রাজ্জাক ভাই শুধু আমার
২৩ জানুয়ারি ২০২৩ ২০:২৬
রাজ্জাক ছাড়া বাংলা চলচ্চিত্রে নায়িকা নূতনের পুনর্জন্ম হতো না। আমাদের রাজ্জাক, বাংলাদেশের রাজ্জাক, আমার রাজ্জাক। নায়ক রাজ রাজ্জাক।
আমি তাকে রাজ্জাক ভাই বলেই ডাকি। তাকে নিয়ে বলা বা স্মৃতিচারণ করা আমার জন্য অনেক কঠিন। কারন সে আমার কাছে অভিভাবক । রাজ্জাক ভাই না থাকলে চলচ্চিত্র শিল্পী হিসেবে নিজের পরিপূর্ণতা আমি পেতাম না। নিজেকে মূল্যায়িত করা আমার জন্য অসম্ভব ছিলো। মাঝে-মাঝে একটু স্বার্থপরতা নিয়ে বলি, রাজ্জাক ভাই, শুধু আমার। যদিও রাজ্জাক ভাই সবার, সমগ্র দেশের এবং বাংলা চলচ্চিত্রের চলচ্চিত্রের জন্য অভিভাবক । রাজ্জাক ভাই বাংলা চলচ্চিত্রের জন্য আল্লাহর দেওয়া আশীর্বাদ।
অভিভাবকহীন চলচ্চিত্রের আজ যে মুমূর্ষু অবস্থা, তা একই ভাবে বিরাজমান আমার মনে।রাজ্জাক ভাই আমার শিক্ষক, আমার নায়ক, আমার পথপ্রদর্শক। আমার জীবনের প্রথম চলচ্চিত্র নতুন প্রভাতের ১৯৬৯ সালে আসার সময় রাজ্জাক ভাই আমার সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন।
স্বপ্নের নায়ক কে সামনা-সামনি দেখতে পাবো ভেবে যতটা না উত্তেজিত ছিলাম তা দেখার পরে নিমিষেই বিলীন। তার ব্যাবহার দ্বারা। অনেক ভেবে, নিজেকে স্থির করেছি যে সে রাজ্জাক ভাই আমি তার সামনে বসা। সে নায়ক বা আমার স্বপ্ন না সে সাধারণ একজন। তার ব্যাবহারে মনে হয়েছে আমি তার কতো চেনা।
সেদিন ১৯৬৯ থেকে মৃত্যু অবদি রাজ্জাক ভাইয়ের ছায়াতলেই ছিলাম। আছি থাকবো। আমার কাছে, আমার মনে সে জীবন্ত। যদিও তার মৃত্যুর দিন আমি তাকে দেখতে যাই নি। কারণ তাকে দেখতে যাওয়ার মতো এত সাহস আমার ছিলো না বা মানসিক দিক থেকে আমি এতটা সাহসী না। তার ওই নিস্তব্ধ মুখ হাস্যোজ্জ্বল “রাজ্জাক” ভাইয়ের গম্ভীর মুখ আমি দেখতে পারবো না। তা আমি কখনোই দেখি নি।
তার জন্মদিন আমি মনে রাখি। তবে তার চলে যাওয়া দিন আমি মনে রাখি না। মনে এলেও মনে করি না। আমার কাছে আমার নায়ক আমার আপনজন আমার শিক্ষক (মহানায়ক রাজ রাজ্জাক) সারাজীবন জীবন্ত।
প্রতিদিন প্রতিমুহূর্তেই “রাজ্জাক “ভাই কে স্মরণ করি বিশেষ করে পূরনো স্মৃতিচারণ করলে। আমার জীবনকে ৪টি ভাগে ভাগ করলে তার ২ ভাগ রাজ্জাক ভাই কে ঘিরে। (যদিও আমার জীবনে সোহেল রানা, খসরু, সুমিতা দেবি, মেহমুদ, জসিম ভাইয়ের অবদান আছে)…তবে চলচ্চিত্রে পুনঃজন্মে রাজ্জাক ভাই একমাত্র অভিভাবক ।
একই সাথে পথ চলতে চলতে একটা সময় পারিবারিক অংশ হয়েছি। আমার পরিবার তার পরিবার আলাদা বলতে কিছু ছিলো না। বাপ্পা-বাপ্পি-সম্রাট-ময়না তার সন্তানরা ছোট ছিলেন আমার আদরের। মন খারাপ বা কিছু হলেই তার বাসায়। বাংলাদেশ চলচ্চিত্রে এখন সে দিন নেই। সবচেয়ে বেশী আয়োজন হতো আমার বাসায় আর তার বাসায়। বাংলাদেশ ভারত যত শিল্পী আছে। আর তার বাসায় গেলেই লক্ষী ভাবিকে রাজ্জাক ভাই বলতেন, লক্ষী তোমার নূতন এসেছে।
রাজ্জাক ভাই কে আমার শিক্ষক কেন বললাম বা আমার জীবনের চলচ্চিত্রের পথপ্রদর্শক বলার কারণ হচ্ছে, রতনে যেমন রতন চিনে, তেমনি নায়করাজ রাজ্জাক নূতনকে চিনেছিলেন। এমন শিরোনামে তখন অনেক সংবাদ হয়েছিলো।
শাবানা, ববিতা, কবরী, সুচরিতা, অঞ্জনা, সুজাতা, রোজি, অলিভিয়া, সুমিতা, সুনেত্রা ,রোজিনাদের দাপট ও তীব্র প্রতিযোগিতার মুখে বেশিরভাগ পরিচালকই আমাকে শক্তিশালী চরিত্র দেয়নি। অনেক ছবিতেই আমাকে সেকেন্ড লিড করতে হয়েছে। আবার অনেকে বলেছে ভালো অভিনেত্রীর কোন চরিত্রের ব্যাপ্তি লাগে না। এই চিন্তা থেকে আমার অসংখ্য চলচ্চিত্র সেকেন্ড লিড করা। তবে রাজ্জাক ভাই তার পরিচালিত ও প্রযোজিত বেশিরভাগ ছবিতেই আমাকে নিয়েছেন প্রধান নায়িকা হিসেবে। ‘বৈকুন্ঠের উইল’ অবলম্বনে যখন রাজ্জাক ‘সৎ ভাই’ ছবিতে তার বিপরীতে আমাকে কাস্ট করেন তখন অনেকে বলেছিলেন এটাতো শাবানার চরিত্র, শাবানা ছাড়া আর কাউকে মানাবে না। কিন্তু রাজ্জাক ভাই নূতনে ভরসা রেখেছিলেন। এবং তিনি আমাকে নিয়েই তা সুপারহিট দিয়েছিলেন।
‘কাবিন’ ছবিটি রাজ্জাক-নূতন জুটির আরেকটি উল্লেখযোগ্য ছবি। বাংলাদেশে কমেডি কখনো তেমন ভাল হয়না। যে দু’চারটা ভাল কমেডি হয়েছে তার মাঝে ‘মি. মাওলা’ অগ্রগণ্য। এই ছবিতেও রাজ্জাক ভাই এর সাথে আমার ছিল দাপুটে অভিনয়।
প্রেমের ছবি ‘মালামতি’-তে রাজ্জাক ভাই এর সাথে নূতনের দারুন অভিনয় স্মৃতি এখনো চোখে লেগে আছে। মানুষের তা আমি নিঃসন্দেহে বলতে পারি। ‘বদনাম’ ছবিটিও আমাদের জুটির উল্লেখযোগ্য কাজ। রাজ্জাক ভাই সর্বশেষ আমাকে নিয়েছেন ‘কোটি টাকার ফকির’ ছবিতে।
আমি তাকে সুপারস্টার বললে লজ্জা পেতেন। বলতেন অভিনয়টা কি হচ্ছে আমার? ভয়ে থাকতাম সে যদি বলে অভিনয় হচ্ছে তাহলে আমরা কী বলবো? রাজ্জাক ভাই এর কাছ থেকেই নিজেকে ছোট ভাবা, বিনয়ী হওয়া, অহংকারহীন হওয়া শেখা। কতটা রপ্ত করতে পেরেছি তা জানিনা।
মাঝে মাঝে তার উপর অভিমান হতো। এখনো অভিমান হয় কেন এত্তো তাড়াতাড়ি চলে গেলেন। প্রকৃতির বা আল্লার হুকুমের সাথে তো আর অভিমান চলে না। তবে রাজ্জাক ভাই এই বিশেষ দিনটি শেষ দুইবার নিজে নিজেই পালন করেছি একা থাকি অনেক কিছু ভাবি। দোয়া করি আর বলি আল্লাহ তাকে বেহেস্ত দান করুন।
রাজ্জাক ভাই ছিলেন আছেন থাকবেন। আমাদের মনে আমার মনে “মহানায়ক রাজ রাজ্জাক” এক জীবন্ত কিংবদন্তি।
ভালোবাসি আপনাকে। আপনি থাকলে হয়তো মানসিক ভাবে এত্তোটা ভেংঙে পড়তাম না। আপনি নাই আমাদের ইতিহাসও নাই।
ভালো থাকুন।
আপনার নূতন। (যার নাম প্রথম আপনার কানে রত্না বেজেছিলো)।
লেখক: চিত্রনায়িকা
সারাবাংলা/এজেডএস