Sunday 15 Jun 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

ঠাট্টা থামান, মেয়েদের সামাজিক অবস্থান নিয়েও ভাবুন


২ অক্টোবর ২০১৮ ১৭:৫০
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

কবির য়াহমদ ।।

‘মিস ওয়ার্ল্ড বাংলাদেশ-২০১৮’ প্রতিযোগিতায় প্রশ্নোত্তর পর্বের একটা অংশে একজন প্রতিযোগীর উদ্দেশ্যে করা প্রশ্ন ছিল, ‘তোমাকে যদি তিনটা উইশ দেয়া হয়, ধরো একটা নিজের জন্য, একটা উইশ করতে পারবে ফ্যামিলির জন্য, অথবা একটা দেশের জন্য। তাহলে কোন উইশটা তুমি পছন্দ করবে? জবাবে প্রতিযোগী বলেন, ‘অ্যাট ফার্স্ট অবশ্যই আমার কান্ট্রির জন্য উইশ করব। বাংলাদেশের একটা লংগেস্ট সি বিচ আছে। কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত। বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় সুন্দরবন। অনেক বিউটিফুল। নেক্সট আমাদের দেশে অনেক সুন্দর সুন্দর পাহাড় পর্বত রয়েছে। আমি এগুলোকেই উইশ করব।’ অপর এক প্রতিযোগীর প্রতি প্রশ্ন ছিল H20  (এইচ টু ও) কী? তিনি জানিয়েছেন এই নামে ধানমন্ডিতে একটা রেস্টুরেন্ট আছে।

বিজ্ঞাপন

টেলিভিশনে অনুষ্ঠানের ওই পর্যায়টা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। হাসিঠাট্টা, সমালোচনা, অপবাদ, অপমান সব জুটছে প্রতিযোগীদের কপালে। তাদের শিক্ষাদীক্ষা, সামাজিক স্ট্যাটাস নিয়ে টান দিয়েছেন ফেসবুক ব্যবহারকারীরা। কখনও সেটা অশিষ্ট ইঙ্গিতে আবার কখনও সেটা শিষ্ট শব্দ-বাক্যে। তবে অধিকাংশ আলোচনার একটাই উদ্দেশ্য কিংবা গন্তব্য; এবং সেটা অপমান।

আলোচনাগুলো এতখানি বিস্তার লাভ করেছে যে সন্দেহ জাগে সকলেই কি পুরো অনুষ্ঠান দেখেছেন? এমনও হতে পারে কেউ কেউ ফেসবুক দেখে, অথবা ফেসবুকে ভাইরাল হওয়া ভিডিওচিত্রে সেই অনুষ্ঠানের খণ্ডাংশ দেখেছেন। তবে ফেসবুক আলোচকদের এই আলোচনা শেষে একটা বিষয়ে নিঃসন্দেহ থাকা যায় যে আয়োজকদের উদ্দেশ্য পূরণ হয়েছে, এই আলোচনা প্রতিযোগিতাকে সব জায়গায় ছড়িয়ে দিতে পেরেছে, হোক না সেটা নেতিবাচক প্রচারণা। এখানে তাদের বাণিজ্যিক লাভ, ব্রান্ডিয়েরও।

ফেসবুকের আলোচকদের আক্ষেপের জায়গা প্রতিযোগীরা বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করবেন। প্রতিনিধিত্বশীল এই সব চরিত্রের জ্ঞানের এমন গরিবি হাল আহত করেছে তাদের। এনিয়ে তারা সমালোচনামুখর। এবং এই সমালোচনার প্রধান লক্ষ্য প্রতিযোগীই। প্রতিযোগী কেন জানেন না প্রশ্নের উত্তর, তিনি কেন ঠিকমত উত্তর দিতে পারেন নি- এটুকু। এ আলোচকদের কারও দেশপ্রেম নিয়ে বিন্দুমাত্র সন্দেহ থাকার কথা নয়, সে সন্দেহ করছিও না। তবে তাদের আক্রমণের এই লক্ষ্যবিন্দু নিয়েই কিছু বলা দরকার মনে করছি।

মিস ওয়ার্ল্ড বাংলাদেশ এর আয়োজক অন্তর শোবিজ। গতবারও তারা এমন প্রতিযোগিতার আয়োজন করেছিল। গতবারের বিজয়ী নিয়ে অনেক জল ঘোলা হয়েছিল, অভিযোগ ওঠেছিল স্বেচ্ছাচারিতার। প্রথমে জান্নাতুল নাঈম এভ্রিলকে বিজয়ী ঘোষণা করে কদিন পর জেসিয়া ইসলামকে বিজয়ী ঘোষণা করা হয়। এরপর জেসিয়া ইসলাম চীনে অনুষ্ঠিত চূড়ান্ত প্রতিযোগিতায় অংশ নেন।

এবারের আসরেও নাকি আগেভাগে অনেকেই জানত বিজয়ীর নাম; এবং শেষ পর্যন্ত বিজয়ী হন তিনিই। জান্নাতুল ফেরদৌস ঐশী নামের সেই মেয়েটি বিজয়ী হচ্ছেন এনিয়ে কানাঘুষাও নাকি চলছিল। গ্র্যান্ড ফিনালের আগে বিজয়ীর নাম যখন এভাবে প্রকাশ হয়ে যায় তখন আয়োজকদের আয়োজন, তাদের বাছাই প্রক্রিয়া, এবং তাদের পুরো আয়োজনকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে।

এখানে বিজয়ীর বিজয় নিয়ে প্রশ্ন তোলা উদ্দেশ্য নয়। প্রশ্নটা মূলত আয়োজকদের বাছাই প্রক্রিয়া নিয়ে। কারণ জানানো হয়েছে সারাদেশের প্রায় ত্রিশ হাজার প্রতিযোগী থেকে চূড়ান্ত লড়াইয়ে নেমেছিলেন সর্বশেষ দশজন। এর মানে দাঁড়ায় যাচাইবাছাইয়ের সবগুলো ধাপ অতিক্রম শেষে তারা এমন বড় পর্যায়ে উন্নীত।

ত্রিশ হাজার প্রতিযোগী থেকে চূড়ান্ত লড়াইয়ে নেমেছিলেন দশজন প্রতিযোগী। অর্থাৎ তারা সকল ক্ষেত্রে অন্যদের চেয়ে সেরা হওয়ারই কথা। অনেকগুলো রাউন্ড শেষে যখন এই পর্যায়ে তারা উন্নীত হয়েছেন তখন তারা অন্যদের চেয়ে সেরা না হলে সেটা বিচারকদের দুর্বলতা নিঃসন্দেহে। আয়োজকরা তাদেরকে নিয়ে এতদিন কাজ করেছেন, গ্রুমিং অর্থাৎ প্রতিযোগীদের ব্যক্তিত্বকে গুছিয়ে নেওয়ার শিক্ষা-প্রশিক্ষণ দিয়েছেন। কিন্তু এই তাদের ব্যক্তিত্ব প্রকাশের প্রশিক্ষণ!

অন্তর শোবিজের মিস ওয়ার্ল্ড বাংলাদেশের এই প্রতিযোগিতার আয়োজন নতুন নয়। গতবারও তারা সেরা সুন্দরী নির্বাচন করে চীনে পাঠিয়েছিল। তবে ইতিহাস বলছে গতবারের আসরে বিচারকের সঙ্গে দ্বন্দ্বে শেষ পর্যন্ত মূল মঞ্চে ঘোষিত চ্যাম্পিয়নের নাম পরে সংবাদ সম্মেলন করে বদলাতে বাধ্য হয় আয়োজক প্রতিষ্ঠান। ফলে আয়োজকরা নিজেরাই যে বিতর্কিত তা বলাই বাহুল্য।

এবারের আসরে মূল বিচারকের দায়িত্ব পালন করেছেন কণ্ঠশিল্পী শুভ্রদেব, মডেল ও অভিনেতা খালেদ সুজন, মডেল ইমি, ব্যারিস্টার ফারাবী। ফাইনালের আইকন বিচারক হিসেবে ছিলেন মাইলস ব্যান্ডের শাফিন আহমেদ, হামিন আহমেদ এবং নৃত্যশিল্পী আনিসুল ইসলাম হিরু। এই বিচারকগণ পুরো আসরে কী প্রক্রিয়ায় বিচার কাজ পরিচালনা করলেন সেটা নিয়ে এখন প্রশ্ন তোলাটা অপ্রাসঙ্গিক নয়, কারণ চূড়ান্ত পর্বের প্রতিযোগীরা ইতোমধ্যেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে হাসিঠাট্টার খোরাক হয়েছেন। এই বিচার প্রক্রিয়ায় আয়োজক প্রতিষ্ঠানের হস্তক্ষেপ কি ছিল, এবং থাকলে সে মাত্রা কতখানি ছিল এনিয়ে তারা মুখ খুলতে পারেন; অন্তত নিজেদের অবস্থানকে পরিস্কার করার জন্যে। যদি এনিয়ে তারা কোন কথা না বলেন তাহলে দায়টা তাদের ওপর পড়বে, এককভাবে।

গ্র্যান্ড ফিনালেতে যে কজন প্রতিযোগী সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে হাসির উপকরণ হয়েছেন তারা উলটাপালটা উত্তরের জন্যেই হয়েছেন। দেশকে কী ‘উইশ’ করবেন কিংবা H20  (এইচ টু ও) এগুলোর মধ্যে উপস্থিত বুদ্ধি ও প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার প্রয়োজন। ‘উইশ’ কীভাবে করবেন এটা একজন প্রতিযোগী হঠাৎই নাও বুঝতে পারে। এখানে তার দোষের কিছু নয়। পানির রাসায়নিক নাম যে H2O (এইচ টু ও)মাধ্যমিক পর্যায়ে বিজ্ঞান নিয়ে না পড়া অনেকেই না জানলেও সেটা তার অপরাধ নয়। এই দুই ক্ষেত্রে আয়োজকদের দায় আছে। প্রথমত এতে ব্যক্তিত্ব প্রকাশের যথাযথ প্রশিক্ষণের অভাবের বিষয়টি চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে। এই প্রশিক্ষণ আয়োজকরা দিলেও সেটা যে সফল হয়নি এবং এই ব্যর্থতার দায়ও নিশ্চয়ই তাদের ওপর বর্তায়। এছাড়া বিজ্ঞান-পাঠ্যভুক্ত কোনো প্রশ্নের জন্যে এক্ষেত্রে স্বভাব প্রশ্ন আসে প্রতিযোগিতার নিবন্ধনের সময়ে আয়োজক প্রতিষ্ঠান শিক্ষাগত যোগ্যতার বিষয়টিকে কতখানি গুরুত্বের সঙ্গে হিসেবে উল্লেখ এবং বিবেচনা করেছে। এই ক্ষেত্রেও তারা দায়মুক্ত হতে পারে না।

ফেসবুকের সমালোচনার সময়ে আয়োজক প্রতিষ্ঠান ও বিচারক প্যানেলের বিচার প্রক্রিয়া নিয়ে আমাদের খুব কমসংখ্যক লোকই কথা বলেছেন। ওই প্রতিযোগীরা কেন যথাযথ উত্তর দিতে পারলেন না, তারা অযোগ্য এবং এই অযোগ্যরাই দেশের প্রতিনিধিত্ব করবে ‘মিস ওয়ার্ল্ড’ প্রতিযোগিতায় এনিয়ে খেদ তাদের। এই সমালোচনাগুলো এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যেখানে যথাযথ উত্তর না দেওয়া প্রতিযোগীরাই যেন চূড়ান্ত অপরাধী, প্রতিযোগিতার সঙ্গে সম্পর্ক থাকা বাকি কারও কোন দায় নেই! সমালোচনা কিংবা ঠাট্টার এই সময়ে আমাদের অনেকেই একবারও খেয়াল করছে না মাত্রাতিরিক্ত এই সমালোচনা, এই অপবাদ-অপমান ওই মেয়েগুলোকে পারিবারিক ও সামাজিকভাবে কোথায় দাঁড় করিয়ে দিচ্ছে।

প্রতিযোগীরা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারকারীদের স্বনির্ধারিত বিচারে অযোগ্য হতেই পারে, কিন্তু এতখানি উপহাস তাদের প্রাপ্য ছিল না। এই প্রতিযোগিতা, এই মঞ্চের সমূহ কাজ শেষে তাদেরও এই সামাজিক পরিবেশে বেঁচে থাকতে হয়, হবে; কিন্তু নেটিজেনদের অতি-প্রতিক্রিয়া তাদেরকে সমাজের কাছে হেয় করছে। আর এর ফল তাদের ভোগ করতে হতে পারে করুণভাবে। তাই দয়া করে হাসিঠাট্টা, উপহাস থামান; তাদের সামাজিক অবস্থান নিয়ে একটু হলেও ভাবুন। মানবিক এ ভাবনাটা কেবল এইক্ষেত্রেই নয়, আগামীর সকল ক্ষেত্রেও।

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর