Thursday 05 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

রাসেলের ‘আব্বা’


১৩ এপ্রিল ২০২৪ ১৬:৫১

রাসেল আজ ঠিক করেছে, আব্বার সঙ্গে আর ভাব নয়। কিছুতেই না। তার বুঝতে বাকি নেই বাবা তাকে আর আগের মতো আদর করে না। ভালোবাসে না। যদি বাসতোই, রাসেল হাত ধরে তাকে দরজার কাছে টেনে নিয়ে যাবার পরেও কেমন করে প্রতিবারই মুচকি হেসে হাত ছাড়িয়ে নিয়ে এভাবে চলে যায় আব্বা। চলে যায় সোজা নিজের ঘরের দিকে। যখন রাসেলের হাত ছেড়ে দিয়ে এভাবে হন হন করে আব্বা চলে যায়, আশ্চর্য, একবারও পিছনের দিকে ফিরে তাকায় না। আব্বাকে তখন খুব দূরের মানুষ, খুব অপরিচিত মনে হয় রাসেলের। ঘর ছেড়ে চলে যদি নাও যায়, তাকে বাড়ি নিয়ে যাবার কথা বললেই খুব তড়িঘড়ি করে পরিবারকে বিদায় দিতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে আব্বা। রাসেলের রাগ কমাবার জন্যে মুখে আবার বলে কিনা, ‘তোমার মার বাড়ি তুমি যাও। আমি আমার বাড়ি থাকি। আবার আমাকে দেখতে এসো।’

এ আবার কেমন অদ্ভুত কথা। রাসেল ভাবে। সকলের আব্বা আম্মাতো একসঙ্গে এক বাড়িতেই থাকে। স্কুলে অন্য বন্ধুদের কাউকে তো বলতে শোনেনি রাসেল, এটা আমার আব্বার বাড়ি, ওটা আম্মার বাড়ি। কেউ বলে না, আজ তোর আম্মার বাড়ি যা, কাল পরশু আসিস আমার বাড়ি। অন্য বাড়িগুলো সব যেন অন্যরকম। আনন্দ আর ভালোবাসা যেন উপচে পড়ে সেখানে। ওসব বাড়িতে আব্বা, আম্মা, আপু, ভাইবোন সকলে একসঙ্গে থাকে। তারা একই লম্বা টেবিলের চারপাশে সাজানো চেয়ারে বসে টেবিলের ওপরে রাখা প্লেটে করে খাবার তুলে অনেকটা সময় ধরে খায়। দুই বেলাতেই। একসঙ্গে। খাবার টেবিলে বসে খাওয়া দাওয়াই শুধু করে না তারা। কত রকম গল্প করে, হাসাহাসি করে। তাদের বাড়িতে বাবাকে কতকাল খাবার টেবিলে দেখতে পায় না রাসেল। যার যখন ইচ্ছা খায় তারা। রাসেলের ইচ্ছা করে তার বন্ধুর পিতার মতো তার আব্বাও মাছের কাঁটা বেছে দেবে পাশে বসে। আর আম্মা মুঠি মুঠি গরাস মুখে তুলে দেবে পরম যত্নে। মা তাকে ঠিকই খাইয়ে দেয়। বাবাকেই কেবল কাছে পাওয়া যায় না।

রাসেল বুঝতে পেরেছে, অন্তত তার কাছে মনে হচ্ছে, বাবা কেমন যেন বদলে যাচ্ছে দিন দিন। রাসেলের মনে হয়, আসলে বাবা আর আগের মতো রাসেলকে না দেখলে অস্থির হয়ে ওঠে না। তা নইলে যখনই দেখা হয়, তখনই তার সঙ্গে বাড়ি যাবার কথা এতো বার বার বলা সত্ত্বেও বাবা কেন একবারও বাড়িতে আসে না। আর কী আশ্চর্যের ব্যাপার! রাসেল ছাড়া আর কেউ এমন কি আম্মু বা আপুরা কেউ, বা ভাইয়ারাও কখনো আব্বুকে বাসায় আসতে বলে না। একবারও। অবশ্য ভাইয়ারা কেমন যেন একটু ভয় করে আব্বাকে। খুব একটা কথাবার্তা বলে না এমনিতেই।

রাসেল শুনেছে বড় ভাইয়া ছোটবেলা আব্বাকে ভাবতো কেবল ‘হাছু আপার’ আব্বা, কাছে ঘেঁষতে সাহস পেত না। একদিন ভয়ে ভয়ে বড় বোনকে জিজ্ঞেস করে ফেলে বড় ভাইয়া, ‘আপু, তোমার আব্বাকে আমি একটু আব্বা ডাকতে পারি?’

রাসেলের কিন্তু নিজের আব্বাকে চিনতে অসুবিধা হয়নি। বড়ভাইয়া সত্যি ছেলেমানুষ ছিল। তবে এটা সত্য। আব্বা এখনও সব ভাইবোনের চেয়ে হাছু আপুর সঙ্গে বেশি কথা বলে। কতো রকম ঘটনা, বিষয় নিয়ে দীর্ঘক্ষন ধরে আলাপ করে তারা। কিন্তু রাসেলের একবারও মনে হয় না আব্বা শুধু হাছু আপার বাবা। সে জানে চশমাপরা এই সুশ্রী মানুষটি তার নিজেরও আব্বা। তবু লক্ষ্য করেছে রাসেল বড় ছেলেমেয়েদের সঙ্গে গম্ভীর মুখে যেরকম আলোচনা করে আব্বা, তার সঙ্গে তেমন করে না। যদিও সময় অথবা সুযোগ পেলেই তাকে শেয়াল অথবা বক কিংবা কাকের গল্প শোনায়। স্কুলে নতুন কী শিখলো জানতে চায়। তার মানে কি এই যে, রাসেলকে শিশুর মতো করে দেখে বাবা, মা দুজনেই। রাসেলের খেলা আর পড়া ছাড়া যেন কোনোদিকেই লক্ষ্য নেই তাদের। ভাবতে গায়ে রাগের মাত্রাটা আপনি আপনি বাড়তে থাকে রাসেলের। এসব ভেবে ভেবে যখন সত্যি সত্যি শরীর ভর্তি উষ্মা জমা হতে শুরু করে, তখন হাতের কাছে যাকে পায় তাকেই মারতে ইচ্ছা করে। বিশেষ করে ছোটআপুকে। তার চুল ধরে টানলে সে যে আঁহা উঁহু করে ওঠে তখন বেশ মজা পায় রাসেল। আজ সকালেও ছোট আপুকে মেরেছে রাসেল। জোরে চুল টানায় ব্যথা পেয়ে চোখ দিয়ে পানি বেরিয়ে গেছে তার। তবু সে পাল্টা মার দেওয়া দূরে থাক, এক ফোঁটা বকেওনি রাসেলকে। মাকে পর্যন্ত বলে দেয়নি। তবে আম্মার কানে কথাটা ঠিক-ই পৌঁছেছিল। তবে অন্যভাবে। আম্মাকে রান্নায় সাহায্য করে যে বুয়া সে-ই বলে দিয়েছিল। রাসেলকে ধমক দিয়েই ক্ষান্ত হয়নি আম্মা, ভয় দেখিয়ে বলেছিল, আব্বাকে যখন আজ সকলে মিলে দেখতে যাবে, তখন তাকেও আজ জানিয়ে দেবে আম্মা কী পরিমাণ অবাধ্য হয়েছে রাসেল, বড়দের ওপর হাত তোলে পর্যন্ত। রাসেলের মনে পড়ে আজ ফেব্রুয়ারির ৮ তারিখ। সত্যি সত্যিই আব্বার সঙ্গে দেখা করতে যাবার দিন আজ। এর আগেও ছোট আপুকে মেরে আব্বার মৃদু ধমক খেয়েছে রাসেল। তবে মায়ের বকুনির কছে তা কিছুই নয়। মার কথা কানে যাবার পর থেকে আজ রাসেলের মন ভালো নেই। আজকের দিনে ছোট আপুর চুলগুলো এভাবে না টানলেও পারত সে।

আজ আব্বাকে দেখতে এসে মনের ভেতর গুমরে উঠতে থাকে রাজ্যের যত অভিযোগ। বাবা কেন বাড়ি যাবে না তাদের সঙ্গে? আব্বার সঙ্গে বলার মতো কত কথা জমা হয়। কথার নিচে কথা জমতে জমতে সব কথা একসময় পচে যায়। যখন রাসেল ভীষণভাবে চায় কথা বলার জন্যে তাকে কাছে পেতে, তার কোলে চড়ে ঘুরে বেড়াতে, হাতে হাত ধরে বিকেলে পার্কে হাঁটতে, আকাশের ছোটবড় তারাগুলোর জ্বলে ওঠা, নিভে যাবার গল্প শোনার জন্যে, তখন তাকে কখনো কাছে পায় না রাসেল। যখন কাছে পায় বকার জন্যে তুলে রাখা অনেক কথাই তখন ভুলে যায়, অথবা কেমন যেন সব পানসে, বাসি হয়ে যায়। আব্বাকে বোঝাতে পারে না রাসেল, অন্য কিছু বাদ দিলেও মাঝে মাঝে শুধু ‘আব্বা’ বলে জোরেসোরে ডেকে উঠতে মন চায়, সময়ে–অসময়ে। কখনো খেলতে খেলতে– কখনো মায়ের বকুনি খেয়ে, কখনো মাঠে, স্টেজে কিংবা টেলিভিশনে কোনো বাচ্চাদের প্রোগ্রাম দেখে। কিন্তু পরক্ষণেই টের পায় রাসেল, আব্বা কাছাকাছি নেই। বেশিরভাগ সময়েই কাছে থাকে না আজকাল। এসব নানা কথা ভেবে আব্বার জন্যে খুব কান্নাকাটি করেছিল সে সপ্তাহখানেক আগে। কাঁদতে কাঁদতে বলেছিল, ‘এই বাড়িতে আব্বা বলে ডাকার কেউ নেই।’ তখন আম্মু তাকে বলেছে, আম্মা শুধু মা নয়, বাবাও। যখন খুশি আম্মাকেই আব্বা বলে ডাকতে পারে রাসেল যতক্ষণ না তার আব্বা ঘরে ফিরে আসছে।

আজ তাই রাসেল অনেক প্রস্তুতি নিয়ে আব্বার সঙ্গে দেখা করতে এসেছে পরিবারের অন্য সকলের সঙ্গে। আব্বার ওপর অভিমান আজ এতোটাই টইটুম্বুর যে সে ভেতরের খোলা দরজা দিয়ে বাইরে গিয়ে রাস্তার শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে পিতার আসার আশায় রাস্তার দিকে তাকিয়ে অপেক্ষা করতে থাকে না। চুপচাপ মায়ের গা ঘেঁষে ওয়েটিং রুমের ভেতরেই দাঁড়িয়ে থাকে। সময় যেন আর কাটে না।

পিতার জন্যে রাস্তার শেষে অপেক্ষা করে না থাকলেও রাসেলের চোখে ভাসতে থাকে ধীর পায়ে হেঁটে আব্বা আসছে এদিকে। সে যেখানে দাঁড়িয়ে থাকে সেদিকেই। বাবা ব্যগ্র হয়ে ছুটে আসছেন তার প্রিয়জনদের সঙ্গে দেখা করতে। তাদের সঙ্গে কথা বলতে। বারবার উৎকন্ঠিত হয়ে সে দরজার দিকে তাকায়। না, আব্বু নয়। অন্য কেউ ঢুকলো। তারপর আরও একজন। অতঃপর দীর্ঘ প্রতীক্ষা শেষে রাসেলের আব্বা এসে ঘরে ঢোকেন। রাসেল মায়ের কোলে, অন্য ভাইবোনেরা মায়ের আশেপাশে। ঘরে ঢুকেই দীর্ঘদেহী পিতা দুই হাত বাড়িয়ে রাসেলকে কোলে তুলে নিলেন, ‘কী ব্যাপার? আজ আমার জন্যে রাস্তায় দাঁড়িয়ে অপেক্ষা না করে ঘরে বসে আছো যে?’ রাসেল বাবার বুকে মাথা গুঁজে দিয়ে অস্ফুটকন্ঠে কেবল ডাক দেয় ‘আব্বা।’ কিন্তু পরক্ষণেই বাবাকে ছেড়ে দিয়ে মার কোলে ঝাঁপিয়ে পড়ে মাকে পুনঃ পুনঃ ‘আব্বা, আব্বা’ বলে ডাকতে শুরু করে। কী ঘটে চলেছে বুঝতে না পেরে প্রকৃত আব্বা বলেন, ‘এটা কী হচ্ছে? ব্যাপার কি?’ রাসেলের মা বলেন, “বাড়িতে ‘আব্বা’ ‘আব্বা’ করে কাঁদে। তাই ওকে বলেছি আমাকে ‘আব্বা’ বলে ডাকতে।”

রাসেল তখন বারবার তার আম্মাকে ‘আব্বা, আব্বা’ বলে ডাকতে থাকে। ওর ডাক শুনে যেই তার পিতা জবাব দেন, সেই রাসেল মায়ের গলা আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলে, ‘তুমি আমার আব্বা।’ পিতা বোঝেন তার উপর অভিমান করেছে রাসেল।

অভিমানের মাত্রাটা এতোখানি যে আজকে বিদায়ের সময়ও পিতাকে সঙ্গে করে বাড়ি নিয়ে যেতে চাইলো না রাসেল। পুত্রের মাথা ভরা চুলে ডান হাতের আঙ্গুল দিয়ে বিলি কাটতে কাটতে পিতা ভাবেন, এই শিশুপুত্র একদিন এই অভিমান ভুলে গিয়ে পিতার বুকের রক্তক্ষরণ ঠিকই টের পাবে। তার আব্বার এই যে বাড়ি, যেখানে দীর্ঘদিন ধরে তিনি বাস করছেন বা করতে বাধ্য হচ্ছেন, তা তার নিজের বাড়ি যেমন নয়, শ্বশুরালয়-ও নয়। প্রিয়জন, আপনজন সকলকে ছেড়ে এই নিরালোকে, নিঃসঙ্গতায় দিনের পর দিন বসবাস যে কী অসহনীয়, কী মর্মান্তিক সে কথা বুঝতে শিখবে কবে রাসেল?

পিতা যখন এতোসব চিন্তায় মগ্ন, তিনি খেয়াল করেন না, আব্বা নামধারী আম্মাও লক্ষ্য করেন না যেহেতু তার বুকে উপুর হয়ে মুখ রেখে লেপ্টে আছে রাসেল আর নিবিষ্টমনে তিনি টিফিন কেরিয়ার থেকে পিঠা বের করে আনছেন স্বামীর জন্যে, রাসেলের চোখ দুটো শুধু ছলছলই করে ওঠে না, একসময় একটি করে সরু জলের রেখা দুই গাল বেয়ে নিচের দিকে গড়িয়ে পড়তে শুরু করে। গত পরশু খেলতে গিয়ে পায়ে ছুটন্ত বল লেগে যে কষ্ট হয়েছিল, তার চেয়েও অনেক বেশি কষ্ট হচ্ছে তার, এখন। আব্বার ওপর প্রচন্ড রাগ করে আব্বারূপী আম্মার গলা দু’হাত দিয়ে পেঁচিয়ে ধরে এবার সত্যি সত্যিই ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে রাসেল।

সারাবাংলা/এসবিডিই

ঈদুল ফিতর ২০২৪ বিশেষ সংখ্যা গল্প পূরবী বসু বৈশাখী আয়োজন ১৪৩১ রাসেলের ‘আব্বা’


বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ
সম্পর্কিত খবর