Sunday 20 Jul 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

চেস্টার বেনিংটন: এক যন্ত্রণাবিদ্ধ কণ্ঠের বিদায়

ফারহানা নীলা
২০ জুলাই ২০২৫ ১৫:২৭

‘আমি সবকিছু ধ্বংস করে পালিয়ে যেতে চেয়েছিলাম’।
— চেস্টার বেনিংটন

বিশ্বসংগীতের ইতিহাসে কিছু কণ্ঠ থাকে, যা শুধু গান গায় না— চিৎকার করে, কাঁদে, জ্বলতে থাকা ঘায়ের গল্প বলে। চেস্টার বেনিংটনের কণ্ঠ ছিল ঠিক তেমনই এক জ্বলন্ত ব্যথার প্রতিধ্বনি, যা আজও কোটি হৃদয়ে বাজে।

২০১৭ সালের ২০ জুলাই, পৃথিবী হারায় এই অসাধারণ প্রতিভাধর শিল্পীকে। আত্মহত্যা— যেন তার বেদনার শেষ প্রান্তে পৌঁছানো এক প্রাকৃতিক পরিণতি। কিন্তু কেন এমন হলো? চেস্টার কেন এমন সিদ্ধান্তে পৌঁছালেন? ময়না তদন্ত কী বলেছিল? এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজলে খোঁজ মেলে এক গা শিউরে ওঠা শৈশব, অব্যক্ত যন্ত্রণা, বিষণ্ণতা ও ভয়াবহ মানসিক স্বাস্থ্য সংকটের।

বিজ্ঞাপন

কণ্ঠে আগুন, অন্তরে ছাই

চেস্টার বেনিংটন ছিলেন সেই শিল্পী, যার কণ্ঠের তীব্রতা এক মুহূর্তে আকাশ চিরে যেতে পারত, আবার পরক্ষণেই হয়ে যেত কান্নাভেজা কফিনের মত ভারী। ‘In the End’, ‘Numb’, ‘Crawling’, ‘Somewhere I Belong’, ‘Breaking the Habit’, কিংবা ‘One More Light’ —প্রতিটি গানে ছিল তার জীবনের অভ্যন্তরীণ যন্ত্রণা আর অসহায়তার কাঁচা রক্ত।

তার সহশিল্পী, মঞ্চ, অ্যালবাম—সব ছিল তার শিল্পজীবনের অংশ, কিন্তু নিজের সঙ্গে চলছিল এক অন্য যুদ্ধ— যা চুপিচুপি প্রতিদিন একটু একটু করে তাঁকে শেষ করে দিচ্ছিল।

শৈশবের নিপীড়ন: এক জীবনের পচনশীল শুরুর গল্প

চেস্টারের জীবন যেন জন্ম থেকেই যন্ত্রণার সঙ্গে বন্ধুত্ব করেছে। মাত্র ৭ বছর বয়সে এক পরিচিত পুরুষের দ্বারা যৌন নির্যাতনের শিকার হন তিনি। সে সময় ভয়, লজ্জা আর সমাজের চাপের কারণে মুখ বন্ধ রাখেন। ছয় বছর ধরে চলতে থাকে সেই নির্যাতন। পরে তিনি স্বীকার করেছিলেন, এতে তার মধ্যে আত্মঘৃণা ও নিরাপত্তাহীনতা জন্মায়।

১১ বছর বয়সে বাবা-মায়ের বিচ্ছেদ হয়। মা চলে যাওয়ার পর বাবার সঙ্গে থেকেও তিনি ভালোবাসা পাননি। এসময় চেস্টার ডুবে যান মাদক, অ্যালকোহল ও আত্মবিরোধী চিন্তায়। সেই ছোট্ট বয়সেই বিষণ্ণতা, নির্জনতা আর ভয়ানক আত্মদ্বন্দ্ব হয়ে ওঠে তার জীবনসঙ্গী।

সংগীত: আশ্রয় না মুক্তি?

চেস্টারের সংগীতজীবন ছিল একইসঙ্গে তার মুক্তির চেষ্টাও, আবার তার যন্ত্রণার প্রতিফলনও। Linkin Park ব্যান্ডের সঙ্গে তার অভিষেক হয় ২০০০ সালে ‘Hybrid Theory’ অ্যালবামের মাধ্যমে। ওই অ্যালবামই বিশ্বজুড়ে সাড়া ফেলে দেয়। চেস্টারের গলায় যেন বেঁচে ওঠে এক যন্ত্রণাদীর্ণ প্রজন্মের আওয়াজ।

তার গানগুলো শুধু গীতিকবিতার স্তবক ছিল না, বরং আত্মার চিৎকার ছিল। ‘Crawling in my skin / These wounds, they will not heal’— এমন লাইনগুলো তার নিজের মানসিক অবস্থা থেকেই উঠে এসেছিল।

তার সহশিল্পীরা বলেছিলেন, ‘তিনি গাইতেন নিজেকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য।’

আত্মহত্যার পেছনে কারণ- ব্যক্তিগত ক্ষরণ, বিষণ্ণতা ও বন্ধুর মৃত্যু:

২০১৭ সালের ২০ জুলাই, ক্যালিফোর্নিয়ার পালোস ভার্দেস এস্টেটস-এর নিজ বাসায় ফ্যানের সঙ্গে ঝুলন্ত অবস্থায় চেস্টারের মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়। বয়স হয়েছিল মাত্র ৪১।

পুলিশের প্রাথমিক রিপোর্ট অনুযায়ী, এটি ছিল আত্মহত্যা। ময়নাতদন্তে জানা যায়, চেস্টারের রক্তে সামান্য মাত্রায় অ্যালকোহলের উপস্থিতি ছিল, তবে কোনও মাদকদ্রব্যের উপস্থিতি পাওয়া যায়নি। ধারণা করা হয়, তিনি সম্পূর্ণ সচেতন অবস্থাতেই আত্মহননের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন।

এ সময় একটা বিষয় বেশ স্পষ্ট হয়— চেস্টার তখনও ভয়ানক বিষণ্ণতায় ভুগছিলেন।

সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ব্যাপার হলো, এই মৃত্যু হয়েছিল তার কাছের বন্ধু ক্রিস কর্নেলের জন্মদিনে। ক্রিস ছিলেন বিখ্যাত ব্যান্ড Soundgarden-এর ভোকালিস্ট। তিনিও কয়েক মাস আগে আত্মহত্যা করেছিলেন। চেস্টার তাকে খুব ভালোবাসতেন এবং তার সমাধি দেয়ার সময়ও গান গেয়েছিলেন। বন্ধু হারানোর শোক চেস্টারকে আরও ভেঙে দিয়েছিল।

একটি চিঠিতে চেস্টার লিখেছিলেন _ ‘তোমার মৃত্যু আমার ভিতরকার সেই ভয়কে জাগিয়ে তুলেছে, যা আমি সারাজীবন লুকিয়ে রেখেছি।’

‘One More Light’: যে গান আজও রক্তক্ষরণ ঘটায়

চেস্টারের মৃত্যুর আগে Linkin Park যে গানটি সবচেয়ে বেশি প্রচার করছিল, সেটি ছিল ‘One More Light’। শুরুতে এটি ছিল এক নারীকর্মীর স্মরণে লেখা, কিন্তু পরবর্তীতে এটি চেস্টার নিজেই হয়ে ওঠেন। এতটাই ব্যক্তিগত, এতটাই বেদনাদায়ক যে চেস্টারের মৃত্যুর পর ব্যান্ডের সহপ্রতিষ্ঠাতা মাইক শিনোডা ঘোষণা দেন— ‘আমরা আর এই গান মঞ্চে গাইতে পারি না।’

গানটির কথা ছিল: “Who cares if one more light goes out?, In a sky of a million stars… Well, I do.” এই গানের প্রতিটি শব্দ যেন চেস্টারের জীবনের শেষ চিৎকার।

মৃত্যুর পর প্রতিক্রিয়া: কান্না ছড়িয়ে পড়ে বিশ্বমঞ্চে

চেস্টারের মৃত্যুর পর সোশ্যাল মিডিয়া, কনসার্ট, টেলিভিশন—সবখানেই নেমে আসে শোকের ছায়া। ভক্তরা বলেন, তিনি তাদের দুঃখে, হতাশায় সঙ্গ দিয়েছিলেন। যারা আত্মবিশ্বাস হারিয়েছিল, চেস্টারের গান তাদের জীবনে ‘বেঁচে থাকার সুর’ হয়ে উঠেছিল।

Linkin Park চিরদিনের মতো বদলে যায়। ব্যান্ড আর আগের মত থাকে না। তার সন্তান, স্ত্রী ও সহশিল্পীদের জন্য এটি ছিল এক ধাক্কা, যাকে তারা এখনও কাটিয়ে উঠতে পারেননি।

চেস্টার নেই, কিন্তু তার যন্ত্রণা আমাদের সঙ্গে

আজ আট বছর পেরিয়ে গেছে, কিন্তু চেস্টার বেনিংটনের মৃত্যু আজও জ্বলে ওঠে নতুন করে, যখন কেউ ভেঙে পড়ে, যখন কেউ বোঝে না তার মনের যন্ত্রণা।

চেস্টার আমাদের শিখিয়ে গেছেন, শক্তিশালী কণ্ঠও ভিতরে ভিতরে বিপর্যস্ত হতে পারে। বাহ্যিক সাফল্য, তারকাখ্যাতি, অর্থ-বিত্ত—সব থাকলেও মানুষ একাকীত্বে ডুবে যেতে পারে।

আর তাই মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে কথা বলুন, সহানুভূতির সঙ্গে শোনার চেষ্টা করুন, এবং সাহস দিন— যাতে আর কোনো চেস্টার বেনিংটন হারিয়ে না যায়।

সারাবাংলা/এফএন/এএসজি

চেস্টার বেনিংটন