বিজ্ঞাপন

৭ দফা দাবি, ১৮ আইটেমের মেন্যু, গণভবন ভেন্যু

November 3, 2018 | 10:03 pm

অনেকদিন ধরেই বাংলাদেশের ক্ষমতার কেন্দ্রে অবস্থান গণভবনের। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বাসভবন বলেই গণভবন নিয়ে সবার আগ্রহ। অবশ্য গণভবনকে প্রথম মর্যাদা দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। অবশ্য তিনি গণভবনে অফিস করলেও থাকতেন ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের বাড়িতেই। ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় এসে পিতার স্মৃতিবিজড়িত গণভবনকেই বাসভবন হিসেবে বেছে নেন শেখ হাসিনা। দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় এসেও তার পছন্দ গণভবনই। বেগম খালেদা জিয়া তিনদফায় প্রধানমন্ত্রী হলেও গণভবনকে সে অর্থে কাজে লাগাননি। সম্ভবত দুবার ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময় করেছিলেন। কিন্তু শেখ হাসিনার খুবই প্রিয় গণভবন। গণভবনের পেছনের লেকে মাছকে খাবার দিতেন বঙ্গবন্ধু। তাঁর অনেকসময় কেটেছে এখানে। তাই শেখ হাসিনা বারবার ফিরে আসেন গণভবনে।

বিজ্ঞাপন

গত ১ নভেম্বর এই গণভবন ছিল গোটা জাতির আগ্রহের কেন্দ্রে। রাজনৈতিক অচলাবস্থা নিরসনে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের সাথে সংলাপে বসে ১৪ দল। ঐক্যফ্রন্টের ড. কামাল হোসেনের আহবানে সাড়া দিয়ে তাদের সংলাপে আমন্ত্রণ জানান শেখ হাসিনা। সংলাপে ১৪ দলের ২৩ সদস্যের প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দেন শেখ হাসিনা। আর ঐক্যফ্রন্টের ২০ সদস্যের দলের নেতৃত্বে ছিলেন ড. কামাল। ভেতরে যখন সংলাপ চলছিল, তখন গণভবনের বাইরে ছিল সাংবাদিকদের ভিড়। জাতির আগ্রহের কেন্দ্রে যে সংলাপ, তা নিয়ে গণমাধ্যমেরও আগ্রহ ছিল তুঙ্গে। এখন বাংলাদেশে গণমাধ্যমের যে বিপুল বিস্তার তাতে গণভবনের সামনে প্রায় জনসভা। ২৬টি টেলিভিশনের একাধিক টিম তো ছিলই, ছিল বিভিন্ন দৈনিক, অনলাইন, রেডিওর সংবাদকর্মীরা। টানা লাইভে টেলিভিশনগুলো দর্শকদের আপডেট জানানোর চেষ্টা করেছে মধ্যরাত পর্যন্ত।

১ নভেম্বর সংলাপ শুরু হলেও শেষ হয়নি। ২ তারিখেই সাবেক রাষ্ট্রপতি বি চৌধুরীর নেতৃত্বে যুক্তফ্রন্টের প্রতিনিধিদল সংলাপে অংশ নিয়েছে। এছাড়া জাতীয় পার্টি, বাম গণতান্ত্রিক জোটসহ অারো অনেক দল সংলাপের অপেক্ষায় অাছে। তবে সংলাপের মূল আগ্রহ ছিল ১৪ দলের সাথে ঐক্যফ্রন্টের সংলাপ নিয়েই। সমস্যা সমাধান হয়ে যায়নি বটে, তবে আলোচনা শুরু হয়েছে; তাতেই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলছেন অনেকেই। দুপক্ষই বলছেন আলোচনা আরো হবে। তার মানে একটা সমঝোতার সম্ভাবনা ফুরিয়ে যায়নি এখনও। ঐক্যফ্রন্ট সংলাপে বসেছে ৭ দফা দাবি নিয়ে, আর ১৪ দল অনড় ছিল সংবিধানে। দেখা যাক, সামনের দিনগুলোতে কে কতটুকু ছাড় দেয়।

তবে এবারের সংলাপে ৭ দফা দাবির চেয়ে বেশি আলোচনা হয়েছে ১৭ আইটেমের মেন্যু নিয়ে, পরে অবশ্য আইটেম সংখ্যা বেড়ে দাড়িয়েছিল ১৮তে। শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে বিরোধী দল অনেক অভিযোগ করতে পারবেন, কিন্তু হোস্ট হিসেবে তিনি যে অসাধারন, এটা মানবেন সবাই। আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদক আবদুস সোবহান গোলাপ শেখ হাসিনার চিঠি নিয়ে গিয়েছিলেন ড. কামাল হোসেনের বাসায়। শেখ হাসিনা তাকে বলে দিয়েছিলেন, ড. কামাল হোসেনের খাবারের পছন্দ জেনে আসতে। ভোজনরসিক হিসেবে ড. কামালের সুনাম আছে। ড. কামাল সেদিন তার পছন্দ হিসেবে শুধু চিজ কেকের কথা বলেছিলেন। মেন্যুতে তাই চিজ কেক ছিল, সেটি আনা হয়েছিল র‌্যাডিসন হোটেল থেকে। সাথে ছিল পিয়ারু সর্দারের মোরগ পোলাওসহ আরো ১৬ আইটেম। বিভিন্ন অনলাইনে সংলাপের আগেই ১৭ আইটেমের মেন্যু ফাঁস হয়ে যায়। তা নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে চলে সরস আলোচনা, খোজাখুজি চলে পিয়ারু সর্দারের মোরগ পোলাওয়ের। তবে সংলাপের সাথে নৈশভোজ নিয়ে আলোচনা তুঙ্গে ওঠে ঐক্যফ্রন্টের নাটকীয় অনীহায়। একদিন আগে গণফোরাম সাধারন সম্পাদক মোস্তফা মহসিন মন্টু ফোন করে আওয়ামী লীগ সাধারন সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরকে জানিয়ে দেন, তারা জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আলোচনা করতে যাবেন, খেতে নয়। তাই নৈশভোজের আয়োজন যেন না রাখা হয়। ঐক্যফ্রন্ট নেতা মাহমুদুর রহমান মান্না গণমাধ্যমকে বলেছিলেন, তারা খেয়ে সময় নষ্ট করতে চান না। তবে ঐক্যফ্রন্টের আপত্তির মূল কারণ ছিল ভিন্ন। চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে কারাগারে রেখে বিএনপি নেতারা গণভবনে ১৭ আইটেমের নৈশভোজে যোগ দেবেন; এ নিয়ে দলীয় নেতাকর্মীদের মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। আবার খালেদা জিয়ার কারাদণ্ড বাড়ানোর প্রতিবাদে সেদিনই গণঅনশন ছিল বিএনপির। সারাদিন অনশন করে রাতে গণভবনে নৈশভোজ; এটা নিয়েও দিনভর আলোচনা ছিল। বিএনপির আপত্তির কারণেই ঐক্যফ্রন্ট নৈশভোজে অনীহার কথা জানিয়েছিল। কিন্তু খালেদা জিয়াকে কারাগারে রেখে তারা নৈশভোজে অংশ নেবেন না; এ নৈতিক অবস্থানটি কেউ স্পষ্ট করে বলেননি। বরং সময় নষ্টের অজুহাত দাড় করান। কিন্তু সংলাপের কোনো সময় বেধে দেয়া ছিল না। সংলাপ সাড়ে ৩ ঘণ্টা চলেছে, প্রয়োজনে চলতে পারতো আরো লম্বা সময়। অন্তত সময়ের জন্য খেতে পারবেন না, এই যুক্তিটা খুব দুর্বল। নৈশভোজের আয়োজন না রাখতে ঐক্যফ্রন্টের করা অনুরোধ রাখেননি আওয়ামি লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা। আগের ১৭ আইটেম তো ছিলই, সংলাপের দিন দেখা গেল মেন্যুতে হাতে লিখে ১৮ নম্বর আইটেম হিসেবে যুক্ত হয়েছে পাটিসাপটা পিঠা। সংলাপে রাজনৈতিক বিষয় নিয়ে যেমন কৌতুহল ছিল, কৌতুহল ছিল ১৮ আইটেম নিয়েও। তবে কৌতুহলের শীর্ষে ছিল ড. কামালের পছন্দের চিজ কেক। র‌্যাডিসন থেকে নাকি ৫০ কেজি চিজ কেক আনা হয়েছিল। গণভবনে উপস্থিত সবাই চিজ কেকের স্বাদ পেয়েছেন। সংলাপে র‌্যাডিসনের চিজ কেকের ব্যাপক বিজ্ঞাপনও হয়েছে।

বিজ্ঞাপন

কৌতুহল ছিল ঐক্যফ্রন্টের নেতারা নৈশভোজে অংশ নেন কিনা তা নিয়েও। সংলাপ সূত্র জানিয়েছে, সংলাপ শুরু হয়েছে সন্ধ্যা ৭টায়, রাত ৯টায় সবার সামনে খাবার পরিবেশন করা হয়। শেখ হাসিনা সবাইকে আমন্ত্রণ জানিয়ে বলেন, ‘সবার জন্য খাবার আয়োজন করেছি। আপনাদের আপ্যায়নের সুযোগ পেয়েছি, সুযোগের সদ্ব্যবহার করলাম।’ ঐক্যফ্রন্ট নেতাদের কারো কারো দ্বিধা দেখে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘ গণভবন সবার। এখানে যারা এসেছেন, সবাই সম্মানীয় ব্যক্তি। আপনারা আপনাদের খাবার খাচ্ছেন। আপনারা শুরু করলে আমিও করবো।’

এরপর আসলে কারো পক্ষে না খেয়ে থাকার উপায় ছিল না। সবাই খেয়েছেন। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল একটু দ্বিধায় ছিলেন। শেখ হাসিনা ব্যক্তিগত কর্মকর্তা পাঠিয়ে জানতে পারেন, রিচফুডে আপত্তি মির্জা ফখরুলের। পরে তার জন্য মাছ-ভাতের ব্যবস্থা করা হয়। খাবার নিয়ে এই জটিলতা ঐক্যফ্রন্ট তথা বিএনপিরই সৃষ্টি। তারা খেতে চাননি বলেই তাদের খাওয়া নিয়ে তুমুল আলোচনা। তারা কেউ কিন্তু খেতে না চাওয়ার মূল কারণটা বলেননি। এমনকি গণভবনে খাওয়ার আগেও বলেননি, খালেদা জিয়াকে কারাগারে রেখে তারা গণভবনে খাবেন না। নিজেদের ফাঁদে তারা নিজেরাই আটকে পড়েছেন। খাবো না বলে পরে খেয়ে তারা এখন সমালোচনার মুখে। আবার প্রধানমন্ত্রীর সামনে না খেয়ে বসে থাকলে শিষ্টাচার লঙ্ঘনের দায়ে সমালোচনা হতো।

সংলাপ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে রুচিহীনতার তীব্র প্রতিযোগিতা চলে। সংলাপ শুরুর মিনিটপাঁচেকের মধ্যে ক্যামেরা বের করে দেয়া হয়। এই সময়ের ছবিতে দেখা যায় ঐক্যফ্রন্ট নেতারা শরবত, বাদাম খাচ্ছেন। এই ছবি নিয়ে ফেসবুকে শুরু হয় ট্রল। যেন আলোচনা নয়, খাওয়াটাই মূখ্য। খাবো না বলে খেয়েছেন, এ কারণে সরকার সমর্থকরা বিএনপি নেতাদের টিটকারি মারতে থাকেন। আর বিরোধী দলের সমর্থকরা দাবি করেন, শরবত, বাদাম খেলেও তারা ডিনার করেননি। এই দাবিতে টিকতে না পেরে তারা এখন বলছেন, খাইয়ে সেটার ছবি ফাঁস করে খোটা দেয়াটা ছোটলোকি।

বিজ্ঞাপন

মজাটা হলো, ১৪ দল বা ঐক্যফ্রন্টের নেতাদের কিন্তু নৈশভোজ বা এর মেন্যু নিয়ে কোনো মাথাব্যথা নেই। কিন্তু ফেসবুক দেখলে মনে হতে পারে, ১ নভেম্বর গণভবনে রাজনৈতিক সংলাপ নয়, নৈশভোজ হয়েছে। ঝগড়াঝাটি সব খাওয়া না খাওয়া নিয়ে। কিন্তু রাজনীতি নিয়ে সচেতন সবার মাথায় রাখা উচিত গণভবনের ১৮ আইটেমের ডামাডোলে যেন হারিয়ে না যায় ঐক্যফ্রন্টের ৭ দফা দাবি।

ফেসবুকে রুচিহীনতা নিয়ে অনেক আলোচনা হলো। খাওয়ার রুচি নিয়ে একটু বলি। দ্বিতীয় দিনে বি চৌধুরীর মেন্যুটা বরং আমার বেশি পছন্দ হয়েছে। লাল আটার রুটি, সাদা ভাত, ফুলকপি, সিম, আলু ভাজি, মাছের ঝোল ও মসুর ডাল। একদম আমার মনের মত। বি চৌধুরী ডাক্তার মানুষ। তাই তিনি স্বাস্থ্যকর মেন্যু দিয়েছেন। এই মেন্যুর মত চলমান সংলাপ যেন রাজনীতিতেও স্বাস্থ্যকর পরিবেশ ফিরিয়ে আনে, এটুকুই প্রত্যাশা।

প্রভাষ আমিন, হেড অব নিউজ, এটিএন নিউজ

সারাবাংলা/এমএম

বিজ্ঞাপন

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন