Thursday 05 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম ও বিশ্বনেতাদের দৃষ্টিতে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ

জহিরুল ইসলাম
৬ মার্চ ২০২৪ ২১:৫৩

১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে ১০ লক্ষ লোকের উপস্থিতিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দেওয়া ভাষণটি ছিল বাঙালি জাতির জীবনে সবচেয়ে প্রভাববিস্তারকারী একটি জাতীয় নির্দেশনা। এই বক্তব্যের প্রতিটি শব্দ এবং বাক্য ছিল ব্যাপক অর্থবোধক। দীর্ঘ ছেচল্লিশ বছর পর ২০১৭ সালের ৩০শে অক্টোবর ইউনেস্কো এই ভাষণকে ঐতিহাসিক দলিল হিসেবে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেয়। কিন্তু একাত্তরের ৭ই মার্চের পর থেকেই আন্তর্জাতিক অঙ্গনে এই ভাষণ ব্যাপক গুরুত্ব অর্জন করে। বিশ্বের প্রভাবশালী সব গণমাধ্যম এবং বিশ্বনেতারা তখন থেকেই এই ভাষণ সম্পর্কে বিভিন্ন মতামত ব্যক্ত করতে থাকেন।

তৎকালীন ঢাকাস্থ মার্কিন কনসাল জেনারেল আর্চার ব্লাড ওইদিন ঢাকায় অবস্থান করছিলেন। এই ভাষণ সম্পর্কে তার মন্তব্য ছিল, “মুজিবের ভাষণে তিনি যা বলেছিলেন, তার চেয়ে লক্ষণীয় হলো তিনি কী বলেননি। কেউ কেউ আশঙ্কা করছিলেন, আবার কেউ কেউ আশা করেছিলেন যে, তিনি বাংলাদেশকে সরাসরি স্বাধীন ঘোষণা করবেন। এর বদলে বাঙালির মুক্তি ও স্বাধীনতার লক্ষ্যে শান্তিপূর্ণ অসহযোগ আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার আহ্বান জানালেন তিনি।” আর্চার ব্লাড সেদিনকার পরিস্থিতির গুরুত্ব ও বঙ্গবন্ধুর ভাষণের মর্মার্থ ও তাৎপর্য গভীরভাবে অনুধাবন করতে পেরেছিলেন।

অনেক সমালোচকই বলে থাকেন, বঙ্গবন্ধু সেদিন স্বাধীনতার ঘোষণা দেননি। কিন্তু তার ওইদিনকার বক্তব্যের পরে স্বাধীনতা ঘোষণার যে আর কিছু বাকি থাকে না তা স্পষ্ট হয়ে ওঠে পাকিস্তানি সামরিক চিন্তাবিদ জেনারেল কামাল মতিন উদ্দিনের মন্তব্যে। ‘দ্য ট্র্যাজেডি অব এরর’ গ্রন্থে তিনি লিখেছেন, “যেকোনও দিক থেকেই ৭ই মার্চ ছিল মুজিবের দিন। তার কণ্ঠে ছিল প্রচণ্ড আবেগ। পুরো পরিস্থিতি ছিল তার নিয়ন্ত্রণে। তার কণ্ঠের দৃঢ়তায় জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত সাড়া পাওয়া গিয়েছিল। তার পুরো বক্তব্যে এতটাই উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়েছিল, মনে হয় সেদিন গাছ-পাথরও আন্দোলিত হয়েছিল। জনগণের প্রাণচাঞ্চল্য ছিল উদ্দীপনাময়।… প্রকৃতপক্ষে ১৯৭১-এর ৭ই মার্চেই বাংলাদেশ স্বাধীন হয়ে যায়।”

যুক্তরাজ্যের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথ এই ভাষণটিকে “স্বাধীনতার জন্য একটি স্পষ্ট আহ্বান” বলে অভিহিত করেছিলেন। তিনি পাকিস্তানকে শান্তিপূর্ণ সমাধানের দিকে কাজ করার আহ্বানও জানিয়েছিলেন। পরবর্তীতে এই ভাষণ সম্পর্কে তিনি বলেন, “পৃথিবীর ইতিহাসে যতদিন পরাধীনতা থেকে মুক্তির জন্য সংগ্রাম থাকবে, ততদিন শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ই মার্চের ভাষণটি মুক্তিকামী মানুষের মনে চিরজাগরূক থাকবে। এ ভাষণ শুধু বাংলাদেশের মানুষের জন্য নয়, সারা বিশ্বের মুক্তিকামী মানুষের অনুপ্রেরণা।”

তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন বঙ্গবন্ধুর সেদিনকার বক্তৃতাটিকে পাকিস্তানের ওপর একটি ‘তিক্ত আক্রমণ’ বলে অভিহিত করেছিলেন। তিনি সতর্ক করেছিলেন যে এটি পাকিস্তানকে গৃহযুদ্ধের দিকে নিয়ে যেতে পারে। মার্কিনিরা যে সেদিন বাঙালির স্বাধিকারচেতনার গুরুত্ব বুঝতে পারেননি, এই মন্তব্যই তার প্রমাণ। কারণ তাদের ‘গৃহযুদ্ধের’ ধারণা সেদিন পরিণত হয়েছিল স্বাধীনতাযুদ্ধে, এবং তা সফল পরিণতি পেয়েছিল একাত্তরের ১৬ই ডিসেম্বর। এই পরিণতির কথা সেদিন হয়তো মার্কিন প্রেসিডেন্ট কল্পনাও করেননি।

তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রধানমন্ত্রী আলেক্সি কোসিগিন এই ভাষণটিকে স্বায়ত্তশাসনের জন্য একটি ‘উজ্জ্বলভাবে প্রণয়নকৃত’ এবং ‘যুক্তিসঙ্গত’ আবেদন বলে অভিহিত করেন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তিনি পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানকে সতর্ক করে বলেন, “পাকিস্তান যদি ভারতের সঙ্গে যুদ্ধে জড়ায় তবে তা হবে আত্মহত্যার শামিল। পাকিস্তানের উচিত অযথা ভারতকে হুমকি না দিয়ে পূর্ববঙ্গে রাজনৈতিক অবস্থার উন্নতির দিকে মনোনিবেশ করা। পূর্ব বাংলায় পাকিস্তান সরকার যে ধরনের নিপীড়ন চালাচ্ছে তা ইতিহাসের নির্মম অধ্যায়। শেখ মুজিবুর রহমানের গোপন বিচারের জন্য পাকিস্তানের সামরিক প্রশাসন যে ধরনের পদক্ষেপ নিয়েছে এবং বক্তব্য রেখেছে, তা খোদ পাকিস্তানের জন্য ভয়ংকর আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত। শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে যা করা হয়েছে তা চূড়ান্ত লজ্জাজনক। তিনি জনগণের দ্বারা নির্বাচিত এবং এককভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়া জনপ্রতিনিধি। অথচ তাকেই বিচারের মুখোমুখি করা হচ্ছে।”

ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণকে একটি ‘ঐতিহাসিক ঘটনা’ বলে প্রশংসা করেন। একই সঙ্গে তিনি পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের প্রতি সমর্থন প্রকাশ করেন। তার এই সমর্থন যে শুধু কথার কথা ছিল না তা একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধকালে ভারতের ভূমিকাই বলে দেয়।

১৯৭৪ সালে শান্তিতে নোবেল বিজয়ী শন ভ্যাকব্রাইড বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ সম্পর্কে বলেছেন, “শেখ মুজিবুর রহমান বুঝতে পেরেছিলেন, কেবল ভৌগোলিক স্বাধীনতাই যথেষ্ট নয়, প্রয়োজন মানুষের মুক্তি। বেঁচে থাকার স্বাধীনতা। সাম্য ও সম্পদের বৈষম্য দূর করাই স্বাধীনতার সমার্থ। আর এ সত্যের প্রকাশ ঘটে তার ৭ই মার্চের ভাষণে।”

যুগোস্লাভিয়ার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট মার্শাল টিটো বলেন, “৭ই মার্চের ভাষণের তাৎপর্যপূর্ণ দিক হলো, এই ভাষণের মাধ্যমে শেখ মুজিব প্রমাণ করেছেন, পূর্ব পাকিস্তানে পাকিস্তানিদের কোনও রকম বৈধতা নেই। পূর্ব পাকিস্তান আসলে বাংলাদেশ।”

জাতিসংঘের তৎকালীন মহাসচিব উ থান্ট বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণটিকে ‘সবচেয়ে চিত্তাকর্ষক এবং চলমান বিবৃতি’ বলে অভিহিত করেছিলেন। সঙ্গে সঙ্গে তিনি সব পক্ষকে সঙ্কটের শান্তিপূর্ণ সমাধানের জন্য আহ্বান জানান।

দক্ষিণ আফ্রিকার অবিসংবাদিত নেতা নেলসন ম্যান্ডেলা ৭ই মার্চের ভাষণকে ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতার মূল দলিল’ হিসেবে অভিহিত করেন।

কিউবার তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ফিদেল ক্যাস্ত্রো বলেন, “৭ই মার্চের শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণ শুধু ভাষণ নয়, এটি একটি অনন্য রণকৌশলের দলিল।”

পশ্চিমবঙ্গের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু বলেন, “৭ই মার্চের ভাষণ একটি অনন্য দলিল। এতে একদিকে আছে মুক্তির প্রেরণা, অন্যদিকে আছে স্বাধীনতা-পরবর্তী কর্মপরিকল্পনা।”

শুধু বিশ্বনেতারাই বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের বক্তৃতা নিয়ে মন্তব্য করেননি। ওই সময়ের বিশ্বের প্রভাবশালী গণমাধ্যমগুলোও বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক এই ভাষণকে বিশ্লেষণ করেছে ভিন্ন মর্যাদায়। নিউজউইক পত্রিকা লেখে, “৭ই মার্চের ভাষণ কেবল একটি ভাষণ নয়, একটি অনন্য কবিতা। এই কবিতার মাধ্যমে শেখ মুজিবুর রহমান ‘রাজনীতির কবি’ হিসেবে স্বীকৃতি পান।”

টাইম ম্যাগাজিনে বলা হয়, “শেখ মুজিব ৭ই মার্চের ভাষণের মাধ্যমেই আসলে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছেন। ওই ভাষণে গেরিলা যুদ্ধের কৌশলও ছিল।”

বিবিসি বলে, “পৃথিবীর ইতিহাসে জন আব্রাহাম লিংকনের গেটিসবার্গ অ্যাড্রেসের সঙ্গে তুলনীয় এই ভাষণটি। যেখানে তিনি একাধারে বিপ্লবী ও রাষ্ট্রনায়ক।”

রয়টার্স লেখে, “বিশ্বের ইতিহাসে এ রকম আর একটি পরিকল্পিত এবং বিন্যস্ত ভাষণ খুঁজে পাওয়া যাবে না, যেখানে একই সঙ্গে বিপ্লবের রূপরেখা দেওয়া হয়েছে এবং সঙ্গে সঙ্গে দেশ পরিচালনার দিকনির্দেশনাও দেওয়া হয়েছে।”

এএফপি মন্তব্য করে, “৭ই মার্চের ভাষণের মধ্য দিয়ে শেখ মুজিব আসলে স্বাধীনতার ঘোষণা দেননি, তিনি বাঙালিকে যুদ্ধের নির্দেশনাও দিয়ে যান। ওইদিনই আসলে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে।”

ওয়াশিংটন পোস্ট লেখে, “শেখ মুজিবের ৭ই মার্চের ভাষণই হলো বাংলাদেশের স্বাধীনতার মৌলিক ঘোষণা। পরবর্তীতে স্বাধীনতা যুদ্ধ হয়েছে ওই ভাষণেরই আলোকে।”

ভারতের আনন্দবাজার পত্রিকায় লেখা হয়, “উত্তাল জনস্রোতের মাঝে এ রকম একটি ভারসাম্যপূর্ণ, দিকনির্দেশনামূলক ভাষণই শেখ মুজিবকে অনন্য এক ভাবমূর্তি দিয়েছে। দিয়েছে অনন্য মহান নেতার মর্যাদা।”

লেখক: সাংবাদিক ও শিশুসাহিত্যিক

সারাবাংলা/এজেডএস

বঙ্গবন্ধুর ভাষণ


বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ
সম্পর্কিত খবর