Saturday 28 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

গ্রন্থমেলায় ফাল্গুনের আবহ


১২ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ ০২:০৪

হাসনাত শাহীন ।।

শীত ঋতুর শেষ মাস ‘মাঘ’ মাস। আর মাত্র একদিন বাদেই প্রকৃতিতে বিরাজ করতে আসছে-ছয়ঋতুর দেশ বাংলার ঋতুরাজ ‘বসন্ত’। অথচ এর বেশ কিছুদিন আগে থেকেই এবারের ‘অমর একুশে গ্রন্থমেলা’য় আগত তারুণ্যের মাঝে দেখা গেছে বসন্তের প্রথম মাস ফাল্গুনের আবহ-বসন্তের ছোঁয়া। সোমবার শীত ঋতুর শেষ মাস মাঘের ২৯তম দিন আর এবারের ‘অমর একুশে গ্রন্থমেলা’র ১১তম দিনেও ছিলো সেই আবহ। সংখ্যায় কম হলেও শীত শেষের হালকা কুয়াশা মাখা সূর্যের হালকা তেঁজের সোনা রোদের সাথে হালকা বাতাস আর পাতা ঝরার সুরোলিত ধ্বনীতে মেলার দুই প্রাঙ্গণেই আগত বইপ্রেমীদের ছিলো প্রাণবন্ত উপস্থিতি। অনেকের সাজ-সজ্জায় ছিলো বসন্তের সাজ। তাদের অধিকাংশই ছিলো তরুণ-তরুনী।

বিজ্ঞাপন

টানা দুইদিনের সাপ্তাহিক ছুটি শেষে গতকাল রোববার প্রথম কর্মদিবস পেরিয়ে সোমবার দ্বিতীয় কর্মদিবসে মাথায় ফুলের তোড়া সঙ্গে বাসন্তি সাজের এসব তারুণের দিপ্ত পদচারনা প্রাণের মেলায় যথেষ্ট গতি সঞ্চারিত হয়েছে। টিএসসি থেকে দোয়েল চত্বর; সোহরাওয়ার্দী উদ্যান থেকে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণ- সবখানেই বইপ্রেমীদের প্রাণবন্ত ও গতিময় পদচারণায় ছিলো মুখরিত।

সমগ্র বিশ্ববিদ্যালয় এলাকাই যেন ছিলো আগন্তক ঋতুরাজের আবেশে গ্রন্থমেলাময়। বইপ্রেমীদের পাশাপাশি মেলার একাদশ দিনে দর্শনার্থীদের সংখ্যাও ছিলো আশাব্যঞ্জক। সার্বিক বিবেচনায় এদিনের মেলায় বিকিকিনি অন্যান্য দিনের তুলনায় একটু কম হলেও বিভিন্ন প্রকাশনা সংস্থার সাথে সংশ্লিষ্টরা শোনাচ্ছে আশার কথা। তারা বলছেন, আজ অন্যান্য দিনের তুলনায় বিক্রি একটু কম। কর্মদিবসে এমন হয়। কিন্তু এই কম বিক্রি আমাদের আশাবাদী করছে। কেননা, এই ধারা অব্যাহত থাকলে এবং বিশেষ দিনগুলো আশানুরুপ গেলে এবারের মেলা অন্যান্যবারের মেলার চেয়ে বেশী সফলতা পাবে।

বিজ্ঞাপন

ধানমন্ডি ১৫ থেকে আসা সালাউদ্দিন আহমেদ জানান, আজই মেলাতে প্রথম এসেছি। মেলার নিরাপত্তার বিষয় থেকে শুরু করে সাজ-সজ্জা, স্টলবিন্যাস সবকিছুই অনেক পরিচ্ছন্ন। পরিশিলিত। মাতৃভাষার আন্দোলনের এবং মহান একুশের এই স্মৃতিবিজড়িত ভাষার মাসের এই বইমেলার জন্য সারা বছর বইপ্রেমী এবং সাধারণ মানুষেরা তীব্র আগ্রহে চেয়ে থাকে। এই মেলা উপলক্ষে দেশের সৃজনশীল কবি সাহিত্যিক-সহ সবধরণের লিখিয়েদের বই প্রকাশিত হয় বেশি। বছরের অন্যান্য সময় প্রকাশিত হওয়া বইগুলোও এ মেলায় পাওয়া যায়। আর, ঢাকার আশে-পাশের মানুষ বটেই এসব বই কিনতে আসে দেশের আনাচে-কানাচে থাকা পড়ুয়ারাও।

এদিকে, পরপর দুইবার বিদ্যুৎ চলে যাওয়াতে আাঁধারে ঢেকে যায় সমগ্র সোহরাওয়ার্দী উদ্যান। অন্ধকার পরিবেশে নানা ধরনের অনাকাঙ্খিত দূর্ঘটনা এড়াতে মেলার সোহরাওয়ার্দী উদ্যান প্রাঙ্গণে আগতদের অনেকই মেলা প্রাঙ্গণ থেকে বের হয়ে যায়। এতে করে অল্প সময়ের মধ্যেই সরব সোহরাওয়ার্দী উদ্যান হঠাৎ করে নীরব হয়ে পড়ে। যার কারনে প্রকাশকরা ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছেন বলে জানিয়েছেন বেশ কয়েকজন প্রকাশক। আর এর পুরো দায়ভার বাংলা একাডেমির বলেও মনে করছেন তারা। একুশের চেতনায় শাণিত এতো বড় একটা আয়োজনে পরপর দুইবার বিদ্যুৎ চলে যাওয়াতে বাংলা একাডেমির অব্যবস্থাপনাকে দায়ি করেছেন বেশ কয়েকজন প্রকাশক।

মেলা প্রাঙ্গণে বেশ কিছুক্ষণ বিদ্যুৎ সংযোগ না থাকায় মেলার ভূতুড়ে পরিবেশের বিষয়ে আবিষ্কারের কর্ণধার দেলোয়ার হোসেন বলেন, যেকোন ধরনের দূর্ঘটনারোধে তাৎক্ষনিক পদক্ষেপ নেয়ার জন্য প্রতিবছর প্রত্যেক প্রকাশকের কাছে বিদ্যুৎ মিস্ত্রির নাম্বার দেয়া থাকলেও এবার তা করা হয়নি। যার ফলে বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার পরও আমরা কারো সাথে যোগাযোগ করতে পারছি না। বিদ্যুৎ চলে যাওয়ার পর নানা ধরনের দূর্ঘটনা এড়াতে গিয়ে অনেকে মেলাপ্রাঙ্গণ ত্যাগ করে।

এর ফলে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছেন কিনা জানতে চাইলে-ক্ষোভ প্রকাশ করে এই প্রকাশক বলেন, বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক ভারতে আছেন। তার অনুপস্থিতিতে মেলা পরিচালনা কমিটির সদস্য সচিব ড.জালাল আহমেদ সব কিছু দেখভাল করার কথা। কিন্তু দুঃখের বিষয় তিনি ফোন ধরছেন না।

এ বিষয়ে বাংলা একাডেমির পরিচালক ও মেলা পরিচালনা কমিটির সদস্য সচিব ড.জালাল আহমেদ বলেন, আমি ফোন ধরি না কথাটি সত্য নয়, এই যে আপনার ফোন ধরলাম। বিদ্যুৎ চলে যাবে এটা আমরা আগেই মাইকে ঘোষণা দিয়েছি। বিভিন্ন জায়গায় বিদ্যুতের কাজ চলছে। সে কারনে এই সমস্যাটি হয়েছে। তবে এই সমস্যা আগামীকাল (আজ) আর থাকবে না।

  • মেলায় নতুন বই:

সোমবার এবারের ‘অমর একুশে গ্রন্থমেলা’র ১১তম দিনে নতুন বই এসেছে ১২৮টি। এর মধ্যে গল্পের বই ২১টি, উপন্যাস ১৬টি, প্রবন্ধ ১০টি, কবিতা ৪৯টি, ছড়া ২টি, শিশুসাহিত্য ১টি, জীবনী গ্রন্থ ৪টি, রচনাবলি ১টি, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক বই ২টি, নাটক ১টি, বিজ্ঞান বিষয়ক বই ৪টি, ভ্রমণ বিষয়ক বই ৩টি, ইতিহাস বিষয়ক বই ৫টি, রাজনীতি বিষয়ক বই ১টি, স্বাস্থ্য বিষয়ক বই ১টি, সায়েন্স ফিকশন ২টি এবং অন্যান্য বিষয়ে বই এসেছে ৫টি। এদিনের উল্লেখযোগ্য বইগুলো হচ্ছে সময় প্রকাশন থেকে বের হয়েছে সৈয়দ শামসুল হকের নাটক ‘ফজল শেখের শেষ ম্যাজিক ও অন্যান্য’, চিলড্রেন বুক কালেকশন এনেছে আনিসুল হকের ‘গুড্ডু বুড়ার নতুন বোকামি তারপর’, কথাপ্রকাশ এনেছে সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী’র প্রবন্ধ ‘গণতন্ত্রের অভিমুখে’, মুক্তধারা থেকে প্রকাশিত হয়েছে কাজী জাফরুল ইসলামের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট নিয়ে বই ‘কার্ল মার্কসের দেশে’ এবং সরলানন্দ সেনের চিঠিসমগ্র ‘ঢাকার চিঠি’, ঐতিহ্য থেকে প্রকাশিত হয়েছে রেজাউর রহমানের উপন্যাস ‘অচেনা আবাস’, আগামী প্রকাশনী থেকে এসেছে মোনোয়েম সরকারের প্রবন্ধের বই ‘বাংলাদেশ শেখ মুজিব থেকে শেখ হাসিনা’ ও ডা. অরুপরতন চৌধুরী’র স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা বিষয়ক গ্রন্থ ‘দাঁতের যত্ন’।

  • মেলার মূল মঞ্চের অনুষ্ঠান:

মেলার এ মূলমঞ্চে সোমবার বিকেল ৪ টায় অনুষ্ঠিত হয় ‘নৃত্যাচার্য বুলবুল চৌধুরী : জন্মশতবর্ষ শ্রদ্ধাঞ্জলি’ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। এতে প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন অনুপম হায়াৎ। আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন আমানুল হক, লুভা নাহিদ চৌধুরী এবং শিবলী মহম্মদ। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন কামাল লোহানী।

প্রাবন্ধিক বলেন, রক্ষণশীল বাঙালি মুসলিম সমাজে বুলবুল চৌধুরী ছিলেন এক বিদ্রোহী নৃত্যশিল্পী। নৃত্যের মাধ্যমে তিনি জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবার সুকুমার বৃত্তি ও মানবিকবোধ জাগিয়েছেন। নৃত্য যে রাজনৈতিক-সামাজিক চেতনাবোধ ও সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে দাঁড়াবার সাহস ও শক্তি সঞ্চয় করতে পারে এবং ক্ষুধা-মন্বন্তরের সময় মুনাফাখোর, চোরাকারবারি, অসৎ প্রশাসনের বিরুদ্ধে ঘৃণা ও প্রতিবাদ ছড়াতে পারে বুলবুল চৌধুরীই প্রথম তা দেখিয়েছেন। তিনি বিদেশি শাসক-শোষকদের দেশ ছাড়ার আহবান জানিয়েছেন নৃত্যের মাধ্যমে। নৃত্যকে তিনি সাংগঠনিক ও পদ্ধতিগতভাবে চর্চার জন্য ক্ষেত্র তৈরি করেছেন।

আলোচকবৃন্দ বলেন, বুলবুল চৌধুরী নৃত্যচর্চায় সমকালীন ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের প্রেরণার উৎস হয়ে আছেন। তার অনুসৃত পথ ধরে নৃত্য বিষয়ক প্রতিষ্ঠান, সংগঠন, একাডেমি, সমিতি, শিক্ষা, গবেষণা, প্রকাশনা এগিয়ে চলেছে তার জন্মশতবর্ষ পরেও। জন্মশতবর্ষে বুলবুল চৌধুরীর সমস্ত সৃষ্টিকর্ম সংগ্রহ, সংরক্ষণপূর্বক প্রচার, প্রকাশ, প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা গ্রহণ করা জরুরি। তার নৃত্যকর্ম পুনরুদ্ধারের পাশাপাশি তাকে নিয়ে একটি স্মারকগ্রন্থ প্রকাশ করা যেতে পারে।

সভাপতির বক্তব্যে কামাল লোহানী বলেন, বুলবুল চৌধুরী নৃত্যের পাশাপাশি প্রাচী নামের উপন্যাস লিখে বাংলা সাহিত্যে যোগ করেছেন নতুন মাত্রা। তার নৃত্য কেবল প্রায়োগিক শিল্পকলা নয়, একই সঙ্গে সমস্ত অসুন্দর এবং কলুষতার বিরুদ্ধে জোর প্রতিবাদের নাম।

মেলার মঞ্চের এ আলোচনা অনুষ্ঠান শেষে সন্ধ্যায় শুরু হয় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। এতে কবিকণ্ঠে কবিতাপাঠ করেন গোলাম কিবরিয়া পিনু এবং চঞ্চল আশরাফ। আবৃত্তি পরিবেশন করেন গোলাম সারোয়ার এবং আহসান উল্লাহ ইমাম খান তমাল। সংগীত পরিবেশন করেন শিল্পী চন্দনা মজুমদার, শফি মণ্ডল, সেলিম চৌধুরী, পাগলা বাবুল, রুশিয়া খানম এবং কোহিনুর আকতার গোলাপী। যন্ত্রাণুষঙ্গে ছিলেন বেণু চক্রবর্তী (তবলা), মো. মামুনুর রশিদ (বাঁশি), আনোয়ার সাহাদাত রবিন (কী-বোর্ড), রতন কুমার রায় (দোতারা)।

সারাবাংলা/এইচএস/টিএস

অমর একুশে গ্রন্থমেলা অমর একুশে গ্রন্থমেলা-২০১৯ কামাল লোহানী গ্রন্থমেলা প্রাণের মেলা বাংলা একাডেমি সোহরাওয়ার্দী উদ্যান

বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ
সম্পর্কিত খবর