Sunday 15 Jun 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

আমাদের শেয়ারবাজারের ধরন-ধারণ


১ সেপ্টেম্বর ২০১৯ ১৪:৪৯ | আপডেট: ১ সেপ্টেম্বর ২০১৯ ১৯:০৮
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

জগৎ খ্যাত ব্যবসায়ী ওয়ারেন বাফেটের শেয়ারবাজার নিয়ে একটা গল্প প্রচলতি আছে। জানা গল্প তবুও বলছি। তিনি একদিন মুচির কাছে গেলেন জুতা সেলাই করাতে। বলা নেই কওয়া নেই মুচি শেয়ারবাজারের প্রসঙ্গ টেনে তুললেন। বললেন, স্যার শেয়ারবাজার তো এখন বেশ চাঙ্গা। বিনিয়োগ করলে লোকসান-টোকসান হবে না- কি বলেন? ওয়ারেন বাফেট তাকিয়ে রইলেন। কিছুই বললেন না। নিঃশব্দে জুতা সেলাই করিয়ে চলে গেলেন। আর মনে মনে ভাবলেন, শেয়ারবাজারের খবর মুচির কান অব্দি পৌঁছে গেছে- এখন বাজারে আর থাকা যাবে না।

আমাদের শেয়ারবাজারের খবর মুচি-কামার-কুমার-জেলে-তাঁতিরা রাখেন কিনা আমি জানি না। তবে এখানে প্রবল ¯্রােতের মতো, আগুনে ঝাঁপ দেয়া পতঙ্গের মতো লাখ লাখ বিনিয়োগকারী এসেছেন, যাদের বেশির ভাগ বেকার, সরকারি, আধা সরকারি চাকুরে ছোট ব্যবসায়ী, গৃহিনী, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী।

বিজ্ঞাপন

ওয়ান-ইলেভের পর রকিবুর রহমান যখন ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ-এর সভাপতি ছিলেন তখন থেকে দেশের শেয়ারবাজারের চিত্র পাল্টে যেতে থাকে। তখন প্রতিদিনই লেনদেন বেড়েছে। লেনদেন এক-দুই-তিন করে হাজার কোটির ঘরেও পৌছালো আর ডিএসইর পক্ষ থেকে সাংবাদিকদের প্রতিদিনই ব্রিফ করা হতো, বিরিয়ানি খাওয়ানো হতো। মিষ্টির বন্যা বয়ে যেতে। বাজার মূলধন, সূচক বাড়তে বাড়তে আকাশ স্পর্শ করার জোগা হলো। নদীর স্রোতের মতো লাখ লাখ বিনিয়োগকারী কারা এসেছিল তখনকার পত্র-পত্রিকা খুললেই জানা যাবে।

বাজার সম্পর্কে ভালো ধারণা নেই, কোন কোম্পানির শেয়ার কেনা যাবে, কত দিন বিনিয়োগ করলে লাভবান হওয়া যাবে, কোন শেয়ার ধরে রাখা যাবে, ছেড়ে দেয়া যাবে, বিক্রির করে লাভবান হওয়া চেয়ে লভ্যাংশ নেয়া ভালো কিনা? এসব প্রশ্নের জবাব না জানা অনেক বিনিয়োগকারী তখন বাজারে এসেছেন। কেউ লোন করে, কেউ স্ত্রীর নামে এসএমই লোন নিয়ে, কেউ ক্রেডিট কার্ডের টাকায়, কেউ জমি বিক্রি করে, কেউ বউয়ের গহনা বিক্রি সেই সময়ে বাজারে এসেছিলেন। সঞ্চয়পত্রের সুদের হার কম হওয়ায় অনেক পেনশন ভোগীও বাজারে টাকা খাটিয়েছিলেন।

বাজার কি এতো বিনিয়োগকারী ধারণ করতে পারে? বিনিয়োগের নিরাপত্তা দিতে পারে? এসব প্রশ্ন তখন কেউ ভেবে দেখেনি। ফলে যা হওয়ার তাই হয়েছিল। ২০১০ সালের শেষের দিকে বাজার পড়তে থাকে। এ সময়ে ব্যাংকসহ ফায়দা লুটে নেয় প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা। এমনকি নিয়ম ভঙ্গ করে অনেক ব্যাংক বিনিয়োগ করে। পরে বাংলাদেশ ব্যাংক সার্কুলার জারি করে ব্যাংকের নিয়ম বর্হিভূত বিনিয়োগ বন্ধ করে।

যারা আদতে চালাক, যারা জানতেন এই উত্থানের পতন আছে। এক টাকার জিনিস ১০০ টাকায় কিনলে তা টেকসই হয় না এই বোধবুদ্ধি যাদের ছিল তারা বেরিয়ে গেছেন এক বছরের মাথায়ই। আর সর্বশান্ত হয়েছিলেন অনভিজ্ঞরা। আত্মহত্যার মতো ঘটনাও ঘটলো শেয়ারবাজারে। সেই দাপুটে পাগলা ষাঁড়টা এখন উল্টো দিকে গুতো মেরে বাজারকে, বিনিয়োগকারীকে রক্তাক্ত করছে।

কয়েক বছরের লাখ লাখ বিনিয়োগকারী লোকসান গুনে বাজার থেকে বেরিয়ে গেছেন। অনেক ব্রোকারেজ হাউজ ব্যবসা চালাতে না পেরে শাখা বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়েছেন।

আমাদের বাজার নিয়ে নানা বিশেষজ্ঞ নানা কথা বলেন। মানুষকে প্রলুদ্ধ করেন। মানুষ বাজারে আসেন। প্রথম দু‘চারবার লাভ পেলেও পরের ধাপে লোকসান গুনতে থাকেন। কেন বারবার এমন হয়? প্রশ্নটা মাথার ভেতর ঘুরপাক খায় অনেকেরই। বিশ্বের অন্যান্য বাজারের সাথে তুলনা করলে আমাদের শেয়ারবাজারটা আসলে কী ধরনের? আমাদের বিনিয়োগকারীদের চিন্তা চেতনা কেমন?

মুলতঃ শেয়ারবাজার হচ্ছে বিনিয়োগের জায়গা। আপনি কোম্পানির শেয়ারের বিনিয়োগ করে লভ্যাংশ নেবেন এটাই স্বাভাবিক। শেয়ার ধরে রাখবেন বছরের পর বছর। কোম্পানীর উত্থান-পতনের ভাগ আপনিও নেবেন। কিন্তু আমাদের শেয়ারবাজারে ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারী নামে এক বিপুল অংশ রয়েছেন তারা কিন্তু দীর্ঘ মেয়াদি বিনিয়োগের বাসনায় শেয়ারবাজারে আসেন না। তারা আজ কিনবেন শেয়ার আর তিনদিন পরেই তা বিক্রির জন্য উন্মুখ হয়ে থাকবেন। এর এই যে তাড়াহুড়া, এরই সুযোগ নেয় সিন্ডিকেড অপ্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা। নিত্য এখানে গেম চলে। দু’চার টাকা শেয়ারের দাম বাড়িয়ে দিয়ে তার পর ধপাস করে সিন্ডিকেড দাম ফেলে দেয়। দাম যখন পড়তে থাকে তখন ক্ষুদ্র বা সাধারণ বিনিয়োগকারীদের মধ্যে প্যানিক সৃষ্টি হয়। তখন অনেকে পুঁজি বাঁচাতে লোকসানেই শেয়ার ছেড়ে দেন। যারা বুদ্ধিমান এই খেলায় তারা যান না। তারা শেয়ার ধরে রাখেন, বছর শেষে কোম্পানির লভ্যাংশ তুলে নেন।

বাংলাদেশের শেয়ারবাজার আসলে বিনিয়োগকারীদের বাজার নয়। এটা লেনদেনকারীদের বাজার। অর্থাৎ এখানে কেউ ইনভেস্ট করতে আসেন না। আসেন ট্রেডিং করতে। সেখানেই মূলত সমস্যা।

গত সপ্তাহে এক ব্রোকারেজ হাউজের মালিকের সঙ্গে কথা হয়। বেচারা মুখ কালো করে বসে আছেন। লেনদেনে নেই তেমন নেই। এক সময়ে প্রতিদিন তার ওখানে ২ থেকে ৪ কোটি টাকা লেনদেন হতো। এখন ৫০ লাখও হয় না। ২০০ লোকবলের ব্রোকারেজ হাউজে এখন ৫০ জন কাজ করছে। প্রশ্ন করলাম কেমন আছেন? উত্তর এলো- ভালো নাই। আমরা তো এখন ডেড হর্স।

জানতে চাইলাম শেয়ারবাজারের এই শনির দশার কারণ কি?

তিনি বললেন, প্রথমতঃ আস্থার সংকট। মানুষের মনে বাজারকে ঘিরে একটা আস্থাহীনতা সৃষ্টি হয়েছে। বিশেষ করে শেয়ারবাজারের অনিময় নিয়ে যে কমিটিগুলো হয় তার প্রতিবেদন আলোর মুখ দেখে না। বিচার হয়না।

দ্বিতীয়তঃ ব্যাংকে টাকা নেই। তারা আর বিনিয়োগ করতে পারছে না। তৃতীয়তঃ কিছু খারাপ শেয়ার বাজারে আইপিওর মাধ্যমে ঢুকে পড়েছে।

ভদ্রলোক টানা বলে যেতে লাগলেন। তার কথার সাথে একমত হতেই গত ১০ বছরে ধীরে-ধীরে বাজার সম্পর্কে আস্থাহীনতা তৈরি হয়েছে। ব্যাংকগুলোর আমানতে ভাটা, ১ লাখ ১২ হাজার কোটি টাকা খেলাপি ঋণ, ৫০ হাজার কোটি টাকা অবলোপন করা হয়েছে। ব্যাংকের কোমরতো ভেঙ্গে আছে! তারা স্বাভাবিক কার্যক্রম চালাতে হিমশিম খাচ্ছে।

সব মিলিয়ে বাজারে যে সংকট তৈরি হয়েছে সেটা দুর করতে সরকারের দৃষ্টি শেয়ারবাজারের দিকে ফেরাতে হবে। গত এক মাসে প্রায় ৩ লাখ বিনিয়োগকারী বাজার থেকে বেরিয়ে গেছেন। এমন চলতে থাকলে বাজার বিনিয়োগকারী শুন্য হয়ে পড়বে।

বাজারে তারল্য সরববাহ করতে আইসিবিকে আরো তৎপর হওয়া উচিত বলে মনে হয়। শেয়ারবাজারের অনিয়মগুলো দ্রুত দুর করার দাবিও সংশ্লিষ্টদের। বিনিয়োগবান্ধন এ সরকার বিষয়গুলো বিবেচনায় এনে শেয়ারবাজারের প্রতি মানুষের আস্থা ফেরাতে পারে।

টুটুল রহমান, সাংবাদিক

সারাবাংলা/এমএম

টুটুল রহমান শেয়ারবাজার শেয়ারে বিনিয়োগ

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর