Saturday 07 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

গভর্নর ও জেনারেলের আখেরী মোলাকাত

অমল সাহা
১৬ ডিসেম্বর ২০২৩ ১১:৩৮

১৯৭১ সালের ডিসেম্বর মাস। গভর্নর হাউজের রসুই ঘরে মুর্গচোলাইয়ের মাখনে আঙুল চুবিয়ে লালু মুখের ভেতর সেই আঙুলটা একটা লম্বা চাটন দিয়ে চোখ বুজে ফেলে। সেটা দেখে খৈয়া বাবুর্চি খেঁকিয়ে ওঠে, আরে আইজও তুই সাহেবগো মাখ্খনে আঙুল দিছস!

লালু এ কথায় মোটেও ভড়কে না গিয়ে বলে, চাচা আখেরী খাওন খাওয়ান, হেরাতো শ্যাষ।

এ কথায় খৈয়া বাবুর্চি চোখ গরম করে, আরে তুইতো নিজের জানটা খোয়াবি! আমারেও মারবি নিজেও মরবি।

লালুর মাথাটা মোটা। মোটা বলেই খৈয়া লালুকে সাগরেদ বানিয়েছে। যা তাকে করতে বলা হয় লালু চুপচাপ সব কামকাইজ করে যায়। কিছুটা বলদ কিসিমের। কিন্তু এতো খাওয়ার মধ্যে থেকেও লালুর খাওয়ার লোভটা যায়নি। সুযোগ পেলেই সাহেবদের রান্না করা খাওয়ার মধ্যে আঙুল চুবিয়ে মুখের মধ্যে সুড়–ৎ করে ঢুকিয়ে দিয়ে স্বাদ নেয়। ইদানিং লালুর এ রোগটা বেড়েছে। সাহেবদের চলাফেরা আর বাইরে মুক্তিদের তাগদ দেখে লালুর ধারণা জন্মেছে চাঁদুদের দিন শেষ।

বহু বছর ধরে খৈয়া বাবুর্চি এ গভর্নর হাইজের বাবুর্চির কাজ করে আসছে। তার আসল নাম গোলাম হোসেন। কিন্তু সে মোহাম্মদ রফির ‘খৈয়া খৈয়া চাঁদ, খোলা আসমান, আখোঁসে সারি রাত যায়েগি…..’ গানটা ভাল গাইতে পারে বলে তার নাম হয়ে গেছে খৈয়া বাবুর্চি। এমনকি সে বিয়ে বাড়িতেও বরযাত্রী কন্যাযাত্রীদের এ গানটা গেয়ে শুনিয়েছে। হইলোটা কী? খৈয়া বাবুর্চি জানতে চায়।

– কী আর হইবো? হোগায়া। মোটা মাথা লালু জানায়, মুক্তিরা নাকি আইসা পড়ছে ঢাকা শহরের কাছে।

– কেইছে তুম কাহা শোনেগা? বিলকুল ঝুট বাত, বিহারী নানকা প্রতিবাদ করে।

– ঝুট বাত? আমি মিছা কইতাছি? আমারতো ডর লাগগিয়ারে নানকা। লালু ফুঁপিয়ে ওঠে।

নানকা লালুকে সান্ত্বনা দেয়, আরে লালু রোনে কিয়া? একসাথ সব শহীদ হো যাইয়ে।

– শহীদ হমু আমি? তুই শহীদ হ গিয়া।

কথা অন্য দিকে চলে যাচ্ছে দেখে খৈয়া বাবুর্চি লালুকে ধমক দেয়, এই লাউল্ল্যা চুপ কর।

নানকা খৈয়া বাবুর্চিকে বলে, দ্যাখ, লালু সোচা ও মর যায়েগি, মউত আ গিয়া হা হা হা, শালে চিকনা মুরগা!

চারদিকে অবস্থা চরম খারাপ। আজ সকালেই ক্যান্টনমেন্টে গভর্নর আবদুল মালেক মোতালেবকে জেনারেল নিয়াজি ডেকে পাঠিয়েছেন পরামর্শ করার জন্য। অথচ হওয়ার কথা ছিল উল্টো। গভর্নরই জেনারেলদের ডেকে পাঠাতে পারেন। গভর্নর মালেক একটু দোনোমোনো করছিলেন প্রটোকল না মানার জন্য। নিয়াজি সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, তিনি ক্যান্টনমেন্ট থেকে এক পাও বাইরে আসবেন না। মুক্তিবাহিনীর যন্ত্রনায় তিনি অতিষ্ঠ আছেন। তিনি গভর্নরকে জানিয়েছেন, এখন তার রাতে ঘুম হয়না। বিছানায় ছটফট করেন। দুইদিন আগে কোন এক ফকিরের থেকে পানি পড়া এনে খেয়েছেন। যদি কিছু হয়। মালেক সাব তাতেও আপত্তি করাতে জেনারেল নিয়াজি সাফসাফ জানিয়ে দিয়েছেন, না আসলে রাজাকার পাঠাবেন চ্যাংদোলা করে ধরে আনতে। আর্মি পাঠাবেন না। আর্মিদের তিনি নীচু করতে চাননা একটা বংশবদ বাঙালি গভর্নরকে ধরে আনার জন্য। এসব শুনে গভর্নর মালেক নিজের স্ত্রীকে বলেছেন, যাইগো। বলা যায় না ফিরে আসি কি না। যাচ্ছি একটা বেয়াদবের কাছে। আমাকে বলে কি না, রাজাকার পাঠিয়ে আমাকে চ্যাংদোলা করে ধরে নিয়ে যাবার জন্য। গভর্নর মালেকের স্ত্রী জানতে চান, চ্যাংদোলাটা কী?

মালেক এ কথায় ক্ষ্যাপেন, বেগমকে বলেন, চ্যাং চিনো? চ্যাং? সেটা দোলাতে দোলাতে নিয়ে যাবে।

গভর্নর সাহেবের স্ত্রী লজ্জা পায়, কারণ তিনি জানেন এটা একটা আঞ্চলিক ভাষা। এবং বিষয়টা শরমের। বেগম সাব বলেন, যান কী আর করবেন? সেই দিনও আর নাই মানুষও নাই। সবই গুজর গ্যায়া। আহা কি দিন সব গেছে! আমেরিকা, ইংল্যান্ড, অষ্ট্রিয়া, চায়না কোথায় না গেছেন? স্বামীও যেত বাষ্ট্রদূত হয়ে তিনিও যেতেন রাষ্ট্রদূতের বউ হয়ে। কি দিন! কি দিন! তিনি মনে মনে ভুট্টোকে একটা গালি দেন। ওর জন্যই সব সব্বনাশ হ’ল। মোটামাথা আইয়ূবকে লারকানায় নিয়ে পাখি শিকারের নামে কী বুঝালো, ব্যাস্ সব গরবর হোগ্যায়া!

গভর্নর সাব ক্যান্টনমেন্টে রওয়ানা দিলেন। গাড়ির পিছনে চারজন রাজাকার সামনে দুইজন রাজাকার বসালেন যাতে গুলি লাগলে আগে ঝুটজঞ্জালগুলিই মরে। রাস্তায় বেরিয়ে তিনি গুলিস্তানে লোকজনের কিছুটা আনাগোনা দেখে ভাবেন, দেশ এতো শান্তশিষ্ট অথচ চারদিকে হচ্ছেটা কী! শাহবাগ পার হওয়ার পরই সব সুনসান। গভর্নর সাব এবার ভয় পান। গা ছমছম করা নীরবতা। একবার যদি দিরিম করে একটা বোমা ফাটে!

নিয়াজির ক্যান্টনমেন্টের অফিসের গেটে এসে দেখেন কেউ নাই। সামনে শুধু দুজন সিপাই স্টেনগান হাতে পাহাড়া দিচ্ছে। তিনি জিজ্ঞেস করেন, জেনারেল সাব কোথায়?

একজন উত্তর দিলো, বলা নিষেধ।

গভর্নর সাব মনে মনে রাগেন কিন্তু কড়লা তিতা কন্ঠে বলেন, জেনারেল সাবকে খবর দাও।

কি একটা অবস্থা! অথচ আগে হলে গেট থেকে এসকট দিয়ে ভিতরে নিয়ে আসতো। এমন সময় এটাচে ব্রিগেডিয়ার হাশেমকে দেখা গেল এগিয়ে আসছেন। একে আগে থেকেই চিনতেন। সামনে এসে বললেন, আসুন স্যার। আমরা আপনার জন্যই অপেক্ষা করছি।

মালেক গভর্নর বললেন, নিয়াজি সাব কোথায়?

– আছে স্যার। উনিতো অফিসে বসেন না। উনি এখন ঘোড়ার ফিড গোডাউনে বসেন। পাশে ঘোড়ার আস্তাবল আছে, সেখানটায়। চলুন-

গভর্নর মালেক হাঁটতে হাঁটতে বিড়বিড় করেন, জেনারেল বসে আস্তাবলের পাশে! কিসব ঘোড়াচোদা কাজকর্ম! কিন্তু মুখে মধু ঢেলে জিজ্ঞেস করেন, কেন ওখানে কেন?

ব্রিগেডিয়ার মালেক অবাক হয়, আরে স্যার কিছুইতো জানেন না দেখছি! যেকোন সময় ইন্ডিয়ার এয়ার স্ট্রাইক হতে পারে। তাই ঘোড়ার পাশে ঠাঁই নিয়েছেন।

এসব শুনে মালেক সাহেবের আর কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। তিনি চুপচাপ ব্রিগেডিয়ার হাশেমের পিছনে পিছনে হাঁটতে থাকেন। সামরিক ফরমান জারী করে ঘোড়ার আস্তাবলের পিছনের একটা গুদাম ঘরকে জেনারেল সাহেবের অস্থায়ী অফিস ঘোষণা করা হয়েছে। সেখানে এসে দেখলেন জেনারেল নিয়াজি সেখানে একটা সাধারণ টেবিলের পিছনে বসে আছেন। সামনে জায়গায় বেশ কয়েকটা সোফা বসানো। গভর্নর মালেক সেখানে এসে বসলেন। জেনারেল উঠেও দাঁড়ালেন না। শুধু হাত দিয়ে সামনের সোফায় বসার জায়গা দেখিয়ে দিলেন। বসতে বসতে গভর্নর মালেক বলেন, এখানে কীভাবে বসেন! এখানেতো ঘোড়ার মুতের গন্ধ আসছে।

জেনারেল নিয়াজি ক্ষোভ প্রকাশ করেন, এখনতো গন্ধ পাইতাছেন এরপর ঘোড়ার মুত খাওয়া লাগবে।

গভর্নর মর্মাহত হ’ন, কি যে বলেন জেনারেল সাহেব। শুনুন, নিয়াজি সাব, ভুট্টোতো ইয়াহিয়ারে সরিয়ে হামুদুর রহমানেরে দিয়া কমিশন বানাবে, আমাদের হারের কারণ কি জানার জন্য।

-আরে রাখেন আপনার কমিশন। ভাত দেয়ার মুরোদ নাই কিল মারার গোঁসাই!

ভুট্টো ই্য়াহিয়ার কথা শুনে নিয়াজি তেলে বেগুনে জ¦লে ওঠলো, অগো কমিশনের গোয়া দিয়া বাঁশ দিমু। অয় আমারে চিনেনা। ওই ফাজিলটার কথা বলবেন না। এই কমিশন বানানের অর্থ কী জানেন? ও সব দোষ আমার ঘাড়ে দিবার চায়।

গভর্নর মালেক বলেন, না না জেনারেল সাব আপনি অমন করে ভাববেন না। ইয়াহিয়া সাব বিচক্ষণ ব্যক্তি….

– ওর বিচি আছে কি না সেটা দেখুন আগে। আবার বিচক্ষণ বলছেন! ও যদি বিচক্ষণ হ’ত তাইলে ৭০ এর ইলেকশনের পর ভুট্টোর কথায় এই তালবাহানা করতোনা। বাঙালিদের হাতে পাওয়ার দিয়ে দিত।

– জেনারেল সাব আমি কিন্তু আপনার এ কথার প্রতিবাদ জানাবো।

– তাতো জানাবেনই। চামচার মতো কথা! বাপের জন্মে গভর্নর হইতে পারতেননি? ইয়াহিয়া মউতের সময়ে তাও গভর্নর বানাইছে।

– না আমাকে বলতে দিন, মালেক কথা বলার ফ্লোর চায়, তখনতো আপনারা সব জেনারেলরাও তাল দিছিলেন, এক্কেবারে এক ব্যাটেলিয়ন সৈন্য দিয়া বাংলাদেশেরে এফোঁড় ওফোঁড় করে দিবেন। আবার কে যেন বলেছিল, মাখনের মধ্যে ঢুকবো আর ছুরির মত বাইর হইয়া যাইবো!

-বলছিল নাকি? বোধহয় নেশার ঘোরে।

-ক্যান আপনিওতো কইছিলেন, বাঙালিদের জাত বদলে দিবেন। নতুন পাকিস্তানি জাত বানাবেন।

-বলছিলাম নাকি? বোধহয় নেশার ঘোরে।

গভর্নর মালেক বলেন, সবই নেশার ঘোরে! এতো সেই, যখন কেউ আমাকে মাতাল বলে… সেই গানটার মতো অবস্থা।

– কার গানের কথা বলছেন? মেহেদী হাসান সাহেবের?

– আরে না, এটাতো মান্না দে’র গান-ইন্ডিয়ান শিল্পী, পাশে বসা নিয়াজির এটাচে ব্রিগেডিয়ার হাশেম বলেন।

নিয়াজি তড়াক করে লাফিয়ে ওঠেন, গভর্নর সাব আপনি ইন্ডিয়ান শিল্পীর গান শোনেন! তাজ্জব কথা! এখনতো আপনাকেই আমার গুল্লি করতে ইচ্ছা করতাছে। আমরা দিনরাত টেনশানে মইরা যাইতাছি আর আপনে হিন্দুদের গান শোনেন?

-হ শুনি। একশ বার শুনি। ক্যান আপনি শোনেন নাই, দুনিয়াকে মজা লেলো, দুনিয়া তোমারি হ্যায়….সেইটাওতো ইন্ডিয়ান ছবির গান। আগেতো আপনার অফিসে আসলেই এই গানটা শুনতে পেতাম।

-আরে ভাই সেসবতো যুদ্ধের প্রথম দিকে। এখনতো আমও গেছে ছালাও গেছে। এখন কি গান শোনার সময় আছে? আর আপনি এখনও গান শোনেন?

– আলবৎ শুনি।

নিয়াজি গভর্নর মালেককে দেখিয়ে ব্রিগেডিয়ার হাশেমকে বলেন, হাশেম, একে বাইরে নিয়ে নাক বরাবর একটা গুলি করো। ও দোযকে গিয়ে গান শুনুক।

ব্রিগেডিয়ার হাশেম সাথে সাথেই বলে, চলেন গভর্নর সাব আপনের নাক বরাবর গুলি করি। অর্ডার হয়ে গেছে। চলেন। আমি আবার এসাইনমেন্ট ফেলে রাখতে পারিনা।

গভর্নর মালেক নিয়াজির দিকে তাকিয়ে বলেন, আপনার কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে?

নিয়াজি বলে, মাথা খারাপ ছিলনা। এখন আমার মাথা পুরা খারাপ। আমি এখন নিজা পাগলা।

ব্রিগেডিয়ার হাশেম, বুঝলেন কিছ ুসিচুয়েশন? স্যার এখন নিজা পাগলা। অবস্থা চারদিকে কেরাসিন।

গভর্নর মালেক আচানক হয়ে ব্রিগেডিয়ার হাশেমের দিকে তাকায়, নিজা পাগলা!

– হুম, মানে নিয়াজি পাগলা। সংক্ষেপে নিজা পাগলা।

নিয়াজি আবার খেঁকিয়ে ওঠে, এতো কথা কিসের? বললাম না নাক বরাবর গুল্লি করতে।

– আরে আমার কথা শুনবেনতো, কেন আমি ইন্ডিয়ার গান শুনি, গভর্নর মালেক আর্জি জানায়।

-আবারও ইন্ডিয়া শব্দটা আমার সামনে উচ্চারণ করছে! আপনি চায়নিজ গান শোনবেন। কারণ তারা আমাদের বন্ধু।

– কী বলছেন এসব? চায়নিজ ভাষাতো আমার বাপের জন্মেও শিখিনি। শুনুন আমি ইন্ডিয়ার গান শুনি মিলিটারি কোড বের করার জন্য। গানের মধ্যে দিয়ে কোন নির্দেশনা দিচ্ছে কিনা মুক্তিদের সেটা দেখছি। এ বিষয়ে আমার প্রশিক্ষণ আছে। আপনার মনে নাই অপারেশন জ্যাকপটের কথা? আমাদের সোয়াত জাহাজ যে মাইন দিয়ে মুক্তিরা উড়িয়ে দিলো। ঐ সময়তো আকাশবাণী থেকে বাংলা গান বাজিয়ে ওদের ইন্সট্রাকশন দিয়েছে।

ব্রিগেডিয়ার হাশেম প্রায় চিৎকার করে ওঠে, ইয়েস স্যার গভর্নর সাব ঠিক কথাই বলেছেন। ঘটনা সত্য। স্যার আপনার অর্ডার উইথড্র করুন।

নিয়াজি বলেন, কোন অর্ডার?

– স্যার এই যে গভর্নর সাবকে নাক বরাবর গুল্লি করতে বললেন।

নিয়াজি হাশেমের দিকে তাকিয়ে বলেন, তুমি একটা বানরের লেজের তলার ফুটো, কুত্তার গারবেজ হাশেম।

– ইয়েস স্যার।

– নো তুমি তাওনা। তোমার একটা আক্কেল থাকা উচিৎ আমি গভর্নর সাবকে মারতে বললেই তুমি মেরে দিবা?

– ইয়েস স্যার, কারণ এখানে আই হ্যাভ নো এনাদার অপশন। অর্ডার ইজ অর্ডার। আই হ্যাভ টু কেরী আউট দিজ অর্ডার।

-আরে গাধার বাচ্চা গাধা চুপ কর, নিয়াজি হতাশ হয়ে সিংহাসনের মতো সোফায় হেলান দিয়ে বসেন। তার মাথাটা ফাঁকাফাঁকা লাগছে। তার মনে পড়ছে ইস্টার্ন কমান্ডে তাকে বদলি করার পর এখানের দায়িত্বে থাকা সাহেবজাদা ইয়াকুব খান তাকে উপদেশ দিয়েছিল, কীভাবে বাঙালিদের টাইট দিতে হবে। ম্যাসাকার করতে হবে। তিনি তখন ইয়াকুবকে বলেছিলেন, আরে ইয়ার ঐসব ছাড়ো সেসব আমি সামলে নিবো, আগে তোমার ঢাকার বান্ধবীদের ফোন নাম্বারগুলি দিয়ে যাও। আহাঃ তাদের একজন যদি এখন কাছে থাকতো একটু রিলাক্স করে নিতে পারতেন। সব হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে। সেই দিন বাঘে খেয়েছে। বাঘ মানেতো রয়েল বেঙ্গল টাইগার! সত্যি প্রশংসাটা করতেই হয় মুক্তিগুলির! কেমন আমাদের মতো একটা চোক্খা বাহিনীকে ভোঁতা কইরা থ্যাবড়াইয়া দিল। নিয়াজি আবার সিনা টান করে সোজা হয়ে বসেন। গভর্নর মালেককে বলেন, এই মিয়া আপনের ইয়াহিয়া আর ভুট্টো না কইছিলো নেপালের পাহাড়ের উরপে দিয়ে চিনা সৈন্যরা আসবো আর বঙ্গোপসাগর দিয়া ভাইস্যা ভাইস্যা সপ্তম নৌবহর আইস্যা আমাগো সাথে যোগ দিবো। কই?

গভর্নর মালেক বলেন. সবতো ঠিকঠাক হয়ে গিয়েছিলো কিন্তু বাগড়া দিলোতো ইন্ডিয়া।

নিয়াজি আরও ক্ষ্যাপে, আরে রাখেন খালি মিছা কতা ক’ন। আপনেরা কি ধইরা নিছিলেন চিনাগো আসার জন্য ইন্ডিয়া আপনেগো লাল গালিচা পাইত্যা দিবো? খালি বেতাইল্যা কথাবার্তা। মিয়া প্ল্যান ভুল করছিলেন। গাঁড়লের দল!

মালেক বলেন, ইউ ক্যান নট সে আস গাঁড়ল। প্রটোকল মানুন জেনারেল সাহেব! আপনিতো যেভাবে বলছেন, মনে হচ্ছে আপনি ইন্ডিয়ার পক্ষ হয়ে কথা বলছেন।

জেনারেল নিয়াজি চিড়বিড়িয়ে ওঠেন, খামোশ! ইশ্ আবার প্রটোকল! দেখেন কবে পটল তোলেন। শুদ্ধভাষায় কথা কইয়া কইয়া আমাকে তখন থেকে খোঁচাইতাছেন। আমার মতো গেরাইম্যা ভাষায় কথা কন। দেখেন না আমি কেমতে কইতাছি।

গভর্নর মালেক থতমত খান, আপনিতো ওস্তাদ মানুষ, আপনি পারেন। গভর্নর মালেক ব্রিগেডিয়ার হাশেমের চোখে চোখ রাখেন। হাশেম মাথা নাড়েন, ওনার মাথাটা গেছে।

এমন সময় দিরিম্ করে কোথায় যেন বোমা পড়ে। দুজনেই চমকে ওঠেন। আগে এরকম হ’ত না। এখন ‘দিরিম্’ শব্দ শুনলেই কলিজা কাঁপে।

নিয়াজি বলে, একটা মেসেজেরও উত্তর নাই। কেমতে যুদ্ধ চলবো, কেমতে সাপ্লাই লাইন ঠিক রাখুম কোন ঠিক ঠিকানা নাই।

গর্ভনর মালেক মাথা নাড়েন, রাওয়ালপিন্ডি কী বলছে? কোন উত্তর দিচ্ছেনা?

– হাতের কাছে পাইলে পিন্ডি চটকাইতাম, নিয়াজি রাগে ক্ষোভে চিৎকার করেন।

গভর্নর মালেক বলেন, এই যে নিয়াজি সাব, আপনি কিন্তু আবার পিন্ডি কথাটা উচ্চারণ করলেন! এটা কিন্তু বাপ মা মরে গেলে হিন্দুরা করে। তারা পিন্ডি চটকায়।

– ওহ্ শিট! ধরে নেন আমারও বাপ মরছে। আমি এখন পিন্ডি চটকাইতে চাই। আপনাদেরওতো বাপ মরছে, ই্য়াহিয়া আপনাদের বাপ ছিল না? ছিলোতো? নিয়াজি চরম হতাশ।

– কি যে বলেন! গভর্নর মালেক উষ্মা প্রকাশ করেন।

জেনারেল নিয়াজি গভর্নর সাহেবকে দেখে মুখটা পাঁচের মতো করে ব্যাজার মুখে অন্যদিকে তাকিয়ে হ্যান্ডশেক করেন তারপর বসতে বলেন। ভাণ ভনিতা না করে জেনারেল নিয়াজি কাজের কথায় চলে যান, একটা জিনিস চিন্তা করেন, যুদ্ধে নামাইছে অথচ সাপ্লাই নাই। কেবল অস্ত্র দিয়ে যুদ্ধ হয়? খাবার নাই। খাবারের কথা বললাম, পিন্ডি থেকে জানাইলো, লোকাল থেকে খাবার সংগ্রহ করো। এইটা একটা কথা? আমার সোলজাররা গ্রামের লোকের গরু বাছুর লুট কইরা নিয়া আসে ক্যাম্পে। গ্রামের লোকজনের মধ্যে কী রকম ক্ষোভ হয় এর জন্য এইটা কি পিন্ডিতে বইসা বুঝবো? এইটাতো জনযুদ্ধ শুরু হইছে। গ্রামের লোক বলে, আমরা নাকি হার্মাদ গরুচোর ছাগল চোর! এটুকু বলে অনুতাপে নিয়াজির চোখের পানি পড়তে থাকে।

গভর্নর মালেক সান্তনা দেন, জেনারেল সাহেব আপনি নিজেকে কেন এতো ছোট ভাবছেন? আপনার অধীনে আছে বিশে^র চতুর্থ শক্তিশালী বাহিনী!

জেনারেল নিয়াজির ফোঁপানি কমে, এসব বলে আর ফাঁপড় নিয়েন না। বাহিনীর শক্তি চলে গেছে এখন শুধু শালী পড়ে আছে। দ্যাখছেন না চোখে কালি পড়ে গেছে আমার!

মালেক বলেন, আপনি আবার পিন্ডিতে জানান।

নিয়াজি ক্ষ্যাপেন, আপনি সিভিল গভর্নমেন্টের লোক, আপনিও বলেন।

মালেক একটা দীর্ঘশ^াস ছাড়েন, আরে ভাই আপনি হলেন পাঞ্জাবী আপনার কথা না শুনে আমার মতো বাঙালির কথা শুনবে পিন্ডি?

– হুম আমি হইতাছি পাঞ্জাবী আর আপনে হইতাছেন পায়জামা। ব্যাস্। আমি পাঞ্জাবী না বুঝলেন? মাঝে মধ্যে পাঞ্জাবী গায়ে দেই। ঐটুকই।

দুজনে চুপচাপ থাকেন কিছুক্ষণ। এরমধ্যে আবার গভর্নর মালেক ফোঁপাতে শুরু করেন। তিনি তার বহু আগে মরে যাওয়া নানীর কথা মনে করে কান্না শুরু করলেন। সেই জেনারেল সাহেব কেঁদেছেন এখন তার না কাঁদলে ভাল দেখায় না। এটা দেখে নিয়াজি বলেন, আপনি আবার কান্না শুরু করলেন কেন? মালেক শুধু বলেন, আহা! সোনার পাকিস্তান! তিনি হাউমাউ করে কেঁদে ওঠেন। এটা দেখে নিয়াজিও আর ঠিক থাকতে পারেন না। তিনিও মাথার ক্যাপে মুখ ঢেকে গভর্নরের গলা ধরে কাঁদতে থাকেন। তার মুখে গন্ধ। চারদিকের চাপে তিন দিন দাঁত মাজার সময়ই পাননি।
কান্নাকাটি দেখে এটাচে ব্রিগেডিয়ার হাশেম মনে মনে খিকখিক হাসেন, হালারা শুরুটা করছে কি!

এরমধ্যে একজন ব্যাটম্যান একটা ট্রেতে চা নাস্তা নিয়ে আসে। রুমে ঢুকে সে অবাক, বাঘা বাঘা সাহেবরা গলা ধরে কাঁদছেন! ঘটনা কি তাইলে সাচ? মুক্তিরা কি ঢাকার কাছে চলে আসছে?

হাশেম দুজনকে বিরতিহীন কান্নার সুযোগ দিতে ব্যাটম্যানকে বলেন, এখন যাও। আর হ্যাঁ শোনো, এসব কান্নাকাটি বাতচিতের কথা যেন বাইরে না যায়।

ব্যাটম্যান ট্রে নামিয়ে দ্রুত নামিয়ে ভাগে। এদের মন মেজাজের ঠিক নাই, যেকোনো সময় যে কোনো ঘটনা ঘটিয়ে ফেলতে পারে। চাই কি কোমড় থেকে পিস্তল বের করে তাকে ঠুস্ করে ফেলতে পারে।

এসব কান্নাকাটির পর চা পানি খেয়ে গভর্নর সাব বিদায় নিতে উঠে দাঁড়ান। জেনারেল নিয়াজি মিটিংয়ের সামারি জানতে চান, তাইলে কী খাড়াইলো?

গভর্নর মালেক এ ধরনের অভব্য ভাষা শুনে মনে মনে রাগেন। কিন্তু গম্ভীর মুখে বলেন, যদি আপনার কথাই ধরি, তাহলে বলতে হয়, আসলে খাড়ানোর আর কিছু নাই। এখন সব ইয়া নফসি ইয়া নফসি। আচ্ছা চলি।

নিয়াজি দরজা পর্যন্ত এগিয়ে গভর্নর মালেককে এগিয়ে দেয়, আচ্ছা ভাইসাব দোয়া কইরেন। গভর্নর মালেক মনে মনে কুপিত হ’ন, ব্যাটা এখন আমাকে ভাই বলিস! প্রটোকল গুলে খেয়েছিস? কিন্তু মনের রাগ মনেই চেপে রাখেন। বেশী কথা বললে ঠুস করে ফেলতে পারে।

গভর্নর মালেক একটা কাষ্ঠ হাসি হেসে বলে, অবশ্যই। দোয়া সব সময় আপনার জন্য। গাড়ি ছেড়ে দেয়। দুজন দুজনের দিকে তাকিয়ে থাকেন কুটিল দৃষ্টিতে। জেনারেল নিয়াজি ভাবেন, বেটা গভর্নর, আমাদের কাছে খবর আছে, গভর্নর হাউজের উপর দু এক দিনের মধ্যেই বোমা ফেলবে ইন্ডিয়া। আমি কি আর সাধে ঘোড়ার ঘরের কাছে ঠাঁই লইছি? নিজের লোকের বিরুদ্ধে বেইমানি করছস। মীরজাফর কোহানকার! তুই মর।

গভর্নর মালেক ভাবে, আমারে অপমান! দু চাইর দিনের মধ্যেই খেল খতম। তুইও শেষ, তর জেনারেলগিরিও শেষ! আমিতো আজই সাঙ্গপাঙ্গ নিয়া রেডক্রস নিউট্রাল জোন ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলে উঠবো।

সন্ধ্যায় জেনারেল নিয়াজি সামরিক এটাচে ব্রিগেডিয়ার হাশেমকে নিজের রুমে ডেকে গভীর দুঃখের সাথে বলেন, গভর্নর হাউজে রেড হইছে।

ব্রিগেডিয়ার হাশেম দুঃখের ভাণ করে কাঁদো কাঁদো হয়ে বলেন, আহারে! আমরা গভর্নর সাহেবের আত্মার জন্য শুধু মাগফেরাত কামনা করতে পারি। আর কি করার আছে!

জেনারেল নিয়াজি আরও গম্ভীর হয়ে বলেন, আবালটা মরে নাই। আগেই গিয়ে কন্টিতে উঠেছে।

ব্রিগেডিয়ার হাশেম মনে মনে বলে, এই খবরতো আমরা ঘন্টা দুয়েক আগেই জানি। তুমি পরে জানলা। তুমিই আবাল!

হাশেম ভয় পান, আমাদের কী হবে স্যার? আমাদের ফোরেডে কী আছে মানে কপালে কী আছে?

জেনারেল নিয়াজির সংক্ষিপ্ত জবাব, মুক্তিযোদ্ধাদের লাত্থি।

সারাবাংলা/এসবিডিই

অমল সাহা গভর্নর ও জেনারেলের আখেরী মোলাকাত গল্প সাহিত্য


বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ
সম্পর্কিত খবর