার করে চলতে হয় তাদের।

রুমা বলেন, সপ্তাহে একদিনও মাছ বা মাংস জোটাতে পারি না। কোনোমতে ভর্তা-শাক-ডাল ভাত খেয়ে দিন কাটাইতেই হিমশিম খাইতে হয়। সাধে কি বাচ্চাকে নানীর কাছে রাখছি! বাচ্চা বড় হচ্ছে, কোনো টাকা জমাতে পারতেছি না। তারও তো ভবিষ্যৎ আছে।

বিজ্ঞাপন

আরও পড়ুন- পোশাক শ্রমিকদের মজুরি সমন্বয়, ৭ম গ্রেডে বেতন বাড়েনি

আক্ষেপ করে রুমা বেগম বলেন, ডাল-ভাত খেয়ে দিন পাড়ি দিচ্ছি, এরপরও তো কিছু জমাতে পারি না। এখন তো সবকিছুর দামই বেশি। সবজির দাম-চালের দাম অনেক বেশি। কারখানায় একটানা কাজ করি, একটু ভালো মন্দ না খেলে তো কাজও করা যায় না। সপ্তাহে একটা ছুটির দিনে (শুক্রবার) মাছ মাংস খাইতে মন চায়, তাও পারি না।

রুমা এক নিঃশ্বাসে বলতে থাকেন, শেষ কবে মাংস খাইছি, মনে পড়ে না। তবে মাস তিনেক আগে একদিন বড় মাছ খাইছি। ডিম অবশ্য মাঝে মধ্যে জোটাতে পারি।

বিজ্ঞাপন

ঢাকায় কম বেতনে চলতে পারেন না, ভালো-মন্দ খেতে পারেন না, সন্তানের ভবিষ্যতের জন্য টাকা জমা করতে পারেন না, তাহলে গ্রাম ছেড়ে ঢাকায় আসলেন কেন— এমন প্রশ্নের উত্তরে রুমা বলেন, গ্রামের অবস্থা আরও খারাপ। ওইখানে আয়ের কোনো ব্যবস্থা নাই। কাজ না পেয়ে দিনের পর দিন না খেয়ে থাকতে হইছে। ঢাকায় আসছি, তাও তো ডাল-ভাত খেতে পারতেছি।

রুমা বেগমের আশা, সরকার পোশাক শ্রমিকদের যে বেতন কাঠামো নির্ধারণ করেছে, তা পেলেও এখনকার চেয়ে একটু ভালোভাবে থাকতে পারবেন তারা। আর সে কারণেই ন্যূনতম ৮ হাজার টাকা বেতনের দাবিতে রাস্তায় নেমেছেন বলে জানান।

রুমা বেগমের মতোই ন্যূনতম বেতনের দাবিতে রাজপথে নেমেছিলেন কোহিনুর আক্তার (২৭)। স্বামী শামীম শিকদার একবছর আগে গাজীপুরে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছেন। এর আগে গাজীপুরের একটি পোশাক কারখানায় ছয় বছর কাজ করেছেন কোহিনুর। গত একবছর হলো দারুস সালাম এলাকায় ডালিয়া এক্সপোর্ট কারখানায় অপারেটর হিসেবে কাজ করছেন। ওভারটাইমসহ প্রতিমাসে বেতন পান ৮ হাজার টাকা। শান্তা মারিয়া নামে ১০ বছর বয়সের এক সন্তান রয়েছে। রুমা বেগমের মতো কোহিনুরও সন্তানকে গ্রামে রেখেছেন নানীর কাছে। কারণ জানালেন, ঢাকায় সন্তানকে রেখে খরচে পুষিয়ে উঠতে পারেন না। তিনিও কোনো সঞ্চয় করতে পারেন না।

আরও পড়ুন- প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে পোশাক শ্রমিকদের মজুরি সমন্বয়ের সিদ্ধান্ত

রাশেদা বেগমের গ্রামের বাড়ি কিশোরগঞ্জের মিঠামইন উপজেলার মিঠামইন গ্রামে। ঢাকায় থাকেন মিরপুরের লালকুঠি লেনে একটি টিনশেড ঘরে। তিনি জানান, ভাড়া করা ঘরে তিন জন থাকেন। থাকা-খাওয়াসহ প্রতিমাসে ৪ হাজার টাকা দিতে হয় তাকে, বেতন পান ৮ হাজার টাকা। বাকি টাকার অল্পকিছু যাতায়াতের জন্য রেখে স্কুলপড়ুয়া মেয়ের জন্য পাঠিয়ে দেন গ্রামে। তাকে বড় করাই এখন রাশেদা বেগমের লক্ষ্য।

রাশেদা বেগম সারাবাংলাকে বলেন, স্বামী সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেলে ৫০ হাজার টাকা পাইছিলাম। ওর মধ্যে ২০ হাজার টাকা বাঁচাইতে পারছিলাম, মেয়ের নামে ডিপিএস কইরা রাখছি। আর কোনো টাকা জমাইতে পারি না। এখন নতুন বেতন দিলে ওভারটাইমসহ মাসে ১১ হাজার টাকার মতো আসবে। তখন একটু ভালোভাবে চলতে পারব, কিছু টাকা হয়তো জমাইতেও পারব।

আরও পড়ুন- আজও সড়কে পোশাক শ্রমিকরা

আন্দোলনে কেন নেমেছেন— জানতে চাইলে রাশেদা বেগম বলেন, সরকার বেতন বাড়াইছে, কিন্তু মালিকরা তো দিচ্ছে না। অথচ বেতন বাড়ানোর খবর শুনে বাড়িওয়ালারা ঘরভাড়া বাড়াইছে। জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে। কিন্তু বেতন তো বাড়ে নাই। তাই সরকার যেইটা বলছে, সেই মজুরির দাবিতে আমরা রাস্তায় নামছি।

আরেক পোশাক কর্মী কোহিনুর ইসলামও (২৪) কাজ করেন ডালিয়া এক্সপোর্ট কারখানায়। গ্রামের বাড়ি চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার শিবগঞ্জ উপজেলার মোবারকপুর গ্রামে। এসএসসি পাস কোহিনুর পোশাক কারখানায় কাজ করছেন ১০ বছর ধরে। এখন তার বেতন ৯ হাজার টাকা। তার স্ত্রী হিমু আরেকটি পোশাক কারখানায় ৬ হাজার টাকা বেতনে কাজ করেন। স্ত্রী ও মা-বাবাকে নিয়ে থাকেন রাজধানীর কল্যাণপুর নতুন বাজার এলাকায়, সাড়ে ৯ হাজার টাকায় বাসা ভাড়া নিয়ে।

আরও পড়ুন- পোশাক শ্রমিকদের বেতন বাড়বে, থাকবে আরও কিছু সুখবর

কোহিনুর সারাবাংলাকে বলেন, স্বামী-স্ত্রী মিলে ১৫ হাজার টাকা বেতন পাই। বাসা ভাড়া বাবদ চলে যায় সাড়ে ৯ হাজার টাকা। খাওয়া-দাওয়াসহ অন্যান্য খরচ মিলে সংসার চালানোই কঠিন হয়ে যায়। কোনো মাসে ঋণ করে চলতে হয়। অথচ সরকার ঘোষিত মজুরি প্রতিমাসে মালিকরা দিলে একটু ভালোভাবে চলা যায়। এত কষ্ট করে আর চলতে ইচ্ছে করে না। একটু বাঁচার মত বাঁচতে চাই।

পোশাক শ্রমিকদের বেতন ও আয়-ব্যয়ের হিসাব নিয়ে জানতে চাইলে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম সারাবাংলাকে বলেন, পোশাক শিল্পের শ্রমিকদের জন্য বেতন বৈষম্য সবসময়ই থেকে যাচ্ছে। ২০১৩ সালে চার জনের একটি পরিবারের জন্য খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা ও অন্যান্য খরচসহ মোট চাহিদা ছিল ১৪ হাজার টাকা, যা সিপিডির গবেষণায় উঠে আসে। ওই পরিবারে দু’জন আয়ের লোক থাকলে হয়তো কিছু পোষাতে পেরেছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এখন তাদের ব্যয় বেড়েছে।

সিপিডির এই গবেষণা পরিচালক বলেন, ‘এখন এরকম একটি পরিবারের ব্যয় দাঁড়িয়েছে সাড়ে ২২ হাজার টাকার মতো। কিন্তু সেখানে বেতন বেড়ে হয়েছে ন্যূনতম ৮ হাজার টাকা। তার মানে পোশাক শ্রমিকদের আয়ের সঙ্গে ব্যয়ের একটা পার্থক্য সবসময়ই থেকে যাচ্ছে।’ এই পার্থক্য দূর করতে হলে প্রতিবছর ইনক্রিমেন্ট সিস্টেমে বেতন বাড়ানোর পরামর্শ দেন তিনি।

এদিকে, পোশাক শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধি ও তা প্রদানের বিষয়ে জানতে চাইলে ডালিয়া ও অ্যাপারেলস এক্সপোর্ট কারখানার মালিক জয়নাল আবেদীন সারাবাংলাকে বলেন, মজুরি বৃদ্ধির সরকারি সিদ্ধান্ত অন্যান্য কারখানাগুলো মেনে নিলে আমিও মানব। তা মেনেই আগামীতে মজুরি দেওয়া হবে।

সারাবাংলা/ইউজে/টিআর

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন