Thursday 05 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

সোনাঝরা-রাঙা শামীম আজাদ

হাবীব ইমন
১১ নভেম্বর ২০২৩ ১৩:৫৯

এক

ফাগুনে হাওয়া লাগছে বিকেলে। মেঘলা আবহাওয়া—হিম-হিম ভাব। দুপুর গড়াতে রোদ উঠেছিল বটে, কিন্তু তেজ ছিল না। ফাগুনে এদিন উত্তরে হাওয়াও মিলেছে। এমন আমেজে এ বছরের ১০ মার্চ সন্ধ্যায় শামীম আজাদের সঙ্গে দেখা। কত বছর পর দেখা—মনে করতে পারছি না। হয়তো ৫ বছর আগে—লম্বা সময়ের পর দেখা হলো। অন্যরকম এক অনুভূতি এটা। ভীষণ ঘোর লাগা এক সন্ধ্যা সেদিন।

মুহূর্তে স্মৃতির জানালা খুলে গেল—২০১২ সালের ২৪ নভেম্বর। ধানমণ্ডির সাত নম্বর রোডের আড়িয়াল হাউজে সেদিন আমাদের কয়েকজনের হাতে তিনি তুলে দিলেন ‘বিজয় ফুল’। আমরা বিজয় ফুলকে নিয়ে গেছি কয়েকটি জেলায়। একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বরে পতাকার ঘন সবুজে যে রক্তিম সূর্য উঠেছিল, তারই রূপকল্পই আমাদের ‘বিজয় ফুল’।

দুই

দেশে শামীম আজাদকে দেখেছি কয়েকবারই—ছোটবেলা থেকে তাঁকে চিনি-জানি। নানান পরিচিতির বৈভবে অসাধারণ তিনি। আজকাল ফ্যাশন সাংবাদিকতা, কিংবা লাইফস্টাইল সাংবাদিকতা বাংলাদেশে একটি সম্মানজনক অবস্থায় রয়েছে। এর গোড়ার কথা যদি বলতে হয়, সবার আগে শামীম আজাদের কথা আসবে। শামীম আজাদ কবিতা লিখতেন কলেজ জীবন থেকেই, তবে বাংলাদেশে তার প্রথম ব্যাপক পরিচিতি ঘটে ১৯৭০ এর দশকের নামী বাংলা সাপ্তাহিক সাময়িকী বিচিত্রার সাংবাদিক হিসেবে। তখনকার দিনে ঢাকায় খুব কম মেয়েই সাংবাদিকতায় আসতেন, বা রিপোর্টিং করতেন। বিচিত্রার প্রতিবেদক হিসেবে শামীম আজাদ সে সময়কার অনেক আলোচিত বিষয় নিয়ে রিপোটিং করেছেন, অনেক বড় বড় ব্যক্তিত্বের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন।

তিন

২০০৮ সালের আগে শামীম আপার সঙ্গে কথা হয়নি কখনও। বড় বড় মানুষদের সঙ্গে কথা বলার আগ্রহ আমার কখনো ছিল না, এখনও খুব একটা নেই। কী জানি এসব গুণী মানুষদের নিয়ে মাতামাতি করার ইচ্ছা হয় না। সবসময় নিজেকে আড়ালে রেখেছি। হয়তো আমার জড়তা কিংবা আমার সংকোচন প্রবণতার কারণে। তবে, দূর থেকে তাদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন রেখেছি।

শামীম আজাদ তখন বিলেতে। পত্রিকায় ছাপা হওয়া তার একটি লেখা থেকে পাওয়া ইমেইল ছিল যোগাযোগ করার একমাত্র মাধ্যম। প্রথমে আমার তোলা তার একটি ছবি পাঠাই। তিনি উত্তর দেননি। আবার আরেকটা ছবি পাঠাই। সাড়া দিলেন তিনি।

অনেক অনেক ভালোবাসা আর মায়ায় তিনি জড়িয়ে রাখলেন, আজ অবধি সে বাঁধন বড়ো শক্ত—বড়ো মিষ্টি। তেঁতো হয়নি কখনও। তার সঙ্গে কয়েকটি কাজ করেছি। দারুণ আনন্দ নিয়ে কাজ করেছি। কাজ করতে গিয়ে ক্লান্ত হয়েছি বলে মনে হয়নি। আগুনছড়া স্বপ্ন নিয়ে তিনি বাঁচিয়ে রেখেছেন আমাকে।

সত্তুরের বেশি বয়স, দুই বছর পর পঁচাত্তুর ছুঁবেন তিনি। এখনও তারুণ্য বেগে দাপিয়ে বেড়ান সৃষ্টির নতুন নতুন আকাশে। থেমে নেই মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ গড়ার নিবেদিত কাজে। কাছে কিংবা দূরে, যেখানেই থাকুন, তিনি আমাকে স্বপ্ন দেখান—অনুপ্রেরণা যোগান।

চার

তিন কি চার বছর পর শামীম আজাদ দেশে আসলেন। বিলেত ফিরে যাওয়ার আগের দিন, দেখা হলো, তার আগে ফোনে আমাকে ছোট্ট অভিমান জানালেন। পরে তিনি নিজেই বললেন, ‘আমি ছাড়া কে বকা দেবে।’ আপা বকা দিতে পারেন! এমনটা কখনও মনে হয়নি। পরম স্নেহে তিনি আমাকে ভালোবেসেন।

আমার কলামসমগ্র ‘লেখা-অলেখা’ প্রকাশ হলো ২০১২ সালের বইমেলায়। মোড়ক উন্মোচন করতে খুব একটা ভালো লাগে না। প্রকাশকের ক্রমাগত অনুরোধে মেলায় মোড়ক উন্মোচন হলো। শামীম আজাদকে বলতেই চলে এলেন। আমার মাকে পেয়ে তিনি বললেন, ‘আপনার ছেলেটাকে আমাকে দিয়ে দেন।’ কথাটা তার নিছক বলার জন্য বলা ছিল না। সবসময় আমাকে তাঁর আরেকটি ছেলেই ভেবেছেন। বিলেত থেকে দেশে এসেই আমাকে ফোন দেন। তিনি যোগাযোগ করেন নাই এমনটা কখনও হয়নি। দেখা করি আমরা। নিজের পাশে বসিয়ে খাওয়ান।

এবার কোনোভাবেই দেখা হচ্ছিল না। মনে মনে খুব আফসোস লেগেছে।

পাঁচ

মাঝে মাঝে জীবনকে খুব অবিবেচক আর নিষ্ঠুর কানামাছি খেলতে চায়। হাসিমুখেই সেই কানামাছি খেলায় অংশ নিয়েছেন শামীম আজাদ। হয়েছেন পর্যুদস্ত। বঞ্চিতও হয়েছেন। রক্তাক্ত হয়েছেন। কিন্তু পরাজিত হননি। লড়াইটা জারি রেখেছেন। দিন শেষে শামীম আজাদ আমাকেও লড়াইয়ে প্রাঞ্জল করেছেন। জীবন অভিজ্ঞতায় ঋদ্ধ তিনি। আমাদেরকেও সমৃদ্ধ করেন তিনি।

ছয়

শামীম আজাদের সঙ্গে পরিচয়ের বয়সটা বেশিদিনের নয়—নেহাত কমও না। ১৫ বছরের বেশি হবে। তবে প্রকৃত প্রকাশে কিছু কিছু পরিচয় জন্মান্তর। ক্ষণিকের পরিচয়কেও অনেকসময় বেশি ব্যাপ্তি ও ঘনিষ্টতা পায়। ঘটনাগুলোও তেমনি। টিএসসিতে সেই সময় জাতীয় কবিতা উৎসব চলছিল। সালটা ২০০৮ হবে। আজকাল সাল-টাল মনে থাকে না। সেই কবিতা উৎসবে সম্ভবত প্রথম দেখি তাকে। দেখা হওয়ার আগ পর্যন্ত বেশ ধন্দে ছিলাম। তিনি মেয়ে না ছেলে। এ ধন্দ হওয়াটা হয়তো স্বাভাবিক। আমি যতদূর জানি তাকে সামনাসামনি দেখার আগে সবাই কমবেশি এ ধন্দে থাকেন। তবে ব্যাপারটি নিয়ে কৌতুহলী ছিলাম না কখনই।

শামীম আজাদ—নামের মধ্যেই তার অনেক রকম বিশিষ্টতা আছে। এ নামটার মধ্যে তার এক ধরনের রহস্যময়তা ভর করে আছে। তাতে তার প্রথাবিরুদ্ধ সচেতনতা আছে, চঞ্চলতা আছে। মানবজীবনের নারী-পুরুষের যে সংকীর্ণ বৈষম্য, তার কিছুটা বেদনা উদ্ভাসিত এই নামে। হয়তো প্রচলিত সমাজব্যবস্থার নীরব প্রতিবাদ তার। সে কারণে প্রকৃত নামের সত্ত্বার আড়ালে তিনি নিবেদিত হয়েছেন নিজস্ব সত্ত্বার সৃষ্টিতে।

ফিরে আসি কবিতা উৎসবে, মঞ্চের সামনে হাজার হাজার মানুষ। তার ভেতর আমি একজন। মুগ্ধতা ছুঁয়ে গেছে। সীমাহীন উচ্ছ্বাসের মধ্যে দিয়ে অসাধারণ শৈলির ভঙ্গিতে তিনি কবিতা বাচন করলেন। এতটা মুগ্ধ হয়েছি, সেদিন তার পারফরমেন্সের মধ্যে বেশ ছন্দনের মুন্সিয়ানা পেলাম। দর্শকরা বেশ উপভোগ করছে দেখলাম। আমি বেশ উদাস, কিন্তু সেদিন চোখের পলক একটু নড়েনি আমার।

সেইবার উৎসবে ছবি আঁকার ব্যাপার ছিল। কবি মোহন রায়হান, কয়েকদিন আগে প্রয়াত সংগীতশিল্পী বুলবুল মহলানবীশ ছবি আঁকলেন পেশাদার শিল্পীদের সঙ্গে। শামীম আজাদও ছবি আঁকলেন। আমি সেইসব ছবি তুললাম। এইভাবে তার সঙ্গে আমার পরিচয়ের আনুষ্ঠানিকতা।

সাত

শামীম আজাদের বিশিষ্টতা নিয়ে অনেক আলোচনা আছে। সেগুলোর একটি বিশেষণত্ব আছে। আবার সমালোচনাও থাকতে পারে। সেইসব নিয়ে আমি আলোচনার সূত্রপাত করব না। তবুও কিছু কথা থেকে যায়।

আমার মা সবসময় বলেন, একসময় তিনি (এখনকার চাইতে) অনেক বেশি সুন্দর ও আকর্ষণীয় ছিলেন। তার মধ্যে ব্যাপক সাহসিকতা ছিল। টেলিভশনে উপস্থাপনা করতেন, তার কথা বলার ধরন উপস্থাপনার জায়গাটা নতুন একটি মাত্রা তৈরি করেছে। আমারও তাই মনে হয়। এখনো সেই ধারাবাহিকতা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে ছড়িয়ে যাচ্ছে। আজকাল ফ্যাশন সাংবাদিকতা সব গণমাধ্যমগুলোতে সংযোজিত হয়েছে, বিষয়টি গণমাধ্যমের কাছেও এখন গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু এই ফ্যাশন সাংবাদিকতার ব্যাপারটি যিনি প্রাতিষ্ঠানিক করে তুলেছেন, তিনি শামীম আজাদ। বাংলাদেশের বাঙালিয়ানা সুরক্ষা করার জন্য আশির দশকে সাপ্তাহিক বিচিত্রার প্রয়াত সম্পাদক শাহাদত চৌধুরীর প্রণোদনা, পৌরহিত্যে এবং শামীম আজাদের ফ্যাশন জার্নালিজমের নির্দেশনায় আজকের আমাদের দেশীয় ফ্যাশনের এই ব্যাপক বিস্তৃতি। তার লেখা গল্প, কবিতা, সাহিত্যের যে আঙ্গিক নিয়ে কথা বলি না কেন, এককথায় বলা চলে এটি তার স্বতন্ত্র ধারা স্রোতমান। কখনো কখনো মনে হয়েছে, ব্রিটিশ-বাংলার সংমিশ্রণ তিনি তৈরি করেছেন। আবার যখন তিনি স্টোরিটেলিং করেন, তখন তার কাজের উপাদানগুলো গ্রামবাংলার এক একটি প্রতিচ্ছবি হিসেবে তুলে ধরেছেন সব জায়গায়। তার মানে এই প্রবাসে থেকেও তিনি এখনো এই বাংলা ও বাংলা সাহিত্যকে সবসময় সর্বোচ্চ মননে প্রতিনিধিত্ব করছেন। প্রগতিচেতনা বা প্রগতিশীলতার শাব্দিক ব্যঞ্জনা তিনি পুরোপুরি প্রয়োগ করতেন। তাতে তার অস্পষ্টতা ছিল না। হয়তো আমার কথাগুলো খুবই হালকা চালে, ভীষণ সাধারণভাবে বলা। তাকে নিয়ে এর চাইতে বড় আয়োজন নিয়ে লেখা শামীম আজাদের জন্য মূর্তমান এবং বেশি যৌক্তিক।

আট

ব্রিটিশরা ১ থেকে ১১ নভেম্বর পপি ফুল পরে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শহিদদের স্মরণ করেন। আপা ভাবলেন, এই যে সবুজ শ্যামল বাংলাদেশে অসংখ্য শহিদ আছে, যারা মুক্তিযুদ্ধে আত্মাহুতি দিয়েছে, অসংখ্য যোদ্ধা রয়েছে, লড়াই করেছে জীবনবাজি রেখে। তাদেরকে আমরা স্মরণ করি না, যেভাবে আমাদের করা উচিত। পাশাপাশি নতুন প্রজন্মের প্রতি মুক্তিযুদ্ধের চেতনা জাগিয়ে তোলাটা দরকার। তাই তিনি ভাবলেন এবং করা শুরু করলেন, ‘বিজয় ফুল’ নামে একটি জাগরণ কার্যক্রম। প্রতিবছর ১ ডিসেম্বর থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত নানান শ্রেণি-মানুষ বিজয় ফুল পরে মুক্তিযুদ্ধের নিশানটা তুলে ধরে। আপার এই স্বপ্নের কাজটা লন্ডন ছেড়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ, এখন বাংলাদেশেও হচ্ছে। এই যে মুক্তিযুদ্ধের প্রতি, বাংলাদেশের প্রতি তার কতটা আকুলতা, এটা তার শুধুমাত্র ঘনিষ্টজনরাই জানে। দেশে যখন মুক্তচিন্তার মানুষ, লেখক, প্রকাশক হত্যার শিকার হয়, আপা নীরবে কাঁদেন। তার কান্নার শব্দগুলো ওই দূর দেশ থেকে আমাদের কানেও মলিন বিবর্ণ পাতা ঝরে পড়ে মর্মর শব্দ তুলে। পলাশের নিষ্পত্র শাখাগুলো ভরে উঠেছে অজস্র ফুলের রক্তিম আভায়।

নয়

শামীম আজাদকে আপা বলি। এটি তার সঙ্গে কাজের সুবাদের কারণে। আবার এ অর্থে বলাও যেতে পারে, সরাসরি ছাত্র না হলেও তার জীবনসমগ্রতায় আমি তার ছাত্র। অনেক কিছু শিখেছি তার কাছে। তিনি হাতে ধরে অনেক কিছু শিখিয়েছেন। অনেক বাস্তবতাকে আমার চোখের সামনে দীপ্যমান করেছেন। সেই অর্থে তো আমি তার ছাত্র। কিন্তু ওই ‘আপা’ শব্দটা একটা প্রতীকী সম্বোধন। আমি বিশ্বাস করি, জানি তিনিও বিশ্বাস করেন, তার একটি সন্তান আমি। আমার দুঃসময়কে তিনিই সবচাইতে বেশি আলোকময় করেছেন। শুধু কথার জন্য কথা নয়, আপা সবসময় সেইভাবে আগলে রেখে গেছেন। আজ আমি যা লিখছি তার ভেতরে আপার অসম্ভব অনুপ্রেরণা সবসময় কাজ করেছে। তিনিই আমাকে কতগুলো কাগজে আমাকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন, পরামর্শ দিয়েছেন ওখানে লিখো। আমি লিখি। লিখে চলেছি। আপাকে যখন ধন্যবাদ জানাই, খুব রাগ হোন। শুধু বলেন, তুই আমার বাপ-না! এত বিনয় ভালো না। আমার প্রতি তাঁর অনেক ভালোবাসা। কিন্তু ভালোবাসার প্রতিদান হয় না।

দশ

১৯৫২ সাল—ভাষা আন্দোলনের অগ্নিগর্ভে শামীম আজাদের জন্ম। সে হিসেবে তার ৭৩তম জন্মবার্ষিকী। জন্মদিন মানে জীবন থেকে একটা বছর চলে যাওয়া, এটা অমোঘ সত্য। তার চাইতে আরও সত্য দেশ, মানুষ ও কালকে উজ্জ্বল করার প্রত্যাশা তৈরি। প্রশ্ন হচ্ছে, ভবিষ্যত শব্দটা অজানা দিশার মতো শোনায়? তবে শুদ্ধ কবি হিসেবে নয়, নানাবিধ কারণে অবগুন্ডিত শামীম আজাদ ভবিষ্যতের দরজায় কড়া নাড়বেন। নিশ্চয়ই তারুণ্যের দৃপ্ততার আন্তর আলোর স্পর্শ ছড়িয়ে পড়বে আগামী দিনে।

লেখক: রাজনীতিবিদ

সারাবাংলা/এসবিডিই

সোনাঝরা-রাঙা শামীম আজাদ হাবীব ইমন


বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ
সম্পর্কিত খবর