Monday 28 Oct 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

মেলার ভিড়ে অন্য মেলা


১৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ ১৭:২৮

এসএম মুন্না :

১৮ দিনে গড়াল অমর একুশে গ্রন্থমেলা। অতীতের সকল হিসেব-নিকেশ পাল্টে দিয়ে প্রতিদিনই পাঠক-দর্শনার্থীদের পদচারণায় মুখর থাকছে মেলা প্রাঙ্গন। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে মোড়ক উন্মোচন মঞ্চে যথারীতি অগ্রজ লেখকরা তরুণ লেখকদের নতুন বইয়ের মোড়ক উন্মোচন করে চলেছেন একের পর এক। বিকেলে মেলা মঞ্চে বিশিষ্ট লেখক, বুদ্ধিজীবীদের নানা বিষয়ে প্রবন্ধ পাঠ এবং আলোচনাও শুনছেন পাঠক ও দর্শনার্থীরা। সন্ধ্যায় থাকছে জমকালো সাংস্কৃতিক আয়োজন।

বিজ্ঞাপন

বর্ধমান হাউসের দক্ষিণে বহেড়া তলায় লিটলম্যাগ চত্বরে প্রতিদিনই চলে তরুণ লেখকদের অন্যরকম আড্ডা। ৭৯টি ছোট কাগজের স্টল রয়েছে এখানে। মজার ব্যাপার হচ্ছে, অন্যান্য স্টলগুলোতে প্রকাশক, ওই প্রকাশনীতে কর্মরত ব্যক্তিরাই বসেন; মাঝে-মধ্যে জনপ্রিয় লেখকদেরও কেউ কেউ বসেন। কিন্তু লিটল ম্যাগাজিন বা ছোট কাগজের স্টলে স্বয়ং তরুণ লেখকরাই বসেন। পাঠকদের সঙ্গে নানা বিষয়ে ভাবনা বিনিময় করেন। কখনো দেন স্রেফ আড্ডা।

স্মৃতিবিজড়িত বর্ধমান হাউস : একুশে গ্রন্থমেলা মানেই বাংলা একাডেমি। আর বাংলা একাডেমি মানেই ঐতিহাসিক বর্ধমান হাউস। এই ভবনকে বাদ রেখে একাডেমির কোনো আয়োজন সম্পন্ন হয় না। তাই তো শুরু থেকেই এই ভবনটি ঘিরে সাজানো হয় বইমেলা। বর্ধমান হাউস যেন বইমেলার বাতিঘর।

নানা স্মৃতিবিজড়িত ঐতিহাসিক এই বর্ধমান হাউস-এ আছে দুইটি জাদুঘর। একটি ভাষা আন্দোলন জাদুঘর, অন্যটি জাতীয় সাহিত্য ও লেখক জাদুঘর । ২০১০ ও ২০১১ সালে জাদুঘর দুটি উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আসছে পহেলা বৈশাখে এই ভবনে চালু হচ্ছে আরও একটি জাদুঘর, লোকঐতিহ্য জাদুঘর। সারাবাংলাকে এ তথ্য জানালেন ফোকলোর মিউজিয়াম ও আরকাইভ বিভাগের পরিচালক ড. শাহিদা খাতুন।

বিজ্ঞাপন

জাতীয় সাহিত্য ও লেখক জাদুঘর : নীচতলার চারটি কক্ষজুড়ে জাতীয় সাহিত্য ও লেখক জাদুঘর। মেলায় আগতরা বেশ আগ্রহ নিয়ে জাদুঘরটি দেখতে আসেন। জাদুঘরের প্রথম কক্ষে আছে বাংলা ভাষা, লিপি ও সাহিত্যের আদি উৎস, বিকাশ ও বিবর্তন। বাংলা ভাষার ছয় হাজার বছরের ক্রমবিকাশের ইতিহাস তুলে ধরা হয়েছে চিত্রমালার মধ্য দিয়ে। আছে কয়েকটি ভাষাচিত্র ও তাম্রলিপি। সুদৃশ্য কাচঘেরা আলমিরাতে সংরক্ষণ করা হয়েছে কবি শামসুর রাহমানের ব্যবহৃত পাখির পালকের কলম, চশমা, ঘড়ি ও সম্পাদক হিসেবে তাঁর পরিচয়পত্র। আরও আছে কবি সুফিয়া কামালের ব্যবহৃত জিনিসপত্র ও সাহিত্যিক মীর মশাররফ হোসেনের হাতের লেখা, পাণ্ডুলিপির অংশ।

 

দ্বিতীয় কক্ষটি সাজানো হয়েছে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ঐতিহাসিক আলোকচিত্র ও তাদের সাহিত্যকর্মের অংশ বিশেষ দিয়ে। তৃতীয় কক্ষটিতে রাখা হয়েছে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বাংলা একাডেমি সংশ্লিষ্ট দুর্লভ সব আলোকচিত্র। আরও আছে জীবনানন্দ দাশ, সুকান্ত ভট্টাচার্যের দুর্লভ ছবি ও সাহিত্যকর্মের আংশিক চিত্র। আছে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহকে লেখা রবীন্দ্রনাথের চিঠির অনুলিপি।

আর শেষ কক্ষটিতে আছে রাজা রামমোহন রায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, মাইকেল মধুসূদন দত্ত, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, দীনবন্ধু মিত্র, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, লালন শাহ, হাছন রাজার দুর্লভ আলোকচিত্র ও কিছু নিদর্শন।

ভাষা আন্দোলন জাদুঘর : বায়ান্ন’র ভাষা আন্দোলন আর ভাষা শহীদদের স্মৃতি জাগরুক রাখতেই গড়ে তোলা হয়েছে ভাষা আন্দোলন জাদুঘর। বাংলা একাডেমির বর্ধমান হাউসের দ্বিতীয় তলায় ২০১০ সালে এ জাদুঘর প্রতিষ্ঠা করা হয়।

বর্ধমান হাউসের দ্বিতীয় তলার চারটি কক্ষের পুরোটাই ভাষা আন্দোলনের নানান স্মৃতি ও সামগ্রী সাজিয়ে রাখা আছে। কক্ষগুলোয় ভাষা শহীদ রফিকের ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষার সার্টিফিকেট, ভাষা শহীদ শফিউর রহমানের ব্যবহৃত কোট, মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর কাছে রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদের স্মারকলিপি, বাংলা ভাষায় মুদ্রিত প্রথম গ্রন্থের পৃষ্ঠা ও ভাষা শহীদ শফিউর রহমানের প্রিয় চটের ব্যাগটিও এখানে সংরক্ষিত আছে।

এ ছাড়া ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস প্রেক্ষাপট, ঘটনাবলি সম্পর্কিত বিভিন্ন লেখকের বইয়ের প্রচ্ছদ, সে সময়ে প্রকাশিত পত্র-পত্রিকার বিশেষ সংখ্যা ও বিভিন্ন আলোকচিত্র আছে জাদুঘরটিতে। এর বাইরে জাদুঘরের একটা অংশকে শহীদ বুদ্ধিজীবী কর্নার হিসেবে গড়ে তোলা হয়েছে। শহীদ বুদ্ধিজীবীদের সৃষ্টিকর্ম ও বিভিন্ন নিদর্শনও প্রদর্শন করা হচ্ছে।

মহাপরিচালকের বক্তব্য : একাডেমির মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খান সারাবাংলাকে বলেন, ‘বর্ধমান হাউস মেলারই একটি অংশ। এটিকে বাদ দিয়ে কোনো আয়োজন চিন্তাই করা যায় না। বই ও ইতিহাসপ্রেমীদের উদ্দেশে আমার একটি আহ্ববান-আমরা যে ভাষায় কথা বলছি, লিখছি, আসুন না একবার এই দুইটি জাদুঘরে নতুন প্রজন্মকে সঙ্গে নিয়ে সময় করে ঘুরে আসি। সামান্য হলেও নিজের শেকড় সন্ধান করি’।

ইতিহাসের পাতা থেকে : ১৯১১ সালে বঙ্গভঙ্গ আইন রদ হওয়ার পর ঢাকা নগরীতে যেসব সরকারি ভবন নির্মাণ করা হয়, তার মধ্যে বর্ধমান হাউস অন্যতম। বর্ধমানের রাজা স্যার বিজয় চাঁদ ম্যাকার্থি ছিলেন পূর্ববঙ্গের গভর্নরের নির্বাহী পরিষদ সদস্য। ঢাকায় তার থাকার জন্য এ ভবনটি নির্মিত হয়। গ্রিক স্থাপত্যরীতি অনুসরণে নির্মিত এ ভবনের ভেতরে ছিল বৈঠকখানা, শয়নকক্ষ, জলসা ঘর, ঠাকুরঘর, রান্নাঘর। দোতলায় ওঠার কাঠের সিঁড়িটি আজও আছে। এর পশ্চিম দিকে ভেতরে গোলাকার একটি লোহার সিঁড়ি ছিল, যা দিয়ে গোপনে ওপরে ওঠানামা করা যেত। এখন অবশ্য তা নেই।

ভবনটিতে প্রথম বসবাস করেন ঢাকা হলের প্রভোস্ট অধ্যাপক কাজী মোতাহার হোসেন। তার আমন্ত্রণে কবি নজরুল ১৯২৭ সালে মুসলিম সাহিত্য সমাজের প্রথম বার্ষিকী সম্মেলনে যোগ দিতে ঢাকা এলে ওঠেন এই বর্ধমান হাউসে। এরপর নজরুল যতবার ঢাকায় এসেছেন উঠেছেন এ বাড়িতেই। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি নুরুল আমিন এ ভবনে বসেই মাতৃভাষার দাবিতে আন্দোলনরত ছাত্র-জনতার ওপর গুলিবর্ষণের নির্দেশ দেন।

১৯৫৪ সালের ৩ ডিসেম্বর বর্ধমান হাউসের একটি কক্ষে বাংলা একাডেমি প্রতিষ্ঠা করা হয়। মুখ্যমন্ত্রী আবু হোসেন সরকার এর উদ্বোধন করেন। ১৯৫৮ সালে সম্পূর্ণ ভবনটি বাংলা একাডেমির অধিকারে আসে। একাডেমি প্রতিষ্ঠার পর এই ভবনটিকে কেন্দ্র করেই বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতির ব্যাপক বিকাশ ঘটে। পাঠক, গবেষক ও সংগ্রাহকদের পদচারণায় মুখর হয়ে ওঠে একাডেমি প্রাঙ্গণ।

জাদুঘরের সময়সূচি : মেলা চলাকালীন নির্ধারিত সময়সূচি অনুযায়ী জাদুঘর খোলা ও বন্ধ থাকছে। তবে মেলার পর মার্চ মাস থেকে শনিবার ও শুক্রবার ছাড়া সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত সবার জন্য খোলা থাকবে। প্রবেশের জন্য কোনো টিকিট লাগে না।

ছবি : আশীষ সেনগুপ্ত

সারাবাংলা/পিএম

 

বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ
সম্পর্কিত খবর