বিজ্ঞাপন

আমেরিকা আসলে কী চায়

January 13, 2024 | 2:31 pm

হাসান নাসির

সমুদ্রের ঢেউ গুণে টাকা কামানোর গল্পটা অনেকেরই জানা। দুর্নীতিবাজ এক রাজ-কর্মচারীকে সাজা দিলেন রাজা। বললেন, রাজদরবারে তোমার আর কোনো কাজ নেই। যাও, তুমি সাগর পাড়ে বসে ঢেউ গুণতে থাকো। টাকা কামাতে সিদ্ধহস্ত অসাধু লোককে কি সহজে দমিয়ে রাখা যায়? সাগর পাড় থেকে সে আঙুল উঁচিয়ে নৌকার মাঝিদের শাসিয়ে বলে, রাজা আমাকে ঢেউ গুণতে বসিয়েছেন। নৌকার জন্য ঢেউ ভেঙ্গে যাচ্ছে। তাই গুণতে অসুবিধা। এই অপরাধের জন্য তোমাদের জরিমানা দিতে হবে।

বিজ্ঞাপন

বাংলাদেশে মানবাধিকার ও গণতন্ত্র নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এত যে চাপাচাপি, তার নেপথ্যে কি শুধুই সুষ্ঠু নির্বাচন? যারা বলেন, অগণতান্ত্রিক মনোভাবের জন্যই বিদেশীরা নাক গলানোর সুযোগ পাচ্ছে তারা কি প্রকৃত কারণটি ধরতে পারছেন না? সেই আলোচগণ যে এতটা অবুঝ, তা মানতে চাই না।

পৃথিবীর অনেক দেশে নির্বাচনই হয় না, মানুষের কথা বলার কোনো স্বাধীনতা নেই। তাদের সঙ্গে তো আমেরিকার সম্পর্কের কোনো টানাপড়েন নেই। তাহলে বাংলাদেশে সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন না হলে যুক্তরাষ্ট্রের সমস্যা কী? প্রকৃত সত্যটি হলো, বাংলাদেশে গণতন্ত্রের সমস্যা না থাকলে যুক্তরাষ্ট্র তখন অন্য কোনো অজুহাতে ঠিকই চাপ সৃষ্টি করত। এর কারণ এ অঞ্চলে তাদের কিছু স্বার্থ রয়েছে, যা উদ্ধারে হয়তো এ সরকারের ওপর ভরসা রাখা যাচ্ছে না।

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্ট বলেছে, এ নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক ছিল না এবং আমরা দুঃখিত যে, সবদল এতে অংশগ্রহণ করেনি। বিবৃতিতে সামনের দিনগুলোতে একটি মুক্ত ইন্দো-প্যাসিফিকের জন্য অভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গীকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ইচ্ছের বিষয়টিও বেরিয়ে এসেছে। এই বিবৃতির শেষদিকে এসেছে আসল চাওয়া।

বিজ্ঞাপন

বাংলাদেশ তার ইন্দো-প্যাসিফিক পলিসি এরইমধ্যে ঘোষণা করেছে, তবে তা নিজদেশের সংবিধান ও পররাষ্ট্রনীতির আলোকে। অর্থাৎ সকলের সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারও সঙ্গে বৈরিতা নয়। ভৌগোলিক অবস্থানগত কারণে ইন্দো-প্যাসিফিক থেকে দূরে থাকা হয়তো সম্ভব নয়, তবে এক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র ও বাংলাদেশের চাওয়া তো ‘অভিন্ন’ নয়। একটি দেশের পক্ষে অবস্থান নিয়ে আরেকটি দেশকে ঠেকানো বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি নয়।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের শেখ হাসিনা সরকারের টানাপড়েন শুরু এই নির্বাচন নিয়ে নয়। কেউ যদি ভাবেন, বাংলাদেশে মানবাধিকার, দুর্বল গণতন্ত্র এবং সুষ্ঠু নির্বাচন ইস্যুতেই মূল বিরোধ, তিনি হয়তো আসল কারণটা বুঝছেন না বা বুঝতে চাইছেন না। আবার এমনও হতে পারে, তারা জেনে বুঝেই এমন বক্তব্য রাখছেন। যেহেতু সমালোচকদের জ্ঞান কম নয়, সেহেতু ধরেই নেওয়া যায় যে-তাঁরা স্বজ্ঞানেই এই অঞ্চলে মার্কিন ইচ্ছা বাস্তবায়নের পক্ষে আছেন।

ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কিছু চাওয়া রয়েছে, যার পেছনে আঞ্চলিক পরাশক্তি চীনকে ঠেকানো। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কিছু কৌশল যে রয়েছে ,তা বুঝতে একটু পেছনে ফিরে যাওয়া যাক। মিয়ানমার থেকে বিতাড়িত হয়ে বাংলাদেশে আসা রোহিঙ্গা ইস্যু ব্যবহার করে আমেরিকার একটি ছক যে রয়েছে, তা এখন পরিস্কার। স্মরণ করা যেতে পারে, ২০১৯ সালের জুলাই মাসে স্টেট ডিপার্টমেন্টের এক শুনানীতে মার্কিন কংগ্রেসম্যান ব্রাডলি শেরম্যান একটি প্রস্তাব করেছিলেন মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশকে বাংলাদেশের সঙ্গে একীভূত করতে। তার এই প্রস্তাবে এদেশেরই অনেকে উচ্ছ্বসিত হলেও এর পেছনে ছিল দারুন একটি কূটনৈতিক চাল। বাংলাদেশ সরকার এতে সায় দেয়নি বরং প্রস্তাবটি নাকচ করেছে।

বিজ্ঞাপন

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ওই বছরের ৮ জুলাই অনুষ্ঠিত এক সংবাদ সম্মেলনে স্পষ্টভাবে জানিয়ে দেন, এটি একটি গর্হিত কাজ। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসম্যানের এই প্রস্তাবের জবাবে তিনি বলেন, তাদের উচিত রোহিঙ্গারা যাতে নিরাপদে নিজদেশে ফিরে যেতে পারে সে প্রচেষ্টা চালানো।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমার সীমানা ১ লাখ ৪৭ হাজার বর্গ কিলোমিটার, আমরা এতেই খুশি। অন্যের কোনো জমি নেওয়া, অন্য কোনো প্রদেশকে আমাদের সঙ্গে যুক্ত করাকে আমি সম্পূর্ণভাবে অস্বীকার করি। এ ধরনের কথা বলা অত্যন্ত গর্হিত এবং অন্যায় কাজ বলে আমি মনে করি। এই প্রস্তাব কখনোই গ্রহণযোগ্য নয়। সেদিন সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, মানবিক কারণেই আমরা রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়েছি। আশ্রয় দেওয়া মানে এই নয় যে, আমরা তাদের রাষ্ট্রের একটি অংশ নিয়ে চলে আসব। এই মানসিকতা আমাদের নেই। এটা আমরা চাই না। তিনি পরিস্কারভাবে বলেন, বাংলাদেশ এমন কিছুই করবে না, যা আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা নষ্ট করে বা অশান্তির সৃষ্টি করে। রাখাইন প্রদেশে প্রতিনিয়ত যে সমস্যা সৃষ্টি হচ্ছে, তাতে আমরা জেনে বুঝে ওই ধরনের একটা গোলমেলে জিনিসের সঙ্গে নিজেদের যুক্ত করব কেন? আমরা তা কখনোই করব না।

সেদিন শেখ হাসিনা আরও বলেছিলেন, প্রতিটি দেশ যার যার সার্বভৌমত্ব নিয়ে থাকবে। মিয়ানমারও তার সার্বভৌমত্ব নিয়ে থাকবে। আর এটাও চাই যে, মিয়ানমার যেন তার নাগরিকদের ফেরত নিয়ে যায়। মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্টের প্রস্তাব প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, তাদের উচিত সেখানে মানবাধিকার লংঘনের বিষয়টি দেখা। এভাবে একটি দেশের ভেতরে গোলমাল পাকানো কোনোভাবেই ঠিক নয়। যেখানে তারা হাত দিয়েছে, সেখানেই তো আগুন জ্বলছে, কোথাও তো শান্তি আসেনি বরং জঙ্গীবাদ সৃষ্টি হয়েছে, অশান্তির সৃষ্টি হয়েছে।

মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্টের প্রস্তাবের প্রতিক্রিয়ায় যদি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী এ ভাষায় বলে থাকেন, তাহলে তাকে অপছন্দ হওয়ারই কথা। কিন্তু আমেরিকা তো হাল ছেড়ে দেওয়ার মতো দেশ নয়। কারণ এ অঞ্চলে তাদের কিছু পরিকল্পনা ও এজেন্ডা রয়েছে। নির্বাচন সামনে রেখে এতো যে চাপ প্রয়োগ, তার নেপথ্যে থাকতে পারে কিছু প্রতিশ্রুতি আদায়, নয়তো এই সরকার হটিয়ে অন্য কোনো সরকারের মাধ্যমে ইচ্ছা পূরণের ছক।

বিজ্ঞাপন

যুক্তরাষ্ট্রকে বাংলাদেশের যতটা দরকার, তার চেয়েও বাংলাদেশকে অনেক বেশি দরকার যুক্তরাষ্ট্রের। কারণ, বাংলাদেশ এমন কোনো দেশ নয় যে, প্রশান্ত মহাসাগরের ওপারে বিমান বা নৌঘাঁটি করার সক্ষমতা রাখে। কিন্তু আমেরিকার এদিকে আসার পরিকল্পনা সর্বজনবিদিত। পরাশক্তি এ দেশটি কতটা মরিয়া তার প্রমাণ তাদের প্রস্তুত করা বার্মা অ্যাক্ট। ইন্টারনেট সার্চ দিলে বার্মা অ্যাক্ট নিয়ে অনেক নিবন্ধ পাওয়া যাচ্ছে, যাতে দেখা যায়-এই অ্যাক্টের আলোকে কার্যসিদ্ধি করতে বাংলাদেশকে কতটা প্রয়োজন।

মিয়ানমারের বিভিন্ন প্রদেশে চলমান বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগ্রামকে অস্ত্র সহায়তা দিতে হলে বাংলাদেশ ও থাইল্যান্ড সরকারকে কাছে পাওয়া খুবই দরকার। মিয়ানমার টুকরো টুকরো হয়ে একাধিক স্বাধীন দেশে পরিণত হলে কোনো না কোনো স্টেটের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের এই অঞ্চলে ঢুকে পড়া সহজ হবে। এতে উদ্বিগ্ন চীন, ভারত দু’দেশই। আর সে কারণে চরম বৈরি প্রতিপক্ষ হওয়া সত্বেও চীন-ভারত এক রয়েছে এই একটি ইস্যুতে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এত চাপাচাপির মধ্যেও দেশ দুটি বলে আসছিল, বাংলাদেশের নির্বাচন তার অভ্যন্তরীণ বিষয়। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী আওয়ামী লীগকে সবার আগে অভিনন্দন জানিয়েছে চীন ও ভারত।

বাংলাদেশের কক্সবাজারে আশ্রিত প্রায় ১২ লাখ রোহিঙ্গা একটি বড় সমস্যা। বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে এ নিয়ে জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক পরিসরে অনেক দেন-দরবার সত্বেও এই জনগোষ্ঠীকে নিজদেশে প্রত্যাবাসনের সুযোগ এখনও সৃষ্টি হয়নি। রোহিঙ্গা ইস্যুতে বিভিন্ন ফোরামে আমেরিকাসহ পশ্চিমা বিশ্বকে উচ্চকন্ঠ দেখা গিয়েছিল। তখন একটি বিশ্বাস প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছিল যে, চীন-রাশিয়া এই প্রত্যাবাসন চায় না। কিন্তু এখন পরিস্কার যে, যুক্তরাষ্ট্রই আন্তরিক নয়। কারণ, চীনের মধ্যস্থতায় বেশ কয়েকদফায় প্রত্যাবাসনের সম্ভাবনা সৃষ্টি হলেও নানা কৌশলে বাধ সেধেছে আমেরিকাই। রাখাইন প্রদেশে পরিবেশ সৃষ্টি হয়নি বা সেখানে নিরাপত্তা ব্যবস্থা হয়নি- এমনসব অজুহাতে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়াকে ভেস্তে দেওয়ার চেষ্টা দেখা গেছে।

বিদায়ী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. আবদুল মোমেন এক সাক্ষাতকারে সাংবাদিকদের স্পষ্ট করেই বলেছিলেন, আমেরিকা বলেছে বাংলাদেশের মধ্যেই রোহিঙ্গাদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে, এমনকি নাগরিকত্বও দিতে। শুধু তাই নয়, রোহিঙ্গাদের জন্য আর্থিক সাহায্য দেওয়ার ক্ষেত্রেও যুক্তরাষ্ট্র মোটামুটি উদারহস্ত বলেই প্রতীয়মান। আমেরিকা থেকে সরকারের উচ্চপদস্থ যিনিই আসুন না কেন, তিনি ছুটে যান কক্সবাজারের উখিয়ার রোহিঙ্গা পল্লীতে। সেখানে গিয়েও তারা প্রত্যাবাসনের ব্যাপারে কোনো ধরনের ভূমিকার কথা না বলে তাদের সহযোগিতার আশ্বাসই প্রদান করে থাকেন।

রোহিঙ্গারা যখন বাঁধভাঙ্গা স্রোতের মতো আসছিল তখন এদেশের অনেকের মধ্যেই আবেগের সঞ্চার হয়। অনেকেই ছুটে গেছেন প্রয়োজনীয় ত্রাণ সামগ্রি নিয়ে। কেউ কেউ হুংকার দিয়েছিল মিয়ানমার অভিমুখে লংমার্চ করার। এখনও অনেকের অভিমত, এই রোহিঙ্গাদের সশস্ত্র প্রশিক্ষণ দিয়ে মিয়ানমারে ঠেলে দেওয়া উচিত। কিন্তু কে না জানে যে, ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের দানব সৃষ্টি করলে তার দ্বারাই আক্রান্ত হওয়ার সমূহ শঙ্কা থেকে যায়। আইএস, তালেবান, হামাস যারা সৃষ্টি করেছিল পরে তারাই হয়েছে আক্রমণের টার্গেট। এই রোহিঙ্গাদের যদি অস্ত্র দিয়ে প্রশিক্ষিত করা হয় তাহলে এরাই যে একদিন কক্সবাজার নিয়ে স্বাধীন ভূখ- প্রতিষ্ঠার দাবি তুলবে না তার নিশ্চয়তা কোথায়? সেটি হলে হয়তো কক্সবাজার অঞ্চল হতে পারে ‘বাংলাদেশের গাজা।’

বাংলাদেশ সরকারের বিচক্ষণ কূটনীতি এখানেই যে, মিয়ানমার তার একটি প্রদেশ থেকে লাখ লাখ রোহিঙ্গা বিতাড়িত করার পরও দেশটির সঙ্গে সম্পর্ক নষ্ট করেনি। বরং সীমান্ত বাণিজ্য, দ্বিপাক্ষিক বৈঠকসহ প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে যেমন সুসম্পর্ক রাখতে হয় সেটিই বজায় রেখেছে।

লেখক: সাংবাদিক

সারাবাংলা/এসবিডিই

Tags: , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন