বিজ্ঞাপন

‘স্বপ্নের রাষ্ট্র এখনও হতে পারেনি বাংলাদেশ’

August 4, 2018 | 8:39 am

।। রমেন দাশগুপ্ত, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট ।।

বিজ্ঞাপন

চট্টগ্রাম ব্যুরো : ষাটের দশকে যৌবনে ভালোবেসে শিক্ষকতাকে পেশা হিসেবে নিয়েছিলেন ড. অনুপম সেন। জীবনের পড়ন্ত বেলায় এসেও শিক্ষকতাতেই আছেন তিনি। এই শিক্ষকতা করতে গিয়েই পাকিস্তান আমল থেকে সকল গণআন্দোলনে সম্পৃক্ত করেছেন নিজেকে। প্রগতিশীল রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক, মানবিক সমাজ গড়ার আন্দোলনে পালন করেছেন অগ্রণী ভূমিকা। প্রগতিশীল সমাজবিজ্ঞানী হিসেবে দেশে যেমন পেয়েছেন অকুণ্ঠ সম্মান, বিশ্বসভায়ও সম্মানিত হয়েছেন। শিক্ষায় পেয়েছেন একুশে পদক।

৫ আগস্ট ড. অনুপম সেনের ৭৮তম জন্মদিন। উত্তাল যৌবনে লড়াই-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বাঙালির জন্য মানবিক, বৈষম্যমুক্ত, অসাম্প্রদায়িক একটি দেশের স্বপ্ন দেখেছিলেন যারা, তাদের সামনের কাতারের একজন এই শিক্ষাবিদ। জন্মদিনের প্রাক্কালে সারাবাংলা’র পক্ষ থেকে প্রশ্ন ছিল, কেমন বাংলাদেশ তিনি চেয়েছিলেন, কেমন বাংলাদেশ তিনি পেয়েছেন?

দেশ নিয়ে প্রচণ্ড আশাবাদী এই মানুষটির জবাব, বারবার হোঁচট খাওয়ার পরও ৪৮ বছরে বাংলাদেশের অর্জন অনেক। উন্নয়নে অনেক এগিয়ে গেছে দেশ। তবে একটি মানবিক, অসাম্প্রদায়িক, বৈষম্যমুক্ত রাষ্ট্র গড়ার স্বপ্ন এখনও পূরণ হয়নি। সেই প্রত্যাশা থেকে দেশ এখনও অনেক পিছিয়ে আছে।

বিজ্ঞাপন

অনুপম সেন বলেন, ‘স্বপ্ন ছিল, দেশ একদিন সোনার বাংলা হবে। এটা বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন। বঙ্গবন্ধুকে যদি হত্যা করা না হতো, এই বাংলাদেশ এতদিনে স্বপ্নের সোনার বাংলা হতো। একটা মানবিক, অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র আমরা পেতাম। কিন্তু সেই স্বপ্নটা এখনও অপূর্ণ থেকে গেছে। সমাজ-প্রগতির সংগ্রামে এখনও সফলতা আসেনি।’

‘বঙ্গবন্ধুর মেয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশকে উন্নয়নে অনেক এগিয়ে নিয়েছেন। অনেক উন্নয়ন আমাদের হচ্ছে। তবে অনেক সময় মনে হয়, এই সোনার বাংলা গড়ার সংগ্রামে শেখ হাসিনা বড্ড একা। যেন সব দায়িত্ব শুধু তার! তাকে একাই যেন সবকিছু টেনে নিয়ে যেতে হচ্ছে!’, বলেন তিনি।

বিজ্ঞাপন

ড. অনুপম বলেন, ‘শেখ হাসিনার পাশে হয়তো পাঁচ-ছয় জন, বলতে পারেন জনা দশেক ভালো লোক আছেন। এর বাইরে অনেকেই আছেন, যাদের কর্মকাণ্ডে মনে হয় তারা সরকার ও দেশকে এগিয়ে নেওয়ার চেয়েও আত্মপ্রচারে মগ্ন। আত্মস্বার্থে যেন তারা অনেক বেশি সরব। প্রধানমন্ত্রীর অর্জন অনেক, সোনার বাংলা গড়ার সংগ্রামে তার প্রচেষ্টার ত্রুটি নেই। কিন্তু আশপাশে যদি ভালো মানুষ পাওয়া না যায়, তাহলে হোঁচট খেতে হয়।’

এই অবস্থায় দল ও সরকারে একটি শুদ্ধি অভিযান এবং সামাজিক বিপ্লব গড়ার প্রত্যাশা আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য অনুপম সেনের। তিনি বলেন, সরকারের ভেতরে ভালো লোকগুলোর বাইরে যারা শেখ হাসিনার অগ্রযাত্রাকে বাধাগ্রস্ত করছেন, তাদের বিষয়ে সতর্ক হতে হবে। যারা দল ও সরকারের জন্য বোঝা হয়ে যাচ্ছেন, তাদের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।

তিনি আরও বলেন, দল দুই দফা ক্ষমতায় থাকার কারণে অনেক পাকিস্তানপ্রেমী, স্বার্থান্ধ মানুষ ছদ্মবেশে আওয়ামী লীগের ভেতরে ঢুকে গেছে। দলের ভেতরে সক্রিয় বড় অংশ এখন আওয়ামী লীগের আদর্শে উদ্বুদ্ধ নন। এরা মুখে আওয়ামী লীগের আদর্শের কথা বলেন, অন্তরে পোষণ করেন না। অনেক দুষ্ট লোক, সন্ত্রাসী আওয়ামী লীগে আশ্রয় নিয়েছে।

বিজ্ঞাপন

‘আওয়ামী লীগ আরেক দফা ক্ষমতায় এলে প্রথম কাজ হওয়া উচিত দলের ভেতরে একটি শুদ্ধি অভিযান চালানো। একইসঙ্গে দেশের ভেতরে শুদ্ধি অভিযান চালিয়ে একটি সমাজ বিপ্লবের পথে এগিয়ে যাওয়া। এটি সর্বাগ্রে এবং জোরালোভাবে হওয়া প্রয়োজন। না হলে আমরা সোনার বাংলা পাবো না।’, বলেন তিনি।

অনুপম সেন বলেন, ‘বলা যেতে পারে শুদ্ধি অভিযান কেন? সমাজ বিপ্লবই বা কেন? শুদ্ধি অভিযান না চালালে সমাজ বিপ্লবের পথ পরিষ্কার হবে না। দুর্নীতি আমাদের মধ্যে শেকড় গেড়েছে। এই যে সরকারি কর্মকর্তাদের বেতন বাড়ানো হলো, তাতে দুর্নীতি কিংবা ‍ঘুষ নেওয়ার প্রবণতা কি কমেছে? বরং খুব সাধারণ পোস্টে যারা চাকরি করেন, তারাও মানুষকে হয়রানি করছেন। এসব যদি বন্ধ করতে হয়, তাহলে সামাজিক বিপ্লব ছাড়া হবে না।’

‘মোট কথা, রাষ্ট্রের শুদ্ধাচারের জন্য আন্দোলন করতে হবে। সেটা নিজের দলকে দিয়ে শুরু করতে হবে।’, বলছেন এই প্রবীণ শিক্ষাবিদ।

বাংলাদেশের রাজনীতির দুরবস্থা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে জিয়াউর রহমানের ক্ষমতায় বসার পর থেকে শুরু হয়েছে বলে মন্তব্য করেন অনুপম সেন। তিনি বলেন, জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় এসে ঘোষণা দিলেন, টাকা কোনো সমস্যা নয়, তিনি রাজনীতিকে রাজনীতিবিদদের জন্য কঠিন করে ছাড়বেন। তিনি সত্যিই রাজনীতি প্রকৃত রাজনীতিবিদদের কাছ থেকে নিয়ে মৌলবাদীদের হাতে তুলে দিয়েছেন। স্বাধীনতাবিরোধী, পাকিস্তানপন্থীদের পুনর্বাসন করেছেন। পুরো দেশটাকেই পাকিস্তানের পথে নিয়ে গেলেন। এর ফল এই দেশ এখনও কাটিয়ে উঠতে পারেনি।

তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশে এখনও অনেক পাকিস্তানপন্থী আছে। বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রকারীর সংখ্যাও কম নয়। দুর্ভাগ্যজনক হচ্ছে, তাদের অনেকে আওয়ামী লীগের ভেতরে ঢুকে গেছে। এরা দলের আদর্শ প্রচার নয়, বিভিন্ন জায়গায় গিয়ে ছাত্রলীগ-যুবলীগ, আওয়ামী লীগের পরিচয় দিয়ে নিজেদের আখের গোছাচ্ছেন।’

এই অবস্থায় বামপন্থীদের কর্মকাণ্ড নিয়েও হতাশা প্রকাশ করেছেন প্রগতিশীল এই বুদ্ধিজীবী। তিনি বলেন, ‘বামপন্থীরা অনেক সময় এমনভাবে কথা বলেন, বক্তব্য দেন কিংবা আওয়ামী লীগের বিরোধিতা করেন যেটা পাকিস্তানপন্থীদের পক্ষে চলে যায়। বামপন্থীরা বামপন্থার কথা বলেন, কিন্তু কাজে দেখা যায় তারা ডানপন্থাকে সমর্থন দিচ্ছেন।’

তবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কর্মকাণ্ডে প্রচণ্ডভাবে আশাবাদী অনুপম সেন। তিনি বলেন, শেখ হাসিনা দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। সামাজিক অনেক ক্ষেত্রে ভারতকেও ছাড়িয়ে গেছি। উন্নয়নেও পিছিয়ে নেই। তবে বৈষম্য কমাতে হবে। শিক্ষায় সর্বোচ্চ জোর দিতে হবে। সেই শিক্ষা হতে হবে মানসম্পন্ন ও মানবিক। আমি মনে করি, শেখ হাসিনাই পারবেন। এই বাংলাদেশ তার হাত ধরেই একদিন স্বপ্নের সোনার বাংলা হবে।

১৯৪০ সালের ৫ আগস্ট চট্টগ্রাম নগরীর আইস ফ্যাক্টরি রোডে জন্ম নেন অনুপম সেন। গ্রামের বাড়ি পটিয়া উপজেলার ধলঘাটে হলেও জীবনের অধিকাংশ সময় কেটেছে চট্টগ্রাম শহরেই। ১৯৬৫ সাল থেকে ৫৩ বছর ধরে শিক্ষকতা পেশায় থাকা ড. অনুপম সেন এখন বেসরকারি প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।

সারাবাংলা/আরডি/টিআর

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন