Sunday 29 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

যে চিঠি আজও পোস্ট করা হয়নি…


১০ ডিসেম্বর ২০১৮ ১২:৪০

তানভীর নাওয়াজ ।। টরেন্টো, কানাডা থেকে ।।

খুব জরুরী দরকার না হলে আমি কখনো কাউকে চিঠি লিখিনা, সেটা ইলেকট্রনিক চিঠি (ইমেইল) হোক কিংবা কাগজে হাতে লেখা চিঠি হোক। আমার নিজের হাতে লেখা শেষ পোষ্ট করা চিঠি সম্ভবত ১৯৯৩ সালে আমার বড় ভাইকে। এরপর আর কাউকে কখনো চিঠি লিখে পোষ্ট করা হয়নি। সময় বদলে গেছে, মানুষের যোগাযোগের মাধ্যমগুলো আরও সহজ হয়েছে। চিঠি পোষ্ট করার মতো চমৎকার বিষয়টি সময়ের সাথে সাথে একদম হারিয়ে গেছে। দেশে থাকতে নিজের নামে ক্রেডিট কার্ডের বিল ছাড়া আর কোনো চিঠি বিগত কয়েক বছরে পেয়েছি বলে মনে পড়ে না।

বিজ্ঞাপন

কানাডা আসার পর একটা বিষয় আমার খুব ভালো লাগে। আমার বাসার গেইটের সাথেই একটা মেইলবক্স। প্রায় দুই-একদিন পরপরই আমার নামে নানারকম চিঠি আসে। কার্ডের বিল, ব্র্যান্ডের অফার, অর্গান ডোনেশান রিকোয়েস্ট, ভলান্টিয়ার করার চিঠি। আরও কতো কি! আস্তে আস্তে কেমন যেনো একটা নেশার মতো হয়ে যায়, বাসা থেকে বের হবার সময় একবার মেইলবক্স চেক করি, আবার বাসায় ঢোকার সময় আর একবার। নিজের নামের মেইলগুলো নিয়ে অস্থির হয়ে একটার পর একটা খুলতে থাকি। অধিকাংশের শেষ জায়গা হয় অবশ্য গার্বেজ বিনে। তাও এ এক অদ্ভুত নেশা! একদিন আমার অসম্ভব রকম মন খারাপ হলো। ছাপা অক্ষরে নিজের নামে গঁৎবাধা চিঠিগুলোর বাইরে আমার কাছে হাতে লেখা কোনো চিঠি আসে না কখনো। রুল টানা কাগজে চিকন কলমে কেউ আমাকে চিঠি লেখে না।

স্কারবোরো টাউন সেন্টার (এসটিসি) – এ ‘ইন্ডিগোস্পিরিট’ নামে চমৎকার একটা দোকান আছে। নানা রকম ডায়েরি, লেটার রাইটিং প্যাড আর বিচিত্র কলম দিয়ে ঠাসা। আগষ্ট মাসের ঘটনা। এসটিসি’র পাশেই একটা ট্রেনিং এ্যাটেন্ড করতে গেছি। লাঞ্চ ব্রেকে মলে ঘোরাঘুরি করতে করতে দোকানটাতে ঢুকলাম। একটা লেটার রাইটিং প্যাড অসম্ভব পছন্দ হলো। দেখেই চিঠি লিখতে ইচ্ছে হলো। বাড়ি ফিরলাম One line a day নামের লেটার রাইটিং প্যাড নিয়ে।
আমার মেয়ে ‘রাবেয়া’। ওর বয়স তেরো। ক্লাস সেভেনে পড়ে। ওর আর আমার সম্পর্কটা চমৎকার আবার অদ্ভুত। আমাদের সম্পর্ক মান, অভিমান, স্নেহ, ভালোবাসা, স্বস্তি, অস্বস্তিসহ আরও নানারকম বিষয় দিয়ে ভরপুর। আমি সিদ্ধান্ত নিলাম রাবেয়াকে একটা দীর্ঘ চিঠি লিখবো। আমাদের ভেতরকার একটা অদৃশ্য দেয়ালের কারণে অনেক কথা ওকে বলা হয়নি কখনো। রাতে সব কাজ সেরে লিখতে বসেছি। উদ্দেশ্য নিজ হাতে চিঠি লিখে ওকে পাঠিয়ে অবাক করে দেয়া! আমি ১৩ বছর আগে ফেরত যাই। অনেক কথা লিখতে ইচ্ছে হয় কিন্তু অবাক কান্ড আমি একটা অক্ষরও লিখতে পারি না। ঘন্টা দুয়েক বসে থেকে শুধু দুটো শব্দ লিখে উঠে আসি, ‘মা রাবেয়া’!

বিজ্ঞাপন

এভাবে কয়েকদিন যায়, একটা রুটিনের মতো হয়ে যায়, প্রতিদিন অফিস থেকে ফিরে এক মগ চা আর One line a day নিয়ে আমি ঘন্টার পর ঘন্টা বসে থাকি, কিন্তু আমার চিঠি লেখা আর আগায় না। আমি লিখতে পারি না। ওয়ান লাইন ইন এ ডে – তে শুধু দুটো শব্দ জমে থাকে। আর আমি আমার মনের খাতায় লিখতে থাকি রাবেয়া’র জন্য আমার তেরো বছরের না বলা কথা।
চিঠিটা আর লেখা হয়নি, তাই পোস্ট করার কোনো সুযোগ হয়নি। মনের খাতা থেকে কিছুটা তুলে দিলাম আমার ‘মা রাবেয়া’র জন্য।

রাবেয়া, এই চিঠিটা তোমার জন্য মা…

‘বাবা তুমি এতো ক্ষ্যাত কেনো? অলওয়েজ একটা লাল জ্যাকেট পড়ে ঘুরো! তোমাকে পুরাই একটা ক্লাউনের মতো লাগে, প্লিজ এই জ্যাকেটটা আর পইড়ো না, বাবা প্লিজ’। বিকেলে পার্কে হাঁটছিলাম, তোমার কন্ঠস্বর শুনে থমকে দাড়ালাম। পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখি তুমি নাই! বিভ্রম! আমি আবার হাঁটা শুরু করি। ‘বাবা, আস্তে হাঁটো, চারিদিকে বরফ, পিছলাইয়া পড়বা। এতো বড়ো শরীর নিয়া একবার পড়লেতো আর উঠতে পাড়বা না, আস্তে হাঁটো বাবা’!
এবার আর আমি পেছনে ফিরে তাকাই না। হাঁটার গতি কমিয়ে দিয়ে আমি আস্তে আস্তে হাঁটতে থাকি।
থ্যাংক ইউ বাবা।
কেনো মা?
এই যে আমার কথা শুনে তুমি আস্তে হাঁটছো সেজন্য থ্যাংক ইউ।
আমি হাসি।
বললা না, সবসময় লাল জ্যাকেট পড়ে ঘুরো কেনো? খুবই অদ্ভুত লাগে তোমাকে দেখতে।
আমার একটাই ওয়াটারপ্রুফ জ্যাকেট। কি করবো? জ্যাকেট ছাড়া ঘুরবো?
না, আর একটা জ্যাকেট কিনবা।
আমার কাপড় কিনতে ভালো লাগে না, আলসেমি লাগে।
আলসেমি লাগলে হবে না, কালকে সান ডে, তোমার অফ, তুমি কালকেই যাবা, একটা ব্লু কালারের জ্যাকেট কিনবা।
কালকে না মা, কয়েকদিন পরে যাই?
না কালকে মানে কালকে। কয়েকদিন পরে বললে হবে না।
আচ্ছা যাবো।
প্রমিজ?
হুম।
হুম না বলো প্রমিজ। আমি কালকে গিয়ে একটা ব্লু কালারের জ্যাকেট কিনবো।
আচ্ছা।
তোমাকে আমি আচ্ছা বলতে বলছি?
তো কি বলবো?
বললাম তো কি বলবা, এখন বলো তাড়াতাড়ি।
আচ্ছা, প্রমিজ আমি কালকে গিয়ে একটা ব্লু কালারের জ্যাকেট কিনবো। ঠিক আছে এখন?
ঠিক আছে, লাল জ্যাকেট কিন্তু আর পড়বা না, মনে থাকে যেন।
তাহলে শুধু একটা জ্যাকেটই পড়বো?
সমস্যা কি? এখনোতো একটাই পড়ো। তখন শুধু কালার চেঞ্জ।
ওহ আচ্ছা। তুমি জেগে আছো কেনো এখনো? এখনতো বাংলাদেশে অনেক রাত।
ঘুমাচ্ছিলাম, ঘুম ভেঙে গেছে। তুমি কোথায় যাও?
কোথাও না, পার্কে হাঁটি। বাদাম খাবা?
তোমাদের ওইখানেও পার্কে বাদাম বিক্রি করে নাকি?
আরে নাহ, বাদাম আমার পকেটে, বাসা থেকে নিয়ে বের হয়েছি, সাথে লবন আর গুড়া মরিচ মিক্স করে মশলা বানায়া নিয়ে আসছি। প্যান্টের ডান পকেটে বাদাম আর জ্যাকেটের ডান পকেটে লবন-মরিচ। নিচের পকেট থেকে বাদাম নেই, উপরের পকেটে লবন-মরিচে ময়ান দেই, তারপুর টুপ করে খেয়ে ফেলি। মজা আছে খাবা?
বাবা, তুমি পকেটে লবন-মরিচ মিক্স করে নিয়ে ঘুরতেছো? কিভাবে নিছো? প্যাকেটে?
উহু, মিক্স করে পকেটে রেখে দিসি, প্যাকেটে নিলে ময়ান দিতে সমস্যা।
উফ্, ময়ান আবার কি? হোয়াট ইজ ময়ান? জীবনেও শুনি নাই।
ময়ান মানে ডলা। মিক্সিং এ বাদামটা ভালো করে ডলা দিয়ে নিতে হয় যাতে মশলাটা লাগে বাদামে। বলতে বলতে আমি কয়েকটা বাদাম ময়ান করে টুপ করে মুখে দিয়ে চাবানো শুরু করলাম।
বাবা তুমি সিরিয়াসলি এইটা করলা?
ক্যান কি সমস্যা? বাদাম খাওয়া দিয়া কথা। আমি গাল চুলকাতে চুলকাতে বললাম।
সমস্যা নাই! পকেটে মরিচের গুড়া নিয়ে ঘুরতেছো আর বলতেসো সমস্যা নাই? বারবার মুখ চুলকাচ্ছো কেনো?
আরে মুখে ঠান্ডা বাতাস লেগে চুলকাচ্ছে, জ্বলতেছে!
ঠান্ডা বাতাসে না, তোমার মুখে তোমার মশলা লাগছে, সেজন্য জ্বলতেছে। মশলা দিয়ে বাদামের সাথে সাথে তুমি তোমার মুখও ময়ান করতেছো। জ্যাকেটের মতো তোমার গালও লাল হয়ে আছে।
কি করবো তাহলে? কালকে গালে রঙ দিয়ে নীল করে ফেলবো? নীল জ্যাকেটের সাথে নীল গাল, ম্যাচিং ম্যাচিং!
উফফ্ থামবা তুমি? এক্ষণি বাসায় যাও, গিয়ে আগে ভালো করে মুখ ধুবা, তারপর তোমার জ্যাকেটের পকেট থেকে মশলাপাতি যা আছে সব ফেলবা। কি শুরু করলা তুমি? উল্টা ঘুরো, বাসায় যাও।
আমি উল্টা ঘুরলাম।
যেতে যেতে বাদাম খাওয়া যাবে? গালে মুখে ময়ান যা হওয়ার সেটাতো হয়েই গেছে। একটু খাই?
খাও বাট ময়ান ছাড়া খাও। ফ্রেশ বাদাম খেতেও মজা। নো ময়ান, ওনলি বাদাম খাও।
ময়ান ছাড়া একমুঠ বাদাম একসাথে মুখে দিয়ে আমি হাসি হাসি মুখে হাঁটছি।
আমার কর্মকান্ড দেখে তুমি হেসে দিলা।
হাসো কেনো?
কই হাসি? বলতে বলতে তুমি আরও জোরে হেসে দিলা!
ছোট্ট একটা মেয়ে মা’র হাত ধরে আমার উল্টা দিক থেকে হেঁটে আসছে। ওয়াক ওয়ে’টা অনেকখানি বরফে ঢাকা। আমি একটু সরে গিয়ে ওদের যাওয়ার জায়গা করে দিলাম, বাচ্চাটা আমার কাছাকাছি আসতেই আমি হাত নেড়ে হাই দিলাম;
মাম্মা, লুক লুক, হিয়ার ইজ এ স্যান্টা। বলেই মেয়েটা আঙ্গুল দিয়ে আমাকে দেখাচ্ছে।
বাচ্চার মা, মেয়ের কথায় মনে হয় লজ্জা পেয়েছেন, তাড়াতাড়ি করে মেয়েকে বললেন, নো ডিয়ার, হি ইজ নট স্যান্টা। স্যান্টা ইজ ওল্ড। হি ইজ এ্যান ইয়াং ম্যান।
আমি হাটা’র গতি একদম কমিয়ে দিয়ে কান খাড়া করে ওদের কথা শুনছি।
নো মাম্মা। হি ইজ এ্যান ইয়াং স্যান্টা। লুক, হি হ্যাজ এ বিগ বেলি, রেড জ্যাকেট এ্যান্ড হি ইজ অলসো বেয়ারড। আই ওয়ান্ট গিফট ফ্রম হিম মাম্মা।
মা বেচারা অপ্রস্তুত হয়ে মেয়ের হাত ধরে হন হন করে হাঁটা শুরু করেছে। আমিও হাঁটার গতি বাড়িয়ে দিলাম।
কেমন লাগে বাবা? হাহাহা।
তোমার কি সমস্যা? তুমি আবার হাসতেছো কেনো? আমি যতোটা সম্ভব গম্ভীর হয়ে বলার চেষ্টা করলাম।
তুমি খিলখিল করে হাসছো, আহা কি সুন্দর হাসি। আমিও হেসে দিলাম।
আমার হাত ধরে হাঁটো বাবা।
উহুঁ।
তুমি আমার হাত ধরবা না? কেনো?
আমার হাতে মশলাপাতি লেগে আছে।
থাকুক। বলে তুমি আমার লবন-মরিচ মাখানো হাত ধরে পাশাপাশি হাঁটা শুরু করলে।
বাবা, এই বাবা?
হুম বলো।
তোমার নীল জ্যাকেট কিনতে হবে না।
কেনো? আবার কি হলো?
তুমি এই জ্যাকেটটাই পড়বা।
আমাকে না ক্লাউনের মতো লাগে? আমি জোরে হাঁটতে হাঁটতে বললাম।
নো, ইউ আর মাই ইয়াং স্যান্টা ক্লজ। ইউ লুক নাইস ইন ইট। লাভ ইউ বাবা।
লাভ ইউ টু মা। হাত এতো শক্ত করে ধরে রাখসো কেনো? বাদাম খাবা? ময়ান ছাড়া?
তুমি যাতে পড়ে না যাও সেজন্য। খাবো। অনেকগুলো বাদাম একসাথে ভালো করে ময়ান দিয়ে দাও।

আমার চোঁখ কেমন ঝাপসা হয়ে আসলো। মনে হয় মশলার ময়ান লেগেছে। ঠান্ডা বাতাসের কারণেও হতে পারে। লাল জ্যাকেটের হাতা দিয়ে চোঁখ মুছতে মুছতে ঘরে ফিরে এলাম।

ভালো থাকো মা। যত্নে থাকো।

ইতি

তোমার বাবা।

সারাবাংলা/পিএম

টরেন্টোর টুইট তানভীর নাওয়াজ

বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ
সম্পর্কিত খবর