Thursday 05 Jun 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

মনরোর মৃত্যু: প্রশ্নবিদ্ধ সভ্যতা

সোহেল রহমান
৩ জুন ২০২৫ ১৯:৩৯

বিরাট রহস্যে ঘেরা মেরিলিন মনরোর মৃত্যু। তিনি সত্যিই আত্মহত্যা করেছিলেন কি না এবং কেন? তার মৃত্যুর পর বিভিন্ন সময়ে এ প্রশ্ন উঠেছে। কিন্তু প্রকৃত রহস্য উন্মোচিত হয়নি। মনরোর মৃত্যুর প্রায় ২৪ বছর পর বিশিষ্ট সাংবাদিক অ্যান্থনী সামারস-এর ‘গডেস: দ্য সিক্রেট লাইফ অব মেরিলিন মনরো’ গ্রন্থে দাবি করা হয় যে, মনরো আত্মহত্যা করেন নি, তিনি ষড়যন্ত্রের শিকার হয়েছিলেন এবং তাকে হত্যা করা হয়েছে।

মনরো মারা যান ১৯৬২ সালের ৪ আগস্ট রাতে। তার মৃত্যুর পর যেটা বলা হয়েছিল, সেটা হচ্ছে- মাত্রাতিরিক্ত ঘুমের বড়ি খেয়ে আত্মহত্যা করেছেন তিনি। তার ড্রেসিং টেবিলে ঘুমের বড়ির ১৫টি কৌটা পাওয়া যায়। আত্মহত্যা প্রচারণার মূল ভিত্তি ছিল এটাই।

বিজ্ঞাপন

মেরিলিনকে সম্পূর্ণ নগ্ন অবস্থায় তার বিছানার উপর পাওয়া যায়। গলায় জড়ানো ছিল হালকা একটা স্কার্ফ আর তার এক হাতে ধরা ছিল টেলিফোন। ধারণা করা হয় যে, হত্যার পর মনরোর হাতে টেলিফোন সেটটা ধরিয়ে দেওয়া হয়।

মনরোর মৃতদেহ ময়না তদন্তের রিপোর্টে বলা হয়, তার পিঠের ও নিতম্বের কাছে আঘাতের চিহ্ন রয়েছে। আর তার পাকস্থলি পরীক্ষা করেও সন্দেহজনক আলামত পাওয়া যায়। কিন্তু এ সব প্রমাণ তখন লুকিয়ে রাখা হয়েছিল।

অ্যান্থনী সামারস-এর গ্রন্থে দাবি করা হয়, মেরিলিনের সঙ্গে দুই কেনেডির গোপন প্রণয় তথা সেক্স স্ক্যান্ডাল ধামাচাপা দেওয়ার জন্যই এ আত্মহত্যার ঘটনা সাজানো হয়েছিল। পরবর্তী সময়ে মেরিলিনের সঙ্গে এ দুজনের প্রেমের মুহূর্তের গোপন কথপোকথনের টেপসহ বিভিন্ন আলামত পাওয়া যায়।

মেরিলিনের বিশ্বাস ছিল যে, জনএফ কেনেডি তাকে বিয়ে করবেন। মার্কিন ফার্স্ট লেডি হওয়ার স্বপ্নও দেখেছিলেন তিনি। কিন্তু স্ত্রী জ্যাকুলিনকে ত্যাগ করে মনরোকে বিয়ে করা তার পক্ষে সম্ভব নয় বলে জানিয়ে দেন জন। ফলে তার ভাই রবার্টকে আঁকড়ে ধরেন মনরো। পরবর্তী সময়ে রবার্টও যখন সরে পড়তে চাইলেন, ক্রুদ্ধ মেরিলিন তখন কেনেডি পরিবারের কাহিনী সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে প্রকাশ করে দেওয়ার হুমকি দেন। আর এ সংক্রান্ত সংবাদ সম্মেলনের দু’দিন আগেই মৃত্যু ঘটে তার।

বইটিতে আরও বলা হয়, মেরিলিন সম্ভবত তখন গর্ভবতী ছিলেন। মৃত্যুর পর তার বন্ধুরা কেউ কেউ মনে করেছিলেন যে, হয় তার মিস-ক্যারেজ হয়েছে অথবা মেরিলিন নিজেই গর্ভপাত ঘটিয়েছিলেন।

মেরিলিনের পরিচারিকা ইউনিক মুররে দীর্ঘদিন এ বিষয়ে কোনো কথা না বললেও পরে এক সময় মুখ খোলেন তিনি। তার দাবি হচ্ছে- মেরিলিন কখনো সম্পূর্ণ নগ্ন হয়ে ঘুমাতেন না। আর তার বেডরুমে টেলিফোন থাকার কথা নয়। কারণ ঘুমের ব্যাঘাত যাতে না ঘটে সে জন্য মেরিলিন শোবার ঘরে কখনো টেলিফোন রাখতেন না। আর মাঝরাতে ঘুম ভাঙার পর তিনি যখন মেরিলিনকে দেখেন তখনো তিনি নাকি বেঁচে ছিলেন। অ্যাম্বুলেন্স ডাকা হয়েছিল। অ্যাম্বুলেন্সে করে হাসপাতালে নেওয়ার পথেই মনরো মারা যান বলে তার ধারণা।

ইউনিক মুররে বলেন, যে রাতে মনরো মারা যান, ওইদিন দুপুরে রবার্ট কেনেডি তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে এসেছিলেন। মূলতঃ তাদের সম্পর্কটি চুকিয়ে দিতেই রবার্ট সেদিন এসেছিলেন বলে তার ধারণা। ওইদিন-ই রাতে এক বাড়িতে (পিটার ল’ ফর্ড) মনরোর দাওয়াত ছিল, কিন্তু শরীর ভালো না বলে তিনি যান নি।

মনরোর সঙ্গে রবার্ট কেনেডির ওই দিনের সাক্ষাৎ প্রসঙ্গে প্রাইভেট ডিকেটটিভ ফ্রেড ওটাশ বলেন, সে দিন মনরোর বাড়িতে রবার্ট কেনেডি তাকে বিয়ে করার প্রতিশ্রুতি নিয়ে তুমুল তর্কে মেতেছিলেন। তারপর মনরোর বাড়ি থেকে বেরিয়ে গিয়ে রবার্ট কেনেডি পিটার ল’ ফর্ড-কে বলেন যে, মেয়েটা ঝামেলা বাধাচ্ছে। আমি জানি, এর পরিণতি কী হতে পারে।

কারো কারো মতে, জন কেনেডির সঙ্গে মনরোর সম্পর্কের ক্ষেত্রে পিটার ল’ ফর্ড দালালের ভূমিকা পালন করতেন। কেনেডি পরিবারের মন্দ দিকগুলো ঢেকে রাখা এবং সবকিছু দেখা-শোনা করাই ছিল পিটারের কাজ। কেনেডি পরিবার যাতে জড়িয়ে না পড়ে সেজন্য মনরোর মৃত্যুর পর তার ঘর থেকে এমন সব প্রমাণ দ্রুত মুছে ফেলেছিলেন তিনি এবং পরবর্তী সময়ে কাজগুলো শেষ করার জন্য নিয়োগ দিয়েছিলেন প্রাইভেট ডিকেটটিভ ফ্রেড ওটাশকে।

অন্যদিকে প্রাইভেট ডিকেটটিভ জন ড্যানোফ দাবি করেন, তিনি পিটার ল’ ফর্ডের বাড়িতে জন কেনেডি ও মনরোর প্রণয় মুহূর্তের টেপ করা ক্যাসেট শুনেছেন।

বইটিতে দাবি করা হয়, মৃত্যুর আগে মনরো রবার্ট কেনেডিকে ফোন করার চেষ্টা করেছিলেন এবং তিনি তখন সম্ভবত কেনেডির ঔরসজাত সন্তান-সম্ভবা ছিলেন। কারো কারো মতে, মনরোর মৃত্যুর সময়ে খোদ জন এফ কেনেডি তার বাড়িতে উপস্থিত ছিলেন।

আবার কারো কারো মতে, ওইদিন রাতে রবার্ট কেনেডি পুনরায় মনরোর ফ্ল্যাটে আসেন। মনরো তখন মৃত্যুর প্রায় কাছাকাছি। তখন ররার্ট-ই তাকে হাসপাতাল নেওয়ার জন্য ফোন করে অ্যাম্বুলেন্স ডেকেছিলেন। তবে আসলেই কে ওই সময় ফোন করে অ্যাম্বুলেন্স ডেকেছিলেন, সেই রহস্যময় লোকটিকে পুলিশ এখনো খুঁজে বের করতে পারেনি।

অ্যান্থনী সামারসের ধারণা– সময়মতো অ্যাম্বুলেন্স মৃতপ্রায় মনরোকে নিতে আসেনি এবং হাসপাতালে নেওয়ার পথে অ্যাম্বুলেন্সেই মারা যান তিনি।

মনরোর মুত্যুর পর তার সব ফোন রেকর্ড মুছে ফেলা হয় এবং তার ব্যক্তিগত ডাইরিটাও সরিয়ে ফেলা হয়। তারপরও মনরোর ঘর থেকে পাওয়া যায় প্রেসিডেন্ট জন কেনেডির ব্যক্তিগত ফোন নম্বর লেখা একাধিক চিরকূট।

বলাবাহুল্য, জন কিংবা রবার্ট কেনেডি কেউই ধোয়া তুলসী পাতা ছিলেন না। দুই ভাই একে অপরের সঙ্গে বান্ধবী বদল করতেন এমন কথাও শোনা যায়। তবে শেষের দিকে মনরোর ওপর ভীষণ ক্ষেপে যান জন কেনেডি। তিনি চাইতেন না যে, তিনি ছাড়া আর অন্য কারও সঙ্গে মনরোর শারীরিক সম্পর্ক থাকুক। আর সে কারণে তার নির্দেশে মনরোর গতিবিধির ওপর লক্ষ্য রাখা হতো। এমন কী মনরোর ঘরেও গোপন টেপ পেতে রাখা হয়েছিল।

প্রাপ্ত গোপন টেপগুলোর একটিতে জনএফ কেনেডির কণ্ঠস্বর পাওয়া যায়। ক্রুদ্ধ কণ্ঠে তিনি বলছেন, ‘এদিকে আসো, এদিকে আসো।’ অন্যদিকে মনরোও উচ্চ কণ্ঠে বলছেন, ‘তোমরা বেরিয়ে যাও বলছি, যাও।’… টেপে ধস্তাধস্তি এবং জোরপূর্বক মনরোকে বিছানায় ফেলে দেওয়ার শব্দ পাওয়া যায়। টেপের শেষে টেলিফোনের রিং বেজে ওঠার শব্দ এবং কেউ একজন রিসিভার তুলে রেখে দেওয়ার শব্দ রয়েছে।

অ্যান্থনী সামারসের বইতে দাবি করা হয় যে, রিসিভার তুলে রেখে দেওয়ার ঘটনাটা একটা চাল। এটা করা হয়েছে এ কারণে যে, যিনিই ফোন করে থাকুন তিনি যেন মনে করেন যে, মনরো জেগে আছেন এবং এ ধরনের ফোনে তিনি বিরক্ত। কিন্তু বাস্তবে মনরোর দেহ ততক্ষণে নিস্পন্দ হয়ে পড়েছে।

শেষ দিনগুলো : শেষের দিনগুলোতে মনরো ছিলেন ভীষণ নিঃসঙ্গ। নিজের বাড়িতে একাই থাকতেন তিনি। গর্ভপাত, মিলারের সঙ্গে বিচ্ছেদ (১৯৬১), অভিনেতা ও গোপন পিতা ক্লার্ক গেবলের মৃত্যুসহ নানা কারণে মানসিকভাবে বিধ্বস্ত মেরিলিন নিজেকে হলিউড থেকে দূরে সরিয়ে রেখেছিলেন অনেক দিন। ১৯৬১ সালে তার শেষ ছবি ‘সামথিং গট টু গিভসস’ থেকে তাকে বাদ দিয়ে দেয় টুয়েন্টিনথ সেঞ্চুরি ফক্স। এরপর সিনেমা জগৎ থেকে নিজেকে প্রায় গুটিয়ে নেন তিনি।

মনরো বিশ্বাস করতেন, ‘সাধারণ দর্শকরাই তারকা বানায়, কোনো স্টুডিও বা ব্যক্তি নয়।’

ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি সম্পর্কে তার ধারণা হচ্ছে–‘ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি আসলেই একটা ইন্ডাস্ট্রি, অন্যান্য কেমিক্যাল বা মেকানিক্যাল ইন্ডাস্ট্রির মতো। এখানে পরিচালকের নির্দেশে হাসতে হয়, কাঁদতে হয়। কিন্তু ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির ভূমিকা হওয়া উচিত মায়ের মতো। অথচ এর ভূমিকা পক্ষপাতপূর্ণ ভিলেনের।’

মৃত্যুর মাত্র পনের দিন আগে প্রদত্ত এক সাক্ষাৎকারে মেরিলিন বলেন, ‘নাম, যশ, খ্যাতি, প্রচার এগুলো আমার কাছে এখন একটা অস্থায়ী আংশিক সুখ। খ্যাতি অনেকটা শখের খাবারের মতো। নিত্যদিনের খাবার নয়। নাম, যশ কখনও পূর্ণতা দেয় না, উষ্ণতার ছোঁয়া দেয়। আর সে উষ্ণতা ক্ষণস্থায়ী।’

তার মতে, ‘প্রাইভেসি ছাড়া প্রতিভা বিকশিত হয় না। এ জন্য একাকীত্বের বড় প্রয়োজন। নিঃসঙ্গতার মধ্য দিয়েই ঘটে মেধার বিকাশ। কিন্তু বেশির ভাগ লোকই বিষয়টি বোঝে না।’

ওই সাক্ষাৎকারে তিনি আরও বলেন, ‘একজন অভিনেতা বা অভিনেত্রী যখন মনের দুঃখে কেঁদে বুক ভাসিয়ে ফেলেন, তখন তার কান্না কেউ দেখে না। কারণ সে কান্নার জন্য কোনো পরিচালক নির্দেশ দেয়নি। তখন সামনে থাকে না কোনো ক্যামেরাও।’

নিজের অবসর জীবনযাপন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘এখন আমি আছি আমার মতো। কোলাহল মুক্ত জীবনযাপন করছি। গুটিকয় নিকট আত্মীয় ও বন্ধু ছাড়া অন্যদের সঙ্গে তেমন যোগাযোগ নেই। বহতা নদীর মতো জীবন ধাবমান সামনের দিকে। এটাই সত্যি, জীবন আমাকে কখনও বেদনায় পিছু টানে না।’

লেখক: সাংবাদিক

সারাবাংলা/এএসজি

মনরোর মৃত্যু মেরিলিন মনরো সোহেল রহমান

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর