Thursday 05 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

অন্য এক আঁধার (পঞ্চম পর্ব)


১০ এপ্রিল ২০২৪ ২০:০৮

। নয়।

সুমি দাঁড়ানো ছিল।
ছেলেটার মৃত্যুর খবর শুনে সে ফ্লোরেই বসে পড়ে।
তবে তার মুখ দিয়ে কোনও শব্দ বের হয় না।

রনি তাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে টেনে তোলে। তারপর সোফায় নিয়ে বসায়। নিজেও বসে। বলে- তোমাকে কিন্তু আমি বেশ সাহসী মনে করেছিলাম। অথচ সেই সকাল থেকে যা শুরু করেছো, কী আর বলবো। আরে বললাম তো এত ভয় পাওয়ার কিছু নেই। কারণ, আমরা ছেলেটাকে মারিওনি, মারার জন্য কাউকে উসকেও দিইনি। হ্যাঁ, রিকশাওয়ালা ধরা পড়লে হয়তো নিজে নির্দোষ সাজার জন্য আমাদের উপর দোষ চাপাতে চাইবে। কিন্তু পারবে না। দিনশেষে জয়টা সত্যেরই হবে।

সুমি পানি খেতে চায়। রনি খাওয়ায়। তারপর বলে- এই ধরনের ঘটনায় আমরা ভয় পেলে কিন্তু পুলিশকেই পাই। তুমি জেনে খুশি হবে, পুলিশ আমার উপর হান্ড্রেড পার্সেন্ট সন্তুষ্ট। তারা বারবার একটা কথাই বলেছে, আমি নাকি অনেক বড় মনের মানুষ। কারণ, এলাকার একটা মানুষও ছেলেটাকে দেখতে যায়নি। অথচ আমি গভীররাত পর্যন্ত ছিলাম। নানাভাবে সহায়তা করলাম। থাক, এসব আর না বলি। ভাল কাজ করতে হয় মনের প্রশান্তির জন্য। বলে বেড়ানোর জন্য না।
: ছেলেটার নাম মাসুম, তাই না? প্রশ্নটা মুখ ফসকে বের হয়ে যায় সুমির। তাই নিজের উপর বিরক্ত হয় সে। তবে চেহারায় এর প্রভাব পড়তে দেয় না।
: না তো! মাসুম না। তার নাম কালাম। একবার নাকি অল্প সময়ের জন্য জ্ঞান ফিরেছিল। তখন ডাক্তারের কাছে নিজের নাম বলেছে, বাবার নাম বলেছে। আর একটা ঠিকানাও নাকি বলেছে। পুলিশ সেই ঠিকানাটার খোঁজ-খবর করছে।
: ঠিক তো? না, মানে তার নাম কালামই তো? সুমি প্রশ্ন দুটো করে মনে অফুরন্ত প্রশান্তি নিয়ে।
: জি, কালাম। আমি নামটা ডাক্তারকে নোট করতে দেখেছি। আবার পুলিশের খাতায়ও দেখেছি। কিন্তু তুমি যে মাসুম বললে, এই মাসুমটা কে?
: রিকশাওয়ালা বলছিল, মাসুম নামে নাকি সে একজনকে চেনে। ভালভাবে চেনে না; অল্প অল্প। আর এই ছেলেটার চেহারা নাকি অনেকটা সেই মাসুমের মতো। যে কারণে তার সন্দেহ হয়েছে সে মাসুমই কি না। মিথ্যা কথাটা বেশ সাবলীলভাবে বলতে পারে সুমি।
: একজনের চেহারার সঙ্গে আরেকজনের চেহারার মিল থাকতে পারে না? শোনো, বাসায় ফিরতে ফিরতে আমি একটা ডিসিশন নিয়েছি। আর ডিসিশনটা নিয়েছি তোমার নিরাপত্তা, মানসিক শান্তি ইত্যাদির কথা বিবেচনা করে।
: কী ডিসিশন?
: আমরা এই বাসাটা ছেড়ে দেবো।
সুমি এবার আবেগাপ্লুত হয়ে ধন্যবাদ জানায় রনিকে। আর বলে- আমি মনে মনে ঠিক এই বিষয়টাই চিন্তা করছিলাম। কিন্তু তোমাকে বলার সাহস পাচ্ছিলাম না। হুট করে বাসা বদলানোা হয়তো ঝামেলার, তবু বদলানো উচিত। কারণ, মনে হয় না এই বাসায় আমি আর কখনও স্বাভাবিক হতে পারব। একটা ভয়, একটা টেনশন সবসময় থেকেই যাবে। কিন্তু এভাবে তো জীবন চলে না। জীবনে স্বাভাবিক থাকাটা খুব জরুরি। নইলে মানুষ মেন্টালি সিক হয়ে যায়।

রনি বলে- আমাদেরকে মেন্টালি সিক বানানোর জন্য ওই এক রিকশাওয়ালাই যথেষ্ট। মনে করো সে পুলিশের হাতে ধরা পড়ল না। আমাদের উপর দোষ চাপানোর চেষ্টা করলো না। তবু কিন্তু যখন তখন এসে আমাদেরকে, বিশেষ করে তোমাকে বিরক্ত করতে পারে। টাকা হাতানোর জন্য ব্ল্যাকমেইল করতে পারে। এদিকে আবার দারোয়ানও আছে। তার যে আগ্রহ দেখলাম, রিকশাওয়ালাকে পেলে সে কুবুদ্ধি দিয়ে আমাদের পেছনে লাগিয়ে দেবে। অতএব বুদ্ধিমানের কাজ হচ্ছে, অন্য কোনও এরিয়ায় চলে যাওয়া।

সুমি জড়িয়ে ধরে রনিকে। ধরেই রাখে। রনি বুঝতে পারে, তার বুকের ধড়ফড়ানি এখনও কমেনি। হয়তো কিছুক্ষণ এভাবে ধরে রাখলে আস্তে আস্তে কমে আসবে। তাই সে তাকে সুযোগ দেয়। আর হাত বুলিয়ে দেয় তার মাথায়, ঘাড়ে, পিঠে। দীর্ঘক্ষণ পর স্বামীকে ছেড়ে দিয়ে সুমি বলে- পুলিশের সাথে বিশ্বাস নেই। কালামের দেওয়া ঠিকানায় তারা হয়তো নাও যেতে পারে। অযথা বাড়তি ঝামেলা কে করতে চায়? হয়তো দেখা যাবে লাশটা বেওয়ারিশ হিসেবে কবর দিয়ে দেবে।
: আমি এসআইয়ের সাথে কথা বলে যা বুঝলাম, এই ধরনের কাজ তারা করবে না।
: কিন্তু কোনও কোনও পুলিশ সদস্য তো এরচেয়ে খারাপ কাজও করে। টাকা না দিলে বাবা-মাকে সন্তানের লাশ দেয় না।
: তা ঠিক। তবে কালামের ক্ষেত্রে এমন কিছু করতে পারবে না। কারণ, আমি দুইজন সাংবাদিকের সঙ্গেও কথা বলেছি। তারা নজর রাখবে। কোনও অনিয়ম দেখলে নিউজ করে দেবে।
আরও কিছুক্ষণ কথা বলে সুমি এবং রনি। তারপর খেতে বসে। কিন্তু একজনও অর্ধেক প্লেটের বেশি খেতে পারে না। পেট কেমন যেন ভরা ভরা লাগে। অথচ সারাদিন দুজন উপোষই ছিল বলা চলে। সুমি তো দুপুরে পানিটা পর্যন্ত খায়নি। খাবার-পর্ব শেষ করে বিছানায় যায় তারা। ঘুমও আসে। কিন্তু গভীর হয় না। তাই তারা রাত কাটিয়ে দেয় কিছুটা জেগে, কিছুটা ঘুমিয়ে।

সকালে অফিসের উদ্দেশ্যে বাসা থেকে বের হয়ে রিকশায় উঠতেই এসআই জাহাঙ্গীরের ফোন পায় রনি। যার সঙ্গে কিনা গতকাল তার হাসপাতালে একাধিকবার দেখা হয়েছে, একাধিকবার কথা হয়েছে। সে ফোন রিসিভ করে সালাম দিয়ে জানতে চায় কোনও খবর আছে কি না। এসআই বলেন- খবর তো অবশ্যই আছে। নইলে এই সকাল সকাল ফোন দেবো কেন? কী বলবো বলেন, আপনি কিন্তু আমাদেরকে ভালই বিপদে ফেলে দিলেন।
: কী রকম বিপদ?
: কালামের বাবা-মার খোঁজ পাওয়া গেছে।
: এটা তো ভাল খবর।
: জি না। ভাল খবর না। এটা হচ্ছে ঝামেলার খবর। কারণ, তারা গা ঢাকা দিয়েছে।
: মানে?
এসআই বলেন- আমাদের দুই কনস্টেবল কালামের বাবা-মার কাছে গিয়েছিল। ছেলের মৃত্যুর খবর শুনে তারা তেমন কোনও রিঅ্যাকশন দেখালো না। বললো লাশ নেওয়ার জন্য একটু পরে আসবে। যেহেতু টাকা-পয়সা যোগাড়-যন্ত করার ব্যাপার আছে। কনস্টেবলরা চলে আসলো। কিন্তু বাবা-মা আসার কোনও নাম-গন্ধ নেই। একটু আগে তাদের এক প্রতিবেশী ফোনে জানাল, তারা নাকি ভয়ে গা ঢাকা দিয়েছে। মানে বস্তি ছেড়ে পালিয়ে গেছে।

রনি জানতে চায় কিসের ভয়। এসআই বলেন- কালাম বখাটে ছিল। মাস্তান ছিল। নেশাখোর ছিল। এই জন্য তার বাবা-মা নাকি ভয় পাচ্ছিল, আমরা তাদেরকে এনে জেলে ঢুকিয়ে দিতে পারি। মানে ছেলের শাস্তি নিজেদের ঘাড়ে এসে পড়ার ভয়। এছাড়া ঘৃণাও নাকি আছে। কালাম তাদেরকে খুব যন্ত্রণা দিতো তো! মারধরও নাকি করতো। এই জন্য তার মুখ তারা দেখতে চায় না। দাফন-কাফনের যে খরচ, সেই খরচটাও করতে নারাজ।
: আমি কি একটু চেষ্টা করবো তাদেরকে খুঁজে পাওয়া যায় কি না?
: রনি সাহেব, আল্লাহর ওয়াস্তে আর ঝামেলা বাড়াবেন না। অনেক হয়েছে। কালামের বাবা-মা যেহেতু গা ঢাকা দিয়েছে, তাদেরকে এই অবস্থায়ই থাকতে দেন। আর তার লাশের কোনও না কোনও গতি হয়ে যাবে। এখন আপনার প্রতি রিকুয়েস্ট, আপনি আপনার সাংবাদিক বন্ধুদের বলে দেবেন, এটা নিয়ে যেন খোঁচাখুঁচি না করে। এতে আমাদেরও শান্তি, কালামের মা-বাপেরও শান্তি। এমনকি কালামের নিজেরও শান্তি।
রনি কথা দেয় সাংবাদিকদের বিরত রাখবে খোঁচাখুঁচি করা থেকে। এসআই তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে লাইন কাটেন। এরপর রনি মোবাইলটা পকেটে রাখতে চাইলেও রাখতে পারে না। কারণ, ফোন আসে। আর ফোনটা করে সুমি। কিন্তু কেন? এই সময়ে তো সে কোনওদিন ফোন করে না! তাহলে কি বিপদ-আপদ হলো?
রনি কিছুক্ষণ সুমির নামের দিকে তাকিয়ে থেকে স্ক্রিনে আঙুল ছোঁয়ায়।

। দশ।

রনি ‘হ্যালো’ না বলেই প্রশ্ন করে- কোনও সমস্যা?
সুমি জানতে চায় তার একটা আবদার রাখবে কি না।
এরপর সরাসরি বলে ফেলে- আমি লাশটা দেখতে চাই।

রনির রাগ হয়। কিন্তু প্রকাশ করে না। কারণ, সে সুমির মানসিক অবস্থা বুঝতে পারছে। বুঝতে পারছে তার অসহায়ত্ব। আসলে কেউ যখন মানসিকভাবে বিপর্যস্ত থাকে, ঝড়ের কবলে পড়া পাখির মতো সন্ত্রস্ত থাকে, তখন কাছের মানুষের কাছে আশ্রয় চাইতেই পারে। আর সেই চাওয়ার বহিঃপ্রকাশ ঘটাতে পারে নানাভাবে। কখনও প্রশ্নের আকারে, কখনও আবদারের আকারে। হতে পারে সেই আবদার ছেলেমানুষি আবেগে ভরপুর কিংবা একেবারেই অযৌক্তিক।
রনি রাগ পুরোপুরি সামলে নিয়ে বলে- তোমাকে কষ্ট করে হাসপাতালে যেতে হবে না। আমি তোমাকে লাশ দেখানোর ব্যবস্থা করছি। বেশি না, বিশটা মিনিট ওয়েট করো। হোয়াটসঅ্যাপে ছবি পেয়ে যাবে। আর হাসপাতালে গেলে ঝামেলাও হতে পারে। এখনই জানতে পারলাম তার বাবা-মা পর্যন্ত আসছে না ভয়ে। এই অবস্থায় তুমি যদি যাও, সবাই কী ভাববে একবার চিন্তা করো। তাহলে এই কথাই থাকলো, বিশ মিনিটের মধ্যে আমি তোমাকে ছবি পাঠাচ্ছি।

এরপর বিশ মিনিট যায়, এক ঘণ্টা যায়, দুই ঘণ্টা যায়, চার ঘণ্টা যায়। কিন্তু রনি ছবি পাঠায় না। এমনকি সুমির ফোনও রিসিভ করে না। তাই সে নিশ্চিত হয়ে যায়, ‘কালাম’ নামটা কাল্পনিক। তাকে সান্ত¡না দেওয়ার জন্য, শান্ত রাখার জন্য পরিকল্পিতভাবে সামনে আনা হয়েছে এই নাম। যে পরিকল্পনার মূল উদ্দেশ্য- ‘মাসুম’ নামটা ঢেকে দেওয়া। কোনওমতে লাশটা দাফন করে ফেলতে পারলে হয়তো সেই উদ্দেশ্য সফলও হয়ে যাবে।

গভীররাতে বাসায় ফেরে রনি। সুমি তার দিকে তাকায়ও না, কথাও বলে না। দরজার কাছ থেকে হনহনিয়ে হেঁটে গিয়ে শুয়ে পড়ে বিছানায়। রনি তার রাগ এবং অভিমানের গাঢ়ত্ব অনুধাবন করতে পারে। তাই কিছু না বলে নিজের কাজ করে। কাপড় পাল্টায়, হাত-মুখ ধোয়। তারপর এক গ্লাস পানি খেয়ে বিছানায় আসে। বসে তার মাথার কাছে। বলে- বিপদ কখনও বলে কয়ে আসে না। এই জন্য মানুষ প্রস্তুতি নেওয়ার সময় পায় না। অসহায় আত্মসমর্পণ করে বিপদের কাছে।
সুমি যেভাবে শুয়ে ছিল, সেভাবেই শুয়ে থাকে। সামান্যও নড়ে না। দেখে মনে হয়, ঘুমিয়ে পড়েছে। রনি তবু বলে- সকালে তোমার সঙ্গে যখন কথা হলো, এর জাস্ট দুই মিনিট পরেই খালু ফোন করলেন। বললেন খালার শরীরের অবস্থা নাকি বেশি খারাপ। তাকে আইসিইউতে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। আর অনেকগুলো কথাও শোনালেন। কেমন মানুষ আমি? একটাবার আমার সময় হলো না খালাকে দেখতে যাওয়ার? কিন্তু আমি এদিকে কী যন্ত্রণার মধ্যে আছি, সেটা উনাকে কীভাবে বোঝাই?
: আমার ফোনটা কি ধরা যেতো না? সুমির গলা ভেজা শোনায়।
: অবশ্যই ধরা যেতো। ধরাটা আমার দায়িত্ব ছিল। কিন্তু কোনও কোনও সময় পরিস্থিতি এমন দাঁড়ায়, দায়িত্বের কথা মনেই থাকে না। খালার খবরটা শোনার পর আমি অস্থির ছিলাম, কখন হাসপাতালে যাবো। এই জন্য টেরই পাইনি, তুমি এতবার ফোন দিয়েছো। এরপর যখন দেখলাম সাতাশটা মিসডকল, আবার বিশ মিনিটের মধ্যে যে কালামের ছবি পাঠাবো বলেছিলাম সেই বিশ মিনিটও পার হয়ে গেছে, তখন ভয় পেয়ে গেলাম।
: ভয় কিসের?
: তুমি যদি বকাবকি করো! এই ভয়ে তোমাকে ফোনও দিলাম না, তোমার ফোন রিসিভও করলাম না। আর ততক্ষণে খালুর কাছে চলে গিয়েছিলাম তো! ফোন রিসিভ করার মতো অবস্থায় ছিলাম না। থাক, আর কথা না বাড়াই। আমি আসলে কালামের লাশের কাছেও যেতে পারিনি, ছবিও তুলতে পারিনি। এই অপরাধে তুমি আমাকে যেকোনও শাস্তি দিতে পারো। আমি মাথা পেতে নেবো। তবে তার আগে তোমার পা ধরে ক্ষমা চাইতে চাই।
সিমু এবার হুড়মুড়িয়ে উঠে পড়ে শোয়া থেকে।
আর পা জোড়া ঢেকে ফেলে ওড়না দিয়ে।
যেন কোনওভাবেই ধরা না যায়, ছোঁয়া না যায়।

রনি তবু ক্ষমা চাওয়া অব্যাহত রাখে। অব্যাহত রাখে নিজের দোষ স্বীকার করা। সুমির মন গলে যায়। সে ভুলে যায় সব অভিমান, সব কষ্ট, সব প্রশ্ন। অথচ এগুলো তার মনের ভেতর ঘাঁটি গেড়ে ছিল আজ সারাদিন। এমনকি রনি বাসায় ফেরার পরও। সে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে- লাশের ব্যাপারে আর টু শব্দটাও করবে না। কী দরকার কেঁচো খুঁড়তে গিয়ে সাপ সামনে গিয়ে আসার? আর সে ওই মানুষটার জন্য এত দরদ কেনই বা দেখাবে, যে তাকে ভুলে নিরুদ্দেশ হয়ে গিয়েছিল?

সুমি ভাত দেয় রনিকে। নিজেও খেতে বসে। রনি আবার খালার প্রসঙ্গে কথা তোলে। এরপর তোলে বাসা বদলানোর প্রসঙ্গ। বলে- হাসপাতাল থেকে বের হতেই আমার এক বন্ধুর সঙ্গে দেখা। কলেজ ফ্রেন্ড। তার সঙ্গে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে অনেক কথা। তারপর যখন বাসা পাল্টানোর কথা উঠলো, সে দুর্দান্ত একটা বাসার খবর দিলো। আমি নিজ চোখে না দেখলেও তার কথা শুনে যেটা বুঝেছি, বাসাটা আসলেই দুর্দান্ত। আর আমরা চাইলে আগামীকাল থেকেই উঠতে পারি।
: কিন্তু এই বাড়িওয়ালা? সে তো নাও ছাড়তে পারে। নানান আইন দেখাতে পারে।
: আরে তাকে ম্যানেজ করা কোনও ব্যাপারই না। অলরেডি ফোনে আমার কথা হয়েছে। সে একটু গাঁইগুঁই করেছে। তবে আমি যদি বলি অ্যাডভান্স যেটা দিয়েছিলাম, সেটা ফেরত দেওয়া লাগবে না; দেখবে খুশিতে বগল বাজাতে বাজাতে আমাদেরকে বিদায় দিয়ে দেবে।
: কিন্তু এতগুলো টাকা ছেড়ে দেবে?
: সুমি, টাকার চেয়ে মনের শান্তিটা বেশি দরকার। এখানে থাকলে সেই শান্তি তুমি কোনওদিনই পাবে না। আমিও পাবো না। কারণ, ওই ঘটনার জের কোনও না কোনওভাবে টানতেই হবে। অতএব টাকার চিন্তা ছেড়ে দাও।
: এই বাসায় শান্তি পাবো না, নতুন বাসায় কি পাবো?
প্রশ্নটা করতে গিয়েও করে না সুমি। সে খাওয়া চালিয়ে যায়। খাওয়া চালিয়ে যায় রনিও। অনেকক্ষণ তাদের মধ্যে আর কোনও কথা হয় না। কিছুক্ষণ কথা হয় কেবল শোয়ার পর। তারপর ঘুমিয়ে পড়ে দুজনেই। সকালে রনি অফিসে চলে গেলে সুমি ফোন করে আরিফকে। জানায় মাসুম মারা গেছে। গণপিটুনিতে। আরিফ বিশ্বাস করে না। সুমি বিশ্বাস করাতে চায়ও না। শুধু জানতে চায় খবরটা মাসুমের মামাদের দিতে পারবে কি না।

আরিফ চুপ থাকে। সুমিও কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলে- দরকার নেই। যে মামারা সবসময় মাসুমকে মাথার বোঝা মনে করেছে, সে নিখোঁজ হয়ে যাওয়ার পর যারা একটু ভালভাবে খোঁজার প্রয়োজন মনে করেনি, তাদেরকে তার মৃত্যুর খবর দেওয়ার কোনও মানে হয় না। দেখা যাবে তারা স্বীকারই করবে না এটা যে তাদের ভাগ্নে। অপমানের মরা মরেছে না? কিন্তু আমার প্রশ্ন হচ্ছে, গণধোলাই খাওয়ার মতো কাজ সে কেন করতে গেল? প্রকাশ্যে যার কাছে আসতে পারে না, তার কাছে কাপুরুষের মতো লুকিয়ে লুকিয়ে আসার মধ্যে কী বাহাদুরি?
: আমার এখন ক্লাস আছে। প্রচ- অনীহা মিশিয়ে বলে আরিফ।
: তো?
: আমি এখন ফোনটা রাখবো। অন্য সময় কথা বলা যাবে।
: একটা জলজ্যান্ত মানুষ মারা গেল। আর তুই আছিস ক্লাস নিয়ে। তোর মনে কি দয়া-মায়া বলতে কিছু নেই? অ্যাই, তুই তো আগে এমন ছিলি না?
: তুইও তো আগে এমন ছিলি না।
: কী বললি? কী বললি তুই?
ওপাশ থেকে উত্তর আসে না। সুমি ‘হ্যালো’ ‘হ্যালো’ করেই যায়। তারপর একসময় বুঝতে পারে, লাইন কেটে দেওয়া হয়েছে।

চলবে….

সারাবাংলা/এসবিডিই

অন্য এক আঁধার (পঞ্চম পর্ব) ইকবাল খন্দকার ঈদুল ফিতর ২০২৪ উপন্যাস


বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ
সম্পর্কিত খবর