১৯ জুলাই— বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ রূপকার, বহুমাত্রিক সৃষ্টিশিল্পী হুমায়ূন আহমেদের মৃত্যুবার্ষিকী। আজ থেকে ১৩ বছর আগে, ২০১২ সালের এই দিনে, যুক্তরাষ্ট্রের একটি হাসপাতালে ক্যান্সারের সঙ্গে দীর্ঘ লড়াই শেষে চলে যান তিনি। কিন্তু সত্যিই কি চলে গেছেন? না, বাংলা সাহিত্য, নাটক এবং চলচ্চিত্রপ্রেমীদের হৃদয়ে তিনি এখনও অমর।
বাংলা সাহিত্যে ‘জনপ্রিয়তা’ শব্দটির সঙ্গে যে কজন লেখকের নাম আজও সমার্থক হয়ে আছে, হুমায়ূন আহমেদ তাদের শীর্ষে। ষাটের দশকে লেখালেখি শুরু করলেও আশি-নব্বইয়ের দশকে তার সাহিত্যিক ও সৃষ্টিশীল প্রতিভা যেন ফেটে পড়ে— প্রথমে সাহিত্য, পরে ছোট পর্দা, বড় পর্দায়।
পর্দায় হুমায়ূনের মহাকাব্য _
বাংলা নাটক যখন কাঠখোট্টা, আড়ষ্ট, তখনই ‘বহুব্রীহি’, ‘কোথাও কেউ নেই’, ‘আজ রবিবার’-এর মতো নির্মাণ দিয়ে নতুন এক ধারা তৈরি করলেন হুমায়ূন আহমেদ। নাটকের ক্যানভাসে নিয়ে এলেন বাস্তব জীবন, মাঝবিত্তের হাসি-কান্না, সহজ ভাষার মায়া। বাক্যালাপ আর চরিত্রায়ণে তার দক্ষতা আজও টেলিভিশন নাটকে অদ্বিতীয়।
একইসঙ্গে তিনি ছিলেন প্রামাণ্য কাহিনিনির্মাতা, কবি এবং চলচ্চিত্রকার। তার সিনেমাগুলোর মধ্যে— ‘আগুনের পরশমণি’, ‘শ্রাবণ মেঘের দিন’, ‘দুই দুয়ারী’, ‘চন্দ্রকথা’, ‘ঘেটুপুত্র কমলা’— প্রতিটিই একটি সময়ের চিহ্ন। মুক্তিযুদ্ধ, প্রেম, বিচ্ছেদ কিংবা গ্রামবাংলার রোমান্টিসিজম— যেকোনো বিষয়কে পর্দায় এনে তিনি তৈরি করেছেন সুর, ছন্দ আর আবেগের অপূর্ব মিশেল।
হিমু-মিসির আলি: বাস্তবের চেয়ে জীবন্ত _
হুমায়ূন আহমেদের সবচেয়ে বড় সাফল্য সম্ভবত চরিত্র নির্মাণে। সাহিত্যে এমন কিছু চরিত্রের জন্ম দিয়েছেন, যারা লেখকের সীমানা পেরিয়ে বাস্তব হয়ে উঠেছে পাঠকের চোখে। হিমু, যে জুতো পরে না, ঘোরে শহরের অলিগলি ধরে; আর মিসির আলি, যিনি যুক্তিবাদী মন দিয়ে রহস্য উদ্ঘাটন করেন— এই দুই বিপরীতমুখী চরিত্র একসঙ্গে বাঙালির কল্পনাবিশ্বে এত গভীর শেকড় গেড়েছে, যার নজির বিরল।
জনপ্রিয়তার সঙ্গে শিল্পমানের ভারসাম্য _
সমালোচকেরা অনেকেই বলতেন, হুমায়ূনের লেখায় ‘সাহিত্যিক গভীরতা’ কম। কিন্তু এই অভিযোগকে ছাপিয়ে গেছে তার কাজের সার্বজনীনতা। তিনি প্রমাণ করেছেন, সহজ করে বলা কঠিনতম কাজ। সাহিত্যের পাঠককে, দর্শককে তিনি সম্মান করেছেন; দিয়েছেন আনন্দ, দিয়েছে আশ্রয়। এবং এসব দিয়েই গড়েছেন অনন্য এক পাঠক সমাজ— যারা এখনো ই-বুক, অডিওবুক, ইউটিউব বা স্মার্ট টেলিভিশনে খুঁজে ফেরে তারই নির্মাণ।
অমরতা— অন্য এক অর্থে _
১৩ বছর হয়ে গেছে হুমায়ূন আহমেদ নেই। কিন্তু তিনি হারিয়ে যাননি। নুহাশপল্লীর নিঃশব্দ ছায়ায়, ঢাকা শহরের ব্যস্ত অলিতে-গলিতে, কিংবা কোনো বইমেলার স্টলে তার নামের বইয়ের ভিড়ে এখনও তিনি জীবন্ত। সামাজিক মাধ্যমে প্রতিদিনই ঘুরে ফিরে আসে তার নাটকের দৃশ্য, সংলাপ, কিংবা কোনো চরিত্রের সংবেদনশীল মুহূর্ত।
এটাই একজন শিল্পীর প্রকৃত অমরতা— শরীর না থেকেও চেতনায় বাস করা। যিনি পর্দায় ও কাগজে একাই তৈরি করেছিলেন এক নতুন ভুবন—তিনি কেবলই এক লেখক নন, এক সময়ের, এক দেশের, এক জাতির চেতনাসত্তার নাম।
তাই আজ, ১৩ বছর পরও আমরা বলি, হুমায়ূন আহমেদ ছিলেন না— আছেন। এবং থাকবেন— অন্তত বাংলা সাহিত্য ও বিনোদনের ইতিহাসে যতদিন আলোকপাত করা হবে, ততদিন।
‘যে চলে যায়, সে কি কখনো ফিরে আসে? হ্যাঁ, আসে… প্রতিদিন, প্রতিক্ষণে, প্রতিস্মরণে।’ — হুমায়ূন আহমেদ