।। নাহিয়ান বিন খালেদ ।।
ঢাকার জনসংখ্যা প্রকৃতপক্ষে কত, তার হিসাব পাওয়া কঠিন। ঢাকা দক্ষিণ ও উত্তর সিটি কর্পোরেশন কাছেও সঠিক হিসাব নেই। কমিয়ে কেউ কেউ বলেন দেড় কোটি। অনেকে বলেন দুই কোটি, কেউ কেউ আড়াই কোটিও বলে থাকেন। ‘দ্য ইকোনমিস্ট’-এর তথ্য অনুযায়ী, ঢাকা বিশ্বের বসবাসের যোগ্যতায় ১৩৭তম শহর। ঢাকার পরের নগরীগুলো হচ্ছে বিধ্বস্ত সিরিয়ার দামেস্ক, লিবিয়ার ত্রিপোলি। বসবাসের এমন পরিবেশ আর অত্যধিক জনসংখ্যার সাথে তাল মিলিয়ে পণ্য ও সেবার মানের নিশ্চয়তা দেওয়া কঠিন হয়ে পড়েছে। নিত্যব্যবহার্য পণ্য ও সেবায় ত্রুটি থাকার পরও সরবরাহ আর চাহিদা নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হচ্ছে না।
রাজধানীর বড় বড় রেস্টুরেন্টে খাদ্য নিরাপত্তা কর্তৃপক্ষ ও প্রশাসনের পক্ষ থেকে অভিযান চালানোর ঘটনা নতুন নয়। ২০০৫-০৬ সালের দিকে ম্যাজিস্ট্রেট রোকন-উদ-দৌলা দফায় দফায় এমন অভিযান চালিয়ে রীতিমতো জাতীয় তারকায় পরিণত হয়েছিলেন। সেই থেকে আজও চলছে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটদের এই অভিযান। অভিযানগুলো প্রতিবছর ‘নামিদামি রেস্টুরেন্টে’ই চালানো হয়। কেএফসি, ব্যাটন রুজ, বসুন্ধরা সিটির ফুড কোর্ট, মীনা বাজার, স্বপ্ন’র মতো দোকানগুলোতে প্রতিবছরই অভিযান চলে। এদের কাউকে কাউকে ৫০ হাজার থেকে ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত জরিমানাও করা হয়েছে এই ক’দিন আগে।
প্রশাসনিক কর্মকর্তারা অনেক রেস্টুরেন্টকে ব্ল্যাকমেইল করার জন্য অভিযান চালান— এমন অভিযোগও কখনও কখনও শোনা যায়। তবে রেস্টুরেন্টে ত্রুটি থাকার কথা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সত্য। এক রেস্টুরেন্টের কর্মচারী ব্যবহৃত ওয়ান টাইম গ্লাস টয়লেটের পানিতে পরিষ্কার করছে— এমন ভিডিও পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছিল সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে।
যেদিন অভিযান চলে বা খাদ্যে ভেজালের খবর প্রকাশ পায়, সেদিন থেকে বড়জোর দুই দিন প্রচুর জনপ্রতিক্রিয়া দেখা যায়। তার পরের দুয়েকদিনের মধ্যেই সেই অভিযানের অভিঘাত সামলে নিয়ে লোভনীয় আর চমক জাগানো অফার দিয়ে বসে বিভিন্ন ধরনের ত্রুটি থাকা খাবার দোকানগুলো। ত্রুটি সংশোধনের এসব রেস্টুরেন্ট কোনো পদক্ষেপ নিয়েছে কি না— তা যাচাইয়ের তো আর সুযোগ নেই। তাই ফুড আইটেমের ঝকঝকে ছবি দেখেই ক্রেতারা ফের হুমড়ি খেয়ে পড়ে রেস্টুরেন্টগুলোতে।
রমজান মাসে তো রাজধানীর সব রেস্টুরেন্টেই ব্যবসা রমরমা। খেয়াল করলেই দেখা যাবে, অভিযান চলা রেস্টুরেন্টগুলোর প্রতিটি টেবিলও ইফতারের সময় ছিল কানায় কানায় পূর্ণ। চমক জাগানো ‘অফার’ওয়ালা রেস্টুরেন্টগুলোতে তো অন্তত ৫-৬ ঘণ্টা আগে বুকিং না দিলে জায়গা-ই মেলে না! কোথাও কোথাও বুকিং দিতে হয় আগের দিন।
ক্রেতাদের পক্ষ থেকে সাড়া মিলছেই, তখন পণ্যের মানোন্নয়নে মনোযোগ দিয়ে কী আর হবে?
এর পাশাপাশি তৈরি শিশুখাদ্য আর প্রসাধনী সামগ্রীতে ভেজাল তো আছেই। টিভি চ্যানেলগুলোর রিপোর্টে প্রায়ই দেখা যায়, পুরানো ঢাকার অলিগলি ও শনির আখড়া বা যাত্রাবাড়ী এলাকায় নকল পণ্য তৈরির প্রচুর কারখানা আছে। এসব পণ্য নিয়মিত উৎপাদন হচ্ছে, বিক্রিও হচ্ছে দেদারছে।
খাদ্য আর নিত্যব্যবহার্য পণ্যে এমন হওয়ার কারণটা অনুমান করা খুব কঠিন নয়। মানুষ এখন বাড়ির বাইরে খাওয়ার জন্য প্রচুর খরচ করে। শহুরে জীবনে বিনোদনের জন্য রেস্টুরেন্ট ছাড়া আর বিকল্প মাধ্যম নেই বললেই চলে। সাম্প্রতিক সময়ে নতুন নতুন খাওয়ার দোকানগুলো এজন্যই ব্যবসা বিস্তার করতে পেরেছে।
ব্যবসার এই দুর্দিনে অল্প কিছু ব্যবসার প্রসার অর্থনীতির জন্য নিঃসন্দেহে ভালো ব্যাপার। কিন্তু সমস্যাটা হয় তখনই, যখন এই বাড়তি চাহিদাকে উপজীব্য করে অসাধু উপায়ে ব্যবসা করা হয়। খাদ্যপ্রেমীদের জন্য ‘ব্র্যান্ড রেস্টুরেন্টে’র বিকল্প যেহেতু খুব বেশি নেই, তারা একই রেস্টুরেন্টেই ছুটে বেড়ায়— সেটা ভেজাল খাদ্য সরবরাহ করুক বা না করুক।
অন্যদিকে, প্রসাধন সামগ্রী ব্যবহার ক্রেতাদের এতই প্রয়োজনীয় হয়ে উঠেছে যে মান যাচাইয়ের বিশেষ কোনো সময় তাদের নেই। অন্যভাবে বলা যায়, যাচাইয়ের সুযোগই বা কোথায়? কোনো মনিটরিং সেল কি বছরজুড়ে এসব সংবেদনশীল পণ্য উৎপাদন দেখভাল করছে? দোকান থেকে প্রসাধন সামগ্রী বা শিশুখাদ্য কেনার আগে মান যাচাইয়ের সুবিধা না থাকায় ‘যা হয় হবে’ ভেবেই কিনে নিতে হচ্ছে এসব পণ্য।
দ্বিতীয় উদাহরণে আসি।
রাইড শেয়ারিং নতুন যুগের সাড়া জাগানো সেবা। শুরুর কিছুদিনের মধ্যেই আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তা পেয়েছে। কিন্তু সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ইউজার গ্রুপগুলোতে কয়দিন পরপর নানারকম তীর্যক অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হওয়ার অভিযোগ আছে গ্রাহকদের। অথচ কোম্পানিকে লিখিত অভিযোগ দেওয়ার পরও সেই অভিযোগকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে অনিয়ম ধরে রেখেই চলছে সার্ভিসগুলো। মোটরবাইকে হেলমেট না থাকা, অনিবন্ধিত মোটরবাইক চলাচল, ঝুঁকিপূর্ণ গাড়িচালনা, চালকের দুর্ব্যবহার— অভিযোগের কমতি নেই। অথচ সমস্যা সমাধান না করে প্রতাপের সাথে ব্যবসা প্রসার ঘটছে এদের।
কারণ? কারণ হলো—আমরা এই সেবা নিতে একরকম বাধ্য হয়ে পড়েছি। অভিযোগকারীরা না চড়লেও জ্যামের শহরে বাইকে চড়ার জন্য যাত্রীর অভাব হয় না এদের। গণপরিবহনে নিরাপত্তার অভাব থাকা আর আরামপ্রদ চলাচলের বিন্দুমাত্র নিশ্চয়তা না থাকায় সবাই ব্যয়বহুল গাড়িতেও সেবা নিচ্ছে। সেবার মান নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে, নাকি ইচ্ছাকৃতভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে না— সেটা বিবেচনার দাবি রাখে। দেশে নিজেদের ব্যবসার সূচনা করেই একটি রাইড শেয়ারিং কোম্পানি ১০০ মিলিয়ন ডলার মূলধনের প্রতিষ্ঠানে পরিণত হতে পারলে সেবার মানের নিশ্চয়তা দিতে এত দেরি হচ্ছে কেন?
গত কয়েক বছরে রাজধানীসহ বড় বড় শহরগুলোতে রাইড শেয়ারিং আর রেস্টুরেন্ট ব্যবসার প্রসার চোখে পড়ার মতোই। উদ্যোগ হিসেবে এরা প্রশংসা কুড়ানোর যোগ্য। কিন্তু এদের ব্যবসার বিরুদ্ধে প্রচুর অভিযোগ। মানুষের স্বাস্থ্য আর জীবন যেসব ব্যবসার সাথে জড়িত, সংশ্লিষ্ট ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গুরুতর অভিযোগের সমাধান করতে বাধ্য।
কয়েকটি দেশে এমন অভিযোগে অভিযুক্ত ব্র্যান্ডের ব্যবসা বন্ধ হওয়ার নজিরও আছে। বুলগেরিয়া, হাংগেরি, ইতালি, স্পেন, যুক্তরাষ্ট্রের কয়েকটির অঙ্গরাজ্যসহ বিভিন্ন দেশে বিশ্বের জনপ্রিয় রাইড শেয়ারিং সার্ভিসকেও পুরোপুরি বা সাময়িকভাবে নিষিদ্ধ হতে হয়েছে। অবিলম্বে সেবামানের উন্নয়ন ঘটানোর জন্য তাদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। খাদ্যপণ্যে ভেজাল দেওয়া হলে সংশ্লিষ্ট কোম্পানিকে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়ার নজিরও আছে, যেন কখনই আর এমন কাজ করার সাহস না হয়।
আমাদের দেশে এদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা মৌসুমনির্ভর। ঈদের সময় এলে প্রচুর হম্বিতম্বি দেখা যায়। তারপর সব একইরকম। আবার কখনও গ্রাহকরা নিজেরাই সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল করে এদের সেবার মানের মুখোশ উন্মোচন করছেন।
অর্থনীতির ভাষায়, বেসরকারিভাবে পরিচালিত এইসব উদ্যোগে পণ্য বা সেবা সরবরাহ সংক্রান্ত অভিযোগ বা গৃহীত আইনি ব্যবস্থা এক ধরনের ‘শক’ বা ‘ধাক্কা’। এই ধাক্কার কারণে পণ্য বা সেবার সরবরাহ কিছুদিন স্থবির হওয়ার কথা। অথবা পণ্য বা সেবার মানোন্নয়ন করার জন্য উঠেপড়ে লেগে পড়বার কথা প্রতিষ্ঠানগুলোর। কিন্তু আদতে এর কিছুই আমরা দেখতে পাচ্ছি না। এই ধাক্কার কারণে চাহিদাও নেমে আসার কথা গ্রাহকদের পক্ষ থেকে। কিন্তু তা হচ্ছে কই? আমরা কি অভিযুক্ত পণ্যগুলো থেকে দূরে থাকতে পারছি?
এমন অবস্থার জন্য দায়ী আইনের যথাযথ প্রয়োগের অভাব, অভিযুক্ত হওয়ার পরও প্রতিষ্ঠানগুলোর স্থানীয় রাজনৈতিক প্রভাবের দৌরাত্ম্য। সবচেয়ে বড় কারণ, ক্রেতাদের জন্য উপযুক্ত বিকল্প পণ্য বা সেবার অভাব। এসব কারণে ত্রুটিপূর্ণ পণ্যের চাহিদার উল্লেখযোগ্য কোনো পরিবর্তন নেই। মানুষ ভেবে নিয়েছে— ‘এভাবেই তো বেঁচে থাকতে হবে। যেভাব চলছে, চালিয়ে নিই!’
জনবহুল এই শহরগুলোতে ভেঙে পড়া একটা ডিমান্ড মেকানিজম বা চাহিদা প্রক্রিয়া নিয়ে আমরা চলছি। জনসংখ্যার আধিক্যের কারণে এমনই উপচে পড়া চাহিদা তৈরি হচ্ছে যে, সাধারণ শক বা ধাক্কা এই পণ্য বা সেবার মান বাড়াতে কোনোই ভূমিকা রাখতে পারে না। কিন্তু এসব পণ্য বা সেবার কারণে যেভাবে দিনের পর দিন আমাদের স্বাস্থ্য আর অর্থ ক্ষয়ক্ষতি আর হুমকির মুখে পড়ছে—তার সমাধান কে দেবে? কিভাবে দেবে?
লেখক: গবেষক
সারাবাংলা/টিআর