Thursday 05 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

কলমের সংসার আর ব্যর্থ হবার অধিকার

সৈকত হাবিব
৩ মে ২০২২ ২০:০৩

অনেক দিন ধরেই ভাবছি, এমন একটা লেখার খাতা হোক না, যা যেভাবে মনে আসে সেভাবেই টুকে রাখব। মানে হলো, যা যেভাবে মাথায় বা কলমের ডগায় আসে, তা ওভাবেই কাগজে পেড়ে ফেলব!

চাই, পারি না; কিংবা পারতে চাই না। কারণ কাগজ-কলম নিয়ে বসতেও যেন ক্লান্তি, অনীহা, অনিচ্ছা।

হায়, এই জীবন লইয়া কী করিব! খালি কি অবসাদের হাতে মারা খাইব?
মাঝে মাঝে নিজের ওপরই বিরক্তি আসে। অক্ষমতার বিরক্তি, কাজ না-করতে পারার যন্ত্রণা, কথা রক্ষা করতে না-পারার অপরাধবোধ আর ক্লান্তি, হতাশা, দুশ্চিন্তা…
ইচ্ছা, স্বপ্ন, সুযোগ আর সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও শরীর-মনের কী এক গহন কীট কিছুই করতে দেয় না…

গত অক্টোবরে (২০২০) যখন তীব্র অবসাদ আর দুর্বলতায় বিধ্বস্তপ্রায়, করোনার আঘাতে সার্বিকভাবে ছিন্নভিন্ন, তখন একটা নোটখাতায় ‘অবসাদের দিনগুলি’ নামে একটা লেখা শুরু করেছিলুম। ‘স্বীকারোক্তি’ শিরোনামে একটা অসমাপ্ত অধ্যায় মাসজুড়ে বিভিন্ন সময় লিখেওছিলাম। কিন্তু ওটা কেমন যেন একটা প্রবন্ধের রূপ নিচ্ছিল আমার ইচ্ছার বিরুদ্ধেই। কারণ আমি তো লিখতে চাইছিলুম ইচ্ছেমতো, মনে যা আসে, তা। কিন্তু ওখানে বড় বেশি যুক্তি-তক্কো-ব্যাখ্যা এসে যাচ্ছিল বিরক্তিকরভাবে, যা নিজেরই পছন্দ হচ্ছিল না। তাই পরে ক্ষান্ত দিয়েছিলুম। যদিও প্রায়-প্রায়ই খাতাটা আর লেখাটার কথা মনে আসত, লিখতে বসতে ইচ্ছে করত। কিন্তু তারপরও হচ্ছিল না।

কিন্তু আজ একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটল। স্নেহভাজন কবি-কথাকার সৌম্য সরকার গত বছর থেকেই একটা পাণ্ডুলিপি এডিট করে দেবার কথা বলছিল। তবে তার লেখা শেখ হচ্ছিল না, তাই দিতেও পারছিল না। বরং দেখা হলেই কইতো, ‘আর একটু বাকি আছে। শেষ করেই আপনাকে দেখতে দিব।’

গত হপ্তায় আমাকে সেই পাণ্ডুলিপি দিল। কিন্তু হাতে কাজ থাকায় ধরা হচ্ছিল না। তাছাড়া কদিন ধরেই মাথার ভিতর এক আজব স্পন্দন চলছে। ফলে সবকিছু কেমন যেন…

আজ সকালে, সাড়ে ৬টার দিকে ঘুম ভাঙল। কী মনে করে সকালেই ওর লেখাটি নিয়ে বসলাম। নামটা যেমন ‘না না একদম না’, তেমনি লেখাও তাইরে নাইরে না! মনে হলো চেতন-অবচেতন নিয়ে বেশ খেলেছে পাগলা। ভাষা-চিন্তা-কথা-বাক্য-বোধ এমন এক অযৌক্তিক-যৌক্তিক ভাষায় লিখেছে, মনে হলো ব্যক্ত-অব্যক্তর যে জটিল সীমারেখা, তাকে অনেকটাই ভেঙে ফেলেও বেশ নামিয়ে নিতে পেরেছে।

আরে আমিও তো এমন ধরনের ফর্মই খুঁজছিলুম! যেখানে চেতন-অচেতন জড়াজড়ি করে থাকবে, যুক্তি-অযুক্তি হাত ধরে হাঁটবে, ভব্যতা-অভব্যতার মাখামাখি থাকবে। মানে কিনে ভেতরে-মগজে-অবচেতনে যে আনসেন্সরড বোধের অনিয়ন্ত্রিত/অসম্পাদিত প্রবাহ চলেÑ যতদূর সম্ভব তাকেই হুবহু কাগজে নামিয়ে ফেরতে পারা। দু-তিন পৃষ্ঠা পড়তে পড়তেই দেখলুম, বেশ সফল হয়েছে তো আমার প্রিয় ‘গভর্নমেন্ট’ (সরকার) সৌম্য!

সৌম্যর এই ক্ষমতাটার কথা আগে থেকেই জানি ওর লেখা গল্প-কবিতা পাঠের সুবাদে। কিন্তু এই ‘না না একদম না’তে যেন নিজেকে অনেকটা ছাড়িয়ে গিয়ে আরো ভেতরে প্রবেশিতে পেরেছে সে। ব্রাভো বাছা, তুমি দেখছি আমাকেও জাগিয়ে দিয়েছো! কারণ তোমার লেখার গুঁতোতেই আমারও যে কলম চলতে শুরু করেছে হে! সাধু! সাধু!!

নতুন নোটবুক, প্যাড, খাতা যদি একটু অন্যরকম হয় দেখতে বেশ লাগে। ওগুলো সংগ্রহ করতে, উপহার পেতে ও দিতে খুব ভালো লাগে। কিছু লিখতে ইচ্ছে করে, লেখার আগ্রহ জাগে।

আর মাথায় যে কত কিছু জাগে, যা লিখতে পারলে, সাহিত্য হোক না হোক, নিজের ভেতরের শৃঙ্খল থেকেও তো কিছু মুক্তি মেলে। বিষাদ-অবসাদের হাত থেকেও কিছু রক্ষা মেলে, বোধহয়।

কিন্তু নানা অহেতুক কাজে লিপ্ত থাকলেও, লিখতে পারা কিংবা লেখার জন্য বসাটাই যেন কঠিন ব্যাপার। আর এটাও আমার এক নিজস্ব অপরাধবোধ, অবচেতনে। কারণ লেখার জন্যই তো জীবনের বহু সাধ-আহ্লাদ, বাসনা-পিপাসা ত্যাগ করেছি। লেখার আনন্দকেই পৃথিবীতে সবেচেয়ে প্রার্থিত জেনেছি; সবচেয়ে তীব্র সঙ্গমের চেয়েও সুখদায়ক ভেবেছি। আর মনে হয়, লেখার আনন্দের সঙ্গে, সম্ভবত, তুলনা হতে পারে সন্তানকে বুকে জড়িয়ে ধরার এক উষ্ণ-গভীর-কোমল অপার্থিব আনন্দের সঙ্গেই।

তবু হায়, না লেখা, না সন্তানকে নিবিড় জড়িয়ে ধরার আনন্দ এ জীবনে এসবই বড় অপূর্ণ রয়ে গেল। মাঝে মাঝে মনে হয়, এতে কিসসু এসে যায় না; এটাই জীবন অপূর্ণতার দুঃখ। আবার মনে হয়, জীবনটা ব্যর্থই থেকে গেল গা!

অবশ্য জীবনের এই যে আধা-শতক বয়স ছুঁই ছুঁইয়ে এসে পৌঁছে গেলাম এখন মনে হয়, সাফল্য-ব্যর্থতার হিসাব কষার দিন বোধহয় ফুরিয়ে গেছে। এখন মানে মানে, কাজেকর্মে, কখনো কখনো কলম চালিয়ে জীবনটা সজ্ঞান-সচলভাবে পার করে দিতে পারলেই বাঁচোয়া!

আর কবি গুণদা, একদিন এক অন্তরঙ্গ আড্ডায়, আমাকেই উজ্জীবিত করতে, কী চমৎকার করেই না ছুড়ে দিলেন এই প্রশ্নটি : ‘মানুষের তো ব্যর্থ হবার অধিকার আছে, না কি!!’
আছে তো নিশ্চয়ই, নইলে তো সবার হাতেই ধরা থাকতো সাফল্যের সোনার হরিণ, তাই না?

কত দিন পর, কেমন তরতর করে নিজেকে প্রকাশ করতে পারছি! অনেক ধন্যবাদ তোমায় প্রিয় খাতাসোনা! এভাবেই আমাকে দিয়ে লিখিয়ে নিয়ো তুমি! যেনো তোমার ভিতর দিয়েই একটু হলেও বাঁচি!

সারাবাংলা/এসবিডিই/এএসজি

ইদ ২০২২ ইদ আয়োজন ২০২২ ইদ সংখ্যা ২০২২ ইদুল ফিতর ২০২২ কলমের সংসার আর ব্যর্থ হবার অধিকার সারাবাংলা ইদ আয়োজন ২০২২ সৈকত হাবিব


বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ
সম্পর্কিত খবর