মায়া দ্য লস্ট মাদার: অস্ফুট বেদনার চিত্রপট
২ নভেম্বর ২০২০ ২০:০২
চেনা সময় ও বহমান জীবনের বারতায় শেকড়ের অনুভূতিটুকু যেন এক পশলা বৃষ্টির মতোই আমাদের মনটাকে ভিজিয়ে দিয়ে যায়। এ ইট কাঠের নগরীতে যাপিত শত ব্যস্ততার ফাঁকে দুঃখী মানুষের অন্তরের চাপাকান্না লোকসম্মুখে নষ্ট সময়ের কথা বলতেও পারে না। কেননা যান্ত্রিক মানব জীবনে শত সুখানুভূতির হিল্লোলে লুকায়িত চাপা কষ্ট নিজেকেই সামাল দিতে হয়। আর এমনই একাকীত্ব ও যন্ত্রণামুখর সময় ছাপিয়ে যে ভালোবাসার বন্ধনটুকু গড়ে ওঠে তাতেই জন্ম নেয় মায়া।
আমাদের জাতীয় জীবনেও এমন মায়া রয়েছে। ১৯৭১ সালে বিশ্ব মানচিত্রে স্বাধীন দেশ হিসেবে আত্মপরিচয় জানান দেওয়ার উত্তাল সময়টিতে যে সীমাহীন সংগ্রাম ও নির্যাতন সহ্য করে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটি জন্ম নিয়েছে; সে সময়টা আমাদের জন্য রেখে গেছে মায়ার এক অভূতপূর্ব বন্ধন, তাই তো দৃশ্যকাব্যে সেলুলয়েডের ফিতায় অনেক গুণী চলচ্চিত্র পরিচালকই সে সময়ের মায়াটুকু তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। তবে এক্ষেত্রে শুধু বীরাঙ্গনাদের কষ্টমাখা অধ্যায়টুকু নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণ করার প্রথম উদ্যোগটি নিয়েছেন ড. মাসুদ পথিক। এজন্য তিনি অবশ্যই সাধুবাদ পাওয়ার যোগ্যতা রাখেন। কেননা অধুনা সময়ে যেভাবে ধর্ষণের খবর পত্রিকার শিরোনামে উঠে আসছে, তা আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকেই ভূলুণ্ঠিত করছে। যুদ্ধের সময় যে ধর্ষণকে যুদ্ধাস্ত্র হিসেবে বিবেচনা করা হয়, সে ধর্ষণ সামাজিক অবক্ষয়ের ফসল হিসেবে আমাদের স্বাধীন দেশেও ছড়িয়ে পড়েছে। কারণ অমানুষেরা নারীর প্রতি মায়া অনুভব করে না, জোর করে ভালোবাসা পেতে চাওয়ার এ ঘৃণ্য মানসিকতা কাপুরুষরা আজও লালন করে থাকে। সেক্ষেত্রে সামাজিক বেশটুকুও কোনো নির্দিষ্ট ঘরানার নয়। এক্ষেত্রে বয়সের গ-িতে শুধু যুবকের ফ্রেম ধর্ষকের আয়নায় উঠে আসছে না, মাঝবয়সী এমন কি ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরাও বাদ যাচ্ছেন না মানুষরূপী ধর্ষকের বেশ থেকে।
আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধেও এমন জঘন্য চিত্র দেখা গেছে। সে সময়ে বীরাঙ্গনা নারীদের ওপর পাক হায়েনাদের অমানবিক নির্যাতনের ফলে থেকে যাওয়া অমীমাংসিত বেদনার ছাপ আজও এক নিদারুণ কষ্টমাখা অধ্যায় হয়ে থেকে গেছে। এ বেদনার বহিঃপ্রকাশ তার ক্রমধারাবাহিকতায় নির্যাতিত মানুষের মানসপটে যে দীপ্তমান জ¦লন্ত বহ্নিশিখার রূপ, অন্যদিকে তা বেদনার হাহাকারেও এক অনুল্লেখ্য অধ্যায়। এ ঘটনার সুলুকসন্ধান যে অত্যন্ত কষ্টসাধ্য কাজ তা ‘মায়া দ্য লস্ট মাদার’ ছবিতে ফুটে উঠেছে।
প্রতিবেশী দেশ ভারতে বসবাসরত ’৭১ এর যুদ্ধশিশু ড. মানবী ঘোষ তার জন্মকালীন সময়ের বর্বরতার কথা জানার জন্য মায়ার টানে নিজের মাকে খুঁজতে বাংলাদেশে আসেন। এখানে এসে একটি এনজিওর মাধ্যমে তিনি মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে বর্বরতার স্বীকার বীরাঙ্গনাদের মাঝে নিজের মাকে খুঁজে পেতে চেষ্টা করেন। অনেক চেষ্টার পর তিনি তার মা-কে খুঁজে পেতে সক্ষম হলেও এ জন্য তাকে যে নিদারুণ পরিশ্রম করতে হয়, সেটির দৃশ্যায়ন পর্দায় সাবলীলভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।
নান্দনিক ভাবনায় এরকম জটিল একটা বিষয়কে ঘটনাপ্রবাহের প্রেক্ষিতে ফুটিয়ে তুলতে ক্যামেরার পেছনে পরিচালক তার মুনশিয়ানা দেখাতে সক্ষম হয়েছেন। বিশেষ করে গ্রামের স্থানীয় রাজনৈতিক দুর্বৃত্তপনা আর নানাবিধ লৌকিক ঝুটঝামেলা আর অধুনা শহরকেন্দ্রিক ভাবনায় একজন সিঙ্গেল মাদারের গ্রাম্য পরিবেশে পুরুষের কামনার চোখে বসবাস এসব যন্ত্রণার চিত্রায়ণ কাব্যিক নাটকীয়তার প্রেক্ষাপটেই চলচ্চিত্রটিতে উঠে এসেছে। আর ছবিটার চিত্রনাট্যই তো নির্মিত হয়েছে শিল্পী শাহাবুদ্দিন আহমেদের চিত্রকর্ম ‘ওমেন’ এবং কবি কামাল চৌধুরীর ‘যুদ্ধশিশু’ কবিতা অবলম্বনে। সেদিক থেকে বিশ্লেষণ করলে বলা যায় ‘নেকাব্বরের মহাপ্রয়াণ’ চলচ্চিত্রের পর পরিচালক তার নির্মাণশৈলী দিয়ে দর্শকমনে আবারও মুগ্ধতার ছাপ রাখতে সক্ষমতার পরিচয় দিয়েছেন।
ছবিটিতে মুমতাজ সরকার, প্রাণ রায়, জ্যোতিকা জ্যোতিসহ যারা অভিনয় করেছেন তারা প্রত্যেকেই নিজ নিজ ভূমিকায় দুর্দান্ত ছিলেন। সরকারী অনুদানের মাধ্যমে নির্মিত এ ছবিটি দর্শককে চোখের পলকে আমাদের গ্রামীণ জীবনের শেকড়ের স্বাদ দিতে সক্ষম, আর যে মায়ার কথা শুরুতেই বলেছিলাম, সে মায়াময় অনুভূতিকে হৃদয়ের গভীর থেকেই দর্শক ছবিটি দেখার সময় উপলব্ধি করতে পারবেন। ঠিক এ যেন এক অদ্ভুত মায়া, যে মায়া চেনা সময়ের ভীড়ে অনুচ্চারিত জীবনের কথা বলে যায়।