বিজ্ঞাপন

স্বাস্থ্য সুরক্ষায় বাধা অসংক্রামক রোগের আক্রমণ!

April 7, 2018 | 10:21 am

।। জাকিয়া আহমেদ, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট ।।

বিজ্ঞাপন

ঢাকা: দেশে বর্তমানে ৬১ শতাংশ মানুষ অসংক্রামক রোগে আক্রান্ত। গত কয়েকবছর ধরেই অসংক্রামক রোগে আক্রান্তের হার বেড়ে চেলেছে। নন-কমিউনিকেবল ডিজিজ বা অসংক্রামক রোগ মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যদি এখনই সচেতন না হওয়া যায় তাহলে ভবিষ্যতে এটি মহামারী আকার ধারণ করবে। তারা বলছেন, সর্বজনীন স্বাস্থ্য অধিকার নিশ্চিত করতে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থাসহ চিকিৎসাসেবা গণমূখী করতে হবে।

চিকিৎসাসেবা সংক্রান্ত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ডায়াবেটিস, শ্বাসতন্ত্রের দীর্ঘস্থায়ী রোগ (সিওপিডি), হৃদরোগ, স্ট্রোক, ক্যান্সারের মতো এসব রোগে আক্রন্ত মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। ভয়াবহ, দীর্ঘমেয়াদি ও ব্যয়বহুল এসব রোগের কারণে তাৎক্ষণিকভাবে মৃত্যু না হলেও শারীরিক, মানসিক ও অর্থনৈতিকভাবে দীর্ঘ ভোগান্তির শিকার হচ্ছে মানুষ।

অপরদিকে বাংলাদেশ হেলথ ওয়াচ রিপোর্ট ২০১৬ তে বলা হয়েছে— দেশে গড় আয়ু বৃদ্ধি, মাতৃমৃত্যু হ্রাস পেলেও অসংক্রামক রোগ যেমন হৃদরোগ, ক্যান্সার, ডায়াবেটিস বেড়েছে। অপরদিকে, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা থেকে জানা যায়, পৃথিবীতে ৬৩ ভাগ মৃত্যুর জন্য দায়ী বিভিন্ন অসংক্রামক রোগ। আর অসংক্রামক রোগজনিত মৃত্যুর ৮২ ভাগই হচ্ছে ডায়াবেটিস, ফুসফুসের দীর্ঘমেয়াদি রোগ, ক্যান্সার এবং কার্ডিওভাসকুলার জিজিজের কারণে।

বিজ্ঞাপন

সারাবিশ্বে অসংক্রামক রোগে আক্রান্তদের মধ্যে ২০ শতাংশ স্নায়ুরোগী। এর অধিকাংশই উন্নয়নশীল দেশে এবং এসব রোগীর বড় অংশই মূলত স্ট্রোক ও মৃগী রোগে আক্রান্ত্র। অপরদিকে, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে জানা যায়, দেশে বর্তমানে স্নায়ুরোগে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ৪০ থেকে ৫০ লাখ। ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস ও হাসপাতালের তথ্য অনুযায়ী ২০১৩ থেকে ২০১৬ সালের নিউরোলজি এবংনিউরোসার্জারি রোগীর সংখ্যা ৬ গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। অপরদিকে, রাজধানীর জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে (এনআইসিভিডি) তিনটি ভবনের কেবিন, ওয়ার্ড মিলিয়ে বেডের সংখ্যা ৪৩৪টি হলেও প্রতিদিন ভর্তি থাকেন ৯০০ থেকে ১ হাজার রোগী। কিডনি রোগে আক্রান্ত ২ কোটিরও বেশি মানুষ এবং প্রতি মাসেই ক্যান্সার, কিডনি ও লিভার রোগী দ্বিগুণ হারে বাড়ছে। অথচ সচেতনতার মাধ্যমে ৫০ থেকে৬০ কিডনি বিকল প্রতিরোধ করা সম্ভব।

ইন্টারন্যাশনাল এজেন্সি ফর রিসার্চ অন ক্যান্সার (আইএআরসি) এর তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশে প্রতি বছর ১ লাখ ২২ হাজার ৭১৫ জন ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়। ধনীরা উন্নত দেশে, মোটামুটি ধনীরা ভারতে, মধ্যবিত্তরা ঢাকায় চিকিৎসা করে থাকে। যাদের আর্থিক সঙ্গতি নেই তারা বিনা চিকিৎসায় মারা যান। বাংলাদেশে বছরে ক্যান্সার আক্রান্ত হয়ে ৯১ হাজার ৩৩৯ জন মারা যান। এর মধ্যে ১৪ শতাংশ খাদ্যনালীর, ১১ শতাংশ ফুসফুসের ক্যান্সারে মারা যান।

বিজ্ঞাপন

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী দেশে প্রতি বছর প্রতি লাখে যক্ষায় আক্রান্ত হচ্ছেন ২২১ জন, মৃত্যু হচ্ছে ৪০ জনের। জাতীয় যক্ষা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির (এনটিপি) তথ্য অনুযায়ী ২০১৭ সালে দেশে দুই লাখ ৪৪ হাজার ২০১ জন যক্ষা রোগী শনাক্ত করা ও চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে। যক্ষা নিয়ন্ত্রণে বালাদেশের অনেক সাফল্য থাকা সত্ত্বেও ঝুঁকিপূর্ণ ৩০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। শহরে ও বয়স্ক জনগোষ্ঠীর মধ্যে যক্ষার প্রাদুর্ভাব বেশি।

সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষায় বাধা অসংক্রামক রোগ এবং এর প্রতিকার কী জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক সৈয়দ আব্দুল হামিদ সারাবাংলাকে বলেন, সবার জন্য স্বাস্থ্য সেবা বা সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করলে প্রথমেই দেশের আপামর জনসাধারণের চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করতে হবে।

তিনি বলেন, জনসাধারণের চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত এবং গণমুখি করতে হলে সরকারি স্বাস্থ্যকেন্দ্র গুলো বিশেষ করে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স এবং কমিউনিটি ক্লিনিকগুলোকে ইফেক্টিভলি ফাঙশনাল (যথাযথ কার্যকর) করতে হবে, সেখানে গিয়ে যেন গ্রামের মানুষ সেবা পায় সেটা নিশ্চিত করতে হবে।

বাংলাদেশে অসংক্রামক রোগ বেড়ে যাবার পেছনে শারীরিক পরিশ্রম না করা, ভেজাল এবং দূষনজনিত খাবার, প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থান গ্রহণ না করার মতো বিষয়গুলোতে ঘাটতি রয়েছে।
স্বাস্থ্য সর্ম্পকিত বিষয়গুলো আসলে ‘মাল্টি মিনিস্ট্রিয়াল’ বিষয় মন্তব্য করে সৈয়দ আব্দুল হামিদ বলেন, স্বাস্থ্য কখনও এক স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কাজ নয়। পানির কোয়ালিটি, পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা, খাদ্য বিষয়ক বিভিন্ন সমস্যা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কাজ নয়, অন্যান্য মন্ত্রণালয়কেও এগিয়ে আসতে হবে। এখানে ‘ইন্টার মিনিস্ট্রিয়াল’কে সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে। নানা অব্যবস্থাপনার কারনে অসংক্রামক রোগের প্রার্দুভাব বাড়ছে।

বিজ্ঞাপন

‘মাল্টি লেভেল ফ্যাক্টর’ দ্বারা আমরা আক্রান্ত হচ্ছি মন্তব্য করে তিনি বলেন, সচেতনতার কাজ শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের, রাস্তা-ঘাট-হাটার জায়গার মতো পার্ক স্থানীয় সরকারের, সুষম খাদ্য নিশ্চিত করবে খাদ্য মন্ত্রণালয়-সুতরাং তাদেরকেও সমান ভাবে কাজ করতে হবে। তারা যদি কাজ না করে তাহলে রোগের পেছনে খরচতো করতেই হবে। তাই রোগ না হবার আগেই প্রতিরোধ করতে পারলেই রোগের পেছনে খরচ কমে যাবে।

অপরদিকে, প্রিভেন্টিভ মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী বলেন, অসংক্রামক রোগ প্রতিরোধে নীতিমালা ও আইনের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। বিদ্যমান নীতিমালা ও আইন বাস্তবায়নের মাধ্যমে এসব রোগ উল্লেখযোগ্য পরিমাণে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।

জনস্বাস্থ্য সুরক্ষায় প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থার প্রতি যথাযথ গুরুত্ব না দেয়া, চিকিৎসা ব্যবস্থায় মারাত্মক দূর্বলতা এবং অপ্রতুল চিকিৎসা সুবিধার কারণে এদেশের জনগণ সর্বজনীন স্বাস্থ্য সেবা থেকে বঞ্চিত জানিয়ে ডা. লেলিন চৌধুরী বলেন, এখানে আর্থিক স্বচ্ছলতার অভাবে অনেকেই প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্য সেবা গ্রহণ করতে পারছেন না, আবার অনেকই চিকিৎসা করতে তাদের স্থাবর অস্থাবর সম্পতি বিক্রি করতে বাধ্য হন।

আর সর্বজনীন স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত করতে হলে বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকে চিকিৎসা ও প্যাথলজি ফি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের নজরদারিতে যৌক্তিক পর্যায়ে নামিয়ে আনা। আর্থিকভাবে অসচ্ছল রোগীদেরআর্থিকভাবে সুবিধা প্রদান এবং ডাক্তারদের কনসালট্যান্সি ফি কমানোর ব্যবস্থা করতে হবে বলেও জানান ডা. লেলিন চৌধুরী ।

সারাবাংলা/জেএ/একে

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন