Friday 27 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

অবরুদ্ধ আষাঢ়ে


১০ জুলাই ২০২০ ১৫:৫১

গ্রীষ্মের খরতাপ প্রকৃতি থেকে মুছে দিতেই আসে দক্ষিণের মেঘ—সেই কবে, কালিদাসের কাল কিংবা তারও কতযুগ আগে থেকে চলে আসছে এই নিয়ম, কেই-বা হিসাব রেখেছে তার। ঘনকালো মেঘে বাদল নামে—বিস্তীর্ণ মাঠ, শান্ত ক্ষীণাঙ্গী নদী, শুকনো খালবিল জেগে ওঠে নতুন রূপ নিয়ে। জলধারায় স্নান করে সতেজ হয়ে ওঠে প্রতিবেশ—ক্ষুদ্র তৃণ থেকে পত্রপল্পবে সমৃদ্ধ মহীরুহ—বাসনার জানালা খুলে যায়, দোলা লাগে কামনার বনে। প্রাণচাঞ্চল্যে মেতে ওঠে প্রকৃতি।

বিজ্ঞাপন

তবুও, বর্ষা বিরহের ঋতু, আষাঢ় বেদনার মাস। এদেশের জলবায়ু, দিগন্ত প্রসারিত মাঠ, কূলহীন নদী আমাদের অন্তরের তলদেশে অনাদি কাল থেকে বিরহ-বেদনার স্থায়ী রং মাখিয়ে দিয়েছে। তাই মেঘ দেখলে বিরহ জাগে, পানি দেখলে উথলে ওঠে বেদনার বাণী—‘আষাঢ় মাইস্যা ভাসা পানি রে, পুবালি বাতাসে।/বাদাম দেইখ্যা চাইয়া থাকি আমার নি কেউ আসে ।।’

প্রিয়জনের জন্য ‘মনপোড়া বা প্রাণকান্দা’র মার্জিত ভাষা বিরহ। কে করেছিল প্রথম এই বিরহ-ব্যথার দরদি রূপায়ণ? প্রাচীন উজ্জয়িনী কিংবা অবন্তীর সৌন্দর্যের কবিগণ, না কি আধুনিক রোম্যান্টিক ‘ভানুসিংহে’র বৃষ্টিস্নাত পদাবলি থেকে আমরা পেয়েছি বর্ষার বিরহের কথামালা, কে জানে! হয়ত উল্টোটাই সত্য—‘যে আছে মাটির কাছাকাছি’, যিনি গীতিকবিতায় অনুবাদ করেছিলেন প্রাকৃত জীবন ও প্রকৃতির রূপবৈচিত্র্য, সেই প্রাচীন লোককবির কাব্যেই রচিত হয় আষাঢ়ের প্রথম প্রশস্তি।

উকিল মুন্সি (১৮৮৫-১৯৭৮) মৃত্তিকাসংলগ্ন জীবনের কবি। তাঁর উপরিউক্ত গীতিকবিতাটি গত দুইদশকে নেত্রকোনার আঞ্চলিক সীমা অতিক্রম করে, চলচ্চিত্র কিংবা আধুনিক সামাজিক মাধ্যমের গণ্ডি পার হয়ে ছড়িয়ে পড়েছে পুবে-পশ্চিমে। ‘বিষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর, নদেয় এল বান’—বললে যেমন নদীর জেগে ওঠার তথ্যের পাশাপাশি এক সৌন্দর্য-ধ্বনি আমাদের শ্রবণেন্দ্রীয়কে আবিষ্ট করে, তেমনি ‘আষাঢ় মাইস্যা ভাসা পানি’র সংবাদে অন্তরে জেগে ওঠে আদি অকৃত্রিম পুরো ভাটি বাংলা—অপরূপ উচ্ছল রূপ নিয়ে নেচে উঠে আমাদের তরঙ্গায়িত করে এবং দৃষ্টির সৌন্দর্য্-তৃষ্ণায় আনন্দবৃষ্টি ঝরায়। আষাঢ় মাস নিয়ে উকিলের আরও রচনা আছে, তবে আপাতত আমাদের দৃষ্টি এই ‘ভাসাপানি’তেই।

বিজ্ঞাপন

এই গানে মূলত চিরায়ত গ্রামীণ বাংলাদেশের এক নারীর বেদনার গল্প বলা হয়েছে। দারিদ্র্যের শেষসীমায় বাস করা এই তরুণী কুলবধূর সারা বছরই হয়ত অভাবে-অনটনে কাটে, কিংবা কাটে না। যখন আষাঢ় মাস আসে, হাওরের পানি বাড়ির প্রান্তসীমায় এসে হাজির তখন শুরু হয় নতুন উপদ্রব—‘যেদিন হইতে নয়া পানি আইলো বাড়ির ঘাটে।/অভাগিনীর মনে কত শত কথা ওঠে।।’

এই আষাঢ় মাসে নতুন পানির ওপরে ভাসমান নৌকার সারি বয়ে নিয়ে যায় কতশত নারী—‘নাইওর’ যাওয়ার বাসনা জাগে তার মনে, পিতামাতার সান্নিধ্যে কিছুদিন ঘুরে আসার জন্যে অন্তর পোড়ে। এই নতুন পানির পথ দিয়ে দিনের পথ আধাদিনে পাড়ি দিতে পারত, পৌঁছে যেত নিকটজনের কাছে। মনে পড়ে, বাবার সংসারে খুব সচ্ছলতা ছিল এমন নয়, বরং মেয়ে হয়ে, বোঝা হয়েই ছিল সেই সংসারে; না-হলে তার পিতা বিয়ের নামে এমন ‘বনবাসে’ রেখে যেতেন না। দারিদ্র্যের শিকল যে জীবনটা আগেপাছে বেঁধে রেখেছে এ-তথ্য গোপন থাকে না। স্বামীর সংসারেও সে সুখে নেই। তার বরও হয়ত সাথে থাকে না, লোককাহিনির চরিত্রের মতো ‘বিদেশ’ গেছে, একদিন সে ফিরে আসবে—তাই অপেক্ষায় প্রহর গোনে। কিন্তু কেউ আসে না, পথ চেয়ে থাকার কষ্ট বুকে বয়ে বেড়ানোই সার। তার এই অপেক্ষার অন্তর্দহন ‘মেঘদূতে’র যক্ষপ্রিয়ার এক বৎসর কালের বিরহ-ব্যথা নয়, এক জীবনের কিংবা হাজার বছরের। বাউল-দার্শনিকের মতো ‘অপার’ হয়ে অপেক্ষা করা ছাড়া তার গত্যন্তর নেই।

উকিল মুন্সির জীবন ও সাধনা মৈমনসিংহ গীতিকার উৎসভূমিকে ঘিরে, যেখানে ছয়মাস জীবন থাকে জলমগ্ন, বাকি ছয়মাসও নদীনির্ভর। হাওর-নদী-সমতলের প্রাকৃতিক বৈচিত্র্য এখানে মানুষের জীবনজীবিকায় ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করে। উকিলের গানের মৌল বিষয় এই পানিবাহিত জীবন। অধ্যাত্মসাধনা তাঁর চূড়ান্ত লক্ষ্য হলেও এই গানটিতে মানবীয় দুঃখবেদনার যে রূপায়ণ তিনি করেছেন তাতে ঐতিহ্যের অনুসরণ পরিস্ফুট হয়ে উঠেছে, এবং গীতিকার মানবীয় বিরহ-বেদনা লাভ করেছে নতুন ব্যঞ্জনা।

এই দরদি লোককবি তার অসাধারণ গীতিকবিতাটিতে ভাটির বিচ্ছেদের সুর এবং কথার যে অপরূপ সমন্বয় ঘটিয়েছেন তা এককথায় অনবদ্য। লোকগান তো আঞ্চলিকই হয়, তবু এই গানে শব্দ বা ভাষা-ব্যবহারের নৈপুণ্য এত যথাযথ যে, এর মর্মার্থ বাঙালি শ্রোতার মরমে পৌঁছাতে কোনোরূপ বাধার সৃষ্টি হয় না, অনায়াসে অন্তরস্পর্শ করে। ভাটি অঞ্চলের নারীজীবনের যে ছবি লোককবি এঁকেছেন, গভীর দরদ থেকে উৎসারিত বলেই তা এমন জীবন্ত ও স্বতঃস্ফূর্ত হয়ে উঠেছে।

গানের ভণিতায় কবি উল্লেখ করছেন—‘কত জনায় যায় রে নাইওর এই না আষাঢ় মাসে।/উকিল মুন্সির হইবে নাইওর কার্তিক মাসের শেষে।।’
উকিল এক নারীর বেদনার কাহিনি বর্ণনা করতে গিয়ে নিজের কথা বলছেন। কিংবা, নিজের কথা বলার জন্যেই এক নারীজীবনের আশ্রয় নিয়েছেন। আষাঢ় মাসে প্রকৃতির এই আনন্দ-আয়োজনে তার কোন অংশগ্রহণ নেই। বন্দি নারীসত্ত্বা অন্তরে ধারণ করে তারও আকুতি, একদিন নাইওর যাবেন। কোথায় বাড়ি তার? অন্যত্র তিনি বলেছেন, ‘মায়ার সাগর’ পাড়ি দিয়ে সেই ‘সোনার দেশ’। নতুন পানির সুসময়ে তার ‘দেশে’ যাওয়া হবে না, হাওরের কোলাহল থামা দুর্দিনে তার যাত্রা হবে। এই আক্ষেপে প্রাণ কাঁদে।

দৈবদুর্বিপাকে যখন জীবন অবরুদ্ধ, মুক্তির পথগুলো রুদ্ধ হয়ে আসে, তখন যুক্তির বাঁধনগুলোও দুর্বল হয়ে যায়। চেতনার গভীরে এক ভাবের উদয় হয়—‘আমার নি কেউ আসে’। কে এই স্বজন—পিতা-মাতা, ভাই, বান্ধব; না অন্য কেউ? কী জানি কার অপেক্ষায় এই ভরা আষাঢ়ে হাওর-সমতলের মানুষের অন্তর হাহাকার করে। বাঙালির বুকে চির বিরহ-ব্যথার এই দুঃখজাগানিয়া সুর বহুকাল ধরে বেজে চলেছে।

সহায়ক গ্রন্থ:
জ্যোতিভূষণ চাকী (সম্পাদিত) ২০০০, কালিদাসসমগ্র, নবপত্র প্রকাশন, কলকাতা।
প্রমথনাথ বিশী ১৪২১, রবীন্দ্রকাব্য প্রবাহ, মিত্র ও ঘোষ পাবলিশার্স প্রা.লি., কলকাতা।
বুদ্ধদেব বসু (অনূদিত) ২০১২, শার্ল বোদলেয়ার : তাঁর কবিতা, দে’জ পাবলিশিং, কলকাতা।
মাহবুব কবির ২০১৩, উকিল মুন্সির গান, ঐতিহ্য, ঢাকা।
মৃদুলকান্তি চক্রবর্তী ১৯৯৯, লোকসংগীত, প্যাপিরাস, ঢাকা।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ২০১২, রবীন্দ্রসমগ্র, খণ্ড ১৩, পাঠক সমাবেশ, ঢাকা।

লেখক– সহকারী অধ্যাপক, বাংলা
বৃন্দাবন সরকারি কলেজ, হবিগঞ্জ। azharshaheen76@gmail.com
প্রকাশিত গ্রন্থ: লোককবি রাধারমণ: জীবনদর্শন ও কবিতা (২০১৯), চৈতন্য প্রকাশন, সিলেট।

অবরুদ্ধ আষাঢ়ে আষাঢ় আষাঢ় মাস উকিল মুন্সি ড. আজহার শাহিন মৈমনসিংহ গীতিকা

বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ

ভারত থেকে ফিরলেন ৯ বাংলাদেশি তরুণী
২৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ১২:২৩

আজ জাতিসংঘে বাংলায় ভাষণ দেবেন ড. ইউনূস
২৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ১২:০৪

সবজি-মুরগির বাজার চড়া, অধরা ইলিশ
২৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ১১:১০

সম্পর্কিত খবর