বাংলা সিনেমায় রবীন্দ্রনাথের গল্পে কিছু অমর সৃষ্টি
৮ মে ২০২৫ ১৬:২৫
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাংলা সাহিত্যের এক অবিসংবাদিত পুরুষ। যার রচনাসম্ভার কেবল পাঠকের হৃদয়কেই স্পর্শ করেনি, বরং চলচ্চিত্র নির্মাতাদের কল্পনাকেও দিয়েছে নতুন দিগন্ত। গল্প, উপন্যাস, নাটক, কবিতা—তার প্রতিটি সাহিত্যকর্মে লুকিয়ে আছে চিরন্তন মানবিকতা, সম্পর্কের জটিলতা, সমাজ-সংস্কৃতির বিশ্লেষণ এবং আত্মোপলব্ধির সূক্ষ্ম ধারা। তাই চলচ্চিত্রকারেরা বারবার ফিরে গেছেন তার সাহিত্যে, খুঁজেছেন চলচ্চিত্রের উপযোগী কাহিনি ও চরিত্র।
রবীন্দ্রনাথের লেখা গল্প, উপন্যাস কিংবা নাটককে ভিত্তি করে প্রচুর সিনেমা নির্মিত হয়েছে যেগুলো আজও দর্শকের মনে বিশেষ স্থান দখল করে আছে। তেমনি কয়েকটি সিনেমার কথা এ লেখায় তুলে ধরা হল।
চারুলতা (১৯৬৪)
পরিচালক: সত্যজিৎ রায়
মূল: ‘নষ্টনীড়’ (গল্প)
সত্যজিৎ রায়ের চারুলতা শুধু রবীন্দ্রনাথের গল্পের অনুবাদ নয়, এটি এক শিল্পীর নিজের ব্যাখ্যায় রবীন্দ্রনাথের পাঠ। ছবিটির কেন্দ্রীয় চরিত্র চারুলতা—এক শিক্ষিত, সংবেদনশীল, কিন্তু একাকীত্বে জর্জর নারী, যিনি স্বামীর ভালোবাসার অভাবে ভেতরে ভেতরে ক্ষয়ে যেতে থাকেন। তার জীবনে আসা অমল—এক তরুণ, উচ্ছ্বল কবিস্বভাবের মানুষ—চারুলতার নিঃসঙ্গ মনের জানালায় আলো ফেলে যায়।
এই ছবি বাংলা সিনেমার ইতিহাসে এক অনন্য নজির, যেখানে ক্যামেরার ভাষা, আবহসঙ্গীত ও অভিনয়ের সংমিশ্রণে গল্পটি এক নতুন জীবন পায়। সুচিত্রা সেন, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় ও শৈলেন মুখোপাধ্যায়ের অভিনয় চরিত্রগুলিকে জীবন্ত করে তুলেছে।
ঘরে বাইরে (১৯৮৪)
পরিচালক: সত্যজিৎ রায়
মূল: ‘ঘরে বাইরে’ (উপন্যাস)
রবীন্দ্রনাথের ‘ঘরে বাইরে’ উপন্যাসটি তার রাজনৈতিক ও দার্শনিক ভাবনার একটি প্রকাশ। স্বদেশি আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে রচিত উপন্যাসটি একদিকে জাতীয়তাবাদের স্বর, অন্যদিকে নারী-স্বাধীনতা ও সম্পর্কের জটিল মনস্তত্ত্ব নিয়ে গড়া। সত্যজিৎ রায়ের হাতে উপন্যাসটি রূপ পেয়েছে অত্যন্ত সূক্ষ্ম এবং শক্তিশালী এক চিত্রনাট্যে।
স্বাতী, নিখিলেশ এবং সান্যালের ত্রিকোণ সম্পর্ক, তাদের আদর্শিক দ্বন্দ্ব এবং মনস্তাত্ত্বিক সংঘাত ছবিটিকে দিয়েছে এক দর্শনচিন্তায় ভরপুর রূপ। স্বাতীর আত্মজিজ্ঞাসা ও দ্বিধা আজও সমানভাবে প্রাসঙ্গিক।
চোখের বালি (২০০৩)
পরিচালক: ঋতুপর্ণ ঘোষ
মূল: ‘চোখের বালি’ (উপন্যাস)
রবীন্দ্রনাথের নারীবিষয়ক দৃষ্টিভঙ্গির একটি শক্তিশালী চিত্রায়ন করেছেন ঋতুপর্ণ ঘোষ। গল্পে বিনোদিনী—এক বিধবা, যিনি কেবল করুণা চান না, চান ভালোবাসা, চান স্বীকৃতি। তার মনোজগত, আকাঙ্ক্ষা ও অধিকারচেতনা ঋতুপর্ণ ঘোষ অত্যন্ত সংবেদনশীলভাবে তুলে ধরেছেন। ঐশ্বর্য রাইয়ের অভিনয় এই ছবির অন্যতম আকর্ষণ, সঙ্গে রয়েছে প্রসেনজিৎ ও রাইমা সেনের সমৃদ্ধ পারফরম্যান্স। ঊনবিংশ শতকের সমাজ-প্রবাহে এক বিদ্রোহী নারীর অবস্থান নিয়ে এই ছবিটি আলোচিত ও প্রশংসিত।
তিন কন্যা (১৯৬১)
পরিচালক: সত্যজিৎ রায়
মূল: ‘পোস্টমাস্টার’, ‘মনিহার’, ‘সমাপ্তি’ (তিনটি গল্প)
এই অ্যান্থলজি সিনেমায় সত্যজিৎ রায় রবীন্দ্রনাথের তিনটি ছোট গল্প নিয়ে নির্মাণ করেন তিনটি পৃথক খণ্ড, যেখানে প্রতিটি নারী চরিত্র এক একটি মানসিক স্তরকে তুলে ধরে।
পোস্টমাস্টার–এ রতনের অবহেলিত ভালোবাসা ও প্রত্যাখ্যানের ব্যথা,
মনিহার–এ রত্নদেবী ও তার সম্পত্তির প্রতি আসক্তির দোষে এক সম্পর্কের ভাঙন,
সমাপ্তি–তে কিশোরী মৃন্ময়ীর পরিণতিতে পৌঁছানো।
রবীন্দ্রনাথের নারীচরিত্রদের বহুমাত্রিকতা ছবিটিতে দুর্দান্তভাবে তুলে ধরা হয়েছে।
কাবুলিওয়ালা (১৯৫৭)
পরিচালক: তপন সিনহা
মূল: ‘কাবুলিওয়ালা’ (গল্প)
‘কাবুলিওয়ালা’ শুধুই এক প্রবাসী ফলওয়ালার গল্প নয়, বরং এক পিতার হৃদয়ের সঙ্গে আরেক শিশুর হৃদয়ের যে মধুর সংযোগ তা নিয়ে তৈরি এক আবেগঘন চলচ্চিত্র।
চিত্রনাট্যে রাখা হয়েছে গল্পের সারল্য, আর অভিনেতা ছবি বিশ্বাসের অভিনয় ছবিটিকে করে তুলেছে হৃদয়স্পর্শী। এটি শিশুদের জন্য একটি শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র হিসেবেও বিবেচিত হয়ে থাকে।
গল্প গল্পর মাঝে (১৯৬৫)
পরিচালক: রাজেন তরফদার
মূল: ‘খোকাবাবুর প্রত্যাবর্তন’ (গল্প)
এই ছোটগল্পটি এক নিষ্ঠাবান চাকরের গল্প—ফটিকচাঁদ, যার হৃদয়ে প্রভুর প্রতি ভালোবাসা শুধু কর্তব্যের জায়গা থেকে নয়, বরং মানবিক এক টান। রাজেন তরফদারের সিনেমাটি এক অনন্য দৃষ্টান্ত কীভাবে একটি ছোট গল্প সিনেমায় গভীর আবেদন তৈরি করতে পারে। ইংরেজ সাহেব ও ভারতীয় চাকরের সম্পর্কটি ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক বাস্তবতায় একটি মানবিক রূপ পেয়েছে।
অতিথি (১৯৬৫)
পরিচালক: তপন সিনহা
মূল: ‘অতিথি’ (গল্প)
এই কিশোর গল্পে আমরা দেখি তারাপদ নামের এক বালক, যাকে ঘিরে প্রশ্ন ওঠে—সে আসলে কার? তার স্থান কোথায়? স্বাধীনচেতা এই চরিত্রটি সংসারের নির্দিষ্ট ছাঁচে ঢোকে না। সে পথের যাত্রী, ভ্রমণ তার ধর্ম। তপন সিনহার চিত্রায়ণে সেই আদর্শবাদী ভ্রমণপ্রেমী কিশোর এক প্রতীক হয়ে ওঠে স্বাধীনতার, দায়মুক্ত জীবনের।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাংলা চলচ্চিত্রকে শুধু কাহিনি দেননি, দিয়েছেন দৃষ্টিভঙ্গি। তার সাহিত্যভাণ্ডার এমনই সমৃদ্ধ, যার প্রতিটি স্তর চলচ্চিত্রকারের কল্পনাকে জাগিয়ে তোলে। তার চরিত্রগুলো আজও বাঁচে—চারুলতা, নিখিলেশ, স্বাতী, অমল কিংবা বিনোদিনীর মতো। এই চরিত্ররা শুধু একেকটি গল্পের অংশ নয়, বরং আমাদের সমাজ, মন, সম্পর্কের প্রতিচ্ছবি। চলচ্চিত্রের মাধ্যমে রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য নতুন করে ফিরে ফিরে আসে আমাদের কাছে—আর সেটাই তার চিরকালীনতার প্রমাণ।
সারাবাংলা/এজেডএস