Sunday 08 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

টুকরো টুকরো গল্পে ‘আমি’ হয়ে ওঠা

হাবীব ইমন
৬ এপ্রিল ২০২৩ ১৬:৪০

এক.
একই জায়গায় দাঁড়িয়ে আছি। হয়তো উন্মুখ হয়ে প্রতীক্ষা করছি কখন শুরু হবে আলোর সেই অমোঘ সম্মোহন। আচ্ছা, আলোর সম্মোহন বলাটা ঠিক হবে! আরও একটি বছর শুরু হয়ে গিয়েছে এতোক্ষণে।

ফেসবুকের বদৌলতে এখন সবাই জেনে যায় কার জন্মদিন কবে এবং প্রতিবছরের মতো এ বছরও আমার ফেসবুক অ্যাকাউন্টের ওয়াল ও মেসেঞ্জার অসংখ্য শুভেচ্ছা, ভালবাসা ভরে আছে। যারা ভালবাসা প্রকাশ করেছেন তাদের শুভেচ্ছা আন্তরিকতার সঙ্গে গ্রহণ করলাম।

মফস্বলে জন্মদিন পালনের প্রচলন ছিল না। কেক কেটে লোকজন দাওয়াত করে জন্মদিন পালনের কোনো চল কখনও ছিল না। এখনও জন্মদিন পালন করি না। তবে পারিবারিকভাবে কেবল কেক কেটে জন্মদিন উদযাপন করা হয়। আমার অনেক বন্ধুর বাসাতেই আমি প্রতি বছর জন্মদিনের দাওয়াত খেলেও নিজের জন্মদিনে কখনও কাউকে বাসায় খাওয়াতে পারিনি।

আলোকিত বর্ণময় আকাশটার দিকে নির্নিমেষ তাকিয়ে হঠাৎ ভীষণ আপন মনে হয় একটি শহরকে। যে শহরে আমি জন্মেছি—প্রিয় শহর মাইজদীর শোকে অবিরত হু হু করা মনটা এক পলকের জন্য হলেও ভুলে যায় সবকিছু—শুষে নিতে চায় এই উল্লাসধ্বনি। মনে হয় আমিও তো তাদেরই একজন।

দুই.
মাইজদী—আমার জন্ম ওখানে। নোয়াখালী জেনারেল হাসপাতালে আমার জন্ম। চৈত্রের ধবধবে ফর্সা—ঝলমলের রোদ্দুর দিন। এমন দিনে আমার জন্ম। সেদিন ছিল বুধবার। একটি মধ্যবিত্ত পরিবারে ঠাঁই আমার। সাংস্কৃতিক আবহ আর শিক্ষার বাতাবরণে গড়ে ওঠা এ পরিবার।

আসল ব্যাপার হচ্ছে, খুব পুরানো কথা, আমার কিছুই মনে নেই। শুরুটা করছি শোনার কথার ওপর নির্ভর করে। শোনার কথাও নির্ভর করা কঠিন। একই গল্প একেকজন দেখি একেক রকম করে বলে। যেমন একজন বললেন, ‘তোমার জন্মের সময় অনেক ঝড় হয়েছিল। অন্য একজন বললেন, ‘কই নাতো, প্রচ- গরম ছিল।’ আমি সবার কথা শুনে একটা ছবি এঁকে ফেলেছি। এই ছবিটা খানিকটা এদিক-ওদিক হতে পারে। তাতে কিছু যায়-আসে না। এমন কেউ না আমি, প্রতিটি ঘটনা হুবহু লিখতে হবে। থাকুক কিছু ভুল। আমাদের জীবনে একটা বড় অংশ জুড়েই তো আছে ভুল আর ভ্রান্তি।

জন্মের পর পরই কাঁদতে হয়। এটাই নিয়ম। চারপাশের রহস্যময় জগৎ দেখে কাঁদতে ভুলে গেছি। ডাক্তার সাহেব আমাকে কাঁদাবার জন্য নির্দয় আচরণ করলেন। আমি জন্ম মুহূর্তে আকাশ ফাটিয়ে কাঁদতে লাগলাম। ঘরে উপস্থিত আপু (আমার নানি) আনন্দিত সুরে বললেন, ‘মেষ রাশির ছেলে।’ শিশুকান্নার শব্দ আমার নানাজানের কানে যাওয়ামাত্র ছুটে এসে বললেন, ‘ছেলে না মেয়ে?’ নানা তখনই মিষ্টি আনতে পাঠালেন। তার অর্থবিত্ত তেমন ছিল না। কিন্তু দিলদরিয়া ধরনের মানুষ ছিলেন।

চৈত্রের তাপদাহ তখন। দরজা-জানালা খুলে আমার গায়ে হাওয়া লাগানোর চেষ্টা করছেন। আশপাশে বৌঝিরা একের পর এক আসছে। আমাকে দেখে আশাহত হয়ে ভ্রু কুচকে বলছে—‘আহারে’।

তিন.
আমার বয়স এখন কত! মনে করতে চাই না। মনে করলে একটা চিনচিনে ব্যথা জাগে। তবুও, প্রতিবছর আজকের দিনটা এলে আমাকে মনে করিয়ে দেওয়া হয়—ওইদিন আমার জন্মদিন। এক একটা ৭ এপ্রিল আসে, বয়সটা এক একটা বছর বেড়ে যায়। কিন্তু কৈশোরের হারানো স্মৃতিভুবনে ফিরে যাওয়া এমন মনোমুগ্ধকর জানালা যেন আর দ্বিতীয়টি নেই। আমার জন্ম যখন, সেই সময় সামরিক শাসন চলছে, জিয়া থেকে সাত্তারের আমল শুরু। অস্থির একটি সময় তখন।

যখন কলেজে পড়ি, এক জন্মদিনে অসীম, শান্ত, টুটুল, মোরশেদ, শিবলী, রাজন, ফয়সল, রিপন মিলে আমরা শহর থেকে একটা গ্রামে গিয়েছিলাম। ওখানে কয়েকজন পথশিশুকে আমরা মিষ্টি খাওয়াই। ওটা দেখে আমার চোখ ঝলঝল করে, চোখের জল আটকাতে পারিনি। ওটা ছিলো বড় আনন্দের।
কিসের কারণে ইদানিং মাঝে মাঝে অতীত নিয়ে আকুল হয়ে উঠি, তা জানি না। মাঝে মাঝে হঠাৎ কোনো অলস দুপুরে, ফেলে আসা আমার শহরের কথা মনে পড়ে যায়। মন ফিরে পেতে চায় অতীতের সব কিছু; বিশেষ করে, কৈশোরের দিনগুলোর স্মৃতি আমাকে প্রবলভাবে টানে। সেইসব দিন আমাকে মাঝে মাঝে এমনই ব্যাকুল করে তোলে যে কেশোরভুবন পরিক্রমায় পথ হাতড়াতে থাকি অন্ধের মতো; খড়কুটোর মতো এখানে যে স্মৃতিখ- দেখতে পাই, ডুবন্ত মানুষের মতো তা-ই আঁকড়ে ধরে ভেসে উঠতে চাই।

আমার শৈশবকে পুরোপুরি আনন্দময় বলা যাবে না।

তাদের কথা মনে পড়ছে, যাঁরা চোখের সামনে নেই, সময় তাদের অনেক দূরে সরিয়ে নিয়ে গেছে। চোখ বন্ধ করলেই তাদের দেখতে পাই। কিন্তু ইচ্ছে করলেও কাছে যেতে পারি না। আমার ছোটবেলার বন্ধু-বান্ধব, নানা-নানি, দাদা, মামা, চাচা, ফুফু—কত প্রিয়জন ওই একটু দূরেই সময়ের ওপাড়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে, আমি প্রাণপণে তাদের ডাকছি। কাছে আসতে বলছি, তবু ওরা সাড়া দেয় না। আজ ওরা আমার ডাকে সাড়া না দিলেও একসময় ওরা আমার সব আবদার-সব অনুরোধ শুনেছেন, সেইসব কথাই এই প্রত্যুষে মনে পড়ে। শোকের সঙ্গে সময়ের এক সুক্ষ্ম রেষারেষি, তাদের মধ্যে এক চাপা লড়াই চলে অবিরাম। এই দ্বৈরথের প্রথম দফায় শোকই জেতে। অকাল প্রয়াত সময় সামনে নিয়ে আসে। তাকে নিশ্চিহ্ন করার শক্তি সময়েরও নেই।

চার.
একসময় ভীষণ দুঃখবোধ হতো সেই জীবনটার জন্য। এখন আর করি না। কিন্তু একঘেয়েমি জীবন ভালো লাগে না। এখনও মাঝে মাঝে পুরোনো ঘটনাগুলোর মুখোমুখি হই। ঘটনাগুলো পরম্পরা কেবল অন্ধকারের গল্প। যখন কোথাও যাই, নিজেকে ভেঙে-চুরে, সেইসব মানুষের ভেতর গিয়ে মিশতে চেয়েছি। কিন্তু পরিবেশ-পরিস্থিতি আমাকে মিইয়ে দেয়। চুপসে দেয়। আমি নিজেকে আর বের করতে পারি না। সংকোচবোধ করি। কখন নিষ্করণ মুখচ্ছবি আর ভারাক্রান্ত জীবনের গ্লানি নিয়ে বাসায় ফিরবো? কারণ ফিরে না এলে এই স্বল্প পরিসরে আমার ছাদখানা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ঐশ্বর্যমন্ডিত হয়ে উঠে না।

মাথার ওপর উজ্জ্বল আলো। তবুও চারদিকে মুখোশপরা কিছু মানুষ দেখি।

কেউ কেউ আমাকে করুণা করার চেষ্টা করতো। আমার দিকে তাকিয়ে হাসাহাসি করতো। অনেক কথা শুনতে হয়েছে, চুপচাপ শুনে গেছি। বুঝতে দেইনি তাদের। কিন্তু নিজের ভেতর খুব অসহায়বোধ করতাম। আমি কোনো আত্মীয়স্বজনের বাসায় যেতে বা কোথাও কোনো দাওয়াতে যেতে স্বস্তিবোধ করিনি। এমন একটা সময় ছিল, কারো বাচ্চা হলে আমি ওখানে যেতে চাইতাম না। আমার ভাগনি আদৃতা হওয়ার সময়ও আমি ওকে দেখতে যাইনি। আমার কেন জানি মনে হতো, আমি গেলে ওই বাচ্চাটির কোনো অমঙ্গল হয়ে কিনা। এসব মনে হওয়ার অনেকগুলো ঘটনা আমার জীবনে ঘটে গেছে। যে আমি কুসংস্কারের বিশ্বাসী নই, সেই আমি কিভাবে যেন এগুলো মান্য করতাম।

স্কুল জীবন কিংবা কলেজ জীবনে ভীষণ চুপচাপ ছিলাম। আমার ভেতরে চেপে থাকা উচ্ছ্বাস, উচ্ছ্বলতা কখনই প্রকাশ করতে পারিনি। স্কুল পার করেছি, কলেজ পার করেছি, কিন্তু আমি স্বতঃস্ফূর্তভাবে সেই জীবনটা উপভোগ করতে পারিনি।

যখন ঘর থেকে বের হওয়া শুরু করলাম, সমাজে আরও দশটা মানুষের সঙ্গে মেশা শুরু করলাম। এটা ছিলো আমার মনের সাহস। আমার আত্মবিশ্বাসের জোর। বিভিন্ন জায়গায় যাওয়া শুরু করলাম। বিভিন্ন সংগঠনে কাজ করতে থাকলাম। ওগুলোকে উপভোগ করতে শুরু করি। সবসময় তা আমার অনুকূলে ছিলো না। অনেকটা সময় লেগেছে নিজেকে তৈরি করতে। প্রস্তুত করতে। খাপ খাইয়ে নিতে। অনেক প্রতিকূলতার ভেতর দিয়ে গিয়েছি, ঘাত-প্রতিঘাত সহ্য করে গেছি, আমার বিশ্বাস আমাকে হারাতে দেয়নি।

পাঁচ.
সম্বিত ফেরে যখন বুঝতে পারি নিজের অজান্তে কখন ময়ূখের হাত আঁকড়ে ধরেছে আমাকে—নতুন আশা, শুদ্ধ প্রতিজ্ঞা আর অফুরন্ত জীবনের আশ্বাসে। ধীরে ধীরে ভিড় ঠেলে হাতে হাত রেখে এগোতে থাকি আমি। কিছু স্বপ্ন, চাওয়া, পাওয়া আর হারানোর টুকরো টুকরো গল্প নিয়ে এভাবেই হয়তো একদিন সত্যিকারের ‘আমি’ হয়ে উঠবো!

ছয়.
প্রতিভা বলে আমার কিছু নেই। কাঁদা মাটি-ময়লা জল গায়ে লেগে লেগে জীবনের পথ মাড়িয়েছি। বড় কিছু হওয়ার কোনো স্বপ্ন আমার ছিলো না। আমার পক্ষে সেটি দেখাটা খুবই দুরূহ একটি ব্যাপার ছিলো সবসময়। তাই কোনো মহৎ কিছু অর্জনের যোগ্যতা বলে কিছু আমার নেই। তবুও মাঝে মাঝে অনাকাঙ্খিতভাবে কিছু অর্জন আমাকে প্রাণিত করেছে, শিল্পের প্রতি-কবিতার প্রতি-লেখার প্রতি দায়বদ্ধ করেছে। পশ্চিমবঙ্গের নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসুর জন্মোৎসব উপলক্ষে একটি ছাত্র-যুব উৎসবে সংবর্ধিত হয়েছিলাম। তা ২০০৮ সালে। সেই সম্মাননাপত্রের লেখাগুলোর শূন্যতা ভীষণভাবে অনুভব করছি। মাঝে মাঝে লেখাগুলো আমার মতোই অযত্নে থাকে। আমার দেয়ালে তাকে বেমানান লাগে, মাঝে মাঝে খসে পড়ে যায়। সমাজ-মানুষ-সংস্কৃতি-প্রগতি-মানবিকতা ছিল আমার ধ্যান। আমার মগ্নতা। সেই কারণে কিনা জানি না, ওই উৎসবে লক্ষ মানুষের সামনে, সকল বাঙলা ভাষার মানুষের জন্য বার বার উচ্চারণ করেছি, রবীন্দ্রনাথের মতো আমি দৃপ্তকণ্ঠে-দ্বিধাহীনভাবে উচ্চারণ করেছি—মোর নাম এই বলে খ্যাত হোক আমি তোমাদেরই লোক।

লেখক: প্রেসিডিয়াম সদস্য, বাংলাদেশ যুব ইউনিয়ন

সারাবাংলা/এজেডএস

টুকরো টুকরো গল্পে ‘আমি’ হয়ে ওঠা হাবীব ইমন


বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ
সম্পর্কিত খবর