Sunday 29 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

বাংলা সাহিত্যের সিঁড়ি হবে ‘ভাষাতরী’

নুসরাত জাহান
২০ এপ্রিল ২০২২ ১৭:৪২

একবিংশ শতাব্দীতে এসে সাহিত্যচর্চায় অসংখ্য গ্রুপ আর অনলাইন ওয়েবম্যাগেরই যেন আধিক্য। অনলাইন সাহিত্যচর্চার অবাধ সুযোগের সময়ে লিটলম্যাগ চর্চা এক ধরনের দুঃসাহসিক কাজ। যাদের মন-মননে সাহিত্য সেবা জেঁকে বসেছে তারা ঝুঁকি নিয়েই কাজ করেন। ‘ভাষাতরী’ সম্পাদক উমর ফারুক সেই দুঃসাহসি যোদ্ধাদের একজন।

শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির মাসিক ‘ভাষাতরী’ যেন সাহিত্যের সবগুলো শাখা নিয়ে অসাধারণ সাজে সেজেছে। কী নেই এখানে, সাম্প্রতিক, প্রবন্ধ, কবিতা, অনুবাদ কবিতা, ছড়া, হাইকু, রহস্য গল্প, ছোটোগল্প, অনুগল্প, রম্যগল্প, চিত্রকলা, মুক্তিযুদ্ধ, চলচ্চিত্র, ধারাবাহিক উপন্যাস, প্রতিবন্ধী, বাউল, ভ্রমণকথা এবং বই আলোচনা। সব মিলিয়ে সমৃদ্ধ মাসিক ম্যাগাজিনটি মুহূর্তেই সাহিত্যপ্রেমী পাঠকের পিপাসা নিবারণে যথার্থ।

বিজ্ঞাপন

সাহিত্যপত্রটির শুরুতেই রয়েছে সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা এবং প্রফেসর ড. মো. ফকরুল ইসলামের করা সাম্প্রতিক বিষয় নিয়ে দুটি আলোচনা। ‘সাহিত্যে স্বাধীনতা পদক বাতিল’ রচনাটিতে সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছেন আমাদের সমাজে পুরস্কার পদক বা কিছু পাওয়ার জন্য মানুষ কতটা মরিয়া। রাজনীতি কিংবা ক্ষমতার প্রভাবে কতটা সহজলভ্য হয়েছে পুরষ্কার বা পদক বাগিয়ে নেওয়া। সাহিত্য সংস্কৃতির পুরস্কার পদক কারা পাবেন সেটাও নির্বাচন করেন আমলারা। তিনি প্রশ্ন তুলেছেন ‘সামান্য সরকারি চাকরিতে নিয়োগের আগেও যেখানে একজন ব্যক্তির বংশ পরম্পরায় সব খবর নেয়া হয়; যাবতীয় আমলনামার অনুসন্ধান করা হয়, সেখানে রাষ্ট্রের সর্বো”চ সম্মানজনক পুরস্কার দেওয়ার আগে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সম্পর্কে রাষ্ট্র কোনো ধরনের খোঁজখবর নেয়ার প্রয়োজনবোধ করবে না?’ তার ভাষ্যে দরখাস্ত দিয়ে, সুপারিশ লিখিয়ে প্রাপ্ত পদক ভিক্ষের চেয়েও হীন আসল লেখকদের কাছে। কথায় কথায় কিছুদিন আগে পশ্চিমবঙ্গের গীতশ্রী সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়কে দেওয়া মোদি সরকারের পদ্মশ্রী পুরস্কার প্রত্যাখ্যান করার বিষয়টি তুলে ধরে বর্তমান সময়কার শিল্পীদের সংকট খুব সুন্দর ভাবে উপস্থাপন করেছেন।

বিজ্ঞাপন

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ড. মো. ফখরুল ইসলাম ‘ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলা: যুদ্ধের বিপক্ষে মানুষ’ রচনাটিতে করোনার মরন কামড়ে যখন বহু প্রতাপশালী ও বিজ্ঞজনের বেসামাল জীবন-যাপন তখন চলমান রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধাবস্তার ভয়াবহতার বর্ণনা দিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন ‘এমন বেপরোয়া মনোভাব তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের দামামা শুরু হওয়ার বার্তা নিয়ে এলো না তো?’ তিনি যুদ্ধের বিপক্ষে সাধারণ মানুষের শান্তিপূর্ণ অবস্থান স্পষ্ট করেছেন।

এর পরেই রয়েছে প্রবন্ধ। মিনার মনসুরের ‘সংকট কি পাঠকের নাকি বাস্তবসম্মত উদ্যোগের’ প্রবন্ধটিতে দেশে গ্রন্থাগারের সংখ্যা, পাঠক সংখ্যা এবং সংকটগুলো উঠে এসেছে। আর কাওসার চৌধুরী খুলনার গল্লামারী খালপাড়ের মুক্তিযোদ্ধা সালাম শিকদারর ভাষ্যে বর্ণনা করেছেন ‘একটি পতাকার লাগি’।

এর পরেই সাহিত্যের একটি অন্যতম শাখা কবিতা। কবিতা শিল্পের মহত্তম শাখা হিসেবে পরিগণিত। ‘ভাষাতরী’র এই সংখ্যায় স্থান পাওয়া তিরিশ জন কবির তিরিশটি কবিতা যেন মুহূর্তেই ভিন্ন ভিন্ন তিরিশ রকম অনুভূতির সঞ্চার করে পাঠক হৃদয়ে। মহাদেব সাহার ‘কে চায় তোমাকে পেলে’ কবিতায় বলেছেন, ‘বলো না তোমাকে পেলে কোন মূর্খ অন্যকিছু চায়/ কে আর তোমার বুকে স্থান পেলে অন্যখানে যায়!’ আবার নিমিষেই মন হারিয়ে যায় আনিসুল হকের সেই বিখ্যাত পঙক্তি ‘তুই কি আমার দুঃখ হবি?/ এই আমি এক উড়নচণ্ডী আউলা বাউল/ রুখো চুলে পথের ধুলো/ চোখের নিচে কালো ছায়া।/ সেইখানে তুই রাত-বিরেতে স্পর্শ দিবি।/ তুই কি আমার দুঃখ হবি?’

এছাড়াও রয়েছে আসাদ চৌধুরীর ‘রিপোর্ট ১৯৭১’, আবু হাসান শাহরিয়ারের ‘নিন্দাবাদ’। ‘পতাকায় লেখা একটি মর্মকথা’ কবিতায় শাহাজাদা বসুনিয়া দেশ-জাতি-বর্ণ-গোত্র নির্বিশেষে সকল মানুষের এক আকাশের নিচে আসার মর্মকথা ব্যক্ত করেছেন। আরো রয়েছে হাসান হাফিজ, গোলাম কিবরিয়া পিনু, বাবুল আনোয়ার, সালাম জুবায়ের, রেবেকা ইসলাম, মুস্তফা হাবীবসহ মোট তিরিশ জন কবির কলমে অনবদ্য সব পদাবলি।

অনুদিত সাহিত্যে নন্দিনী সেনগুপ্ত কর্তৃক ভাষান্তরকৃত আরবি সাহিত্যের উল্লেখযোগ্য নাম নিজার কাব্বানির দুইটি কবিতা স্থান পেয়েছে। আরো আছে ছয়জন ছড়াকারের ছয়টি ছড়া এবং তিনজন লেখকের চমৎকার কিছু হাইকু।

‘পাগলি কন্যা’ রহস্য গল্পটি গল্পকার সাইফুল ইসলাম জুয়েল কি অসাধারণ ভঙ্গিতে ফুটিয়ে তুলেছেন। গল্পটি পড়ার পরেও কয়েক মুহূর্ত যেন এর রেশ থেকেই যায়। এর পরেই শফিক নহোর রচিত ছোটোগল্প ‘মুক্তিযোদ্ধা মজিদ কাকা’। সম্পাদক উমর ফারুক রচিত ‘আঁধারঘেরা সকাল’ কিংবা অঞ্জনা চট্টোপাধ্যায় রচিত ‘বেডকভার’ গল্পটি যেন আমাদের সমাজ বাস্তবতারই প্রতি”ছবি। রয়েছে দুর্দান্ত চারটি অণুগল্প। শফিক হাসান রচিত রম্যগল্প ‘সংসার সুখের হয় পুরুষের গুণে’ গল্পটি দারুণ মজার। পাঠক হাসতে বাধ্য।

চিত্রকলায় নাজনীন আখতারের কলমে উঠে এসেছে নারী প্রচ্ছদ শিল্পীদের চ্যালেঞ্জ। তিনজন নারী প্রচ্ছদ শিল্পী ব্যক্ত করেছেন হাজারও প্রতিবন্ধকতার মাঝে তাদের চ্যালেঞ্জিং পেশার কথা। মুক্তিযুদ্ধ বিভাগে রয়েছে অনিমেষ রায় রচিত ‘মুক্তিযুদ্ধের গান ও সংস্কৃতি বিপ্লব’ এবং মলয় বিকাশ দেবনাথ রচিত ‘বাংলা নাটকের ইতিহাস ও মুক্তিযুদ্ধের নাটক’। হাসান রাউফুন দেখিয়েছেন চলচ্চিত্রে মুক্তিযুদ্ধের কথা। আছে সোনালী রচিত ধারাবাহিক উপন্যাস ‘পাঁচফোড়নের গন্ধ’-এর দ্বিতীয় অংশ। ‘প্রতিবন্ধী’ বিদুষী ফারজানার কথা। ড. মুহম্মদ এমদাদ হাসনায়েন লিখেছেন ‘মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি’। ভ্রমণকথা অংশে মো. কামরুল হাসান পর্যটনের স্বর্গভূমি মালদ্বীপের সৌন্দর্য বর্ণনা করেছেন। আর সব শেষে রয়েছে নিভৃতচারী লেখক হায়দার বসুনিয়ার উপন্যাস ‘হাতবদল’ নিয়ে নুসরাত জাহানের করা বই আলোচনা।

সব মিলিয়ে সমৃদ্ধ মনে হয়েছে ম্যাগাজিনটি। তবে অতিরিক্ত শাখাপ্রশাখা না রেখে বাউল, প্রতিবন্ধী বিষয়গুলো প্রবন্ধের অন্তর্ভুক্ত করলে নৈপুণ্যের দিক থেকে পত্রিকাটি আরো সুন্দর এবং পরিপাটি হতো। আর ‘ভাষাতরী’ নামটির সঙ্গে ধ্রুব এষের করা প্রচ্ছদের চমৎকার মিল রয়েছে। পত্রিকাটি সমসাময়িক সময়ে সাহিত্য প্রেমী পাঠককে তৃপ্ত করতে সক্ষম হবে বলে আমার বিশ্বাস।

কাগজ, ছাপা, শুদ্ধতা, বিষয়-বৈচিত্র্য সবদিক দিয়ে সময়ের অলংকার হিসেবে বুকসেলফে রাখার মতো একটি ম্যাগাজিন ‘ভাষাতরী’।

মাসিক ভাষাতরী
১ম বর্ষ, ২য় সংখ্যা, মার্চ ২০২২
সম্পাদক : উমর ফারুক

সারাবাংলা/এসবিডিই/এএসজি

নুসরাত জাহান বাংলা সাহিত্যের সিড়ি হবে ‘ভাষাতরী’ মাসিক ভাষাতরী

বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ

সিনিয়র সাংবাদিক বদিউল আলম আর নেই
২৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ১৬:৩১

সম্পর্কিত খবর