Tuesday 12 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

আছে-নাই’র উৎসব দিন


৩০ মে ২০১৯ ২২:২৪

আমি বললাম, এই তোর নাম কি?
সে উত্তর দেয়, নাই
ও তোর নাম হলো নাই?  আচ্ছা, সুন্দর নাম।
কিছু বলে না সে, মাথা নিচু করে নিজের বাসি হয়ে যাওয়া হলুদের রঙের জামার ছেড়া বোতামের ঘরের বের হয়ে থাকা সাদা সুতো ধরে টানতে থাকে। আমার কৌতুক বুঝলো কিনা বুঝলামনা। তার পায়ের দিকে চোখ পরে আমার। ঠিক যেন বালুর পা।  বালুতে ঢাকা খালি পায়ের রং ও বোঝা যায়না।  আমি বাটা থেকে কেনা আমার পায়ের ক্যাটক্যাটে নীল চপ্পল জোড়ার দিকে তাকিয়ে অযথা বিব্রত বোধ করি।
আমি হাঁটি।  নাই আমার পিছে পিছে হাঁটে।
কি রে কিছু বলবি? পিছন পিছন আসিস কেন?
না। নাই উত্তর দেয়।
আমি পিছন ফিরে দাঁড়ায়ে যাই।  দেখি নাই তার ছেড়া বোতাম ঘর ধরে টানাটানি বহাল রেখেছে।
বলি -জামাটা না ছিঁড়ে তোর শান্তি নাই, না? জামা টানিস কেন? জামা ছিঁড়লে পরবি কি?
আমার আরো একখান জামা আছে, গ্যালো ঈদে কোম্পানিওয়ালারা দিসে।
আমি ভুরু কুঁচকাই, কে দিয়েছে?
উত্তর দেয় না, সাদা সুতা ধরে তার টানাটানি চলছে।
আমি বলি, ওই দেখ বরই বিক্রি করে, খাবি বরই?
নাহ, আমার দাঁতে পোকা ধরসে, বরই খেলে চুকা লাগে।
নাই সাহেব এই মুহূর্তে সুতা টানাটানি বাদ দিয়ে, মাথা চুলকাচ্ছে।
-মাথা চুলকাস কেন? উকুন?
হ।
তাইলে তোর  নাম নাই কেমনে হলো? তোর তো সবই আছে, দাঁতে পোকা, মাথায় উকুন।
নাই এখন মাথা চুলকানো বাদ দিয়ে বোতাম ঘরের সুতা টানাটানি শুরু করেছে আবার।
আমি  প্রশ্ন করি আবার, বলতো আমার নাম কি?
সুতো টানাটানি বন্ধ করে আমার দিকে মাথা উঁচু করে তাকায়। কয়েক  ফিটের উচ্চতার দুরত্ব অতিক্রম করে তাকাতে একটু কষ্ট হচ্ছে বোধহয় তার।  উপরের পাটির একটা পোকা খাওয়া দাঁত আর নিচের পাটির ফোকলা দাঁতের মাড়ি বের করে এক খান হাসি দেয়।
কি বললিনা, আমার নাম কি?
উত্তর দেয়  – আপনার নাম হইলো – আছে  কৌতুকের এমন রসালো উত্তর পেয়ে আমি হাসতে থাকি। সেও হাসতে থাকে।  আছে-নাই মিলে  হাসতে থাকি।  আমি তার কৌতুকে হাসতে থাকি। আমি আছে হয়ে বেঁচে আছি এই আনন্দে হাসতে থাকি। বালুর পা -অলা নাই যে কেন হাসতে থাকে আমি বুঝতে পারিনা।  কিন্তু আমরা হাসতে থাকি।
ঠিক এমন করেই এমন ভাবেই, উৎসবিহীন আয়োজনে, নাই এর সাথে আমার পরিচয়।  তথাকথিত চুক্তি-ভিত্তিক রীতিনীতিতে তার সাথে আমার পরিচয় হয়নি দেখেই হয়তো বা তাকে আমার এতো আকর্ষণীয় মনে হয়।  নাই কে এক ফালি  উৎসব মনে হয়, ছোট্ট নির্ভেজাল উৎসব।
এমন করেই, হুটহাট, সময়ে কিংবা অসময়ে নাই এর সাথে আমার দেখা হয়।  বসন্তের ক্যাটক্যাটে গোলাপি হাওয়াই-মিঠাই উৎসবে, কিংবা  পাতা-ঝরা শীতের রং হারানোর উৎসবে, গ্রীষ্মের কাঁঠালপাকা ঘ্রাণের দুপুরে, বর্ষার স্যাতস্যাতে কদম দিনে, আমার সাথে নাই এর আয়োজনহীন সাক্ষাৎ হয়ে যায়।
আবার কখনো কখনো যখন দেখা হয়না অনেকদিন, আমরা খুঁজিনা কেউ কাউকে।  আমরা আবার দেখা হবে বলে আমরা জানি। অপেক্ষা করি আবার দেখা হবার উৎসবের।
এই যেমন বেশ কদিন হলো  নাই এর কোনো খবর আমার জানা নেই।   নাই এর সাথে তো দেখা হচ্ছে না অনেকদিন।  তার সাথে দেখা না হলে তাকে নিয়ে গল্প গুজব করা কিংবা তাকে নিয়ে  লেখালিখি করা আমার পক্ষে অসম্ভব।  কারণ তার মানসিক ব্যাকরণ আমার পুরোপুরি  বোধগম্য নয়।  এবং এ কারণেই সে আকর্ষণীয়।

বিজ্ঞাপন

এই শহর জুড়ে এখন  তাপজ্বর। চারিদিকে ঝিম ধরা ভাব, এর মাঝে মাত্র উৎসব শেষ হলো। এই শহর এখন পোস্ট-উৎসব সিনড্রোমে আক্রান্ত। আমিও। ঝিম ধরা ভাবের মধ্যে উৎসব মিলেমিশে এমন খিচুড়ি অবস্থা যে নাই এর সাথে সাক্ষাৎটা ঠিক হয়ে ওঠেনি।
উৎসব  চলে গেছে বটে, কিন্তু একটা আলস্য ফেলে রেখে গেছে। সেই  পোস্ট-উৎসব সিনড্রোমে  আক্রান্ত হয়ে, দুবেলা পোলাও-রোস্ট খাবার দিনটি শেষ হওয়ায় খানি কটা ব্যথিত হয়ে, উৎসব পরবর্তী ফ্রিজ রাখা বাসি পোলাও কদিন গরম করে কাঁচা মরিচ দিয়ে সকালের নাস্তা খাওয়ার সুবাদে খানিকটা হাঁসফাঁস অবস্থা নিয়ে এবং কিছু করতে ভালো লাগেনা ধরণের ভাবকে সাথে নিয়ে ক্যাম্পাসে চলে এলাম। খুব একটা প্ল্যান করে আসিনি।  হাঁটতে হাঁটতে, হাঁসফাঁস করতে করতে কি যেন কি ভাবতে ভাবতে চলে এলাম।
নাই এর সাথে দেখা হয়ে যাবে, এমন সূক্ষ্ম কিন্তু আনন্দময় একটি সম্ভাবনা ও ভাবনায় লুকোচুরি খেলছিল। পোস্ট-উৎসব সিনড্রোমের শহরে আজ বৃষ্টি হয়েছে। তাপজ্বর শেষে বৃষ্টি। বৃষ্টি শেষে ঘাসগুলো কেমন যেন কান্না শেষের ক্লান্ত মুখের মতন ভেজা ভেজা হয়ে আছে। এদিক ওদিক পানি জমে আছে।  একটু  এদিক  সেদিক হলে যেন কান্নার জমে থাকা শেষ  শেষ বিন্দু   চোখের কোণ বেয়ে মুখে  জলের দাগ কাটবে।  আমি তাই ভেজা ঘাসে বসবার ঝামেলায় না যেয়ে, পাঁচিলের ওপর পা ঝুলিয়ে বসলাম।
সামনের ডান দিকের কোণায় জারুল গাছের তলায় জটলা। আড্ডা জমেছে।  মুখগুলো পরিচিত।  এই এলাকাতেই  দেখি প্রায়ই। নাই নেই সেখানে।  নাই এর এক বন্ধু আছে, জাফর না জালাল কি যেন নাম।  বসেছে, আমার মুখ বরাবর।  তাই  নাম ধরে ডাকার ঝামেলায় না  যেয়ে, হাত ইশারা করে ডাক দিলাম।  সে আড্ডা ছেড়ে আেমার দিকে এগিয়ে আসলো। নাই এর খোঁজ করলাম।  জানালো ওই পাশেই  নাই  আছে।   ওই পাশ ঠিক কোন পাশ  বুঝলাম না।  এবং  আমাকে কোনো বোঝাবুঝির সুযোগ না দিয়ে জারুল গাছ ছাড়িয়ে বাম দিকে দৌড় দিলো।  পুরো হাওয়া।  আমি জারুল গাছের দিকে তাকিয়ে আছি, ঘটনা বোঝার চেষ্টা করছি।  এবং ঘটনা বুঝতে বেশি কষ্ট করতে হলোনা।  মিনিট তিনেকের মধ্যেই গাছের ওই পাশ থেকে নাই এবং তার বন্ধুকে হেঁটে আসতে দেখা গেলো।  বন্ধু জারুল গাছের নিচে আড্ডায় যোগ  দিলো।  আর নাই গুটিগুটি পায়ে হেঁটে এসে আমার পাশে পাঁচিলে তার বালুর পা ঝুলিয়ে বসলো।
কিরে ঈদ কেমন গেলো? – আমি প্রশ্ন করলাম।
এইবার দ্যাশে যাইনি। – নাই এর উত্তর।
কি কথার কি উত্তর।  যাই হোক।  বুঝলাম ঈদ ভালোই হয়েছে।  খারাপ হলে, সে উত্তরের ধারকাছ দিয়েও যেতোনা।
– এইডা আপনার ঈদের জামা? – নাই দেখি আমাকে পাল্টা প্রশ্ন করে।
আমার প্রতি নাই এর এমন অকৃত্তিম আগ্রহে আমি নড়েচড়ে বসলাম।
ওই আর কি, চাচী গিফট করেছে। আমি কোনোমতে উত্তর দেই।  এই কমলা রঙের কাপড় চাচী ঈদে গিফট করেছে  কমলা রং দেখলেই আমার চোখ জ্বলে, মেজাজ খিচড়ে যায়। গিফট বলে পরে বসে আছি।  তাই কাপড় নিয়ে কথা বাড়ালামনা।
নাই এর দিকে তাকিয়ে মনে হলো সে কিছু বলবে।  আমার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে।  সে নতুন হাফহাতা  একটা শার্ট পরে আছে।
– এইডা আমার ঈদএর জামা – আমি তাকিয়ে আছি দেখে সে নিজেই বলে।
ওহ আচ্ছা , কে কিনে দিলো?  – আমি প্রশ্ন করি।
– আমার ঈদের জামা আমি নিজেই কিনি, চয়েস করে।
নাই এর রুচি বেশ খারাপ।  আমি বাঁকাচোখে নাই এর নতুন শার্টের দিকে তাকাই।  রানিরঙের শার্টে হলুদ আর আকাশি নীল ফুল, শার্ট হিসেবে এই কাপড় বেমানান।
ওহ তুই নিজের কাপড় নিজে কিনিস? বাহ্ ভালো তো, চয়েস করে  … গুড . নাই কিছু উত্তর দিলোনা।
আমার গলার স্বরে হালকা হিংসাভাব মনে হয় প্রকাশ পাচ্ছে।  নাই একজন যার সামনে হিংসা, অভিমান ধরণের ছেলেমানুষি  অনুভূতি প্রকাশ করতে খারাপ লাগে না। কারণ সে হয় ধারণ করে সবটুকুই, অথবা অগ্রাহ্য করে।  তাতে আমার সুবিধাই হয়।  সব অনুভূতির হিসাবনিকাশ শেষে, আমি ভারমুক্ত হয়ে যাই।
তা তুই নিজের সব কাপড় নিজেই কিনিস নাকি?  – আমার কণ্ঠের তির্যক খোঁচা আমি নিজেই বুঝতে পারি।
কিন্তু নাই তা অগ্রাহ্য করে উত্তর দে, শুধু ঈদের সময় আম্মা টাকা দিলে, মার্কেট যেয়ে  কিনি, চয়েস করে।
আমি কিছু বলি না।  বরং নাই স্বভাববিরুদ্ধ ভাবে আবারো বলে, আপনার কাপড়টাও সুন্দর।
বুঝলাম, আমার মতন নাইএর ও পোস্ট-উৎসব সিনড্রোম চলছে।  জানলাম, চয়েস করে কিনতে পারার  স্বাধীনতাই নাই এর উৎসব।  হিসাব মিলালাম, চয়েস করে কিনতে পারিনি বলে এবং অন্যের উপহার দেয়া অপছন্দের কমলা রঙের কাপড় পরে আছি বলে, নাইএর চয়েসএর প্রতি আমার হালকা হিংসাভাব জন্মেছে।
আমরা এমনই ।  আছে-নাই মিলে আমরা আমাদের অনুভূতির হিসাবনিকাশ শেষে নিজেদের কাছে ফিরে আসি।  সেই হিসাব-নিকাশে শব্দ বা অংকের প্রয়োজন পড়েনা। আছে-নাইর উপস্থিতিই যথেষ্ট।
আপাতত আমরা বৃষ্টি শেষের ভেজা হাওয়ায় বসে আকাশ-কুসুম ভাবছি। আপাতত আমরা দুজনেই পোস্ট-উৎসব সিনড্রোমের হিসাব-নিকাশ মিলাচ্ছি।

বিজ্ঞাপন

আছে-নাই’র উৎসব দিন কিযী তাহনিন গল্প

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর