ঢাকার ব্যস্ত শহর যখন রোজকার কোলাহলে ব্যস্ত, তখন উত্তরার আকাশে ঘটল একটি হৃদয়বিদারক দুর্ঘটনা। ২১ জুলাই, দুপুরের পরপরই বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর একটি প্রশিক্ষণ বিমান ভেঙে পড়ে মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের এক ভবনের উপর। মুহূর্তেই ছড়িয়ে পড়ে আগুন। আতঙ্কে ছোটাছুটি শুরু করে শিক্ষার্থীরা। আর সেই ভয়ের ঠিক মাঝখানে দাঁড়িয়ে ছিলেন এক নারী— শিক্ষিকা মাহেরীন চৌধুরী।
তিনি ছিলেন না কোনো রাজনীতিক, বিখ্যাত ব্যক্তিত্ব কিংবা সশস্ত্র বাহিনীর সদস্য। তিনি ছিলেন একজন শিক্ষক—একজন মা, একজন অভিভাবক। কিন্তু সেদিন তার ভূমিকায় মিশে গিয়েছিল মা-শিক্ষক-নায়িকার পরিচয়। নিজের দুই সন্তান স্কুলেই থাকলেও তিনি আগে রক্ষা করতে চেয়েছেন নিজের ছাত্রছাত্রীদের। নিজের জীবন দিয়ে রক্ষা করেছেন প্রায় ২০ জন কোমলমতি শিশুকে।
প্রায় ধ্বংসপ্রায় ভবনের ধোঁয়ার মধ্যেও মাহেরীন চৌধুরী পিছু হটেননি। ছাত্রছাত্রীদের নিরাপদে বের করে আনার চেষ্টা চালিয়ে গেছেন বারবার। শেষবারের মতো যখন তিনি ভবনে প্রবেশ করেন, তখনও ভাবেননি নিজের কথা। সেই শেষ প্রবেশ আর ছিল না প্রত্যাবর্তনের। আগুন ও ধ্বংসস্তূপের মধ্যে হারিয়ে গেলেন তিনি— শুধু দেহে নয়, প্রাণে প্রাণে বেঁচে থাকলেন শিক্ষার্থীদের হৃদয়ে।
তার সম্পর্কে লিখতে গিয়ে শিল্পী আসিফ আকবর লিখেছেন, “হেরে গেছেন মা মাহেরীন, জিতে গেছেন শিক্ষিকা মাহেরীন ম্যাডাম।” এমন উপলব্ধিমূলক একটি বাক্য আমাদের বুঝিয়ে দেয় মাহেরীন শুধু একজন মা নন, একজন আদর্শ শিক্ষক, যিনি নিজের জীবন দিয়ে শিক্ষা দিয়েছেন— সত্যিকারের ভালোবাসা মানে আত্মত্যাগ।
‘সিক্রেট সুপারস্টার’ বললেও কম বলা হয়
এতদিন হয়তো অনেকেই তার নাম জানতেন না। হয়তো তিনি ছিলেন সবার মতো সাধারণ, নিঃশব্দে কাজ করে যাওয়া মানুষ। কিন্তু এই নীরব যোদ্ধাই মৃত্যুর মুহূর্তে হয়ে উঠলেন একটি প্রজন্মের ‘সিক্রেট সুপারস্টার’। কারণ সুপারহিরোরা শুধু সিনেমায় থাকে না, থাকেন আমাদের চারপাশেও— যেমন ছিলেন মাহেরীন চৌধুরী।
আসিফ আকবর তার পোস্টে আরও লিখেছেন, “জিতিয়ে গেলেন শিক্ষকতার মত মহান পেশাকে। অনিয়মের দেশে মাইলস্টোন ট্র্যাজেডির চেয়ে আরো ভয়াবহ অনেক কিছুই আসবে, কিন্তু ভবিষ্যতের আলো বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টায় নিজেই পরপারে চলে গেলেন ম্যাডাম মাহেরীন।”
এই ‘ভবিষ্যতের আলো’ মানেই আমাদের শিক্ষার্থীরা— যাদের জন্য মাহেরীন নিজের আলো নিভিয়ে দিয়ে গেলেন।
রাষ্ট্র না চিনলেও মানুষ চিনেছে
মাহেরীনের মৃত্যু কেবল একজন শিক্ষিকার মৃত্যু নয়, এটি একটি সমাজের বিবেকের জাগরণ। তিনি আমাদের দেখিয়ে গেছেন যে, শিক্ষকতা কেবল ক্লাসরুমের পাঠদান নয়; এটি জীবনবোধ, দায়িত্ব এবং সর্বোচ্চ আত্মত্যাগের নাম। রাষ্ট্র হয়তো মরণোত্তর পুরস্কার দেবে, হয়তো কিছুদিন পর ভুলেও যাবে, কিন্তু সাধারণ মানুষ তার আত্মত্যাগ মনে রাখবে বহুদিন।
একজন ফেসবুক ব্যবহারকারী লিখেছেন, “মাহেরীন ম্যাডাম আমাদের জন্য এক আকাশ সমান অনুপ্রেরণা।”
শেষ দৃশ্যের এক অমোচনীয় শিক্ষা
বিমান বিধ্বস্ত হওয়ার পর মুহূর্তের মধ্যে যেভাবে তিনি সিদ্ধান্ত নেন, যেভাবে ছাত্রছাত্রীদের বাইরে বের করে দেন, তা কেবল প্রশিক্ষণ নয়—একটা অন্তর্দৃষ্টি, একটা হৃদয়ের টান। এ ধরনের মানবিকতা আজকের দুনিয়ায় বিরল। মা, শিক্ষক, নারী—তিনটি পরিচয়ের ভার কাঁধে নিয়েও তিনি ছিলেন দুর্বার।
এই মৃত্যু শোক নয়, শক্তির উৎস। এই কান্না কেবল বেদনার নয়, বোধের। কারণ মাহেরীনদের হারানো মানে কেবল একটি প্রাণ নয়, সমাজের বুকে গেঁথে দেওয়া একটি মাইলস্টোন।