আষাঢ়ের অতিবৃষ্টিতে কৃষকের মুখে হাসি
১৭ জুলাই ২০২১ ১১:২৯ | আপডেট: ১৭ জুলাই ২০২১ ১১:৩০
চাঁপাইনবাবগঞ্জ: অঝোর ধারায় বৃষ্টি ঝরার মাস আষাঢ়ের শেষ দিন বৃহস্পতিবার (১৫ জুলাই)। গাছের পাতায়, টিনের চালে কিংবা ছাদের রেলিং ছুঁয়ে খোলা আকাশের প্রান্তরজুড়ে ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি পড়ার ঋতু বর্ষা। জ্যৈষ্ঠের দাবদাহে তপ্ত দেহমন নিয়ে এ দিনটির জন্য প্রতীক্ষায় থাকে বাঙালির হৃদয়। আষাঢ়-শ্রাবণের ঋতু বর্ষার আগমনে সব রুক্ষতাকে বিদায় জানিয়ে নরম-কোমল হয়ে ওঠে বাংলার মাটি। নতুন প্রাণের আনন্দে অঙ্কুরিত হয় গাছপালা, ফসলের মাঠ। মাঠেমাঠে কৃষকের মুখে ফুটে ওঠে হাসি।
চলতি বছরে কৃষকের এই হাসি হয়েছে আরও চওড়া। একদিকে ধানের ন্যায্যমূল্য প্রাপ্তি, অন্যদিকে আষাঢ়জুড়ে অতিরিক্ত বৃষ্টিতে খুশি দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের জেলা চাঁপাইনবাবগঞ্জের কৃষকরা। অন্যান্য বছরের তুলনায় চলতি বছরে অধিক পরিমাণে বর্ষার অফুরন্ত পানিতে কৃষক ধান বুনতে বুনতে দেখছেন নতুন দিনের স্বপ্ন। বর্ষার অকৃত্রিম এই দান এ বছর চাঁপাইনবাবগঞ্জের কৃষকের সেচের খরচ বাঁচিয়ে দেবে বলে জানান কৃষকরা। অন্যদিকে গতবছরের তুলনায় শ্রমিকদের মজুরি বেড়েছে ৩০-৬০ টাকা।
জেলার ধানচাষী ও ধান রোপণ করা শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, অন্যান্য বছরের তুলনায় এবার আষাঢ়ের বৃষ্টি একটু আগেই শুরু হয়েছে। জ্যৈষ্ঠ মাসের শেষ সপ্তাহ থেকে পুরোদমে বৃষ্টি শুরু হয়েছে। আষাঢ় মাসের ৩১তম ও শেষ দিন বৃহস্পতিবার। পুরো আষাঢ় মাসজুড়ে হাতেগোনা কয়েকটা দিন পাওয়া যাবে, যেসব দিনে বৃষ্টি হয়নি। তাই অগ্রিম বৃষ্টি পেয়ে আমন চাষে মাঠে নেমে পড়েছে কৃষকরা। চাঁপাইনবাবগঞ্জে সব উপজেলায় এখন আমন চাষে ব্যস্ত সময় পার করছেন কৃষকরা।
কৃষকরা বলছেন, অন্যান্য বছরের চেয়ে চলতি মৌসুমে আমন চাষে বাড়তি আগ্রহ আছে তাদের মাঝে। গত কয়েক বছরের মধ্যে চলতি বছরে বোরো ধানে সবচেয়ে ভালো দাম পেয়েছেন। এমনকি ফলনও ভালো পেয়েছেন তারা। তাই এবার ধান চাষ করে কৃষকরা লাভের মুখ দেখেছেন। জেলায় চলতি মৌসুমে আষাঢ় মাসের প্রথম সপ্তাহ থেকে আমন চাষের প্রস্তুতি শুরু করেছেন এ অঞ্চলের কৃষকরা। আষাঢ়ের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকেই বীজতলা থেকে চারা তুলে আমন রোপণ শুরু করেছেন। জেলার বিভিন্ন মাঠে ঘুরে দেখা গেছে, এখন পুরোদমে আমন রোপণ চলছে।
সদর উপজেলার গোবরাতলা ইউনিয়নের চাঁপাই গোরস্থান-পাড়ার কৃষক ফারুক হোসেন (৩৫) বলেন, এবার বোরো ধান চাষ করে বাম্পার ফলন পেয়েছি। সেই সাথে দামও খুব ভালো ছিল। দুই বিঘা আমন চাষের সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছি। অন্যান্য বছরের তুলনায় এ বছর অনেক বেশি বৃষ্টি হয়েছে। অন্যান্য বছরে বৃষ্টি হলেও গভীর নলকূপ থেকে কিছু পানি নিতে হয়। তবে এ বছর তা করতে হয়নি। কারণ অনেক অতিরিক্ত বৃষ্টি হয়েছে। তাই আকাশের (বৃষ্টির) পানিতে আবাদ হয়ে গেল।
তিনি আরও বলেন, অতিরিক্ত বৃষ্টির কারণে আমন চাষে তেমন সেচ খরচ লাগে না। এছাড়া সার খরচও কম। বর্ষার পানির উপর নির্ভর করে উঁচু-নিচু সকল জমিতে আমন চাষাবাদ করা হয়ে থাকে। এ বছর অগ্রিম বৃষ্টি হওয়ায় দেরি না করে আমন চাষে নেমে পড়েছেন চাষীরা।
আরেক ধানচাষী সুমন আলী জানান, সদর উপজেলার খিন্নিতলা মাঠে দেড় বিঘা জমিতে ধান চাষাবাদ করেছি। এক ফোঁটা পানিও কিনতে হয়নি। এতে কৃষকদের খরচ কমেছে। তবে এবছর ধান রোপণ করা শ্রমিকদের মজুরি গতবছরের চেয়ে ৩০-৬০ টাকা বেড়েছে। গতবছর যেখানে দৈনিক একজন শ্রমিকের মজুরি ছিল ৩০০-৩২০ টাকা, সেখানে চলতি বছরে তা বেড়ে ৩৫০-৩৮০ টাকা হয়েছে। ধানের দাম বাড়ার কারনে শ্রমিকের মজুরি বেড়েছে বলে জানান তিনি।
শিবগঞ্জ উপজেলার নয়ালাভাঙ্গা ইউনিয়নের কৃষক সবুর আলী ১২ বিঘা জমি চাষাবাদ করেছেন নাচোল উপজেলার নেজামপুরে। তিনি বলেন, আমি যে মাঠে জমি চাষাবাদ করেছি, সেই মাঠে বৃহস্পতিবার (১৫ জুলাই) পর্যন্ত প্রায় বারো আনা (৭৫ শতাংশ) ধান লাগানো হয়ে গেছে। আশা করছি, ইদের আগে (২১ জুলাই ঈদুল আযহা) এই মাঠের প্রায় সবগুলো ধান চাষাবাদ হয়ে যাবে।
নাচোল উপজেলার ফতেপুর ইউনিয়নের সানপুর গ্রামের আব্দুর রাকিব রাজধানী ঢাকায় রাজমিস্ত্রীর কাজ করেন। রোজার মাসে বাসায় এসে আর কাজে যাননি তিনি। কারণ বাসায় এসে বোরো ধান কাটা ও আমন ধান লাগানোর জন্য থেকে গেছেন আব্দুর রাকিব। তিনি বলেন, রাজমিস্ত্রির কাজ করলেও ধান কাটা ও ধান লাগানোর সময় বাসায় চলে আসি। পেশা বদলিয়ে রাজমিস্ত্রি থেকে কিছুদিনের জন্য ধানকাটা ও রোপণের শ্রমিক বনে যায়।
তিনি আরও বলেন, চলতি বছরে খুব কাজের চাপ। ধান লাগানোর জন্য আগামী ৫ দিনের বুকিং হয়ে গেছে। সকালে কাজে গিয়ে দুপুর ২টা থেকে আড়াইটা পর্যন্ত কাজ করেই সাড়ে তিনশ টাকা আয় হয় বলে এই কাজেই আগ্রহী। আব্দুর রাকিব আরও জানান, তার মতো অনেকেই বিভিন্ন পেশা থেকে এসে ২০-২৫ দিনের জন্য ধান লাগা শ্রমিক হিসেবে কাজ করেন৷
চাঁপাইনবাবগঞ্জ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মুহাম্মদ নজরুল ইসলাম জানান, চলতি মৌসুমে আমন চাষাবাদ করার জন্য জ্যৈষ্ঠ মাসের শেষ সপ্তাহ থেকে বীজতলার কাজ শুরু করেছেন জেলার কৃষকেরা। আষাঢ়ের শুরুতেই পুরোদমে বৃষ্টিতে আমন রোপণ শুরু করেছেন তারা। আষাঢ়ের অতিরিক্ত বৃষ্টিতে কৃষকদের খরচ অনেক কমে যাবে বলেও জানান তিনি।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, চলতি বছরে চাঁপাইনবাবগঞ্জে ৫৩ হাজার ২০৫ হেক্টর জমিতে আমন ধানের চাষাবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। যা গতবছর চাষাবাদ হয়েছিল ৫৩ হাজার ২২০ হেক্টর জমি। বৃহস্পতিবার (১৫ জুলাই) পর্যন্ত জেলায় প্রায় ২০ হাজার ৪১০ হেক্টর জমিতে ধান রোপণ সম্পন্ন হয়েছে। এ বছর আমন মৌসুমে ২ লাখ ১১ হাজার ৮৬৬ মেট্রিক টন ধান ও ১ লাখ ৪১ হাজার ২৪৪ মেট্রিক টন চাল উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে কৃষি বিভাগ।
সারাবাংলা/এএম